ভালোবাসার উষ্ণতা পর্ব ২

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#২য়_পর্ব

– স্যার, রাইসা ম্যামকে খুঁজে পাওয়া গেছে। কিন্তু উনি ভালো নেই স্যার। এখানে একজন পরিচিত আত্নীয়ার বাড়িতে থাকছেন। একটি সাধারণ প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষিকা হিসেবে যোগ দিয়েছেন। খুব কষ্ট করে বাচ্চাটিকে বড় করছেন। ছেলেটির বয়স সাত মাস হতে চলেছে। এখানে সবাই জানে উনি বিধবা, আসছে দিন উনাকে উত্তক্ত ও কম করা হয় না। মাটি কামড়ে ওখানে পড়ে রয়েছেন। এখানে উনার আত্নীয়া ছাড়া কেউ থাকেন না। উনি প্রায় পঞ্চান্ন বছরের একজন মহিলা। উনার আপন বলতে কেউ নেই, তাই রাইসা ম্যামকে এখানে থাকার পারমিশন দিয়েছেন। স্যার এখন আমরা কি করবো?
– রাইসাকে যাতে কেউ কোনো রকম ডিসটার্ব না করে সেটা দেখার দায়িত্ব তোমার। আমি খুব দ্রুত চিটাগং আসছি।

বলে ফোনটা রেখে দেয় আবরার। আজ রাইসাকে এতো কিছু সহ্য করা লাগছে এটা শুধু মাত্র তার জন্য। সেদিন যে ভুল করেছিলো, আজ সেই একই ভুল সে করবে না। চোখ দুটো মুছে, স্টেজে চলে গেলো সে। আবরারকে দেখে মহীমা চৌধুরীর হাসি কিছুটা মলিন হয়ে গেলো, তিনি আঁচ করতে পারছেন সামনে আবরার কি করতে যাচ্ছে। মাইকটা হাতে নিয়েই আবরার ডিক্লেয়ার করে দিলো,
– আপনাদের দামী সময় নষ্টের জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখিত, সামনে এমনটা যাতে না হয় সেটাই চেষ্টা করবো। আজ এনগেজমেন্টটা হবে না। উই আর সরি, যাওয়ার সময় অবশ্যই খেয়ে যাবেন। থ্যাংক উ।

আবরারের ডিক্লেয়ারেশনের পর, মহীমা চৌধুরী যখন তাকে কিছু জিজ্ঞেস করে সে পাশ কাটিয়ে নিজ রুমে চলে যায়। তাকে প্যাকিং করতে হবে। রাইসাকে একবার যেহেতু খুজে পেয়েছে আর হারাতে দিবে না সে। আবরারের এটোতা ঔদ্ধত্য দেখে রাগে ফুসছেন মহীমা সিকদার। কোনোভাবে হেলাল খানকে বুঝিয়ে শান্ত করলেন তিনি। এতোদিনের বন্ধুত্বের খাতিরে উনিও শান্ত হয়ে গিয়েছেন। কিন্তু আবরারের, তার সাথে কোনো কথা না বলে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়াতে অনেক বেশি অখুশি হলেন মহীমা সিকদার।

রাত ১১টা,
আবরার, অয়ন এবং মহীমা সিকদার মুখোমুখি বসে আছেন। অয়নের অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আবরারের কথায় এই মিটিং এ থাকতে রাজি হয়েছে। নিরবতা ভেঙ্গে মহীমা বেগম বলে উঠলেন,
– হুট করে কি এমন হলো যে আমার মান সম্মানের তোয়াক্কা না করেই তুমি এই প্রোগামটা নষ্ট করে দিলে। তুমি জানো আমি কতোটা অপমানিত হয়েছি? হেলাল আমাকে সম্মান করে তাই কিছু বলে নি। এখন কি আমি জানতে পারি কি এমন হয়েছে?
– আমি কাল চিটাগং যাচ্ছি, ওখানে একটা খুব বড় ইস্যু হয়ে গেছে। আমাদের প্রজেক্ট অর্ধেক কাজেই থেমে গেছে।
– তাহলে সেটা অয়ন হ্যান্ডেল করবে, তাতে কি খুব কিছু যায় আসবে?
– যায় আসবে, মানুষের জানা উচিত সিকদার কোম্পানির মালিক আমি অয়ন নয়। এই এক বছরের ও বেশি আমি ছিলাম না, সবাই অয়নকেই এই কোম্পানির হেড মেনে নিয়েছে। আমি যেন কিছুই পারি না। আমি চাই এই ইস্যুটাকে আমি হ্যান্ডেল করি। আপনার যদি এতে আপত্তি থাকে আমি কিছু বলবো না।

