#ভ্রম_নাকি_তুমি!(৬ষ্ঠ পর্ব)
লেখাঃ Md. Nazmul Huda
ডক্টর এসে জানালো যে রিয়ান এর দুটো চোখই নষ্ট হয়ে গেছে। ও সারাজীবনের জন্য অন্ধ হয়ে গেছে। ডক্টর এর কথা শুনে আয়ান ভেঙে পড়লো।
– কেন এমন টা হচ্ছে? আমার আপন মানুষ দের কেন এত কষ্ট দেয়া হচ্ছে? কারো আমার সাথে শত্রুতা থাকলে সে আমাকে কষ্ট দিক। কিন্তু আমার পরিবারের সাথে এরকম কেন করছে?
– আপনি প্লিজ শান্ত হোন। এই মূহুর্তে আপনি যদি এভাবে ভেঙে পড়েন তাহলে কিভাবে চলবে বলুন? আপনাকে তো শক্ত হতে হবে? নাহলে বাকিদের কে সামলাবে?
– আমি আর পারছি না। সত্যিই পারছি না।
– প্লিজ শান্ত হোন। সব ঠিক হয়ে যাবে।
অবনীকা আয়ান কে শান্ত্বনা দেয়ার চেস্টা করছে। কিন্তু আয়ান মেয়েদের মতো হাউমাউ করে কাঁদছে। বেশ কয়েকদিন ধরে ওর পরিবারের ওপর দিয়ে যা যাচ্ছে তাতে নিজেকে ঠিক রাখতে পারছে না। রিয়ান এর কেবিনের বাইরে আয়ান বসে আছে। অবনীকা আয়ান কে জড়িয়ে ধরে রেখেছে। আয়ান সেভাবেই ঘুমিয়ে গেলো। অবনীকা ঘুমায় নি। আয়ান এর মাথাটা নিজের কাঁধের উপর রেখে আলতো করে স্পর্শ করছে। ওর চুলগুলো ছুঁয়ে দিতে অন্যরকম ভালো লাগা কাজ করছে। অবনীকা বসে বসে সারারাত সেই ভালো লাগার স্বাদ নিলো। কখন রাত শেষ হয়ে গেছে টেরই পায়নি। ওর কাছে মনে হলো মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত।
ভোর হয়ে গেছে। রিয়ান কে রেখে আয়ান আর অবনীকা বাসায় চলে গেল। বাসায় মা একা আছে। আয়ান এর মা এই ব্যাপারে কিছুই জানেনা। গত রাতে রিয়ান এর এমন অবস্থা দেখে অবনীকা আয়ান কে ফোন করে। আয়ান আসতে বেশ কিছুক্ষণ সময় লেগে যায়। অবনীকা কি করবে বুঝতে পারছিলো না। ওর মনে হয়েছিলো এখনই এসব শাশুড়ী কে জানানো ঠিক হবে না। সে এমনিতেই অসুস্থ তার ওপর মানসিক চাপে আছেন। এখন যদি তাকে এসব বলা হয় তাহলে না জানি কি কান্ড করে বসবেন। তাই আয়ান আসতে আসতে অবনীকা ওর শাশুড়ী কে জোর করে ওষুধ খাইয়ে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পারিয়ে দিল।
ভোরে অবনীকা আর আয়ান বাসায় চলে আসলো। খবর পেয়ে আয়ান এর বাবা ও দেশে চলে আসলেন। আয়ান কিছুক্ষণ বাসায় থেকে আবার রিয়ান এর কাছে গেল ওর মা কে নিয়ে। রিয়ান এর অবস্থা দেখে মিরা রহমান আরো ভয় পেয়ে গেলেন এবং উনার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে গেল। প্রচন্ড ভয়ে উনি অস্বাভাবিক আচরণ শুরু করে দিলেন। অবনীকা কে দেখলেই চিল্লাপাল্লা করে। এমনকি হাতে কিছু থাকলে ও সেটা ছুড়ে মারে। আয়ান কি করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারছে না। অবনীকা ওর শাশুড়ির চোখের সামনেও যেতে পারছে না। তাই তার দেখাশোনা পুরোপুরি আয়ান এর ওপর। একদিকে রিয়ান অন্যদিকে মা দুজনকে সামলাতে আয়ান হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। আয়ান এর বাবা নিজেই হার্টের পেশেন্ট। তবুও সে যতটা পারছে দুজনের খেয়াল রাখার চেস্টা করে যাচ্ছে আয়ান এর সাথে।
