মরিচাধরা মনের খাঁচা পর্ব -১৫

#মরিচাধরা_মনের_খাঁচা
লেখনীতেঃ তাহমিনা তমা
পর্বঃ ১৫

রাতে নিয়াজ বাড়ি ফিরে প্রথমে একটু ঝামেলা করলেও সেলিনা তাকে সামলে নিয়েছে। বুঝিয়েছে ভুল মানুষেরই হয়। অয়ন ঠিক সময়ে তার ভুল বুঝতে পেরেছে, তাই তাকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। নিয়াজ মেনে নিয়েছে, তবে সিদ্ধান্ত ছেড়ে দিয়েছে নিঝুমের উপর। এদিকে তনয়কে চলে যেতে বলেছিলো অয়ন কিন্তু সে যাবে না বলে দিয়েছে।

গাড়িতে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অয়ন। নিঝুম এখন ভার্সিটি যাবে তাই। গতকাল দুপুরের পর অয়নের সাথে আর কথা বলেনি। অয়ন রাগ ভাঙানোর অনেক চেষ্টা করেছে কিন্তু কিছুতেই কাজ হয়নি। নিঝুমকে আসতে দেখে সোজা হয়ে দাঁড়ালো অয়ন। নিঝুম পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে হাত টেনে ধরলো।

নিঝুম হাতের দিকে তাকিয়ে বললো, হাত ছাড়ুন।

অয়ন হাতটা আরো একটু শক্ত করে ধরে বললো, গাড়িতে উঠো।

নিঝুম হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বললো, আপনার কী কানে সমস্যা নাকি মাথায় ? কতবার বলেছি আমার থেকে দূরে থাকুন।

তুমি বললেই আমাকে শুনতে হবে ?

আচ্ছা আপনার লজ্জা করছে না এসব করতে ? অন্যের বাড়িতে শুয়ে বসে খাচ্ছেন লজ্জা করছে না ?

অয়ন জানে নিঝুম তাকে রাগানোর জন্য এসব বলছে তাই না রেগে মুচকি হেসে বললো, লজ্জা নারীর ভূষণ। আর আমি জানি, তোমাকে নিজের করে পেতে আমার পথে বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে আমার রাগ, ইগো, লজ্জা। তাই এসব আমি ঢাকায় রেখে এসেছি। এবার চলো তোমার লেট হচ্ছে।

আমি যাবো না আপনার সাথে।

যাবে না তো ?

না যাবো না।

ওকে এবার দেখো, আমি কী করি।

নিঝুম প্রশ্নবোধক চাহনিতে তাকালে অয়ন তাকে কোলে তুলে নিলো ঝটপট।

নিঝুম চেঁচিয়ে বললো, আরে আরে কী করছেন আপনি ? নামান বলছি এখনই।

নামাবো তো অবশ্যই তবে জায়গা মতো।

অয়ন নিঝুমকে কোলে নিয়ে ড্রাইভিং সীটে গিয়ে বসে পড়লো।

নিঝুম রেগে বললো, এসব কী করছেন আপনি ?

অয়ন সীটবেল লাগাতে লাগাতে বললো, আজ তুমি আমার কোলে উঠে ভার্সিটি পর্যন্ত যাবে, এটা তোমার শাস্তি।

আপনার কী মাথা খারাপ হয়ে গেছে পুরোপুরি ? এটা ঢাকার রাস্তা নয়, এক্সিডেন্ট করে মারার প্ল্যান আছে নাকি হ্যাঁ ?

সমস্যা নেই, মরে গিয়ে দু’জনে একসাথে জান্নাতে গিয়ে ঘুরবো, প্রেম করবো। আমার জান্নাতি হুর লাগবে না তুমি থাকলেই হবে।

নিঝুম তাকায় অয়নের দিকে। অয়নের ঠোঁটে তখনও মুচকি হাসি বিদ্যমান।

আমাকে নামান, আমি পাশের সীটে বসে যাচ্ছি।

সেই সুযোগ হারিয়ে ফেলেছো, এখন এভাবেই যেতে হবে।

আমার এত তাড়াতাড়ি মরার শখ নেই।

আমি থাকতে তোমার কিছু হতে দিবো না ইনশাআল্লাহ।

দেখুন বেশি কথা না বলে নামান আমাকে। নাহলে পুলিশ দেখলে চিৎকার করে বলবো, আপনি আমাকে কিডন্যাপ করছেন।

নিঝুমের কথা শুনে অয়ন ছোট ছোট চোখে তাকালো তার দিকে। নিঝুম সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। অয়ন দরজা খোলে দিলে নিঝুম নেমে গিয়ে ঘুরে এসে পাশের সীটে বসলো। নিঝুমের দিকে একবার তাকিয়ে গাড়ি স্টার্ট দিলো অয়ন।

অনেকটা সময় নিরবতায় কেটে গেলে হঠাৎ অয়ন বললো, আমাকে কী মাফ করা যায় না নিঝুম ?