মহীমা সিকদার, আবরারের কথা শুনে মনে মনে খুশি হন। তার মুখে প্রশান্তির হাসি ফুটে উঠে। অপরদিকে অয়নের মুখেও বাঁকা হাসি ফুটে উঠে। অয়ন খুব ভালোভাবে বুঝতে পারে প্রজেক্টের জন্য এভাবে ছুটে যাওয়ার মানুষ আবরার নয়। অয়ন আবার বলে উঠে,
– এতোদিন এখানে অয়ন সামলে এসেছে, এতো ও কোনো বড় ইস্যু এখানে নেই তাই এই এক মাস অয়ন সামলাতে পারবে। আপনি দুই মাস সময় উনাদের কাছে নিয়ে নেন। আমার উপর ভরসা রাখেন, আমি আপনার বিশ্বাস ভাঙ্গবো না।
– এই না হতো আমার নাতি, আমি উনাদের সাথে কথা বলে নিবো। আর অয়নকে বলে রাখি, ভেবো না এখানের দায়িত্ব তোমাকে দেওয়া হচ্ছে বলে তুমি সব সিদ্ধান্ত নিতে পারবে। এই একমাস তুমি আবরারের সাবস্টিটিউট হিসেবেই থাকবে।

মহীমা সিকদারের কথা শুনে মুচকি হেসে অয়ন বলে,
– আমি তো সবসময় ভাইয়ের সাবস্টিটিউট ই ছিলাম, এতো ভাববেন না। আমার যদি আর কোনো কাজ না থাকে আমি কি রুমে যাবো?
– হুম, যাও