চারদিন পরে রিয়ান কে বাসায় আনা হলো। আগের থেকে কিছুটা সুস্থ্য। তবে দৃষ্টিশক্তি আর কখনোই ফিরে পাবে না। হস্পিটাল থেকে বাসা দুজনের দিকে খেয়াল রাখা আয়ান এর একার পক্ষে কঠিন হয়ে গেছে, তাই রিয়ান কে তাড়াতাড়ি বাসায় নিয়ে আসা হলো।
অবনীকাও দূর থেকে যতটা সম্ভব দুজনের খেয়াল রাখছে। রিয়ান এর ঘরে গেলে অবনীকা কোন কথা বলে না। কারণ ওর মায়ের মতো রিয়ান ও অবনীকা কে ভয় পায় আর চিৎকার চেচামেচি করে।
রাত এগারো টা বাজে। আয়ান সবাইকে খাইয়ে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে নিজের ঘরে এসে ল্যাপটপ নিয়ে বসেছে। অবনীকা নিজের কাজ শেষ করে আয়ান এর পাশে বসে আছে। আয়ান কাজ করছে আর অবনীকা আয়ান কে দেখছে। হঠাৎ কি মনে করে অবনীকা আয়ান এর গালে একটা চুমু খেলো। আয়ান কিছু না বুঝে অবনীকার দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো। আয়ান এর এমন চাহনী দেখে অবনীকা লজ্জায় মুখ ঢেকে অন্যদিকে ঘুরে শুয়ে পড়লো। আয়ান এখনও গালে হাত দিয়ে বসে আছে।
বেশ কিছুক্ষণ নিরবতায় কেটে গেল। আয়ান চুপ করে বসে আছে। অবনীকার হঠাৎ এরকম চুমু দেয়াতে একটা অন্য রকম অনুভূতি হচ্ছে ওর। কেমন যেন এক অজানা ভালো লাগা কাজ করছে। আয়ান ভাবছে, তবে কি অবনীকার প্রতি দুর্বল হয়ে যাচ্ছে? হতেও পারে! মানুষ তো। একসাথে থাকতে থাকতে মায়া বেড়ে যায়। হয়তো আয়ান এর ও তাই হয়েছে৷ তাছাড়া মানুষ যদি প্রতিকূলতা কাটিয়ে টিকে থাকতে না পারতো তবে অন্য প্রাণীর মতো কবেই বিলুপ্ত হয়ে যেত! মানুষের ভেতর এক অসম ক্ষমতা আছে যে কোন পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে আসার! যদিও কঠিন আর সময়সাপেক্ষ, তবুও অসম্ভব নয়। হয়তো আয়ান ও পারবে ওর প্রথম ভালোবাসার মায়া থেকে বের হয়ে একটা সুস্থ স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে।
আয়ান এসব ভাবছে হঠাৎ অবনীকা ওর বুকে এক প্রকার আছড়ে পড়ে ওকে খামচে ধরলো। ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেল আয়ান। অবনীকা কে দুহাতে জাপটে ধরলো।
– কি হয়েছে আপনার?
– আপনি কিছু শুনতে পাচ্ছেন না?
– কি?
– নূপুর এর শব্দ আপনি শুনতে পাচ্ছেন না?
– কই? খেয়াল করিনি।
অন্যমনস্ক থাকায় আয়ান কিছু শুনতে পায়নি। অবনীকার কথায় বাস্তবে ফিরে এলো। সত্যি সত্যি জোরে জোরে নূপুর এর শব্দ শোনা যাচ্ছে। কখনো বাথরুম আবার কখনো বারান্দা। আয়ান উঠে দেখতে যাবে কিন্তু অবনীকা কোনভাবেই যেতে দিচ্ছেনা। শার্ট খামছে ধরেছে। তবুও অবনীকা কে ছাড়িয়ে আয়ান উঠে বাথরুম এর দিকে পা বাড়াতেই রিয়ান এর ঘর থেকে রিয়ান এর চিৎকার শুনতে পেল। “আবার কি হলো?” বলেই আয়ান দৌড়ে গেল রিয়ান এর ঘরে। অবনীকা ও গেল পেছন পেছন।
– কি হয়েছে রিয়ান? তুই এভাবে চিৎকার করছিস কেন? কোন স্বপ্ন দেখেছিস নাকি?