নিঝুম তাকালো অয়নের দিকে কিন্তু কিছু বললো না।

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে সামনে তাকিয়ে বললো, আমি জানি অনেক অনেক অন্যায় করেছি তোমার সাথে। তার জন্য যা ইচ্ছে শাস্তি দাও আমাকে, তবু ফিরে এসো।

নিঝুম আনমনে বললো, শাস্তি তো দিচ্ছি।

অয়ন চমকে উঠলো নিঝুমের কথা শুনে, তবে কিছু বললো না। বাকি রাস্তা চুপচাপ থেকেই পৌঁছে গেলো ভার্সিটির সামনে।

নিঝুম নামতে গেলে অয়ন বললো, এটা যদি আমার শাস্তি হয়, ঠিক আছে তোমার যতদিন ইচ্ছে আমি এই শান্তি ভোগ করবো।

নিঝুম কিছু না বলে নেমে গেলো গাড়ি থেকে। অয়নও গাড়ি থেকে নেমে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে নিঝুমের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রইলো।

দোস্ত ছেলেটা জোস না ?

ঠিক বলেছিস, তবে এর আগে তো দেখিনি।

নিঝুম যেতে যেতে গেইটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েদের কথা শুনে তাদের দিকে তাকালো। তাদের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই রাগে মুখ লাল হয়ে গেলো। অয়ন গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। নিঝুম অয়নের দিকে একটা রাগী লুক দিয়ে ভেতরে চলে গেলো। অয়ন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো নিঝুমের লুক দেখে। হঠাৎ রেগে যাওয়ার কারণ বুঝতে পারলো না। নিঝুম চলে যেতেই অয়ন গাড়িতে উঠে চলে গেলো।

২৬.
তয়ন বেডে আধশোয়া হয়ে ল্যাপটপে কিছু কাজ করছিলো তখনই সাথী চা নিয়ে তার রুমের দরজার সামনে দাঁড়ালো।

আসবো ভাইয়া ?

তয়ন দরজার দিকে তাকিয়ে বললো, হ্যাঁ আসো ?

সাথী ভেতরে এসে চায়ের কাপ সাইড টেবিলে রেখে বললো, আপনার জন্য চা এনেছি।

তয়ন মুচকি হেসে বললো, ধন্যবাদ কিন্তু আমি চা খাই না।

সাথী মলিন মুখে বললো, চা খান না কোনো ?

আমি চা খাই না কফি খাই।

ঠিক আছে আমি কফি কইরা দিতাছি।

তয়ন এবার ভ্রু কুঁচকে তাকালো সাথীর দিকে। সাথী দাঁতে জিহ্বা কেটে বললো, সরি।

সাথী চলে যেতে গেলে তয়ন বললো, কফি লাগবে না। তোমার সাথে একটু কথা ছিলো।

সাথী ঘুরে তাকিয়ে বললো, জি বলুন।

যদি কিছু মনে না করো তাহলে বলতাম আর কী।

কিছু মনে করবো না বলুন, সমস্যা নেই।

তোমার হাসবেন্ড কোথায় ?

সাথী ঘুরে তাকালো তয়নের দিকে। এই প্রশ্নের মুখোমুখি হয়তো তাকে বারবার হতে হবে। কিন্তু প্রশ্নটা যে তাকে পীড়া দেয় ভয়ংকর পীড়া, সেটা কী কেউ বুঝে ?

তয়ন বললো, প্রবলেম থাকলে বলতে হবে না, ইটস ওকে।

সাথী সামনে তাকিয়ে বললো, না না সমস্যা নেই। তার সাথে আমার ডিভোর্স হয়ে গেছে।

তয়নকে আর কোনো প্রশ্ন করার সুযোগ না দিয়ে সাথী বের হয়ে গেলো। তয়ন যেনো বিশ্বাস করতে পারছে না সাথীর কথা। এতো সুন্দর আর নিষ্পাপ একটা মেয়েকে কীভাবে কেউ ছেড়ে যেতে পারে ? তাছাড়া তিথির মতো ফুটফুটে মেয়েটাও কী তার মন গলাতে পারেনি ? সাথী আর তিথির জন্য খুব খারাপ লাগছে তয়নের।

কী করছিস তুই ?

আরে ভাইয়া যে, ভাবীকে ভার্সিটি দিয়ে এসেছিস ?

হ্যাঁ দিয়ে এসেছি আর তোর জন্য ফ্লাইটের টিকিট নিয়ে এলাম।

তয়ন ভ্রু কুঁচকে বললো, কীসের টিকিট ?