অপরদিকে,
দরজায় কড়া নাড়লে প্রাপ্তির ঘুম ভেঙ্গে যায়। ঢুলুঢুলু চোখে দরজা খুলতেই দেখে বাহিরে নিশান দাঁড়ানো। নিশান সেই ব্যাক্তি যার গাড়িতে সেই রাতে প্রাপ্তির এক্সিডেন্ট হয়েছিলো। একজন শুভাকাঙ্ক্ষী, বন্ধুর মতো নিশান প্রাপ্তিকে আগলিয়ে রেখেছে এই চার মাস। প্রাপ্তির অতীত সম্পর্কে সে কিছুই জানে না। প্রাপ্তি যখন বেঁচে উঠেছিলো, তখন তার অতীত জানার অনেক চেষ্টা করেছিলো নিশান। কিন্তু প্রাপ্তির একটাই কথা, তার কিছু মনে নেই। তাই আর ঘাটায় ও নি, তার নাম দেয় খুশবু। অনেকদিন যাবৎ প্রাপ্তির জন্য চাকরি খুজার চেষ্টা করে গেছে সে, কিন্তু পারে নি। তাই নিজের বাড়িতেই একটা রুম ভাড়া দেয় তাকে। নিশানের বাবা-মা খুশবুকে নিজের মেয়ে হিসেবেই ভালোবেসে এসেছে। অসহায় মেয়েটি তাদের ছেলের গাড়ির নিচে পড়ে নিজের বাচ্চাও হারিয়েছে। বাঁচার আশাটুকু ছিলো না। উপর ওয়ালা হাতে ধরিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছে তাকে। নিশান এতো রাতে৷ আশার মতো লোক নয়, হুট করে এতো রাতে তাকে দেখে খুবই অবাক হয় প্রাপ্তি। জিজ্ঞেস করে বসে,
– আপনি? এতো রাতে?
– তোমাকে ডিস্টার্ব করার জন্য সরি। আসলে, আমার এক বন্ধুর ফোন এসেছিলো। তোমার চাকরির ব্যবস্থা সে করে দিতে পারবে। কিন্তু তোমাকে ঢাকা যেতে হবে। আনোয়ার কোম্পানি এন্ড লিমিটেড এর মেইন অফিসে একটি পোস্ট ফাঁকা আছে। আমার বন্ধু ওখানেই চাকরি করে। ও তোমার সি.ভি জমা দিয়ে দিয়েছে। ওরা পরসু ইন্টারভিউ নিবে। তুমি কি যাবে?
– আচ্ছা, আমার কোনো সমস্যা নেই। এমনিতেও আমি ঢাকা যেতে চেয়েছিলাম। অতীতের কিছু প্রশ্নের উত্তর যে আমার চাই।
– তোমার কি কিছু মনে পড়েছে?
– না, তবে ওখানে যেহেতু আমার অতীত তাই, সেখানে গেলেই উত্তরগুলো পাবো।
– বেশ আমি কাল তোমাকে নিয়ে যাবো।
– এতোদিন আমাকে আশ্রয় দেবার জন্য ধন্যবাদ।
– এটা আমার দায়িত্ব ছিলো। আচ্ছা, একটা কথা জিজ্ঞেস করবো?
– করুন
– তোমার হাসবেন্ডকে যদি খুজে না পাও, তুমি কি তোমার জীবন নতুন করে শুরু করবে না?
– আমি জানি না, আমার প্রশ্নের উত্তর গুলো না পাওয়া অবধি আমি সত্যি ই জানি না কি করবো।
– এতোদিন তোমাকে বলি নি, তবে আজকে কিছু জিজ্ঞেস করবো উত্তর দিবে?
– জ্বী, বলুন
– যদি কোনোদিন অতীতকে প্রত্যাক্ষান করো, তবে কি আমাকে তোমার ভবিষ্যৎ মানাতে পারবে? আজ উত্তর দিতে হবে না। তুমি ভেবেচিন্তে উত্তর দিও।
– আ..আমি কিছু ভাবি নি এই ব্যাপারে।
– প্লিজ ভেবে দেখো।

বলে নিশান বেরিয়ে যায়। প্রাপ্তি তখন ও সেখানে দাঁড়িয়ে রয়েছে। যতই অয়নের প্রতি রাগ, অভিমান জমে থাকুক সে অয়নের জায়গা কাউকে দিতে পারবে না। অয়ন হয়তো তাকে ভুলে অন্য কাউকে নিজের জীবনে জায়গা দিয়েছে, ধুমধাম করে এনগেজমেন্ট করছে কিন্তু প্রাপ্তি এখনো তার মনের গহীনে অয়ন নামক মানুষটিকে পুষে রেখেছে। সেই অয়নের সাথে বোঝাপড়া এখনো বাকি যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর পাবার সময় চলে এসেছে। শুধু সময়ের অপেক্ষা।

