ভালোবাসার উষ্ণতা পর্ব ৪

#ভালোবাসার_উষ্ণতা
#দ্বিতীয়_অধ্যায়
#৪র্থ_পর্ব

প্রাপ্তিকে টানতে টানতে কোথাও নিয়ে ধাক্কা মারে অচেনা লোকটি। টাল সামলাতে না পেরে মেঝেতে পড়ে যায় প্রাপ্তি। অচেনা লোকটি তখন প্রাপ্তিকে চেপে ধরে তার উপর নিজের ভর ছেড়ে দেয়। লোকটির গরম নিঃশ্বাস যেন প্রাপ্তির ভেতরটাকে পুড়িয়ে দিচ্ছিলো। নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করেও যখন ব্যর্থ তখন প্রাপ্তি নিজেকে আর সংযত রাখতে পারে না। মুখের গোঙানি ক্রমশ বেড়েই চলেছে। অচেনা মানুষটি প্রাপ্তির গলায় জোরে একটি কামড় দিতেই ব্যাথায় কুকড়ে উঠে৷ তারপর প্রাপ্তিকে রেখে সেখান থেকে বেরিয়ে যায়। বেশ কিছুক্ষণ কোনো সারা শব্দ না পেলে, প্রাপ্তি নিজের চোখ ও মুখের বাঁধন খুলে ফেলে। আশেপাশে শুনশান নীরবতা,, কেউ নেই। আশেপাশে কাউকে না দেখতে পেয়ে খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো প্রাপ্তি। উঠে দাঁড়াতেই যাবে পাশে একটা চিরকুট পেয়ে খুবই অবাক হলো সে। চিরকুট খুলতেই নজরে পড়ে,
” আবার দেখা হবে ”
প্রথমে ভেবেছিলো এই রকম কাজ অয়ন ই করতে পারে, কিন্তু হাতের লেখাটা অচেনা। যদি অয়ন না হয় তবে কে হতে পারে। আগেও অয়ন তাকে পাগল প্রমাণ করতে নানা রকম জঘন্য প্লান করেছে, এবার ও কি এমন কিছু করছে!! অবাককর ব্যাপার জায়গাটি একটি দোকান যা তার বাসার পাশের গলিতে। অচেনা লোকটি তাকে এখানে কেনো নিয়ে আসলো, যদি তার কোনো খারাপ মতলব থাকতো তবে তো নিরব কোনো জায়গায় নিয়ে যেতে পারতো। মাথাটা বড্ড ব্যাথা করছে, তখন পড়ে যেয়ে মাথায় বেশ জোরে আঘাত পেয়েছে সে,, হাটু ও খানিকটা ছিলে গেছে। খুব কষ্টে বাড়ির পানে রওনা দিলো। বাসায় পৌঁছে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গ্রিল ধরে দাঁড়ালো প্রাপ্তি। গলার জায়গাটা এখনো জ্বলছে। নিজেকে শান্ত করাটা এখন খুব জরুরি হয়ে পড়েছে। কিন্তু কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে, আজ অয়নকে দেখে মন বারবার চাইছিলো যা হয়েছে ভুলে যাও। মানুষটা ভালো নেই, কিন্তু চার মাস আগে ঘটে যাওয়া ঘটনা তাকে বারংবার অয়নের প্রতি ঘৃণা বাড়িয়ে দিচ্ছে। মানুষের ভেতর কত রুপ থাকে সেটা বুঝা যে খুব কঠিন।।

সোডিয়ামের লাইটের আলো প্রাপ্তির অতীতের কালো দাগ যেন আরোও সুস্পষ্ট করে তুলেছে। প্রাপ্তি তো ফিরে যেতে চেয়েছিলো, কিন্তু সে পথ অয়ন নিজে বন্ধ করে দিয়েছিলো। এক্সিডেন্টে যখন বাচ্চাটিকে হারিয়ে প্রাপ্তি নিঃস্ব তখন বাঁচার তাগিদে খড়কুটো টুকু জড়িয়ে ধরতে চেয়েছিলো,, নিজের ভঙ্গুর সম্পর্ককে নতুন রুপ দিতে চেয়েছিলো সে। কিন্তু তা আর হলো কই! অয়নকে যখন ফোন দিয়েছিলো, তখন একটি মেয়ে কন্ঠস্বর ফোনটি রিসিভ করে। প্রাপ্তি কিছু বলার আগেই মেয়েটি বলে,
– হ্যালো, কে বলছেন? অয়ন বাথরুমে আছে। আমাকে বলতে পারেন। হ্যালো? অয়ন বের হও,, কেউ তোমাকে ফোন করেছে?
– কে ফোন করেছে?
– জানি না, চুপ করে আছে।
– রেখে দাও, গুরুত্বপূর্ণ সময়ে শুধু ফাউল রং নাম্বারে ফোন আসে। রেখে দাও আর তুমি এখানে আসো
– আচ্ছা

