#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৪
নিঝুম অয়নের থেকে দৃষ্টি সরিয়ে এদিক ওদিক তাকিয়ে নিজেকে সামলে নিলো।
শুকনো ঢোক গিলে কাঁপা গলায় বললো, আপনি এখানে ?
অয়নের ঘোর কাটলো নিঝুমের কথায় তবে মুখ দিয়ে কেনো শব্দ বের করার শক্তি পাচ্ছে না।
ভেতর থেকে তয়ন পাশে এসে দাঁড়িয়ে বললো, আগে ভেতরে এসো ভাবি, তারপর সব কথা জানা যাবে।
তয়নকে দেখে নিঝুম অবাক হয়ে বললো, তয়ন ভাইয়া আপনি দেশে আসলেন কবে ?
তয়ন একটু ভেবে অয়নের দিকে তাকিয়ে বললো, আচ্ছা ভাইয়া আমি কবে এলাম বল তো ?
অয়ন বিরক্ত হয়ে তাকালো তয়নের দিকে। নিঝুম দু’জনকে পাশ কাটিয়ে ভেতরে ঢুকে গেলো।
সাথীকে উদ্দেশ্য করে বললো, সাথী এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দে তো বোন।
সাথী তাড়াতাড়ি পানির গ্লাস নিঝুমের দিকে এগিয়ে দিতেই ঢকঢক করে গ্লাস ফাঁকা করে দিলো।
সাথী আরেক গ্লাস দে।
গ্লাসটা কে দিলো না দেখেই খেয়ে নিলো নিঝুম। খালি গ্লাসটা ফেরত দিতে গিয়ে খেয়াল করলো এটা সাথী নয়। উপরে তাকালে অয়ন মুচকি হাসলো নিঝুমের দিকে তাকিয়ে।
আরো খাবে ?
নিঝুম উঠে দাঁড়ালো আর শক্ত গলায় বললো, মা তোমার বান্ধবীর ছেলেটা এসেছে। ভালো করে আদর আপ্যায়ন করে করে বিদায় করো।
নিঝুম নিজের রুমের দিকে পা বাড়ালে অয়ন বলে উঠলো, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে নিঝুম।
নিঝুম বললো, আপনার সাথে আমি সব কথা শেষ করে তবেই এসেছি। এখন আপনার সাথে আমার না কোনো কথা আছে আর না আছে কোনো সম্পর্ক। সম্পর্কের একটা সুতো ছেঁড়া বাকি আছে সেটাও খুব তাড়াতাড়ি ছিন্ন হতে চলেছে।
অয়ন অসহায় গলায় বললো, তুমি আগে আমার কথাটা একবার শুনে নাও।
নিঝুম আর কিছু না বলে নিজের রুমে চলে গেলো। দরজা আঁটকে দিবে তার আগেই একটা বলিষ্ঠ হাত তাকে বাঁধা দিলো। তাকিয়ে দেখলো অয়ন শক্ত করে ধরে রেখে দরজাটা।
নিঝুম কঠিন গলায় বললো, দরজা ছাড়ুন মিস্টার ইমরান আহমেদ অয়ন। এটা আপনার বাড়ি নয়, যে এখানে আপনি অভদ্রতা করবেন।
অয়ন নিঝুমকে সরিয়ে ভেতরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিয়ে বললো, বাড়িটা আমার না হলেও বউটা আমার।
নিঝুম নাকমুখ কুঁচকে বললো, লজ্জা করছে না বাড়িতে নতুন বউ রেখে এসে, এখানে এমন বেহায়াপনা করতে। কেনো এসেছেন এখানে ? আমি তো বলেই এসেছি ডিভো,,,,
নিঝুম কথা শেষ করতে পারলো না তার আগেই অয়ন নিঝুমের মুখ চেপে ধরে বললো, হুঁশ কোনো ডিভোর্স হবে না। আমার বউ নিঝুম ছিলো আর নিঝুমই থাকবে।
নিঝুম একটা ঝটকায় অয়নকে নিজের থেকে দূরে সরিয়ে বললো, একদম স্পর্শ করবেন না আমাকে। আমাকে স্পর্শ করার অধিকার আপনার নেই।
অয়ন নিঝুমকে একটানে নিজের সাথে মিশিয়ে জড়িয়ে ধরে বললো, তোমাকে স্পর্শ করার একমাত্র অধিকার আছে আমার। এতদিন নিজের অধিকার খাটাইনি এবার থেকে খাটাবো।
নিঝুম নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, কেনো নয়না ধোঁকা দিয়ে চলে গেছে ?
