ভালোবাসার ভেজা সন্ধ্যে পর্ব ২৩

#ভালোবাসায়_ভেজা_সন্ধ্যে
#রোকসানা_রাহমান

পর্ব (২৩)

আতরের গন্ধের টানে পুরো গ্রামের মানুষ হাজির হয়েছে রিপ্তিদের বাড়ী। উঠোন জুরে চেনা অচেনা মানুষদের ভীড়। সকলেই এক নজর দেখতে চায় সাদা কাফনে ঢাকা মৃত মানুষটির মুখ। বাচ্চা-কাচ্চা থেকে শুরু করে সত্তরে পা দেওয়া বুড়ো মতিলব সাহেবও হাজির হয়েছেন। এক সময় এই গ্রামের বেশ ক্ষমতাবান ছিলেন। এখন কবরে যায় যায় অবস্থা। শুকনো কাঠের লাঠিতে ভর করে উঁকি দিলেন চৌকিতে শুয়িয়ে রাখা নিথর দেহটির উপর। একজন মুখ থেকে কাপড়টা সরাতেই দুর্বল কন্ঠে বললেন,,

“” বড়ো ভালা মানুষ আছিল কবির। আল্লাহ বেহেস্ত দান করুক!””

সাথে সাথে চারপাশের মানুষের মধ্য থেকে ভেসে আসলো মৃদু কান্নাসুর। বাড়ির মূল দরজার সামনে বিন্যাসিত সিড়ির এক কোনে বসে ছিলো রিপ্তি। হঠাৎ করেই চেঁচিয়ে উঠলো,,

“” উফ! এতো শব্দ কিসের? দেখছো না আমি মানুষ গুনছি? সবাই চুপ করো তো।””

রিপ্তির কথায় কেউ কান দিলোনা। রিপ্তিও সেদিক থেকে নজর সরিয়ে গেটের দিকে মনোনিবেশ করলো। উৎসুক নয়নে চেয়ে আছে। আরেকজন ছেলেমানুষ আসলেই পাঁচশত পূর্ণ হবে!

বাড়ীর ভেতরে জায়গা না পেয়ে অনেকে রাস্তা থেকেই ভেতরে উঁকি মারছে। অনেক্ষণ কেটে যেতেও যখন আরেকটি পুরুষ মানুষের আগমন ঘটলো না রিপ্তির মন খারাপ হলো। সিড়ি ছেড়ে উঠোনে পা রাখতেই দুজন লোক ভেতরে প্রবেশ করে। খুশিতে রিপ্তির চোখ চকচক। দৌড়ে বাসার ভেতর ঢুকে গেলো। সোজা রান্না ঘরে ঢুকেছে। বিশাল এক হাড়ি চুলায় বসিয়ে দিলো। ম্যাচে শলা ঘষতেই মিন্মি দৌড়ে এসেছে। চোখ,মুখ ফোলা। চোখের কোলে অশ্রু নিয়ে বললো,,

“” কি করছিস,রিপ্তি?”‘

রিপ্তি চুলায় আগুন ধরালো। বড় মগ দিয়ে গুনে গুনে পানি ঢালছে পাতিলে। ব্যস্ত ভঙ্গিতে উত্তর দিলো,,

“”চা বানাচ্ছি,ভাবী। বাড়ীতে এতো মেহমান এসেছে খাতিরযত্ন করতে হবেনা?””

মিন্মির গাল ভিজে গেলো। রিপ্তিকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে বললো,,

“” তোর কি হয়েছে রিপ্তি? এসব পাগলামি কেন করছিস?””
“” কিসের পাগলামী? পাগলিরা কি চা বানায়? তুমি বরং ভাইয়াকে বলো,দোকান থেকে কয়েক প্যাকেট বিস্কুট এনে দিতে। বাসায় যেগুলো আছে,সবার হবেনা। পরে তো সবাই বলবে,কবির সাহেব কৃপণ হয়েছে গিয়েছে। আমার বাবা মোটেও কৃপণ নয়। আমি থাকতে বাবার অপমান হবে? কিছুতেই না।””

মিন্মি রিপ্তিকে জড়িয়ে ধরে বললো,,

“”আমাদের বাবা আর নেই রিপ্তি। এটা তুই কেন বুঝতে চাচ্ছিস না?””

