ভালোবাসার ভেজা সন্ধ্যে পর্ব ১৩

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (১৩)

রাতের খাবার শেষ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দিলেন কবির সাহেব। ঘুমুতে যাওয়ার আগে বইয়ে মুখ গুজা উনার তরুন বয়সের অভ্যাস। কিন্তু আজ বইয়ে মন বসাতে পারছেননা। বয়সের ভারটা কি খুব বেশি হয়ে গিয়েছে?? আজকাল শরীরটা একদম মনের সাথে তাল মেলাতে চায়না। একটু থেকে বেশি কিছু করতে গেলেই হাত-পায়ে কাঁপুনি ধরে। দুর্বলতায় ভরপুর শরীরটা দিনে দিনে আলসেমিতে রূপ নিচ্ছে। কবির সাহেব চোখের চশমাটা খুলতে গিয়েও খুললেননা। খোলা দরজার আবছা ছায়াটাকে উদ্দেশ্য করে বললেন,,

“” কিছু বলবে,বউমা? আমার মনে হচ্ছে তুমি এই নিয়ে চারবার আমার দুয়ারে পাক দিচ্ছো!””

বাবার ডাক অমান্য করে পালিয়ে যাওয়ার সাহস নেই মিন্মির। গুটিগুটি পায়ে ভেতরে ঢুকে মাথা নিচু করে দাড়ালো। শাড়ীর আঁচলটা আরেকবার ঘোমটায় রেখে বললো,,

“” আপনার কিছু লাগবে,বাবা?””

কবির সাহেব মন্থরগতিতে উঠে বসলেন। ইশারায় মিন্মিকেও বসতে বললেন। ঠোঁটে মৃদু হাঁসি নিয়ে বললেন,,

“” যা বলতে চাচ্ছো তা বলে ফেলো। আমি নিশ্চিত,তুমি কিছু জানার ইচ্ছেতে এসেছো।””

মিন্মি মাথা তুলে বাবার দিকে তাকালো। ছোট্ট চাহনি একেঁ সাথে সাথে মাথা নামিয়ে ফেললো। বেশ কিছুক্ষণ ইতস্ততায় ভুগে নিচু্স্বরে বললো,,

“” আমি রিপ্তির ব্যাপারে সবটা জানতে চাই,বাবা। আপনি আমায় অনেককিছু বলেছেন। কিন্তু আমার মনে হচ্ছে আপনার সেই অনেককিছুর মাঝেও কিছুই নেই। আমার চোখে রিপ্তির এমনকিছু পড়েছে যা আমার সব চিন্তাভাবনাকে ঝাপসা করে দিচ্ছে। আবছা কল্পনায় ভুলভাল ভেবে বসছি।””

কবির সাহেব ছেলের বউয়ের দিকে তাকালেন। ঠোঁটের মৃদুহাসিটা মিলিয়ে গেছে। মুখে ভর করছে গাম্ভীর্য। তিনি চুপ করে রইলেন। মিন্মিও চুপ। তবে সে অপেক্ষায় আছে কিছু শোনার!

কবির সাহেব কিছু সময় নিরব থেকে রুমের নিরবতা ভাঙলেন,,,

“” রিপ্তি জন্ম নেওয়ার চারঘন্টা পর ওর মা মারা যায়। রেনুর আকস্মিক মৃত্যুটায় আমি বড্ড বেশি ভেঙে পড়ি। রাসেলও খুব ছোট। সবে স্কুলে ভর্তি করিয়েছি। ও খুব কাঁদছিলো। কিছুতেই ওর কান্না থামাতে পারছিলাম না। শেষে রিপ্তিকে ওর কোলে দিয়ে বললাম,দেখ তোর কান্না দেখে তোর বোন কেমন মিটিমিটি হাঁসছে! রাসেল কান্না থামিয়ে বললো,,বাবা,আমার হাত কাঁপছে,বোন যদি পড়ে যায়? তুমিও আমার সাথে ধরো!