নাহ, আমিই নিজের ভুল বুঝতে পেরে তাকে ছেড়ে এসেছি।
নিঝুম অবাক হয়ে বললো, মানে ?
অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে নিঝুমকে ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে বিয়ের দিন থেকে পুরো ঘটনা খুলে বললো নিঝুমকে।
সরি নিঝুম।
সব শুনে নিঝুম নিঃশব্দে হাসলো।
অয়নকে ধাক্কা দিয়ে নিজের থেকে সরিয়ে বললো, আজ নয়নাকে মনে হচ্ছে আবেগ আর আমাকে ভালোবাসা। দু’দিন পর অন্যকাউকে ভালোবাসা আর আমাকে আবেগ মনে হবে না, তার কী নিশ্চয়তা ? আর আমার সম্পর্কে সত্যিটা জানলে আবেগ ভালোবাসা যাই আছে সব ধোঁয়ার মতো বাতাসে মিলিয়ে যাবে।
অয়ন মলিন হেসে বললো, আমার চাই না কোনো সন্তান। সারাজীবন তুমি পাশে থাকলেই হবে।
নিঝুম চমকে তাকালো অয়নের দিকে আর অবাক গলায় বললো, আপনি কী করে জানলেন ?
মা আমার পাগলামি দেখে সব বলে দিয়েছে। ভেবেছিলো সব জানলে হয়তো তোমাকে ভুলে যাবো।
নিঝুম পেছনে ঘুরে কঠিন গলায় বললো, পেছনে ফেলে আসা জীবনে আমি আর ফিরে যেতে চাই না। আপনি চলে যান এখান থেকে। যখন মনেপ্রাণে আপনাকে চেয়েছিলাম বারবার আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছেন। আপনাকে মুক্ত করে দিয়ে চলে এসেছি এখন আবার ফিরে যেতে বলছেন। আজ নয়নাকে আবেগ মনে হয়েছে আগামীকাল আমাকেও হয়তো,,,
অয়নও কঠিন গলায় বললো, তোমাকে না নিয়ে আমি কোথাও যাচ্ছি না। আর রইলো আমার ভালোবাসার কথা। আমি প্রমাণ করে দিবো আমি ভালোবাসি তোমাকে, তুমি আমার আবেগ বা মোহ না।
আমি কোনোদিন যাবো না আপনার সাথে।
সেটা তো সময়ই বলে দিবে।
অয়ন দরজা খোলে বের হয়ে গেলো নিঝুমের রুম থেকে। তয়ন তিথিকে কোলে নিয়ে বসে ছিলো সোফায়। মেয়েটা খুব মিষ্টি আর শান্ত। তয়নের কোলে একদম চুপ করে বসে আছে। তয়ন তাকে নানা কথা বলছে আর গাল টানছে।
অয়ন তয়নের কাছে গিয়ে তিথির মাথা হাত বুলিয়ে বললো, গাল টানছিল কেনো ? ব্যাথা পায় না নাকি ?
সেলিনা অয়নকে দেখে ব্যস্ত গলায় বললো, নিঝুম কী বললো ?
অয়ন সেলিনার দিকে তাকিয়ে বললো, রাগ করে আছে। আমি ঠিক রাগ ভাঙিয়ে ছাড়বো, আপনি চিন্তা করবেন না মা।
সেলিনা চমকে উঠলো অয়নের মুখে মা ডাক শুনে। নিঝুম তাদের একমাত্র মেয়ে। মেয়ে জামাইয়ের মুখে মা ডাক শোনার স্বপ্ন সেলিনারও ছিলো কিন্তু অয়ন সবসময় আন্টি আর আঙ্কেল বলেই ডাকতো তাদের।
অয়ন মাথা নিচু করে বললো, মা আমরা বরং আজ আসি।
সেলিনা অবাক হয়ে বললো, এখনই ঢাকা ফিরে যাবে ?
অয়ন মুচকি হেসে বললো, নিঝুমকে না নিয়ে এই সিলেট থেকে এক পা নড়ছি না আমি।
তাহলে কোথায় যাবে ?