ফোনের অপারের অয়ন আর মেয়েটি কথোপকথন শুনে অয়নের প্রতি ভালোবাসাটুকু শূন্য হয়ে যায়। সে তো ভালোই আছে, শুধু শুধু তার জীবনে অনাকাঙ্ক্ষিত ব্যাক্তি হয়ে ফিরে যাবার তো দরকার নেই। হয়তো তার প্রয়োজন অয়নের জীবনে ফুরিয়ে গেছে। থাক না সে নিজের মানুষকে নিয়ে, প্রাপ্তি না হয় মরে গেছে সারাজীবনের জন্য। সেদিনের পর থেকে প্রাপ্তি নিজ আত্নসত্ত্বাকেও প্রকাশ করতে দেয় নি। নিশান ও তার পরিবার বহুবার তাকে তার অতীত সম্পর্কে জানতে চেয়েছে। কিন্তু প্রাপ্তি লুকিয়ে গেছে,, তবে মনের মাঝে হাজারো প্রশ্ন উঁকিঝুঁকি দেয়। কেনো অয়ন প্রাপ্তির সাথেই এমন করেছে। যদি একটা বাচ্চা ই প্রয়োজন ছিলো তবে প্রাপ্তি কেন!! আরো কত মেয়ে রয়েছে যারা টাকার বিনিময়ে সব করতে রাজি। কেনো অয়ন প্রাপ্তির জীবনটাকেই ছারখার করতে চলে এলো। অতীতের কথা মনে পড়তেই চোখ ভিজে এসেছে। কাল সকালে ঐ মানুষটাকে আবার দেখতে হবে। মাথা ব্যাথাটা তীব্রতর হচ্ছে। কখন যে ঘুমের দেশে পাড়ি দিয়েছে প্রাপ্তি নিজের ও হুশ নেই।

অপরদিকে,
রাত ৩টা,
আব্রাহাম কান্নায় ঘুম ভেঙ্গে গেছে রাইসার। বাচ্চাটা খুব জোরে জোরে কাঁদছে,, সচারাচর এভাবে আব্রাহাম কখনোই কাঁদে না। মাথায় হাত রাখতেই চমকে উঠে রাইসা। গা জ্বরে পুড়ে যাচ্ছে বেচারার। এতো রাতে কোথায় যাবে কি করবে কিচ্ছু মাথা কাজ করছে না তার। দৌড়ে রেশমা বেগম ঘুম থেকে জাগায় যে। রাত তিনটায় ছেলেটাকে কোথায় নিয়ে যাবে বুঝতে পারছে না সে। রাইসার উত্তেজনা শান্ত করতে রেশমা বেগম বলেন,
– আচ্ছা, রাইসা শান্ত হও। কিচ্ছু হবে না, আমি ড্রাইভ করে দিয়ে যাচ্ছি দরকার হলে। রাতে কোনো না কোনো হসপিটাল খোলা তো থাকবে।
– সরি আন্টি, আপনাকে এতো রাতে এভাবে হয়রানি করার জন্য। আব্রাহাম আমার সব আন্টি আমি ওকে ছাড়া সত্যি কিচ্ছু ভাবতে পারি না।
– ইটস ওকে। চলো আমি চাবি নিয়ে আসছি।

