মন পাড়ায় পর্ব ১৩

#মন_পাড়ায়
#পর্ব_১৩
#নিলুফার_ইয়াসমিন_ঊষা

অর্ক প্রভার খোঁপার কাঁটা খুলে দিলো আবারও। পুকুর পারের মিষ্টি ঘ্রাণের হাওয়া এলো তীব্র বেগে। মুহূর্তে প্রভার চুলগুলো এলোমেলো করে দিলো। সে সময় যখন সূর্যোস্তের কমলা আভা তার উপর এসে পড়ছিল তখন যেন অর্কের মনে হচ্ছিলো অসময় তার জীবনে বসন্ত এসে পড়েছে, আবারও।

প্রভা মাথা নিচু করে নিলো। আবারও পুকুরের দিকে তাকালো। প্রশ্ন করলো না কীভাবে জেনে যায় অর্ক তার কান্নার কথা। প্রশ্ন করাটা কেন যেন উচিত মনে হলো না তার। জীবনে সবকিছুর উওর পেতে নেই, সব উওর পেয়ে গেলে কিছু জানার আগ্রহটা যে শেষ হয়ে যায়।

অর্ক জিজ্ঞেস করল, “তোমার আত্নীয়রা তো ভালোই আপ্পায়ন করল। অনেক ভালো তারা। তাহলে হঠাৎ করে মন খারাপ হলো কেন?”

“মানুষ ভালো হয় বলে তাদের সব কথা ভালো হবে তাও এতটা প্রয়োজনীয় নয়।”

“বুঝলাম না ঠিক।”

প্রভা হাত আড়াআড়ি ভাঁজ করে মৃদু হেসে বলল, “বুঝতেও পারবেন না। কষ্টগুলো নিজে অনুভব ছাড়া কেউ-ই বুঝে না। আপনি অনেক ভাগ্যবান জানেন? এই সমাজে নারী হয়ে জন্ম নেওয়াটা অভিশাপের মতো।”

“কেউ কী কিছু বলেছে?”

প্রভা অর্কের দিকে তাকালো। বলল, “আমি কিছু বললে তো আপনি ভাববেন মিথ্যা বলছি, বলে লাভ কী?”

“সবসময় এই একই কথা বলার প্রয়োজন আছে?”

“আছে। যখন কেউ আমার কষ্টগুলো নিয়ে মজা নেয় তখন আরও বেশি ব্যাথা লাগে।”

“আমি তোমার কষ্টগুলোর মজা নিয়েছি?”

“হ্যাঁ, নিয়েছেন। এছাড়া আমি তো আপনার কেউ না, তাহলে আমার কার কোন কথায় কষ্ট পেয়েছে তা জেনে আপনার সময় নষ্ট করার প্রয়োজন নেই।”
কথাটা যেন অর্কের বুকে যেয়ে বাজলো। বলল, “তুমি আমার স্ত্রী।”

প্রভা মুহূর্তে খানিকের জন্য বিস্ময়ে চেয়ে রইলো অর্কের দিকে। কিছু বলতে পারলো না কেন জানি। যেন অর্ক কখনো এই কথাটা বলবে সে ভাবতেও পারি নি। সে ছোট এক নিশ্বাস ফেলে বলল, “আপনিই তো বলেছিলেন যে এই বিয়েটা শুধুই আমাকে কষ্ট দেওয়ার জন্য করেছেন। তাহলে আমার কষ্ট জেনে আপনার কী লাভ। শুধু একটু প্রশান্তি পেতে পারেন এইতো।”

“তাহলে সে প্রশান্তিটুকু দেও।”