রাসেলের কথায় সেদিন আমিও হেঁসে উঠেছিলাম। আমাদের তিনজনের সংসার তিনজনেরই রয়ে গেলো। শুধু যোজন-বিয়োজনের ফলে হাঁসিকান্নার খেলা চললো। রাসেল আর আমি দুজনেই স্কুল যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। দুজনেই রিপ্তিকে সামলাতে ব্যস্ত! এরমধ্যে কানাঘুষো অনেক দায়-উপদেশ চলছিলো আমার দ্বিতীয় বিয়ে নিয়ে। কিন্তু মা শব্দটির আগে সৎ শব্দটা ব্যবহার করতে আমার ঘোর আপত্তি। সেই আপত্তি বজায় রেখেই রিপ্তি আর রাসেলকে কোলেপিঠে মানুষ করতে লেগে গেলাম। রেনুর মা অনেকবার আরজি নিয়ে এসেছিলেন রিপ্তিকে নিয়ে যাওয়ার। কিন্তু রাসেলের মুখের দিকে তাকিয়ে উনাকে বারবার ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। এভাবেই চলছিলো। রিপ্তি বসতে শিখলো,হাঁটতে শিখলো,কথা বলতে শিখলো। শিখনি চর্চা ঠিক রাখতে দিলাম কিন্ডার গার্টেনে ভর্তি করে। তখনি বাধলো বিপদ। আমার হাঁসিখুশি মেয়েটা স্কুল থেকে ফিরতো মন খারাপ নিয়ে। জিজ্ঞেস করলেই ঠোঁট উল্টিয়ে বলতো,আমার মা কোথায়,বাবা? আমার মা চাই। মায়ের হাত চাই,আমি আম্মুর আঙুল ধরে স্কুলে যাবো।

ছোট্ট রিপ্তিকে এ কথা,সে কথা দিয়ে ভুলিয়ে রাখার তুমুল চেষ্টা আমার আর রাসেলের। নিত্যনতুন খেলনা,নতুন নতুন জায়গায় ঘুরতে নেওয়ার কায়দাকেও ধরে ফেললো সে। দিন যত এগুচ্ছিলো ও তত জেদি হচ্ছিলো। আমার সব কথাতে সে অবাধ্য। ভুল ধরিয়ে দিতে গেলেই বলতো,আম্মু এনে দাও তাহলে আর ভুল করবোনা।

রিপ্তির জেদের মুখোমুখি হওয়া থেকে আমি নিজেকে দুরে রাখতে শুরু করলাম। রিপ্তিও আমাকে এড়িয়ে চলতে থাকলো। সময় যত গড়াচ্ছিলো আমাদের দুরত্ব তত বেড়ে যাচ্ছিলো। এরমাঝেই ও একদিন আমার রুমে আসলো। ওর বয়স তখন নয়। আমি পরীক্ষার খাতা দেখছিলাম। ওকে আমার রুমে দেখে আমি বেশ অবাক। খাতা দেখা বন্ধ করে ওর কাছে দাড়াতেই ও মুখ ফিরিয়ে নিলো। পরিষ্কার গলায় বললো,,যে বাসায় মা নেই,সেই বাসায় আমি থাকবো না। আমি নানির সাথে থাকবো!””

আমার এখনো মনে আছে,রিপ্তিকে নানীবাড়ী রেখে আসাতে রাসেল টানা নয়দিন জ্বরে কাতরিয়েছিলো। তবু্ও আমি ওকে ফিরিয়ে আনতে যায়নি। ঐ ছোট্ট মেয়েটার উপর আমার অভিমান হয়েছিলো,গাঢ় অভিমান। আর সেই অভিমান থেকেই প্রতিজ্ঞা করে বসি,ও যতদিননা আমাকে ডাকবে আমি ততদিন ওর কাছে যাবো না। আমার ঐ প্রতিজ্ঞা পুরো পাঁচ বছর পর্যন্ত অব্যাহত রইলো। না ও আমায় ডেকে পাঠালো,না আমি ও বাড়ীতে পা রাখলাম। ওর খরচপাতি,প্রয়োজন-অপ্রয়োজন সব খবরাখবরের দায়িত্ব রাসেলের কাঁধে দিয়ে আমি আমার শিক্ষকতায় ব্যস্ত। ব্যস্ততার মাঝে হঠাৎ হঠাৎ মন কেঁদে উঠতো আমার মা মরা মেয়েটার জন্য। মা যদি কোনো বাজারের পন্য হতো,তাহলে তারজন্য যতমূল্যই পরিশোধ করতে হতো আমি ততমূল্য দিয়েই কিনে আনতাম। মেয়ের মুখের তৃপ্তির হাঁসিটা আমার আর দেখা হলোনা।

পাঁচবছর বাদে রিপ্তি হুট করে হাজির। সেদিনও আমি পরীক্ষার খাতা দেখায় ব্যস্ত। চোখে চশমা ব্যবহার করি। চশমার ঝাপসা দুর করতে নরম কাপড়ের টুকরোটা দিয়ে কাঁচ মুচ্ছিলাম তখনি রিপ্তি খোলাগলায় বললো,,

“” আমার আম্মুর বেনারসী কোথায় রেখেছো? চাবিটা দাও।””
“” বেনারসী?””

