ভয়ংকর প্রণয় পর্ব ১৯+২০

#ভয়ংকর_প্রণয়
Part_19+20
লেখনীতে_#Nusrat_Hossain

দেখতে দেখতে ছাব্বিশ টা দিন পার হয়ে গেল । স্পর্শ আর নাফিয়ার ভালোবাসাময় দিনগুলো কাঁটছে একে অপরের সুখ দুঃখ ভাগাভাগি করে ।স্পর্শকে জীবনে পেয়ে নাফিয়ার অতীতগুলো আজকাল আগের মত আর নাফিয়াকে পীড়া দেয়না বলতে গেলে বেশি একটা মনে পরেনা ।আজকাল রঙ বেরঙের প্রজাপতিরা নাফিয়ার ভালোবাসার আকাশে উড়ে বেড়ায় ।আগের মত নাফিয়ার মনে আর কালোমেঘেরা হানা দেয়না বরং তার ঠোটে লেগে থাকে প্রানখোলা হাঁসি ।নাফিয়ার এমন পরিবর্তনে নাফিজ রহমান , অনিতা বেগম খুব খুশী অবশেষে মেয়েটাকে হাঁসিখুশি দেখতে পেয়ে ।তবে এই ক’টা দিনে স্পর্শ আর নাফিয়ার একদিনও দেখা হয়নি ।যদিও স্পর্শ অনেকবার দেখা করার অনুরোধ করেছিল নাফিয়াকে কিন্তু নাফিয়া সরাসরি নাকচ করেছে ।কারন ক’দিন আগেই তারা কক্সবাজার থেকে বাড়ি ফিরল তারপর আবার বাড়ি থেকে বারবার বের হলে নাফিজ রহমান আর অনিতা বেগম যদি কিছু মনে করে তাই এসব ভেবেই নাফিয়া স্পর্শের অনুরোধ নাকচ করেছে ।দেখা সাক্ষাত না হলেও নির্ঘুম রাত জেগে দুজনে হাজারো স্বপ্ন বুনেছে একে অপরকে নিয়ে মুঠোফোনের আলাপে।তবে আরদিন সুযোগের অপেক্ষায় ছিল ঘুরানোর নাম করে একদিন নাফিয়া আর রিয়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হবে তারপর নাফিয়া আর স্পর্শের সাথে সরাসরি আলাপ করবে সেই বিষয়ে।

আজ সকাল সকাল আরদিন নাফিয়া আর রিয়াকে নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়েছে ।

