#ভ্রম_নাকি_তুমি!(৪র্থ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
মানসিক হাসপাতাল থেকে বের হয়ে আয়ান অফিসে চলে গেল। কিছুক্ষণ পরে অবনীকা কে ফোন করলো।
– হ্যালো।
– হুম বলুন।
– খেয়েছেন আপনি?
– হ্যাঁ, আপনি?
– আমিও। আচ্ছা আপনি কি আজ বাসায় আসবেন? তাহলে আমি অফিস থেকে ফেরার পথে আপনাকে নিয়ে আসবো।
– আচ্ছা ঠিক আছে।
সকালে অবনিকা ওর এক বান্ধবীর বাসায় গেছে। সকালে আয়ান এর সাথেই বের হয়েছিলো। রাতে আয়ান এর সাথে বাসায় ফিরবে।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় আয়ান এর মা একা আছে। কলিং বেল এর শব্দ পেয়ে দরজা খুললেন কিন্তু কাউকেই দেখতে পেলেন না। কিছুটা অবাক হলেন। কিন্তু ততটা গুরত্ব দিলেন না। আরেকবার কলিং বেল এর শব্দ পেয়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ভাবছেন দরজা খুলবে কিনা। তখনই আরো একবার কলিং বেল বাজলো। উনি কিছু একটা ভেবে ভয়ে ভয়ে দরজা টা খুললেন। কিন্তু কিছুই দেখতে পান নি এইবারেও। হঠাৎ রান্নাঘরে কিছু একটা পড়ার আওয়াজে পেছন ঘুরে তাকালেন। রান্নাঘরে গিয়ে দেখলেন একটা পানির জগ নিচে পড়ে ভেঙে গেছে। “আশ্চর্য! এটা এখানে পড়লো কিভাবে? এখানে তো কেউই নেই। কোন মানুষ কিংবা বিড়াল কিছুই তো দেখতে পাচ্ছি না। তাছাড়া পানি ভর্তি জগ বাতাসে তো পড়তে পারে না।” মনে মনে বিড়বিড় করলো মিরা রহমান। “এসব কি হচ্ছে আমার সাথে?” বেশ খানিকটা ভয় পেয়ে গেলেন এইবার। হঠাৎ মনে পড়লো যে দরজা তো খুলে রেখে এসেছেন। এক দৌঁড়ে গিয়ে দরজা টা বন্ধ করে দিয়ে আসলেন। হঠাৎ করে দেখতে পেলেন সিঁড়ি বেয়ে অবনীকা নেমে আসছে। ওর হাতে একটা চাকু। লাল রঙের রক্ত লেগে আছে চাকুতে। খোলাচুল গুলো বাতাসে উড়ছে। রক্তচক্ষু দেখে মনে হচ্ছে এ কোন মানুষ নয়। যেন কোন অশরীরী হেটে আসছে মৃত্যুর বার্তা নিয়ে।
অবনীকা কে এভাবে আসতে দেখে ভয়ে গলা শুকিয়ে গেল মিরা রহমান এর। তিনি আস্তে আস্তে পিছিয়ে আসছেন অবনীকা কে তার দিকে এগিয়ে আসতে দেখে। অবনীকা এগিয়ে এসে ওর শাশুড়ীর মুখ টা শক্ত করে চেপে ধরলো।
“নিজের প্রিয় ছেলের রক্ত চাকুতে লাগানো দেখে কেমন বোধ করছেন প্রিয় শাশুড়ী মা?”
“মা মানে? কি বলছো তুমি? আর কে তুমি?”
“আমি আপনার বউমা। আমাকে দেখে এত ভয় পাচ্ছেন কেন মা?”