রিপ্তি নিজেকে ছাড়িয়ে নিলো। চা-পাতির কৌটো’টা খুলতে খুলতে বললো,,

“” আমি কি পিচ্ছি মেয়ে যে,এই ছোট জিনিসটা বুঝবোনা? ঐতো উঠোনে বাবার মৃতলাশটা পরে আছে। একটু পরে জানাজা হবে। তারপর চাইলেও বাবাকে দেখতে পারবোনা। ছুতে পারবোনা। কথা বলতে পারবোনা। কখনোইনা। আমি সব বুঝি ভাবী!””

রিপ্তির ডান হাতটা চেপে ধরে মিন্মি। হাতে কৌটো’টা মাটিতে পড়ে গেলো। রান্নাঘরে চা-পাতির ছড়াছড়ি!

“” দিলে তো সব ফেলে? এখন চা করবো কি দিয়ে?””

রিপ্তির কথা অগ্রাহ্য করে সামনে হাঁটা ধরেছে মিন্মি। বাবা যে আর নেই এ খবরটা রিপ্তিই এসে জানিয়েছিলো। ভোর বেলা। এমনভাবে বলেছিলো যেন এমন ঘটনা দৈনিক আট-দশবার করে ঘটে। তারপর থেকে সকলে কান্নারকোলে ঢলে পড়লেও রিপ্তি পড়েনি। এতোটা স্বাভাবিক কি করে থাকছে মেয়েটা? অতিরিক্ত শোকে অনুভূতিনামক জিনিসটা কি হারিয়ে ফেলেছে? কিন্তু অনুভূতি ছাড়া কি মানুষ হয়? হয়না। তারা প্রাণীর কাতারেই পড়েনা। তাহলে কি রিপ্তিও জড়বস্তুর মহলে নিজের নাম লিখিয়েছে? নাহ! এ হতে পারেনা। মিন্মি থাকতে তো কখনোইনা। ওকে কাঁদতে হবে। একবার চোখের পানি পড়লেই সব ঠিক হয়ে যাবে। সব!

রিপ্তি শক্ত হয়ে দাড়িয়ে পড়ায় হাঁটায় বাধা পেয়েছে মিন্মি। প্রচন্ড পরিমানের বিরক্ত নিয়ে বললো রিপ্তি,,

“” কোথায় নিয়ে যাচ্ছো? চুলোয় আগুন ধরিয়ে এসেছি তো।””

মিন্মি রিপ্তির গালে হাত রাখলো। শান্ত গলায় বললো,,

“” বাবাকে দেখতে। শেষবারের মতো বাবাকে দেখবিনা?””
“”বাবা কি আমাকে দেখবে?””

মিন্মি চমকে উঠে। রিপ্তি আরো কয়েকগাছা প্রশ্ন রাখে,,

“” বাবা কি আমার সাথে কথা বলবে? বাবা কি আমার চোখের পানি মুছে দিবে? বাবা কি আমার মাথায় হাত বুলাবে? বাবা কি আমার সাহস জোগাবে? করবে নাতো? তাহলে আমি কেন দেখতে যাবো?””
“” এমন অবুঝের মতো করছিস কেন রিপি?””

রিপ্তি রান্নাঘরের দিকে যেতে যেতে বললো,,

“” আমি অবুঝ নই,ভাবী। তোমরা অবুঝ। তাইতো মিছে কান্না করছো! কান্না করলে কি মৃতরা ফিরে আসে?””

মিন্মি ওখানেই থমকে আছে। না রিপ্তির কাছে যাচ্ছে না অন্য কোথাও। তখনি রান্নাঘর থেকে জোরালো কন্ঠ এলো,,,

