#ভালোবাসি_বলেই_তোমাকে_প্রয়োজন
লেখক – এ রহমান
পর্ব ৮
চা বাগান আর পাহাড়ের মাঝেই কেটে গেছে বেশ কয়েকদিন। শুটিং এর কাজও প্রায় শেষের দিকে। এখন ঘড়িতে সময় সকাল ১১ টা। আজ রোদের তেজটা বেশ। গা জ্বালা করছে। সদ্য কিছু কাজ শেষ করে অরণ্য রিসোর্টে ফিরলো। বারান্দায় রাখা চেয়ারে বসে পড়লো। ঘামে শার্ট ভিজে গেছে। ক্লান্ত শরীর চেয়ারে এলিয়ে দিলো। সামনে থেকে টিস্যু নিয়ে মুখটা ভালো করে মুছে নিয়ে চোখটা বন্ধ করলো। তার মাথায় এখন একটা বিষয় কাজ করছে আজ রাতের মধ্যেই শুটিং শেষ করতে হবে। কাল ঢাকায় ফেরার কথা। আজ রাতেই শেষ না করতে পারলে আরো একটা দিন পিছিয়ে যাবে। আর সে কোন ভাবেই আর একটা দিনও এখানে থাকতে চায় না। যে কোন উপায়ে কাজ শেষ করে কাল তাকে ঢাকায় ফিরতেই হবে। অনেক কাজ এখনো বাকি আছে। আর তার থেকেও বড় কথা সারিয়াকে নিয়ে এখানে থাকা বেশ বিপদ। সব সময় মনের মাঝে একটা ভয় কাজ করে।
সারিয়া জানালা খুলে বাইরে তাকাল। রোদের তেজ এতো বেশি যে চোখে লাগছে। চোখ মুখ কুচকে বাইরে তাকাতেই বারান্দায় বসে থাকা অরণ্য কে চোখে পড়লো। আবার সেই জানালা বন্ধ করে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। দরজা লাগিয়ে পেছনে তাকাতেই দেখলো সীমান্ত দাড়িয়ে আছে। সারিয়া একটু বিরক্ত হলো। এভাবে হুট হাট সীমান্তের তার কাছে আসার বিষয়টা মোটেই ভালো লাগে না তার। কিন্তু ভদ্রতার খাতিরে মুখ ফুটে কিছু বলে না। তারপরেও আচরণে বুঝিয়ে দেয়। কিন্তু সীমান্ত কি বুঝেনা নাকি বুঝতে চায় না সেটা তার মাথায় আসে না। সীমান্ত হেসে সারিয়া কে বলল
— কোথাও যাচ্ছেন?
— হ্যা। ওই একটু মার…।
তড়িঘড়ি করে উত্তর দিতে গিয়েও থেমে গেলো। মার্কেটে যাওয়ার কথা ভাবছিল সে। কিছু কেনাকাটা করবে। কিন্তু সীমান্ত জানতে পারলে জোকের মত লেগে যাবে তার সাথে। বিষয়টা কতটা বিরক্তি কর ভাবতেই কেমন অস্থির হয়ে গেল সারিয়া। একটু ভেবে বলল
— দোলনায় বসবো ভাবছিলাম।
সীমান্ত মৃদু হেসে বলল
— আমি একটু শহরের দিকে যাচ্ছিলাম। একটু কাজ আছে। আসার পর থেকে তো কোথাও বেরোনোই হয়নি। তাই ভাবছিলাম আপনাকে একটু ঘুরে নিয়ে আসি। যাবেন নাকি?