অবশেষে আজকে একমাস তিনদিন পর নাফিয়া আর স্পর্শের দেখা হল । রেস্টুরেন্টে দুজন একই টেবিলে মুখোমুখি হয়ে বসে আছে ।দুজোনের পাশের চেয়ার দুটোতে অবশ্য আরদিন আর রিয়া বসে আছে ।কেউ টুঁ শব্দটাও করছেনা যেন এখানে সবার মৌনতার প্রতিযোগিতা চলছে । সবাই একদম চুপ হয়ে বসে আছে ।স্পর্শ অবশ্য প্রথমে নাফিয়াকে দেখতে পেয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল এতদিন পর প্রেয়সীকে দেখতে পেয়ে । কিন্তু আরদিনের কথাগুলো শুনে স্পর্শের ঠোটে লেগে থাকা হাঁসিটাও এখন আর দেখা যাচ্ছেনা ।গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবছে সে ।আর নাফিয়া মাথা নিচু করে বসে আছে । তার চোখজোড়া দিয়ে অঝোর ধারায় জল গড়িয়ে পরছে ।যে ভয়ংকর অতীতগুলো সে মনে করতে চায়না সেই ভয়ংকর অতীতগুলোই তার ভবিষ্যত ধ্বংস করতে উঠে পরে লেগেছে । স্পর্শকে নিজের করে পাওয়ার ক্ষেত্রে তার কালো অতীতগুলো বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।আর স্পর্শের নিজের-ও তো একটা পরিবার আছে ।স্পর্শ ভদ্র ফ্যামিলির ছেলে ।কোনো ভদ্র ফ্যামিলি কোনোদিন চাইবেনা একটা খুনীর পরিবারের মেয়েকে ছেলের বৌ করতে ।আজ-ই হয়ত স্পর্শকে সারাজীবনের জন্য হারিয়ে ফেলবে সে , এমন হাজারো ভাবনা এই মুহূর্তে নাফিয়ার মাথায় ঘুরপাক করছে ।সে মনে মনে ধারনা করছে আরদিনের কাছ থেকে সব শুনে এখন স্পর্শ আর তাকে চাইবেনা ।হয়ত বলবে , তোমাকে আর চাইনা নাফিয়া আমায় ভুলে যাও তুমি ।এসব ভেবে নাফিয়া আড়চোখে তাকাল গম্ভীর হয়ে বসে থাকা স্পর্শের দিকে । সব বলার পর আরদিন বলেছে স্পর্শকে যেখোনো একটা সিদ্ধান্ত নিতে কিন্তু স্পর্শ সেই যে চুপ মেরে বসে আছে একটা টুঁ শব্দ করেনি এখন পর্যন্ত ।হয়ত খুনী পরিবারের মেয়েকে ভালোবেসে এখন মনে মনে খুব পস্তাচ্ছে ।কিন্তু সে-তো কক্সবাজার থাকতেই স্পর্শকে সব জানিয়ে দিয়েছিল তবে এখন কেন স্পর্শ এমন গুমোট ভাব ধরে বসে আছে ? বলে দিক নিজের সিদ্বান্তের কথা ।স্পর্শ যা সিদ্বান্ত নিবে নাফিয়া সেটাই মেনে নিবে ।যদি স্পর্শ এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি চায় সেটাও মেনে নিবে নাফিয়া কোনো দ্বিরুক্তি দেখাবেনা ।হয়ত কষ্ট হবে তার তারপর-ও স্পর্শের সিদ্বান্তকে মেনে নিবে।নাফিয়া এসব ভেবে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল ।

তবে তার সব ভাবনা সব ধারনা ভুল করে দিয়ে বেশ অনেকক্ষণ নিরবতা কাঁটিয়ে স্পর্শ হ্ঠাৎ চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সবার উদ্দেশ্য বলে উঠল,

আমরা বিয়ে করব এবং সেটা আজকেই।

নাফিয়া, আরদিন , রিয়া গোলগোল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে স্পর্শের দিকে ।

বিস্ময়ে আরদিনের চোখজোড়া ছোটছোট হয়ে গেল ।সে ভাবতে পারেনি সব শোনার পরও স্পর্শ সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে বসবে ।ভেবেছিল সব শোনার পর স্পর্শ নিজেই এই সম্পর্ক থেকে মুক্তি নিবে ।কিন্তু তার ধারনা ভুল হয়ে গেল সম্পূর্ন ।
স্পর্শের সিদ্বান্তে আরদিনের মনক্ষুণ্ণ হল ।সে ভয় পাচ্ছে প্রানের বন্ধুকে না শেষ পর্যন্ত হারাতে হয় আবার !

আরদিন নিজের বিস্ময় মুহূর্ত কাঁটিয়ে স্পর্শের উদ্দেশ্য বলল,

তুই ভেবেচিন্তে বলছিস তো ?

স্পর্শ নাফিয়ার পাশে বসে নাফিয়ার হাতটা ধরে বলল ,

এত ভাবাভাবির কিছু নেই ।আমরা বিয়ে করব আর সেটা আজকেই ।

আরদিন হতাশ গলায় বলল , স্পর্শ… নি:সন্দেহে নাফিয়া তোর জন্য পার্ফেক্ট একজন মেয়ে।নাফিয়া খুব ভালো মেয়ে এই বিষয় আমার কোনো সন্দেহ নেই।তবে আমি ভয় পাচ্ছি আজম খাঁনকে নিয়ে ।ঐ লোকটার কানে যদি বিয়ের কথা যায় তাহলে কি হবে তোদের ? আজকে নাহয় বিয়ের কথা জানবেনা কিন্তু একদিন না একদিন তো জানবেই ঐ লোক তখন কি হবে ? আমি ভাবতে পারছিনা সবকিছু জেনেও কেন তুই এইরকম একটা সিদ্বান্ত নিলি ? আর তোর বাবা মায়ের কথা ভাব ওরা কি কোনোদিন মানবে তোর বিয়ে একটা খুনীর পরিবারের মেয়ের সাথে ? এবার আরদিন ইচ্ছেকরেই কড়াভাবেই কথাটা বলল যাতে স্পর্শ নিজের সিদ্বান্ত পাল্টায় ।
আরদিনের শেষ কথাটা শুনে নাফিয়া নির্বাক দৃষ্টিতে তাকাল আরদিনের দিকে ।স্পর্শ ক্রুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আরদিনের দিকে ।

রিয়া আরদিনের কানে ফিঁসফিঁস করে বলল

কি বলছিস ভাই এসব ? তোর মাথা ঠিক আছে ?