“” এ বাড়ীতে আমি যতদিন আছি ততদিন যেন বাবার কোনো ছাত্র ঢুকতে না পারে। এমনকি বাবার মৃত্যুসংবাদটাও না পায়।””

~~~
কবির সাহেব চলে গিয়েছেন আজ চারদিন। বাসার সবাই গভীর শোকাহত। এখনো যেন ধাক্কাটা সামলিয়ে উঠতে পারছেনা। মৃত্যু সবসময় আকস্মিকই হয়। কিন্তু কবির সাহেবের জন্য যেন খুব বেশিই আকস্মিক। মেনে নেওয়ার মতো কোনো মনোবলই পাচ্ছেনা কেউ। একমাত্র রিপ্তি বাদে। তার মধ্যে কোনো শোক শোক ভাব নেই। যখন তখন কান্না তো দুর,এক পলকের জন্যও এক ফোঁটা পানি ঝরেনি তার চোখ থেকে। তার চোখ শুকনো। অনেকটা মরুভমির বিশাল বিস্তৃতের ন্যায়। তবে সে খুব ব্যস্ত। সকাল,দুপুর,রাত তিনবেলায়ই রান্নার চুলো জ্বালাচ্ছে আর নিভাচ্ছে। কোমড়ে ওড়না বেধে ঘর মুচছে,কাপড় কাচছে,উঠোন,ঝাড়ু দিচ্ছে। পাক্কা গিন্নি! আচ্ছা বিয়ে না হয়েও বুঝি গিন্নি হওয়া যায় না? কেন যায় না? বিয়ের আগে গর্ভবতী হতে পারলে গিন্নিও হতে পারে।

রাতের খাবার সাজাচ্ছে রিপ্তি। আজ সে অনেক কিছু রান্না করেছে,মুরগির মাংসের ঝোল,ডিম বোনা,পাতলা ডাল,দুরকম ভাজি সাথে আলুভর্তা। একে একে সব সাজাচ্ছে আর সকলকে ঠিক সময়ে টেবিলে আসার তাগিদ দিচ্ছে। মিন্মি লুকিয়ে লুকিয়ে রিপ্তিকে দেখছে আর শাড়ীর আঁচলে চোখ মুচ্ছে! আর সহ্য করতে না পেরে স্বামীর বুকে ঝাপিয়ে পড়ে। করুণ কন্ঠে বলে,,

“” আমার মেয়েটাকে ঠিক করে দাও!””

~~~

যাত্রী ছাউনিতে বসে আছে রিপ্তি। ঢাকার বাস ধরবে। এতো তাড়াহুড়ো করে বেরোলো তবুও ট্রেণটা মিস করেছে। তাই বলে তো বাসায় ফেরত যেতে পারেনা। এক গুরুত্বপূর্ণ কাজের উদ্দেশ্যে এগারদিন বাদে বাইরে পা ফেলেছে সে। হসপিটাল যেতে হবে। ভালো হসপিটাল লাগবে সাথে ভালো ডাক্তার। অবশ্যই মহিলা ডাক্তার হতে হবে। যাতে সে লজ্জা না পায়। নিজের কুকর্মের জন্য! বাবা নেই তো কি হয়েছে? বাবার রেখে যাওয়া সম্মানটা সে কিছুতেই নষ্ট হতে দিবেনা। তারজন্যই তো ঢাকা যাওয়া। আজ যে সে আরেকটা পাপ করতে যাচ্ছে। একটা নিষ্পাপ,ফেরেশতাসমতুল্য প্রাণকে খুন করতে যাচ্ছে। এতো বড় বড় দুটো পাপের জন্য তার কি শাস্তি হবে? যা খুশি হোক। তবুও সে বাবার সম্মানহানি হতে দিবেনা!

বাস চলে এসেছে। রিপ্তি সবার আগে উঠলো। পুরো বাস ফাঁকা। তেমন কোনো যাত্রী নেই। নরসিংদী থেকে ছাড়া এটাই প্রথম বাস। কিছুক্ষণ পরেই ভরাট হয়ে যাবে। রিপ্তি একদম পেছনের সিটে গিয়ে বসলো। কন্টাক্টর চেচিয়ে উঠলেন,,

“” আপা,এতো পেছনে বইছেন ক্যান? সামনে আহেন।””