প্রভা নম্র দৃষ্টিতে তাকালো অর্কের দিকে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “ছোট থেকে শুনে এসেছি আমার রঙ কালো বলে কেউ বিয়ে করবে না। তাই মা প্রথম সমন্ধ পেয়েই আমাকে বিয়ে দিয়ে দিলো। তখন আমার বয়স আঠারো বছর ছিলো আর বুকে ছিলো একরাশ স্বপ্ন। ইচ্ছে ছিল আমি শিক্ষিকা হব। মা বলল, ‘শিক্ষিকা হতে ইচ্ছে হলে হবি। বিয়ের পর কী কেউ পড়াশোনা করে না?’ মা’য়ের কথা মেনে নিলাম। একরাশ স্বপ্ন বুকে গেঁথে কারও ঘরের বউ হয়ে গেলাম, কারও স্ত্রী তো কারও ভাবির উপাধি পেলাম। সেখানে যেয়ে জানতে পারলাম বিয়ের পর পড়ার প্রয়োজন পরে না। স্বামী চাকরি করছে, টাকা আনছে, তার চাকরির দরকার কী? মেয়েদের ঘর সামলানো উচিত। মা আবারও বলল, ‘বিয়ের পর শশুড়বাড়িই মেয়েদের পরিবার। এইখানে আমি কিছু বলতে পারি না মা। তাদের কথা মতো চল। সংসারে আগুন লাগায় না গো মা।’ আবারও মানলাম মায়ের কথা। আমার প্রকৃতি দেখা ভীষণ পছন্দের৷ এই জমজমাট শহরে একটু ঝরে যাওয়া পাতা দেখেও আনন্দ পেতাম। একদিন স্বামী বলে, ‘বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছ কেন? অন্য পুরুষ দেখতে ভালো লাগে?’ এরপর আর যাই নি বারান্দায়। স্বপ্নবিলাসী মেয়েটা সংসারী হয়ে গেল। বুকে একরাশ স্বপ্নগুলো মিশে গেল ধুলোয়। এরপর প্রশ্ন এলো বাচ্চা নেই না কেন? বাঁজা না’কি? তখনও বিয়ের এক বছর। সবার খুশির জন্য বাচ্চাটাও নিলাম। মেয়ে বলে সবাই খুশি হয় নি বটে তবে আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুখের দিনটা অনুভব করেছিলাম যখন আমার মেয়েটাকে প্রথম নিজের কোলে নিয়েছিলাম। বাচ্চাটা হওয়ার পর থেকে দ্বিগুণ পরিশ্রম শুরু হয়। একদিকে বাচ্চা সামলানো আবার অন্যদিকে পুরো ঘরের কাজ, এতগুলো লোককে দেখা। শাশুড়ী বলেছিলেন, ‘আমরা কী এইসব করে আসি নি? এইসব তো স্বাভাবিক।’ আমিও স্বাভাবিক মেনে চললাম। ঘরে প্রতিদিন অশান্তি হতো কোনো না কোনো কথায়। কিছু বলতাম না শুধু রাতে যখন স্বামী বুকে ভরে নিতো নৈশব্দ কাঁদতাম। সেই দিনগুলোও চলে গেল। তখন ও আর আমায় ভালোবেসে বুকে আঁকড়ে নিতো না। আমার না তখন খুব কষ্ট হতো। কিছুই তো ছিলো না আমার। না ভালো লাগতো সংসারের অশান্তি আর না স্বামীর অবহেলা। ইচ্ছে করতো সব ফেলে চলে যাই কোথাও। এই আশায় যদি খুঁজে পাই কোনো শান্তির নগর। আমার দ্বিতীয় বাচ্চা হলো। ওদের নিয়েই আমার জীবন চলতে শুরু করল। তখনও কিছুই বদলায় নি, শুধু বদলে গেছিলাম আমি। যেদিন প্রথম শুনলাম, ও মধ্যরাতে মুঠোফোনে অন্যকারো সাথে প্রেমালাপ করছে। মনে হয়েছিলো আমার জীবনটা সেখানেই শেষ। ও বিয়ের পর মাঝেমধ্যে মারত যৌতুক যে লাগতো তার মায়ের। কিন্তু তখনও এত ব্যাথা লাগে নি। মনে হয় নি হৃদয়টায় কেউ জ্বলন্ত লোহার শিখা লাগিয়ে দিয়েছে। তবে সেদিন তা মনে হলো।
ওর প্রতি আমার ভালোবাসাটা ছিলো গভীর। কিন্তু সে ভালোবাসার কাছে পরাজিত হই নি আমি, হয়েছি মমতার অধীনে। সেদিন ভাবলাম যদি আমি আজ এই সংসার ছেড়ে চলে যাই তাহলে এই বাচ্চা দুটোর ভবিষ্যত কী? আমি তো যথেষ্ট শিক্ষিত নই যে ওদের সুন্দর এক জীবন দিতে পারব। এখন ভাইয়ের কামাইয়ে চলে বাবার সংসার। বউ এলে কী আর ভালোবাসা দিবে তাদের?