আরদিন রিয়ার কথার কোনো প্রত্যুত্তর করলনা ।সে স্পর্শের ক্রুব্ধ চেহারার দিকে তাকাল ।

স্পর্শ ভারী গলায় বলল , ভবিষ্যতের কথা ভেবে বর্তমান সময়টাকে নষ্ট করতে চাইনা আমি আর আমার মা বাবাকে নাফিয়ার পরিবারের কথা কিছুই জানাবনা ।যে পরিবার থাকতেও নেই ঐ পরিবারের কথা জানালেও বা কি আর না জানালেও বা কি !আর বাকি রইল নাফিয়াকে মা বাবা মানবে কিনা ? ওরা যদি আমায় বিন্দুমাত্র ভালোবেসে থাকে তাহলে ছেলের পছন্দ করা মেয়েকে বাড়ির বৌ মানতে বাধ্য তারা ।আর আমার বিশ্বাস আমার মা বাবা আমার পছন্দ করা মেয়েটিকে ছোট করে দেখবেনা ।এখন তুই বল আমাদের পাশে থাকবি কিনা ? আর তুই না থাকলেও সমস্যা নেই আমরা আমরাই বিয়ে করব ।কারো সাহায্যর প্রয়োজন নেই আমার ।স্পর্শের শেষের কথাটায় তাচ্ছিল্য ছিল ।

আরদিন বন্ধুর শেষের কথাটায় খুব-ই মর্মাহত হল ।সে চেয়ার ছেড়ে দ্রুতগতিতে গিয়ে স্পর্শকে জড়িয়ে ধরে ধরা গলায় বলল,

কি বলছিস ভাই এসব ? আমায় এতোটা পর করে দিসনা ! তুই যখন সিদ্বান্ত নিয়েছিস আজকেই নাফিয়াকে বিয়ে করবি তাহলে আজকেই হবে বিয়ে ।আর আমি তোদের পাশে আছি আর ভবিষ্যতেও থাকব ।আমরা সবাই থাকব তোদের পাশে ।

স্পর্শ একহাতে জড়িয়ে ধরল বন্ধুকে ।আরদিন স্পর্শের থেকে সরে এসে চোখজোড়া মুছে বলল ,

তবে বিয়েটা হবে কই ?

স্পর্শ ঠোট কামড়ে বলল , আমাদের বাড়িতে হবে ।তোর ফ্যামিলি , আমার ফ্যামিলি আর আমাদের বন্ধু বান্ধবরা সবাই থাকবে বিয়েতে ।

রিয়া উত্তেজিত গলায় বলল , তাহলে আর দেরি করছি কেন ? সবাই কাজে লেগে পরি !

রিয়ার সাথে সাথে আরদিনও তাল মিলিয়ে বলল ,

হ্যাঁ হ্যাঁ অনেক কাজ আছে ।বাড়ি গিয়ে সবাইকে জানাতে হবে আর মানাতেও হবে বাবা মাকে । আমার বাবা মা হ্ঠাৎ করে নাফিয়ার বিয়ের কথা শুনে কেমন রিয়েক্ট করবে আল্লাহ জানে !!