লোকটির কথা কর্ণপাত করলো না রিপ্তি। জানালার কাঁচ খুলে দিচ্ছে। সকালের মিষ্টি রোদ এখন কড়া হয়ে উঠেছে। সূর্যের সবটা তেজই গিয়ে পড়লো রিপ্তির মুখে। সেদিকেও ভ্রাক্ষেপ করেনি রিপ্তি। রোদকে সঙ্গি করেই সিটে হেলান দিলো। চোখদুটো বুঝতেই পাশে কেউ এসে বসেছে। সাথে বাচ্চাও আছে। ভ্যা ভ্যা করে কাঁদছে। এতো অল্প সময়েই সব সিট দখল হয়ে গেলো? পেছনে বসেও শান্তি নেই! বাচ্চাটি অনরবত কেঁদে চলেছে। বাচ্চার মা বিরক্ত হচ্ছেন। প্রথমে বাবা,সোনা,কলিজা,লক্ষি,পেঁচা ডাকাডাকি করেও থামাতে না পেরে ঠাস করে একটা চড় বসিয়ে দিয়েছেন। চড়ের শব্দটা রিপ্তির কানে পৌছিয়েছে। সাথে সাথে সব নিরব। রিপ্তিও খুশি। কঁপালে জমে থাকা বিরক্তের ভাজটা মিলিয়ে যেতেই মৃদু সুর ভেসে এলো। গান বাজছে কোথাও। রিপ্তি ঠিক অনুৃমান করতে পারছেনা কোথায় বাজছে। তার পাশেই কি? নাকি অন্যকোথাও? আজকাল তো বাসের মধ্যেও গান হয়। সেখানেও হতে পারে। কোথায় বাজছে কেন বাজছে তা নিয়ে কোনো মাথাব্যথা নেই রিপ্তির। তবে মনের কোনো এক কোণ সেই গানেই আটকা পড়েছে। কানের ভেতর দিয়ে গভীরে চলে যাচ্ছে সেই গানের কথাগুলো,,

না জানি কোন অপরাধে
দিলা এমন জীবন!
আমারে পোড়াইতে তোমার
এতো আয়োজন!!
আমারে ডুবাইতে
তোমার এতো আয়োজন!!(গান)

গানের কথাগুলো রিপ্তির অন্তরে বাজছে। হারিয়ে যাচ্ছে এক অজানায়। রিপ্তির মনে হলো এই গানটা তাকে নিয়েই গাওয়া হয়েছে। হ্যা তাকেই। রিপ্তি পুরোদমে গানে ডুবে গেলো। তলিয়ে যাচ্ছে ঘুমের তলদেশে। গাঁথছে সাদাকালো স্বপ্ন। নানা আবিজাবি স্বপ্নের মাঝেই সে তার বাবাকে খুজে পেলো। সাদা চমকানো সাদা পান্জাবী পড়ে আছেন তিনি। পান্জাবীতে পা ঢেকে আছে। মাথায় পাগড়ী,মুখে সাদা দীর্ঘদাড়ি। এমন চমকানো সাদা রঙ আগে কখনো দেখেনি রিপ্তি। সে বিস্ময় নিয়ে বাবাকে দেখছে। বাবার মুখটাও কেমন দুধসাদা। কিন্তু বাবা তো এতো ফর্সা রঙের ছিলোনা। তাহলে এই লোকটি কে? বাবার মতো অন্য কেউ?? রিপ্তির ভাবনার মধ্যেই সাদারঙের লোকটির এক চোখ দিয়ে রুপোলি পানির টুকরো গড়িয়ে পড়েছে। রিপ্তি শঙ্কিতকন্ঠে বললো,,

“” বাবা! তুমি কাঁদছো কেন?””

এবার দুচোখ থেকে রুপোলি পানির টুকরো ঝরছে। রিপ্তি আতঙ্কে পড়ে যায়। মহাব্যস্ত হয়ে পড়ে বাবার চোখের পানি মুছে দিতে। কিন্তু তার ছটফট করা শরীরটা নড়তে পারেনা। এক জায়গায় গেথে আছে। মনে হচ্ছে কোনো শক্ত বরফজমা দিয়ে সে তৈরী। রিপ্তি অসহায়ভাবে বাবার দিকে তাকাতেই বাবা নরমসুরে বললেন,,

“” কোনো প্রাণের বিনিময়ে সম্মান চাইনা,মা। আবার সম্মানের বিনিময়েও প্রাণ চাইনা।””

বাবার গুরুগম্ভীর কথার মানে বুঝতে পারছেনা রিপ্তি। প্রশ্নবিদ্ধ চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু বুঝার আগেই বাবা মিলিয়ে গেলেন। রিপ্তি চিৎকার করে বাবা,বাবা বলে ডাকছে।

“” আপা! আপা!!””