সারিয়া গম্ভীর হয়ে গেলো। সীমান্তের সাথে সে কিছুতেই যাবে না। মৃদু হেসে বলল
— আজ খুব রোদ। বাইরে যেতে ইচ্ছা করছে না। আমি আশে পাশেই বসে থাকবো। আপনি যান।
সীমান্ত সারিয়ার কথাটা মেনে নিতে পারলো না। জেদ চেপে বসলো মনে। এখন পর্যন্ত এভাবে কেউ তাকে ইগনোর করেনি। এই মেয়েটাই করে। সীমান্ত সেটা দাতে দাঁত চেপে সহ্য করে নেয়। কিছু বলে না বলেই আরো বেশী মাথায় উঠে যাচ্ছে। তীব্র আবদারের সুরে বলল
— কাল তো চলেই যাচ্ছি। চলুন না ঘুরে আসি।
সারিয়া বুঝতে পারলো সীমান্ত জেদ করছে। তাই মাথায় হাত দিয়ে বলল
— আমার মাথাটা হালকা ব্যাথা করছে। মাইগ্রেনের ব্যাথা আছে। এই রোদে ঘুরলে ব্যাথা বাড়বে। তাই যেতে চাচ্ছিলাম না। কিন্তু আপনি যখন জোর করছেন তখন আর উপায় নেই।
সীমান্ত একটু ভাবলো। বুঝতেও পারলো এটা নাটক। সারিয়া যাবে না। অযথা কথা বললেই পরিস্থিতি বিগড়ে যাবে। তাই আর কথা না বাড়িয়ে বলল
— না না। আমি জোর করছি না। এমনিতেই বললাম। সমস্যা থাকলে আপনি রেস্ট নেন। আমি ঘুরে আসি। বিকেলের মধ্যেই চলে আসবো। আর হ্যাঁ মেডিসিন নিয়ে নিবেন কিন্তু।
সারিয়া প্রশস্ত হাসলো। সীমান্ত সেই হাসির অর্থ কি ধরে নিলো কে জানে। কিন্তু সারিয়া মনে মনে খুশি হলো কারণ এই আপদ অন্তত বিকেল পর্যন্ত আর চোখের সামনে ঘুরঘুর করবে না। সীমান্ত চলে গেলো। সারিয়া দরজা থেকে দেখছিল। গাড়িটা রিসোর্ট থেকে বেরিয়ে যেতেই সে হেসে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়ালো। অরণ্য তখনো চোখ বন্ধ করে আছে। সারিয়া মনযোগ দিয়ে তাকাল। ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি জেগে আছে সেটা বুঝতে পারছে না। ডাকবে কিনা সেটা নিয়ে একরাশ দ্বিধাদ্বন্দ্বের অবসান ঘটিয়ে মৃদু স্বরে বলল
— আপনি কি জেগে আছেন?
অরণ্য চোখ খুলে ফেললো। সারিয়া কে নিজের উপরে এভাবে ঝুঁকে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে নিলো। সারিয়া সোজা হয়ে দাড়াল। ভাবলো এভাবে ডাকাতে অরণ্য রাগ করেছে। তাই নিচের দিকে তাকিয়ে মিনমিনে কণ্ঠে বলল
— আমি আসলে বুঝতে পারিনি যে আপনি ঘুমাচ্ছিলেন।
অরণ্য তার কথার কোন উত্তর না দিয়ে গম্ভীর সরে বলল
— বসো।
সারিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সামনের চেয়ারে বসে পড়লো। বলল
— আপনি কি সত্যি ঘুমিয়ে পড়েছিলেন?
অরণ্য মাথা নেড়ে না বলল। ক্লান্ত সরে বলল
— কি বলতে চাও বলো।
সারিয়া অবাক হয়ে তাকাল। সে যে কিছু বলতে এসেছে সেটা অরণ্য কিভাবে বুঝে গেলো। অরণ্য হেসে আবার বলল
— কি হলো? কি বলবে বলো।
সারিয়া খুশি হয়ে গেলো। চোখের পাতা পিটপিট করে তাকিয়ে বলল
— এখানে আসার পর থেকে তো কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়নি। তাই ভাবছিলাম একটু ঘুরতে যাবো। কিন্তু কার সাথে যে যাই।
বলেই এদিক সেদিক তাকাতে লাগলো। অরণ্য হাসলো। সারিয়া যে তাকেই উদ্দেশ্য করে কথাটা বলেছে সেটা বুঝতে পেরেই হাসলো। বলল
— তুমি কি রেডি নাকি আরো সময় লাগবে?
সারিয়া চোখ বড় করে তাকাল। মৃদু হেসে বলল
— ১০ মিনিট।
অরণ্য হাসতেই সারিয়া উঠে গেলো। অরণ্য ফোন বের করে টেবিলে রেখে বলল
— ১০ মিনিট যেনো ১১ মিনিট না হয়। হলে কিন্তু তোমাকে রেখেই চলে যাবো।
সারিয়া মাথা নেড়ে ঘরে গেলো। অরণ্য সামনে তাকিয়ে প্রশস্ত হাসলো।
————–
দিনের বেলা গরম হলেও রাতে বেশ ঠান্ডা পড়েছে। শিরশির করে ঠান্ডা বাতাস বইছে। শীতের কাপড় জড়িয়ে নিলেও মাঝে মাঝেই বাতাসের দাপটে শরীর কেপে উঠছে। এর মাঝেই চলছে শুটিং। অরণ্য বেশ ব্যস্ত। খুব তাড়াহুড়ো করছে কাজটা শেষ করতে। সারিয়া গায়ে চাদর জড়িয়ে বেরিয়ে এলো ঘর থেকে। অরণ্য যেখানে বসে আছে তার পাশেই একটা চেয়ার নিয়ে বসে পড়লো। কিছুক্ষণ যেতে না যেতেই খেয়াল করলো শিশির পড়ে ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। চোখ ফিরিয়ে অরণ্যর দিকে তাকাল। ভীষন এলোমেলো মনে হলো তাকে। শীতের তেমন কোন কাপড় গায়ে নেই। সারিয়া বেশ নিম্ন সরেই বলল
— আপনার ঠান্ডা লাগছে না?