মনে হচ্ছে না এতো তাড়াতাড়ি আপনার মেয়ের মন গলবে। তাই থাকার জন্য একটা থাকার ব্যবস্থা করতে হবে আর কী।
আমাদের এতোবড় বাড়ি থাকতে তোমরা বাইরে থাকবে কেনো ? তোমরা এখানেই থাকবে।
অয়ন চিন্তিত গলায় বললো, কিন্তু নিঝুম আর আঙ্কেলও নিশ্চয়ই রেগে আছে আমার উপর।
সেলিনা আশ্বাস দিয়ে বললো, আমি আছি তো ? পৃথিবীর কোনো মা চায় না তার মেয়েকে সমাজের মানুষ বাজে কথা বলুক, বাজে নজরে দেখুক। তেমন আমিও চাই না। তবে নিঝুম মেনে নিলেই আমরা তোমাকে মেনে নিবো৷ এখন সম্পূর্ণটা নির্ভর করছে নিঝুমের সিদ্ধান্তের উপর।
অয়ন মুচকি হেসে বললো, নিঝুম আমাকে মাফ করে দিবে এটা আমার বিশ্বাস।
গাড়ি ভেতরে নিয়ে এসো আর তোমাদের জিনিসপত্র ও, সাথী রুম দেখিয়ে দিবে।
২৫.
পানি পরার ঝমঝম শব্দ খুব মনোযোগ দিয়ে শুনছে নিঝুম। অয়ন বেড়িয়ে যাওয়ার পরই শাওয়ারে এসেছে আর এখনো ঝর্নার নিচে বসে আছে। ঘণ্টাখানেক পার হয়ে গেছে, চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার। চোখের নোনাপানি মিশে যাচ্ছে শীতের এই ঠান্ডা পানির সাথে।
ওয়াশরুমের দরজায় ধাক্কা দিয়ে সাথী বললো, আপু মা খেতে ডাকছে তোমাকে।
নিঝুম নাক টেনে কোনোমতে বললো, আমি খাবো না।
আমি তার কিছু জানি না। মা তাড়াতাড়ি যেতে বলেছে তোমাকে।
নিঝুমের উত্তরের অপেক্ষা না করে চলে গেলো সাথী। নিঝুম বসে না থেকে উঠে দাঁড়ালো। এখন খেতে না গেলে আবার মা আসবে ডাকতে আর তাও না গেলে বাবার কানে চলে যাবে এই খবর। সে অফিস থেকে চলে আসবে কোনোকিছু না ভেবে। নিঝুম মাঝে মাঝে ভাবে সে তার বাবা মায়ের একমাত্র সন্তান না হয়ে আরো ভাইবোন থাকলে ভালো হতো। একমাত্র সন্তান হওয়ায় নিঝুমের বাবা-মা মেয়েকে জীবন মনে করে। নিঝুম চেঞ্জ করে বের হতেই সেলিনা রুমে এলো। মেয়ের চেহারা দেখে বুকে ধক করে উঠলো তার।
করুন গলায় বললো, এতোই যখন কষ্ট পাচ্ছিস তাহলে ফিরিয়ে দিয়েছিস কেনো ?
নিঝুম মায়ের দিকে তাকিয়ে বললো, সব জানার পরও এসব বলছো তুমি ?
আচ্ছা তুই আমাকে বল। কেনো ফিরে যাচ্ছিস না তুই ? অয়নের করা অন্যায়ের জন্য, নাকি নিজের অক্ষমতার জন্য ?
নিঝুম ধুপ করে বসে পরলো ড্রেসিংটেবিলের সামনের টুলে আর ক্লান্ত গলায় বললো, আমি জানি না মা।
সেলিনা দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ঠিক আছে সময় নে। নিজেকে বুঝার চেষ্টা কর, কী চাস তুই। সাথী বললো তুই নাকি খাবি না ?