হঠাৎ ভরাট গলার পুরুষকন্ঠে রিপ্তির ঘুম ভেঙে যায়। স্বপ্নের সাথে বাস্তবটা এখনো ঘোলাটে হয়ে আছে। রিপ্তি আবার চোখ বন্ধ করে নিতেই বাস কন্টাক্টর বিরক্ত নিয়ে বললেন,,

“” বাস আর যাইবোনা। আপনি কি নামবেন?””

রিপ্তি লাফ দিয়ে উঠে। পুরো বাস ফাঁকা। সে আর এই মাঝ বয়সী কঠোর লোকটা ছাড়া কেউ নেই। কিছুটা ঘাবড়ে গেলেও নিজেকে সামলে নেয়। কন্টাক্টরকে পাশ কাটিয়ে দ্রুত নেমে আসে। এখান থেকে রিকসা উঠলে দশ মিনিটের রাস্তা আমেনা হসপিটালের। স্থিরমূর্তি হয়ে দাড়িয়ে আছে রিপ্তি। তার সামনে দিয়ে চলে যাচ্ছে খালি রিকসা। রিপ্তির চোখ সেদিকে নেই রোডের উল্টো পাশে। চোখ বন্ধ করে দম আটকে দাড়িয়ে রইলো কিছুক্ষণ। হঠাৎ শব্দ করে নিশ্বাস ছেড়ে বিড়বিড় করলো,বাবা,সম্মান আর প্রাণ দুটোই বাঁচবে!

~~~

বাড়ি ফিরেই এক কঠিন সিদ্ধান্ত নিয়েছে রিপ্তি। ঘর ছাড়বে সে,শুধু ঘর নয় গ্রামও ছাড়বে। সাথে পুরো নরসিংদী। কিন্তু কিভাবে? লুকিয়ে? না বলেই রাতের আধারে হারিয়ে যাবে নাকি ভাইয়া-ভাবীকে জানিয়ে যাবে? কিন্তু উনারা কি রাজি হবে? নানা চিন্তাভাবনার মাঝেই রাতের খাবার সাজাচ্ছিলো রিপ্তি। মিন্মিও হাতে হাতে কাজ করে দিচ্ছে। আড়চোখে রিপ্তিকে পরখও করছে। তার এই জীবনের দেখা সবচেয়ে আশ্চর্যজনক চরিত্র হলো রিপ্তি। কিছুদিন আগেও ভেবেছিলো রিপ্তির মন পড়ার অদৃশ্যশক্তি আয়ত্ব করে ফেলেছে সে। কিন্তু বাবা মারা যাওয়ার পর তার চিন্তাভাবনাকে ভুল প্রমান করে দিলো রিপ্তি। যতদিন যাচ্ছে মেয়েটা তত জটিলরুপ ধারণ করছে। না কিছু বলছে না কিছু বুঝতে দিচ্ছে। তবে আজ অন্যরকম লাগছে। কিছু একটা নিয়ে মগ্ন। কিন্তু সেটা কি?

ভাইয়ের পাতে ভাত বেড়ে দিচ্ছে রিপ্তি। নিজের ভয়টা কাটিয়ে সাহস করে বলেই দিলো,,

“” ভাইয়া, আমি হলে থেকে পড়তে চাই।””

রাসেল গরম ভাত নাড়ছিলো। ভাত নাড়া বন্ধ করে বললো,,

“” যখন বাবা বলেছিলো তখন যাসনি। এখন মত পাল্টালো কেন? আর তুই তো সবে ফার্স্ট ইয়ারে পড়িস। হলে সিট পাওয়া কি এতো সহজ?
“”তাহলে অন্য কোথাও থাকবো।””
“” কোথায়?””
“” কোথাও একটা!””

রাসেল আর শান্ত থাকতে পারলোনা। কঠিনসুরে বললো,,

“” কোথাও যাবিনা। এখানে থেকেই পড়বি। তোর যাতায়াতে সমস্যা হলে মিন্মি তোর সাথে যাবে।””

রিপ্তিও কঠিন করে বললো,,

“” আমি যাবো যাবো যাবো! আমার যেখানে থেকে ইচ্ছে হয় সেখান থেকেই পড়বো। আমার তোমাকে জানানোর ছিলো জানিয়ে দিয়েছি।””

রাসেল চেয়ার ছেড়ে দাড়িয়ে গেলো। চোখ পাকিয়ে কিছু বলতে যাবে তখনি মিন্মি সামনে এসে দাড়ালো। দুজনের মাঝে দেয়াল হয়ে মিন্মিকে বললো,,

“” আগে খাওয়াটা শেষ কর। পরে ভাবিস কোথায় থেকে পড়বি।””

হাতে থাকা ভাতের বোলটা শব্দ করে রাখলো রিপ্তি। চুপচাপ নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায়। পেছনে ভাবী,নানির ডাককে পরোয়া করলোনা।