অয়ন টিকিট তয়নের হাতে দিয়ে বললো, বিকেলের ফ্লাইটে তুই ঢাকা যাচ্ছিস।

তয়ন টিকিটের দিকে একবার তাকিয়ে অয়নের দিকে তাকালো, আমি তো তোর সাথে এসেছি আর তোর সাথেই যাবো।

অয়ন দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো, নিঝুম এতো সহজে ফিরে যাবে না আমার সাথে। অফিস রেখে দুজনেই এখানে পরে থাকলে বিজনেস গোল্লায় যাবে। বাবার অনেক কষ্টে গড়ে তোলা প্রতিষ্ঠান আমাদের জন্য শেষ হয়ে যাবে। তাই তুই ঢাকায় গিয়ে অফিস সামলা কিছুদিনের জন্য। আর মাও একা আছে সেখানে।

তয়ন গাল ফুলিয়ে বললো, আমি যদি না আসতাম।

তুই না আসলে সেদিন হয়তো বাঁচতামই না আমি।

তয়ন রেগে বললো, একদম বাজে কথা বলবি না, কয়টার ফ্লাইট ?

দুপুর দুইটার।

ঠিক আছে, আমি চলে যাবো।

তাহলে এখন রেস্ট নে, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।

অয়ন চলে গেলে তয়ন হাতে রাখা টিকিটের দিকে তাকিয়ে রইলো। অজানা কারণে এখান থেকে যেতে ইচ্ছে করছে না তয়নের কিন্তু কিছু করারও নেই। তবে যাওয়ার আগে সাথীকে একবার সরি বলতে হবে। তয়ন বেড থেকে নেমে সাথীকে খুজতে বের হয়ে গেলো। কিচেনে দাঁড়িয়ে দুপুরের রান্নার জন্য সবজি কাটছিলো সাথী। সেদিকে তার খেয়াল নেই, অন্য এক দুনিয়ায় ডুবে আছে সে। তয়ন দরজার সামনে দাঁড়িয়ে কিছুটা সময় দেখলো সাথীকে। মেয়েটা সত্যি অনেক মায়াবী, মুখটা যেনো নিষ্পাপ। সাথী হঠাৎ উহ্ করে উঠলে তয়নের ভাবনার ব্যাঘাত ঘটে। সাথী হাতের আঙুল চেপে ধরে তাকিয়ে আছে, টপটপ করে রক্ত পড়ছে হাত থেকে।

তয়ন এগিয়ে গিয়ে হাত ধরে দেখে বললো, একটু সাবধানে কাজ করতে পারো না। কতটা কেটে গেছে দেখো তো, চলো আমার সাথে।

তয়ন আঙ্গুল শক্ত করে চেপে ধরে সাথীকে নিজের রুমে নিয়ে গেলো। সাথী অবাক চোখে তাকিয়ে আছে তয়নের দিকে৷ এর থেকে অনেক বড় বড় আঘাতে কেউ একটু তাকিয়েও দেখেনি। সাথীর চোখে পানি চলে এলো তয়নের এটুকু কেয়ারে। তয়ন সাথীকে বসিয়ে রেখে নিজের ব্যাগ থেকে ফাস্টএইড বক্স এনে তুলোয় মেডিসিন লাগিয়ে কাটা জায়গায় লাগাতেই সাথী ব্যাথা কুঁকড়ে গেলো।

তয়ন ব্যস্ত গলায় বললো, সরি সরি আমি আস্তে আস্তে করছি।

তয়ন ফু দিয়ে ধীরে ধীরে কাটা জায়গা পরিষ্কার করে ব্যান্ডেজ করে দিলো। সাথী তখনো মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে তয়নের দিকে।

সাথীকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে তয়ন একটু অপ্রস্তুত হয়ে বললো, আমি আসলে তোমাকে সরি বলতে গিয়েছিলাম। নিজের অজান্তে তোমাকে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি আমি।

সাথী দৃষ্টি সরিয়ে বললো, আমি কিছু মনে করেনি। আপনি তো খুব কমন একটা প্রশ্ন করেছেন, কষ্ট পাবো কেনো।

আমি সত্যি দুঃখীত সাথী।

এভাবে বলবেন না দয়া করে। আমি এখন আসি, কাজ আছে।

সাথী উঠে আবার কিচেনের দিকে চলে গেলো। কিচেনে গিয়ে ব্যান্ডেজের উপর আলতো হাত ছুঁইয়ে দিলো। মুগ্ধতায় ডুবে গেলো সে। আড়াল থেকে তয়ন ক্যামেরা বন্দী করে নিলো সাথী হাসিমাখা মুখটা। কাজটা কেনো করলো তয়নের নিজেরও জানা নেই।

চলবে,,,,,,,
/

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here