মেয়ে আমার প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। কিছু সময় শেষে রেনুর মাকে নিয়ে হাজির হলো। আমাকে উদ্দেশ্য করে নানির দিকে মুখ করে বললো,,

“” নানি,বাবাকে বলো না,বেনারসীটা দিতে। আমি কখন পড়বো? আর কখন বিয়ে করবো? এতো দেরি করলে তো আমার বর চলে যাবে!””

আমি ভেবেছিলাম ওটা ওর ছেলেমানুষী ছিলো। আলমারীর চাবীটা ওর দিকে বাড়িয়ে দিলাম। ও নিজে আলমারী খুলে শাড়ী বের করে পড়লো। মাথায় বিশাল ঘোমটা টেনে আমার সামনে এসে দাড়ালো। আমি কিছু বুঝার আগেই পায়ে ধরে সালাম করে বললো,,

“” বাবা,দোয়া করে দাও তো!””

আমার দোয়া নিয়ে ও রুম ছেড়ে বেরিয়ে গেলো। সেদিন শুধু রুম না,আমার বাড়ী এমনকি গ্রাম ছেড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো । সারাদিন অপেক্ষা করেও যখন ওর কোনো দেখা পেলাম না। তখন রাতের অন্ধকারে পুরো গ্রাম তন্ন তন্ন করে খুজেছি ওকে। শুধু আমাদের গ্রাম নয়,আশেপাশের গ্রামগুলোতে খোঁজ লাগিয়েও ওকে পাওয়া যায়নি। রাসেল ভয়ভয় মুখ বানিয়ে বললো,বাবা,আমার বোন বেঁচে আছে তো?? আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে থাপ্পড় মেরেছিলাম। রাগ ঝেড়ে খুব বকেও ছিলাম। এমন পরিস্থিতিতে কেউ এমন কথা বলে??

বাপ ছেলে হতাশ আর নিরাশে যখন ডুবে যাচ্ছি ঠিক তখন পাশের বাড়ীর সাগরের বাবা দৌড়ে এলো। বেলানগর রেল স্টেশনে নাকি রিপ্তি ঘুমাচ্ছে। খবরটা পেয়েই আমি আর রাসেল ছুটলাম রেল স্টেশন। হুম,সাগরের বাবার তথ্য সঠিক ছিলো। আমরা যখন ওর কাছে পৌছুলাম ও তখনো ঘুমেই। আমি হাল্কা করে ডাকতেই রিপ্তির ঘুম ভেঙে যায়। ঘুমজড়ানো চোখে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলো,,বাবা,এখন থেকে আমি তোমার সাথে থাকবো। তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাবো!

তারপর থেকে রিপ্তি আবার আমার কাছে থাকতে শুরু করলো। সেই একদিনের নিখোঁজ মেয়েটির সব পাল্টে গেলো। আমার চঞ্চল,অবাধ্য বদমেজাজী,জেদি মেয়েটা হঠাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো।

মিন্মি আর অপেক্ষা করতে পারলোনা। চটজলদি প্রশ্ন করে বললো,,

“” রিপ্তি,সেদিন বউ সেজে কোথায় গিয়েছিলো?””

কবির সাহেব বউমার দিকে তাকালেন। ছোট্ট নিঃশ্বাস ছেড়ে বললেন,,

“” আমি জানিনা।””

এমন একটা উত্তরের জন্য মিন্মি মোটেও প্রস্তুত ছিলোনা। বসা থেকে উঠে পড়লো। বাবার দিকে অবিশ্বাসী চাহনি একেঁ বললো,,

“” আপনি সত্যিই জানেননা?””
“”না। আমি ওর মুখ দেখে বুঝে গিয়েছিলাম ও আঘাত পেয়েছে,গভীর আঘাত। আর সেই আঘাতের কারণ উন্মোচন করতে গিয়ে যদি ও আবার আমার থেকে দুরে চলে যায়? তাই তখন আর জানতে চাওয়া হয়নি। তবে আমার ছোট্ট আশা ছিলো হয়তো রিপ্তি নিজে এসেই আমাকে বলবে। কিন্তু বলেনি। আর আমিও পুরোনো কথা ঘেটে ওর ক্ষতটাকে জাগিয়ে তুলতে চাইনি। তবে আশা ছাড়িনি,এখনো অপেক্ষায় আছি রিপ্তির সেই না বলা কথাটা শোনার। কি এমন ঘটেছিলো যে রিপ্তি এক রাতে এতোটা বদলে গেলো?? প্রশ্নটা আমাকে খুব জ্বালাতন করে,মাঝে মাঝে তো খুব ইচ্ছে হয় রিপ্তিকে জিজ্ঞেস করি! কিন্তু ওর মুখের দিকে চোখ পড়লে আর করা হয়না।””