~~~

নিয়মিত ক্লাস করার সুবাদে অনেকের সাথেই পরিচয় হয়েছে রিপ্তির। তবে কারো সাথেই তেমন একটা সখ্যতা গড়ে উঠেনি একমাত্র রুবিনা বাদে। ওর সাথে মিশতে খুব একটা ভালো লাগেনা রিপ্তির। প্রচুর কথা বলে! সবকিছুতেই আগ বাড়িয়ে ঢুকে পড়ে। সাথে রিপ্তিকেও জড়িয়ে ফেলে। মাঝে মাঝে এতো রাগ হয় যে ইচ্ছে করে গালে দু/চারটা থাপ্পড় মেরে বসে। আজও ক্লাস শেষে বের হতেই রুবিনা সামনে এসে দাড়ালো।

“” কোথায় যাচ্ছিস?””

রিপ্তির দায়সারা উত্তর,,

“” বাড়ীতে।””
“” এতো জলদি?””

রিপ্তি ভ্রূ কুঁচকে ফেললো। বিরক্ত নিয়ে বললো,,

“” প্রতিদিন তো এই সময়েই যায়। আমার ট্রেণ ধরতে হয়।””

রুবিনা হাত ঘড়িটার দিকে চোখ বুলিয়ে বললো,,

“” এখনো অনেক সময়। চল আমার ভাগ্নিকে দেখে আসি।””
“” ভাগ্নি?””
“” হুম। চলনা। আমি আপুকে বলেছি তোকে নিয়ে যাবো।””
“” আমি বলেছি যাবো?””
“” আমি তো বলেছি! তোর ট্রেণ মিস না হলেই তো হলো।””

রিপ্তিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ওকে টানতে টানতে ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে রুবিনা।

হসপিটালে ঢুকতে ঢুকতে প্রশ্ন করে রিপ্তি,,

“” এটা তোর আপুর বাসা?””

রুবিনা একগাল হেঁসে বললো,,

“” হুম। কাল রাতেই ভাড়া নিয়েছে। আরো দুদিন থাকতে হবে,বুঝলি?””
“” মশকরা বন্ধ করবি? আমার কিন্তু রাগ হচ্ছে।””
“” তোর রাগ হয়না কখন? সারাক্ষণই তো চোখে কড়া দৃষ্টি! আচ্ছা রাগটা কি শুধু আমাকে দেখলেই আসে নাকি সবাইকে দেখলেই?””

রিপ্তি কড়া কথা বলতে যাবে তখনি শুনতে পেলো,,

“” আমার স্ত্রী!””

রিপ্তি হাওয়াবেগে ডানপাশে ঘুরলো। পলকহীনভাবে চেয়ে আছে সামনে থাকা মানুষটির দিকে। কতযুগ পরে দেখা পেলো এই মানুষটাকে?? শতাব্দিও কি পেরিয়ে গিয়েছিলে? রিপ্তি অদ্ভুত উত্তেজনায় সামনে পা ফেলছে। এইতো আর কয়েককদম ফেললেই অনুভবের মুখোমুখি হবে। চোখে চোখ রেখে বলবে,কোথায় ছিলেন লাল ব্যাঙ?

অনুভবের সামনে থাকা নার্সটি ভরাট গলায় বললো,,

“” আপনার মেয়ে হয়েছে।””

চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here