মিরা রহমান পেছনে সরতে সরতে একদম দেয়ালের সাথে মিশে গেল। অবনীকা চাকু টা দিয়ে ওর শাশুড়ীর হাত দেয়ালের সাথে গেঁথে দিলো। ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠলেন তিনি। হাত থেকে গলগল করে রক্ত পড়ছে। টেবিলের ওপর থেকে আরো একটা চাকু এনে বাকি হাতটাও দেয়ালে গেঁথে দিলো। দুই হাতের তালু থেকে রক্ত পড়ছে। মিরা রহমান ব্যথায় কুকড়ে গেছেন। নড়াচড়া করলে হাতে ব্যথা লাগে তাই ছাড়ানোর চেস্টা ও করছেন না। এদিকে ভয়ে চিৎকার করতে ও ভুলে গেছেন তিনি। অবনীকা একটা কাপড় দিয়ে মুখটা বেঁধে দিলো।
“বাবা মায়ের কাজ হলো সন্তান কে সুশিক্ষা দেয়া। সন্তান যদি কোন ভুল কাজ করে তো তাকে সঠিক পথ দেখানো মা বাবার সবথেকে বড় দায়িত্ব। কিন্তু সেই বাবা মা যখন সন্তানকে অপরাধ করতে সাহায্য করে তখন তার কোন ক্ষমা হয়না। আপনার ও ক্ষমা নেই। তবে চিন্তা করবেন না। আপনাকে এত তাড়াতাড়ি আমি মারবো না।”
বলেই অবনীকা বাইরে বের হয়ে গেলো। রাত আট টার দিকে আয়ান গেল অবনীকার বান্ধবীর বাসায় অবনীকা কে আনতে। তারপর সেখানে ডিনার করে দুজনে বাসায় চলে আসলো। বাসার ভেতর ঢুকে নিজের মাকে এই অবস্থায় দেখে শিউরে উঠলো আয়ান। তাড়াতাড়ি গিয়ে ওখান থেকে বের করে তাকে নিজের ঘরে নিয়ে গেল। চোখ খুলে অবনীকা কে দেখে বিস্ফোরিত চোখে তাকিয়ে কিসব বলতে বলতে জ্ঞান হারিয়ে ফেললো। আয়ান ডক্টর কে কল করে ইমিডিয়েটলি আসতে বললো। ডক্টর এসে ওর মায়ের চিকিৎসা করলো ভালো ভাবে। কিছু ওষুধ দিয়ে ঘুমের ইনজেকশন দিয়ে চলে গেল।
আয়ান এখনো কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। মায়ের এমন টা হলো কি করে? কি নৃশংস ভাবে আঘাত করেছে। এটা কোন মানুষের কাজ হতে পারেনা। অবনীকা ও ঘাবড়ে আছে। ওর মুখ একদম শুকনো।
– আচ্ছা আপনার কি এখনো মনে হচ্ছে না যে অদ্ভুত কিছু হচ্ছে আমাদের পরিবারে?
– হুম অদ্ভুত তো হচ্ছেই। কিন্তু এসব কে করছে, কেন করছে সেটাই তো বুঝতে পারছি না।
– আমি একটা কথা বলবো?
– হুম।
– আমার মনে হয় অবনীর আত্মা এসব করছে। হয়তো ও চায় না আপনার জীবনে অন্য কোন মেয়ে থাকুক।
– ও জাস্ট শাপ আপ। আপনার কোন আইডিয়া আছে আপনি কি বলছেন? যতসব মনগড়া আজগুবি গল্প বলে যাচ্ছেন?
আয়ান এর ধমক শুনে অবনীকা একদম চুপ হয়ে গেল। এই প্রথম বার ও আয়ান কে রাগতে দেখলো। কিছু না বলে চুপচাপ শুয়ে পড়লো। কিন্তু ঘুমাচ্ছে না। এপাশ ওপাশ করে যাচ্ছে। আয়ান অবনীকার পাশে বসে বসে ভাবছে এসব কি হচ্ছে? আচ্ছা এসব কি অবনীকা করছে? ও আবার অবনী নয় তো?? কিন্তু কিভাবে? অবনীর লাশ সবাই দেখেছে। উফফফ আর ভাবতে পারছে না। মাথাটা ধরে গেছে। মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। অবনীকা খেয়াল করলো আয়ান কে। ও উঠে বসে আয়ান এর মাথায় হাত রাখলো। আচমকা আয়ান অবনীকার হাত ধরে ফেললো।
– সত্যি করে বলো তুমি কে?
– মা, মানে? আমাকে চিনতে পারছেন না?
– না। তোমাকে বুঝতে পারছি না আমি। তুমি অবনী?
– হ্যাঁ আমি অবনী ই তো।
– কিহ? আবার বলো!