বাইরে বের হতেই একটি কালো গাড়ি দেখে অবাক রাইসা৷ গাড়িটা আবরারের, তার মানে বান্দা এখনো যায় নি। বিগত সাত দিন লোকটা গাড়ি নিয়ে তার বাড়ির সামনেই বসে থাকে, সকাল সন্ধ্যা এভাবে রাইসার সামনে ঘুরঘুর করে উত্তক্ত করাই এই বান্দার মুল উদ্দেশ্য। যেন আঠার মতো লেগে আছে রাইসার সাথে সে। রাইসা আর রেশমা বেগমকে হন্তদন্ত করে বের হতে দেখে গাড়ি থেকে বেরিয়ে আসে আবরার। আজকাল রাতগুলো নির্ঘুম কাটে তার। রাইসাকে এক ঝলক না দেখলে ঘুমেরা যেন তার কাছে আসতেই চায় না। রাইসার উদ্বিগ্ন মুখখানা তাকে জানান দিচ্ছে, কিছু একটা গুরুতর ঘটেছে। রাইসাকে প্রশ্ন করলে কোনো উত্তর পাবে না এটা তার অজানা নয় তাই সরাসরি রেশমা বেগমকে প্রশ্ন করে সে। রেশমা বেগম আব্রাহামের শারীরিক অবস্থার কথা সব খুলে বলে আবরারকে। আবরার এক মূহুর্তে দেরি না করে বলে,
– আন্টি, আপনি বাসায় থাকুন। আমি নিয়ে যাচ্ছি ওদের।
– আন্টি ওকে বলে দিন,, আমার এবং আমার বাচ্চার কারোর দয়ার দরকার নেই।
– আন্টি এটা জেদের সময় নয়, ওকে বলুন প্লিজ গাড়িতে উঠতে। ইট উইল বি ফাস্ট
– আন্টি আমি বললাম তো আমাদের কারোর দয়ার দরকার নেই। এতো আহ্লাদ এতোদিন কোথায় ছিলো? প্লিজ আন্টি দেরি হয়ে যাচ্ছে।
– চুপ করবে তোমরা?? বাচ্চাটার জ্বর, ১০২° আর তোমরা পড়ে আছো নিজেদের জেদ নিয়ে। এই রাতে আবরারের সাথে যাওয়াটাই সেফ হবে রাইসা। আমার এজ হয়েছে আমি এতোটা দ্রুত হয়তো নিতে পারবো না। প্লিজ জেদ করো না। নাও গো ( রেশমা বেগম)

অগত্যা বাধ্য হয়ে আবরারের সাথেই হাসপাতালের দিকে রওনা হয় রাইসা। হাসপাতালের করিডোরে দাঁড়িয়ে আছে তারা। ভেতরে ডাক্তার আব্রাহামকে দেখছেন। আব্রাহামের অসুখটা প্রায় ই হয়। তবে এই এক মাস তার কোনো সমস্যা হয় নি। রাইসা চিন্তিত মুখে এক কোনায় দাঁড়িয়ে আছে। আবরার তাকে নিপুণ দৃষ্টিতে দেখে যাচ্ছে। এই মেয়েটার কতরুপ, এক বছর আগে এই মেয়েটি ছিলো বেখেয়ালি, প্রাণোচ্ছল একটি নারী,, যাকে দেখলে তার মনে হাজারো রঙের মেলা লাগতো। হ্যা, তখন এই অনুভূতিকে ঠিক কি বলে সেটা জানতো না। অথচ আজ সেই নারী তার বাচ্চার মা, নিজের শরীরের কথা চিন্তা না করে হাসপাতালের করিডোরে পাংশু মুখে দাঁড়িয়ে আছে। ডক্টর সিদ্দিক হুসেইনের ডাকে ধ্যান ভাঙ্গে আবরারের।
– জ্বী বলেন?
– বাবুর বাবা, মা কি আপনারাই?
– জ্বী, বলেন।
– আমার কেবিনে আসুন কিছু কথা বলার আছে।

চিন্তিত মুখে মুখোমুখি বসা ডক্টর সিদ্দিক এবং আবরার-রাইসা। ডক্টরের হঠাৎ কেবিনে ডাকা তাদের চিন্তায় ফেলে দিয়েছে।
– আচ্ছা, বাবুর ইমিউনিটি যে খুবই দূর্বল সেটা কি আপনারা জানেন?
– জ্বী, ও প্রিম্যাচ্যুর বেবি ছিলো। কি হয়েছে ডক্টর?
– আপনারা বাবা-মা, তাই আপনার কাছ থেকে কিছুই লুকাবো না। বাবুর……

চলবে

মুশফিকা রহমান মৈথি

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here