বড্ড দ্বিধায় ছিলাম। সেই দ্বিধাটুকু কাবু করে নিলো।মা’য়ের মমতা।
ওর ভালোবাসা পেলাম না মানলাম। ওর স্ত্রীর সম্মানটাও যে বিক্রি করে দিয়েছিল ও। এক রাতে ওর বন্ধুর অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। রাতের আঁধারে কেউ একজন এসে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরেছিল। ওর বন্ধু ছিলো। ভীষণ কষ্টে যখন নিজেকে বাঁচিয়ে ওর কাছে গেলাম সুরক্ষার আশায় কিন্তু ও কিছুই বলল না তাকে। যেন আমার নিজে কোনো খেলনা ওর কাছে। যাকে চাইবে দিয়ে দিবে। আমার প্রচন্ড কষ্ট হচ্ছিল। জিজ্ঞেস করেছিলাম ‘তোমার স্ত্রী তো আমি একবারও বুক কাঁপে নি তোমার?’ ও শুধু বলেছিল, ‘আমার বিশ্বাস নেই তোমার কথায়। আমার বন্ধু এমন করবে? অসম্ভব। ওর বউ এত সুন্দরী আর ও তোমার পিছনে পাগল হবে? এইসব বাজে করা কথা বন্ধ কর।’ আমি শুধু অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলাম সেদিন। সেদিন, সে মুহূর্তেই আমি ওকে ওর প্রতি সকল সম্মান আমি হারিয়ে ফেলেছিলাম। আমি শুধু সেই ঘরে ছিলাম আমার দুটো সন্তানের জন্য। কিন্তু যে মুহূর্তে আমি নিজের চোখ আমার স্বামীকে অন্যকোনো মেয়ের সাথে এমন অবস্থায় দেখলাম যা দেখে একটি মাও হেরে গেল। তখন আমি এটাও চিন্তা করি নি লোকে কী বলবে বা এই বাচ্চাদের কীভাবে মানুষ করব। আমি যা পারব তা দিয়ে আমার সন্তানগুলো মানুষ করব কিন্তু একজন নারী হিসেবে নিজের সম্মান নিয়ে আর খেলতে পারব না। ও আমাকে এক সাপ্তাহ পরই ফোন করল। মা’কে ও বাবাকেও করল। মা তখনও বলেছিল, ‘ও তো ক্ষমা চাচ্ছেই মাফ করে দেয়। একটা ভুল তো মাফ করাই যায়।’ এইখানে শুধু একটা ভুল তো ছিলো না। আমি আমার সারাটা জীবন শুধু ভুলেই কাটিয়ে দিলাম। আশেপাশের লোকেরা বলতো ‘বাবার বাড়িতে আর কয়দিন থাকবে?’ শশুড়বাড়ির লোকেরা ফোন দিয়ে বলতো, ‘দেখিতো বাবার বাড়িতে আর ক’দিন রাখে অবশেষে তো স্বামীর বাড়িতেই অাসতে হবে। এ ছাড়া ঠিকানা কই?’ আমি ভাবতাম, বাবার বাড়ি আর স্বামীর বাড়ি আমার নিজস্ব বাড়িটা কোথায়? নিজস্ব অস্তিত্বটা কোথায়?
সে প্রথমবার আমি অন্যকারো না নিজের মনের কথা শুনেছিলাম। বাবাকে বলেছিলাম আমি তালাক চাই। আমি তখন অবাক হই যখন আমি আমার জীবনে প্রথমবার বাবার কাছে কিছু চাইলাম আর বাবা দিয়েও দিলো। ও এক মধ্যরাতে ফোন করে খুব কেঁদেছিল। কিন্তু ওর প্রতিটি কান্নার শব্দ আমার কানে পৌঁছাত না, চোখে শুধু যে ভাসতো অন্যকোনো মেয়ে ওর বাহুডোরে আটকে আছে। আমি ফোন রেখে দিলাম। অবাক কান্ড হলো। ফোনটা রাখতে আমার চোখের জলগুলো অবাধ্য হয়ে গেল। এত কষ্ট দেওয়া মানুষটার জন্যও মন কাঁদে? সে রাত নির্ঘুম কাটল। হৃদয়ের ভিতরে এক অজানা তুফান উঠেছিলো।”
অনেকক্ষণ কথা বলতে বলতে ক্লান্ত বয়ে একটু থামলো প্রভা। প্রভার চোখে জল এসে পরেছিল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আবারও বলল, “কয়দিন পর আমার চোখের সামনে এক মৃত্যু ঘটে। পরক্ষণেই খবর পাই ওর মৃত্যুর। আমি কখনো ভাবি নি আমি ওর বিশ্বাসঘাতকতার থেকে বেশি কিছুতে কষ্ট পাব। কিন্তু আমি ভুল ছিলাম। যে মুহূর্তে ওর মৃত্যুর খবর আমি পাই সেদিন আমি কাঁদি নি কিন্তু আমার ভিতরটা হাহাকার করছিলো।” প্রভা তাচ্ছিল্য হাসলো, “কিন্তু সবাই চোখে জল দেখতে পায় বুকের হাহাকার নয়।”