অরণ্য কোন উত্তর দিলো না। কারণ সে নিজের কাজে এতটাই ব্যস্ত যে তার কথা শুনতেই পায় নি। এমন কি সারিয়া যে তার পাশে এসে বসেছে সেটাই এখনো বুঝতে পারেনি। সারিয়া আবার জিজ্ঞেস করলো
— বেশ ঠান্ডা পড়েছে। শীতের কাপড় পরেন নি কেনো?
এভাবে কথা বলায় অরণ্যর মনোযোগ বিঘ্ন ঘটছে। সে বিরক্ত হলো। চোখমুখ কুঁচকে গেলো তার। কোন কিছু না বুঝেই দৃষ্টি এক জায়গাতেই স্থির রেখে ধমকের সুরে বলল
— এতো কথা বলছো কেন? দেখতে পাচ্ছো না কাজ করছি।
সারিয়া অবাক দৃষ্টিতে তাকাল। অরণ্য এভাবে কথা বলবে সেটা তার ধারণাতেও ছিলো না। মন কেমন বিষন্ন হয়ে গেল। হুট করেই অভিমান জমে গেলো। সারাদিন তো সব ঠিক ছিলো। কত জায়গায় ঘুরেছে দুজন। কত শপিং করেছে। কিন্তু এখন তার কথা শোনার মত সময় নেই অরণ্যর। ভাবতেই কেমন অস্থির হয়ে উঠলো মন। চোখ ভরে এলো। পরক্ষনেই আবার নিজের কাজে নিজেই অবাক হয়ে গেলো। অরণ্যর কথা বলা না বলা নিয়ে তার সাথে অভিমান করার কারণ কি? কেনো এমন অস্থির লাগছে তার। মনটা ভার করে উঠে গেলো সেখান থেকে। ঘরে চলে এলো। জানালা পুরোটা খুলে দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকলো। তার দৃষ্টি বাইরে বসে থাকা অরণ্যর উপরে স্থির। মন বারবার সেই ব্যবহারের কথা মনে করে কষ্ট পাচ্ছে আর মস্তিষ্ক বলছে কেনো অরণ্যর ব্যবহারকে সে প্রাধান্য দিচ্ছে। অরণ্য তো তার জীবনে এমন কেউ না যার গুরুত্ব তার কাছে এতটা হওয়ার কথা ছিল। যার কথা তার উপরে এতটা প্রভাব ফেলতে পারবে। কিন্তু কেনো? এলোমেলো ভাবনা গুলো মস্তিষ্কে ঘোর প্যাঁচ খাচ্ছে। কোন সমীকরণ মেলাতে পারছে না। এই সব কিছু তার থেকেই কিছুদূরে দাড়িয়ে দেখছে সীমান্ত। সবটা দেখেই তার বিচক্ষণ মস্তিষ্ক বুঝে গেছে পুরো ঘটনা। রাগে পুরো শরীর রি রি করে উঠলো। এতদিন ধরে এতো অপেক্ষা করে সে কিছুতেই হার মানবে না। কারো পিছনেই তাকে এতো সময় নষ্ট করতে হয়নি। কিন্তু এই মেয়েকে বশে আনতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে তার। আর এখন পরিস্থিতিও হাতের বাইরে চলে যাচ্ছে। এখনই কোন কিছু না করলে পুরো পরিস্থিতি হাতের বাইরে চলে যাবে খুব শীঘ্রই। কারণ বেশ কয়েকদিন ধরেই অরণ্যর সাথে সারিয়ার বেশ সখ্যতা হয়ে উঠেছে। সেটা তার দৃষ্টিতে গিয়ে ঠেকেছে ঠিকই কিন্তু সেরকম গুরুত্ব দেয়নি। কিন্তু আজ সে বিষয়টা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হচ্ছে। অরণ্য পর্যন্ত ঠিক ছিলো কিন্তু এখন সারিয়ার ভাব ভঙ্গিও তার ভালো লাগছে না। কাল ঢাকায় ফিরলেই খুব তাড়াতাড়ি কিছু একটা করে ফেলবে। মস্তিষ্ক তার জটিল ছক সাজাতেই ব্যস্ত হয়ে উঠলো। অপেক্ষা শুধু ঢাকায় ফেরার।
চলবে…..