– ভাইয়া বাথরুমে কে যেন আছে। জোরে জোরে হাসছে। আর বাথরুম থেকে কখনো জোরে জোরে পানি পড়ার আবার কখনো নূপুর পায়ে কেউ দৌঁড়াদৌঁড়ি করার আওয়াজ আসছে। আবার কখনো বারান্দা থেকে শব্দ আসছে। আমাকে বাঁচাও প্লিজ ভাইয়া। ও আমাকে মেরে ফেলবে।
– আরে কি বলছিস? এসব তোর মনের ভুল।
– না ভাইয়া কোন ভুল না। আমি সত্যি বলছি।
আয়ান অবনীকার মুখের দিকে তাকালো। মুখ দেখে মনে হচ্ছে খুব ভয় পাচ্ছে। মুখটা চুপসে গেছে। আচমকা বাথরুম থেকে পানি পড়ার আওয়াজ শুনতে পেল। অবনীকা কিছুটা লাফিয়ে উঠে আয়ান এর শার্ট খামচে ধরলো কিন্তু কোন শব্দ করলো না। আয়ান উঠে আস্তে আস্তে বাথরুম এর দিকে গেল। কিন্তু দরজার কাছে যেতেই শব্দটা বন্ধ হয়ে গেল। আয়ান এর ও কিছুটা ভয় ভয় লাগছে। তবুও এই মূহুর্তে সেটা কাউকে বুঝতে দেয়া চলবে না। তাই আস্তে আস্তে দরজা টা খুলল। আজব ব্যাপার এখানে তো কেউই নেই। আয়ান বাথরুমের চারদিকে চোখ বুলিয়ে নিলো। নাহ, কোথাও কেউ নেই। কিছুই না পেয়ে আয়ান চলে আসতে যাবে হঠাৎ ওর চোখ আটকে গেল বাথরুম এর দেয়াল এর দিকে। এটা কি? আয়ান ভেতরে গিয়ে ভালো করে দেখলো। ও তাহলে এই ব্যাপার? আয়ান কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে বাইরে আসলো। রিয়ান কে কোনভাবে বুঝিয়ে সুঝিয়ে নিজের ঘরে এসে শুয়ে পড়লো। অবনীকা কিছু জিজ্ঞেস করতে চেয়েও করলো না।
পরদিন সকালে আয়ান অফিসে গেল। বাসার পরিস্থিতি আগের থেকে একটু ভালো। তাই অনেকদিন পরে আজ অফিসে গেল। আয়ান যাওয়ার পরপরই অবনীকা বের হয়ে গেল বাসা থেকে। এ কদিন আয়ান বাসায় থাকায় অবনীকা একবারও বের হতে পারে নি। তাই তাড়াতাড়ি বের হয়ে গেল। ঘন্টা দুয়েক পরেই আবার বাসায় ফিরে এলো। কিন্তু আসার সময় মনে হচ্ছিলো কেউ যেন ওকে ফলো করছে। পেছনে কয়েকবার ঘুরে তাকালো কিন্তু কাউকেই দেখতে পেল না। কিছুটা চিন্তা হচ্ছিলো অবনীকার।
রাতে অফিস থেকে ফিরে রোজকার মতো মা আর ভাইকে ওষুধ খাইয়ে আয়ান নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো। অবনীকা ও শুয়ে পড়লো। অনেক সময় এপাশ ওপাশ করার পরে আয়ান ঘুমিয়ে পড়ে। হঠাৎ ওর মনে হলো কেউ যেন ওর গলায় ওড়না পেঁচিয়ে ধরেছে খুব শক্ত করে। আয়ান ছাড়ানোর চেস্টা করছে কিন্তু কোনভাবেই ছাড়াতে পারছে না। জোরে জোরে নিশ্বাস নিচ্ছে। চোখ খুলে তাকালো আয়ান। তখন দেখলো অবনীকা ওর বুকের ওপর ঝুঁকে চোখ বড়বড় করে তাকিয়ে আছে। অবনীকার হাত ওর গলায়। তার মানে অবনীকা ওকে মেরে ফেলতে চাচ্ছে? আয়ান নিজেকে ছাড়ানোর কোন শক্তি পাচ্ছে না। হঠাৎ অবনীকা বললো
[চলবে…..]
গল্প প্রেমিরা এই পেজে ফলো দিয়ে রাখবেন।