খাবো, আসছি তুমি যাও।
সেলিনা মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বের হয়ে গেলো রুম থেকে। নিঝুম চুল মুছতে লাগলো ধীর গতিতে আর চিন্তা করতে লাগলো কী করা উচিত তার। এতকিছু করার পর শুধু একবার সরি বললেই কী সব ঠিক হয়ে যায় ? মনে যে আঘাতের দাগ রয়ে গেছে সেগুলো কী একবার চাইলে সব ভুলে যাওয়া সম্ভব ? অয়নকে দেখলে চোখে ভাসে তার করা প্রত্যেকটা অপমান, অবহেলা। নিঝুম বিরক্ত হয়ে হাতে থাকা চুল মোছার টাওয়েল ছুঁড়ে ফেললো সোফায় আর মাথায় ওড়না দিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে এগিয়ে গেলো। মাথার লম্বা ঘন চুল চুইয়ে পানি পরে ভিজে যাচ্ছে গায়ের জামা।
চেয়ার টেনে বসে বললো, মা খাবার দাও।
নিঝুম এসে বসতেই তার পাশে একটা চেয়ার টেনে কেউ বসে পড়লো৷ নিঝুম মনে করেছিলো সাথী কিন্তু পুরুষালি হাত দেখে মুখের দিকে তাকিয়ে চমকে উঠলো। নিঝুম ভেবেছিলো অয়ন চলে গেছে।
নিঝুম প্রায় চিৎকার করে বললো, আপনি এখনো এখানে ?
সেলিনা টেবিলে খাবার রাখতে রাখতে বললো, তুই না বললি, মেহমান এসেছে ভালো করে আদর আপ্যায়ন করতে।
নিঝুম শক্ত গলায় বললো, শেষে বিদায় করতেও বলেছিলাম। সেটা কী শুনতে পাওনি ?
সময় হলে সেটাও করবো। আপাতত যেটার সময় সেটাই করি না হয়।
সেলিনা কথাটা বলে আবার কিচেনে চলে গেলো। নিঝুম রেগে টেবিল ছেড়ে উঠে যেতে নিলে অয়ন হাত টেনে ধরলো আর নিচু গলায় বললো, চুল থেকে পানি পড়ছে। ভালো করে মুছোনি কেনো ? ঠান্ডা লেগে যাবে তো।
নিঝুম হাত ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, ভালোবাসা একটু বেশি বেড়ে গেছে মনে হয়।
এটা কিন্তু আমি তোমাকে নতুন করে বলছি না নিঝুম। আগেও এমন দেখলে একই কথা বলতাম। তবে আগে যেটা করতাম এখন সেটা করবো।
নিঝুম ভ্রু কুঁচকে বললো, মানে ?
কথার উত্তর না দিয়ে অয়ন নিঝুমের হাত ধরে নিঝুমের রুমের দিকে যেতে লাগলো।
নিঝুম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, আপনি কিন্তু এবার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি করছেন। এসব করে আপনি কী প্রমাণ করতে চাইছেন ?
কিছুই প্রমাণ করতে চাইছি না। নিজের অধিকার আগে ছেড়ে দিয়েছিলাম, এবার থেকে সব বুঝে নিবো। অনেক ভুল করেছিলাম এবার থেকে শুধরে নিবো।
অয়ন আর একটা শব্দও করলো না। নিঝুমের রুমে গিয়ে ছুঁড়ে মারা টাওয়েল তুলে নিঝুমের চুল মুছে দিতে লাগলো। নিঝুম সরে আসতে চাইলে অয়ন একহাতে জড়িয়ে ধরে আরেক হাতে চুল মুছতে লাগলো। অনেকটা সময় সাপের মতো মোড়ামুড়ি করে হঠাৎ থেমে গেলো নিঝুম। অয়নের এতোটা কাছে এসেছে আগে খেয়াল হয়নি। নিঝুম একদম শান্ত হয়ে অয়নের বুকে মাথা এলিয়ে দিলো। শুনতে লাগলো বুকের ধকধক শব্দ।
অয়ন মুচকি হেসে বললো, এভাবেই শান্ত মেয়ে উপস সরি শান্ত বউ হয়ে থাকবে।
নিঝুমের ঘোর কেটে গেলো। নিঝুম শান্ত হয়ে যাওয়ায় অয়নের হাত একটু ঢিলে হয়ে গিয়েছিলো। ঘোর কাটতেই অয়নকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলো নিজের থেকে।
কাঁপা গলায় বললো, দূরে থাকুন আমার থেকে।
নিঝুম বড় কদমে বের হয়ে গেলো রুম থেকে।
অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, ভালোবাসা নিয়ে তুমি বারংবার আমার কাছে এসেছো আর আমি তোমাকে আঘাত করে ফিরিয়ে দিয়েছি। এবার নাহয় আমার পালা। তুমি যতবার আমাকে ফিরিয়ে দেবে আমি ততবার ভালোবাসার দাবি নিয়ে তোমার সামনে দাঁড়াবো।
চলবে,,,