দুইদিন পর,
সকাল ৯টার মধ্যে স্কুলে ঢুকতে হবে রাইসাকে। আব্রাহামকে রেখে যেতে মন চায় না। মাত্র বসা শিখেছে ছেলেটা,কিন্তু উপায়ন্তর না পেয়ে চাকরিটা করতেই হবে। রেশমা আন্টি এই বিপদে থাকার জন্য ছাদ দিয়েছেন এই কত! ছেলে আর নিজের ভরণপোষণের খরচটা তো তারই চালাতে হবে। শরীরটা দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। প্রেগ্ন্যাসির সময়ের থেকে কিছু কমপ্লিকেশনগুলো রয়েই গিয়েছে। মাঝে মাঝে ভয় হয় ছেলেটাকে একা করে দিয়ে না ফেরার দুনিয়াতে চলে যাবে নাতো সে? না না এসব কি ভাবছে, এখনো কত দায়িত্ব বাকি। চিকিৎসা করাতে হবে, কিন্তু টাকাও লাগবে। এখন বিভিন্ন টেস্ট করতেই দশ হাজার পকেট থেকে খসে পড়ে। রেশমা বেগমের কাছে ছেলেকে বুঝিয়ে দিয়ে স্কুলের দিকে রওনা দিবে রাইসা। দরজাটা খুলে বের হতেই হাত পা জমে গেলো তার। দরজার বাহিরে সেই মানুষটি দাঁড়ানো, যার কাছ থেকে পালাতেই এই দূর শহরে ছেলেকে নিয়ে বহু কষ্টে জীবন কাটাচ্ছে সে। আবরার রাইসাকে প্রায় বছর খানিক পর দেখছে। গোলগাল চেহারার ফর্সা মেয়েটি যেন হাড্ডিসার হয়ে গেছে। আজ তার চোখে সেই ঔজ্জ্বল্য নেই, চোখের নিচের কালি যেন তার নির্ঘুম রাতের বর্ণনা দিচ্ছে। এক পাশে বেনুনি করে কালো শাড়ি পরিহিতা নারীটি এক সময়ে তার সকল হাসির কারণ ছিলো। অথচ আজ এই নারীর সকল কষ্টের কারণ সে। তার জন্য এই নারীটিকে সকল প্রকার বঞ্চনা মুখ বুঝে সহ্য করতে হয়েছে। আবরার দু কদম এগিয়ে রাইসার সামনে এসে দাঁড়ায়। রাইসা এখনো চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে। মনের মধ্যে কিছু ভয়,জড়তারা মনের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে। তবে কি আব্রাহামকে কেঁড়ে নিতে এতো দূর চলে এসেছে সে। আবরার নিরবতা ভাঙ্গতে বলে উঠলো,
– কেমন আছিস রাইসু?
-…..
– কথা বলবি না?
-……
– ভয় নেই, ছেলেকে নিতে আসি নি। বরং মা-ছেলে দুজনকেই একসাথে নিয়ে যেতে এসেছি। বড্ড দেরি করে ফেলেছি, তাই নারে? অনেক ভুল করেছি, হয়তো সেই ভুলের ক্ষমা হয় না। কিন্তু এই একটা বছর আমি যা বুঝেছি তা হলো আমার তোকে দরকার, খুব করে দরকার। তুই যে আমার রক্তে মিশে আছিস রাইসা। আমার তোকে ছাড়া চলবে না, এই কয়েক মাস পাগলের মতো খুজেছি তোকে। আমি সেদিন বাধ্য ছিলাম আজ নয়। আমি তোর কাছ থেকে আব্রাহামকে কখনো কেড়ে নিবো না। আমার যে আমার পুরো পরিবার চাই। রাইসু প্লিজ একটা সুযোগ দে, আমি নিজেকে তোর যোগ্য করে তুলবো, তোরে কোনো কষ্ট পেতে দিবো না। প্লিজ রাইসু

এতোক্ষণ চুপ করে আবরারের কথা শুনে যাচ্ছিলো রাইসা। এতোদিনের কষ্টগুলো যেনো তাজা হয়ে উঠেছে আবরারকে দেখে। আবরার যে কথাগুলি বললো, কথাগুলি শোনার প্রতিক্ষা এতোগুলো বছর সে করেছে। চোখ থেকে না চাইতেও সোডিয়াম আর পটাশিয়াম ক্লোরাইড মিশ্রিত জল গড়িয়ে পড়ছে। এটা অতীব খুশিতে নাকি সদ্য তাজা হওয়া মনের ক্ষততে, এটা বুঝতে পারছে না রাইসা। খুব কষ্টে নিজেকে সামলিয়ে বলে উঠে,……..

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here