অর্কের বুকটা একবার মুচড়ে উঠলো প্রভার চোখে জল দেখে। সে একটু এগোল প্রভার গালে বয়ে যাওয়া অশ্রুজল মুছে দেওয়ার জন্য। তখনই প্রভা বলল, “সে মানুষগুলোর মাঝে আপনিও ছিলেন।” তখনই অর্ক থেমে গেল। নড়তে পারল না। সে শীতল মাতোয়ারা হাওয়া যেন তার হৃদয়ের শিখা নিভাতে পারল না।

প্রভা বলল, “বিধবা হওয়ার পর সবাই বলল, মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দেওয়া উচিত, নাহলে পরে বয়স হলে দুই বাচ্চার মা’কে কে বিয়ে করবে। যখন আপনি বাধ্য করায় বিয়ে করলাম তখন সবাই বলল, স্বামী মারা যাওয়ার দুইবছরও হয় নি অথচ বিয়ের জন্য অস্থির হয়ে পড়েছে, কী নিলজ্জ মেয়ে! কিন্তু কেউ বুঝে নি আমি বাধ্য ছিলাম। আজ আমার সেই আত্নীয়রা সব বিনয়ের সম্পর্কে সব সত্যি জানা সত্ত্বেও কী বলল জানেন? বলল যে, হয়তো দোষ বিনয়ের মধ্যে না আমার মধ্যে ছিলো। আমার সাথে আপনার সঙ্গে বিয়ের আগের থেকে—–” কথাটা বলতে গিয়েও শেষ করতে পারলো না প্রভা। কান্নায় ভেঙে পড়লো। দুই হাত মুখে চেপে ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। ভেজা কন্ঠে আবার বলল, “তারা এটাও বলেছে আপনার আর আমার অবৈধ সম্পর্কের কারণে বিনয় ও নূহা মারা গেছে। আরও অনেক বা—বাজে কথা। যা আমি মুখে বলতে পারব না।”

অর্ক হঠাৎ তার হাত মুঠোবন্দী করে নিলো। রাগে তার চোয়াল শক্ত হয়ে গেল। সে প্রভার হাত ধরে বলল, “চলো।”

“কোথায়?” প্রভা ভেজা কন্ঠে জিজ্ঞেস করল। অর্ক বলল, “তোমার আত্নীয়দের বাসায়। তাদের সাহস দেখব আমার সামনে এইসব বলে দেখাক। তাদের সাহস কত বড় আমার বউকে এইসব বলেছে, তার সম্মান নিয়ে কথা তুলেছে।”

প্রভা নির্বিকারে জিজ্ঞেস করল, “আপনিও তো তুলেছিলেন। আপনি পারলে তারা পারবে না কেন?”

চলবে……

[

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here