– আমার নাম অবনী, কিন্তু তার সাথে একটা “কা” যোগ করুন। অবনী আর কা। মানে হলো অবনীকা।
আয়ান অবনীকার হাত ছেড়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুয়ে পড়লো। দুজনেই জেগে আছে। হঠাৎ বারান্দায় জোরে জোরে নূপুর এর শব্দ হচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ নূপুর পায়ে দিয়ে দৌঁড়াদৌঁড়ি করছে। অবনীকা ভয় পেয়ে আয়ান কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে ওর বুকে মাথা লুকালো। ওর অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে পারলে ও আয়ান এর বুকের ভেতর ঢুকে যাবে।
– আমি দেখে আসছি ওখানে কে আছে।
– না না আমাকে একা রেখে যাবেন না। আমার খুব ভয় করছে। প্লিজ প্লিজ।
– কিচ্ছু হবেনা। আমি আছি তো। আমাকে দেখতে দিন।
আয়ান কোনমতে অবনীকা কে ছাড়িয়ে বারান্দায় গেল। কিন্তু ততক্ষণে শব্দটা থেমে গেছে। আয়ান কিছুটা অবাক হলো। বারান্দায় তো কেউই নেই। এখানে লুকানোর জায়গাও নেই। আর বেডরুমের দরজা ছাড়া এখান থেকে বের হওয়ার ও জায়গা নেই। তাহলে কে ছিলো? আর কোথায়ই বা গেল? আয়ান ভালো করে চেক করলো সব কিছু। কিন্তু কোথাও কিছু পেল না। কি হচ্ছে এসব? আসলেই কি কোন অশরীরী আছে??
পরদিন সকালে আয়ান অবনীকা কে বললো রেডি হয়ে নিতে। আয়ান এর মা তখনো ঘুমুচ্ছে। আয়ান এর কথা মতো অবনীকা রেডি হয়ে নিলো।
– আমরা কোথায় যাচ্ছি?
– আমার সাথে চলুন। কোথায় যাচ্ছি সেটা তো দেখতেই পাবেন।
অবনীকা কোন প্রশ্ন করলো না। ও জানে আয়ান কে প্রশ্ন করে কোন লাভ নেই। এখন উত্তর দিবে না। তার থেকে অপেক্ষা করা যাক।
কিছুক্ষণ পরে একটা মানসিক হাসপাতালের সামনে আয়ান গাড়ি দাঁড় করলো। অবনীকা কিছু বুঝতে পারছে না। আয়ান ওকে এখানে কেন নিয়ে আসলো??
আয়ান এর পেছন পেছন অবনীকা চুপচাপ একটা কেবিনে ঢুকলো। কেবিনে ঢুকে বিছানায় শোয়া মহিলাকে দেখে অবনীকা আয়ান এর মুখের দিকে তাকালো।
– চিনতে পারছেন এনাকে?
– না তো। কে উনি?
আয়ান চোখদুটো সরু করে অবনীকার মুখের দিকে তাকালো। অবনীকা এক দৃষ্টিতে মহিলার দিকে তাকিয়ে আছে। আয়ান কোন উত্তর দিচ্ছে না দেখে অবনীকা চোখ সরিয়ে আয়ান এর দিকে তাকিয়ে বললো,
– বলছেন না কেন? কে ইনি?
– ইনি অবনীর মা।
– ওহ আচ্ছা। উনি এখানে কেন?
– অবনীর মৃত্যুর পরে উনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। অবনী ছাড়া ওনার আর কেউ ছিলো না। একমাত্র অবনীর জন্যই বেঁচে ছিলেন। কিন্তু যখন অবনীও তাকে ছেড়ে চলে গেলেন তখন আর সেটা সহ্য করতে পারেন নি। ২ বছর ধরে ওনার ট্রিটমেন্ট করাচ্ছি। উনি যতদিন বেঁচে আছেন ওনার সব দায়িত্ব আমার। যদিও এটা আমার পরিবারের কেউ জানে না। আসলে বলার প্রয়োজন মনে করিনি।
– ওহ আচ্ছা। খুবই ভালো করেছেন। কিন্তু আমাকে এখানে আনলেন কেন?
– কিছুই না, এমনিই। মনে হলো আপনাকে দেখালে ক্ষতি কি?
– না কোন ক্ষতি তো নেই।
আরো কিছুক্ষন থেকে আয়ান আর অবনীকা বাসায় আসার জন্য গাড়িতে উঠলো। আয়ান অবনীকা কে খুব ভালো ভাবে লক্ষ করছে। ওর মধ্যে তেমন একটা পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না। আয়ান অবনীকা কে সন্দেহ করছে। ও ভেবেছিলো এটা অবনী। তাই সন্দেহ দূর করতে এখানে নিয়ে আসলো। কিন্তু যদি অবনী হতো তাহলে নিজের মাকে দেখে এতটা স্বাভাবিক থাকতে পারতো না।
তাহলে রহস্য টা কি?
[