কবির সাহেব নিজেও বসা থেকে উঠে দাড়ালেন। মিন্মির মাথায় হাত রেখে বললেন,,

“” একটা মেয়ের মনের ভেতর ঢুকার ক্ষমতা একটা মেয়েরই থাকে। আর সে যদি হয় মা রূপি তাহলে তো কথাই নাই। আমি নিশ্চিত,আজ যদি রিপ্তির মা বেঁচে থাকতো,তাহলে কিছুই অজানা থাকতো না। তুমি পারবে তো,আমার মেয়ের মনের গভীরে ঢুকতে??””

বাবার কথার উত্তরে মিন্মি মাথা নাড়লো। চোখ তার ভিজে উঠছে। চোখের পানি আড়াল করতে ঘোমটাটা আরেকবার টেনে নিয়ে দরজার দিকে পা বাড়ালো।

~~~

সকালে রিপ্তির ঘুম ভাঙলো তৃণার ডাকে।

“” অনুভব ভাইয়া কোথায়?””

তৃণাকে দেখেই রিপ্তির মিষ্টি সকাল বিরক্তে ছেয়ে গেলো। শোয়া থেকে উঠে পড়লো। ব্রাশে পেস্ট লাগাতে লাগাতে বললো,,

“” জানিনা।””
“” জানিসনা মানে?””
“” জানিনা মানে জানিনা।””
“”তোদের বাড়ী থেকে এমন নাদুস-নুদুস একটা ছেলে নাই হয়ে গেলো আর তুই বলছিস জানিসনা?””
“” তোর বয়ফ্রন্ডের খবর আমি জানতে যাবো কেন?””

তৃণা ভুল করে আকাশ থেকে মাটিতে পড়েছে এমন ভাব নিয়ে বললো,,

“” অনুভব ভাইয়া আমার বয়ফ্রেন্ড?””
“” না,ছেলেবন্ধু!””

তৃণা রিপ্তির ফ্যানামাখা ব্রাশটা কেড়ে নিয়ে বললো,,

“” নিজের বয়ফ্রেন্ডকে অন্যের ঘাড়ে ঝুলিয়ে দিতে তোর লজ্জা করছেনা?””

রিপ্তি ভ্রূ কুঁচকে বললো,,

“” ঐ লাল ব্যাঙ আমার বয়ফ্রেন্ড হতে যাবে কেন?””
“” প্রপোস করবে তোকে,আর বয়ফ্রেন্ড হবে অন্যকারো?””
“” প্রপোস? কিসের প্রপোস?””
“” অনুভব ভাইয়া কাল তোকে প্রপোস করেনি?””
“” না।””
“” তুই মিথ্যে বলছিস। তোরা দুজন কি প্ল্যান করেছিস বলতো? একজন তোকে সারপ্রাইজ দিবে বলে আমাকে সারারাত রাস্তায় দাড় করিয়ে রাখলো,আরেকজন মিথ্যার ঝুলি খুলে বসেছিস৷ নিজেরাই যদি তলে তলে মধুখাবি,আমাকে কেন মশার কামড় খাওয়ালি?””

তৃণার কথা রিপ্তির মাথায় ঢুকছেনা। তাহলে কি ও যা ভেবেছিলো তা ভুল? অনুভব আর তৃণার মধ্যে তেমন কোনো সম্পর্ক নেই?? রিপ্তি আর কথা প্যাচালোনা। সরাসরি প্রশ্ন করলো,,

“” তুই বলতে চাচ্ছিস লাল ব্যাঙ আমাকে ভালোবাসে? আর সেই ভালোবাসার কথা জানাতে একটা সারপ্রাইজ সাজাতে তোকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলো?””
“” হুম। কিন্তু উনি তো কাল আসেনি। আমি এতোবার করে কল দিলাম,ধরলোইনা!””
“” তোকে কে বললো উনি আমায় ভালবাসে?””
“” উনি নিজে বলেছেন।””
“” মিথ্যা বলেছেন।””
“” মিথ্যে বলতে যাবে কেন?””
“” কারণ উনার তুই বাদেও আরো একটি প্রেগন্যান্ট গার্লফ্রেন্ড ও একটি বউ আছে! হতে পারে অধিক প্রেগন্যান্ট গার্লফ্রেন্ড আর অধিক বউ আছে। আমি তো শুধু একটির খোঁজ পেয়েছি!!

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here