স্পর্শ আরদিনকে বলল , আঙ্কেল আন্টিকে রাজি করানোর দায়িত্ব তোর ।

আরদিন কিছু বলার আগেই রিয়া বলল ,
আপনি চিন্তা করবেন না বাবা আর মাকে আমি রাজি করিয়েই ছাড়ব ।স্পর্শ রিয়ার কথায় হাঁসল ।

এসব কথার ভীরে নাফিয়া যেন স্তব্ধ হয়ে বসে আছে ।আজকে তার বিয়ে তাও আবার স্পর্শের সাথে ।তার কি এখন খুশিতে কান্না করা উচিত ?কিছু সময় আগেও সে ভেবে নিয়েছিল আজকেই হয়ত স্পর্শ তাকে বলবে , আমায় ভুলে যাও নাফিয়া এই সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে সম্ভব না ।কিন্তু তার ধারনা ভুল প্রমান করে দিল স্পর্শ উল্টো সরাসরি বিয়ের প্রপোজাল দিয়ে বসল ।স্পর্শের সাথে বিয়ের কথাটা ভাবতেই নাফিয়ার চোখজোড়া দিয়ে আনন্দের শ্রাবন ধারা বইতে লাগল ।

স্পর্শ নাফিয়ার হাতটা শক্ত করে ধরতেই নাফিয়া ভাবনা থেকে বেরিয়ে এল ।স্পর্শ নাফিয়ার হাতজোড়া শক্ত করে ধরে শান্তগলায় বলল ,

কথা দিচ্ছি নাফিয়া কোনোদিন-ও তোমার হাত ছাড়বনা ।আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তোমার পাশে থাকব ।তুমি কি আমার পাশে থাকতে চাও নাফিয়া ?

নাফিয়া স্পর্শের হাতের মুঠোয় থাকা তার হাতজোড়ার দিকে তাকাল ।তারপর মাথাটা হালকা দুলিয়ে ধরা গলায় বলল,

থাকতে চাই ।আমি থাকব স্পর্শ আপনার পাশে ।এর থেকে বেশি কিছু বলতে পারলনা নাফিয়া । বুক ফেঁটে কান্না এসে যাচ্ছে তার ।মানুষ খুশিতে আনন্দ পায় হাঁসে আর সে কেমন সবার সামনে ঠোট ফুলিয়ে কাঁদছে ভাবতেই নাফিয়া আশপাশ একবার আড়চোখে তাকিয়ে লজ্জা পেল খুব ।

“থাকতে চাই ।আমি থাকব স্পর্শ আপনার পাশে ” এই একটা কথাতেই নাফিয়ার বিয়ের সম্মতি
আছে কিনা তা বুঝে নিল স্পর্শ ।স্পর্শের ঠোটে মনোমুগ্ধকর হাঁসির রেখা ।অবশেষে আজ তার প্রেয়সীকে নিজের করে পেয়ে যাবে ।ভাবতেই তার শিরদাঁড়া দিয়ে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল ।

নাফিয়া সিদ্বান্ত নিল রেস্টুরেন্ট থেকে বাড়ি ফিরে আতিফাকে একটা কল করবে ।যদিও নাফিয়া রিয়াদের বাড়ি আসার পর থকে কোনোদিন নিজে থেকে আতিফাকে ফোন দেয়নি ।কারন আতিফা নিজেই নিষেধ করেছিল নাফিয়া যেন তার কাছে কোনোদিন ফোন না দেয় সুযোগ সুবিধা বুঝে আতিফা নিজেই ফোন করবে বলেছিল । মাঝেমধ্যে আতিফা সুযোগ পেলে নাফিয়াকে ফোন করে নাফিয়ার খোঁজ খবর নিত-ও তবে বেশ কয়েকদিন হল আতিফা ফোন দেয়না হয়ত সময় সুযোগ হয়না।তবে নাফিয়া আজকে নিজে থেকে আতিফাকে ফোন দিবে আর আছিয়া , রাইসা , আতিফার কাছ থেকে দোআ নিবে শতহোক আজকে তার বিয়ে ।প্রিয় মানুষগুলো বিয়েতে পাশে না থাকুক অন্তত দোআ তো করতে পারবে স্পর্শ আর নাফিয়ার জন্য জন্য দূর থেকে ।

রেস্টুরেন্ট থেকে বেরিয়ে যে যার বাড়িতে চলে গেল ।বিয়ের যোগাড়যন্ত্র করতে হবে আবার সবাইকে জানাতে হবে মানাতে হবে।বেশি তো সময় নেই হাতে আর মাত্র কয়েক ঘন্টা আছে বিয়ের ।এর মধ্যে সব কাজ সেড়ে ফেলতে হবে ।

চলবে,
@Nusrat Hossain

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here