মরুর বুকে বৃষ্টি পর্ব ৭

#মরুর_বুকে_বৃষ্টি 💖
#লেখিকা-মেহরুমা নূর
#পর্ব-৭

★সেই কখন থেকে আদিত্য এটা ওটা বলে নূরকে খাওয়ানোর চেষ্টা করে যাচ্ছে। কিন্তু কোন মতেই খাবার মুখে তুলছে না। আদিত্যর জীবনে বোধহয় এতো এফার্ট ও কোন কাজেই করেনি। অন্য কেউ হলে হয়তো আদিত্য এতক্ষণে তার হাড্ডি মাংস এক করে দিতো। কিন্তু এই মেয়েটাকে মারা তো দূরের কথা, তার দিকে চোখ গরম করে তাকানোরও ক্ষমতা নেই আদিত্যের।

এসব দেখে মিনু আন্টি সহ বাসার সব সার্ভেন্ট রা অবাকের শীর্ষে এবার। আদিত্যর মতো লোক, যাকে শুধু মানুষের গর্দান উড়াতে দেখেছে। সেই আদিত্য আজ একটা মেয়ের পিছনে আয়ার মতো কাজ করছে। এটা যেন ওদের চোখের ধারণ ক্ষমতার বাইরে। এদের দেখে মনে হচ্ছে যেকোনো সময় এরা অ্যাটাক খেয়ে বসবে।

আদিত্যে নূরের দিকে তাকিয়ে অসহায় কন্ঠে বললো।
–খাওয়ানারে বাবা, এমন করছ কেন? দেখ তুমি খাবার শেষ করলে আমি তোমাকে অনেক গুলো চকলেট দেব।

নূর ফট করে বললো।
–তাহলে আগে দাও।

–না আগে খাবে তারপর দিব।

–তাহলে আমি খাবোই না।

–আচ্ছা তুমি মোবাইল দেখবে?মোবাইল বা টিভি দেখে খাবে?

–নাহ মোবাইল, টিভি দেখতে ইচ্ছে করছে না।আমি ডান্স দেখবো, আমার ডান্স দেখতে ইচ্ছে করছে।

–হ্যাঁ তো মোবাইলে বা টিভিতে দেখ। অনেক সুন্দর সুন্দর ডান্স আছে।

–না না মোবাইলে বা টিভিতে না। আমি সরাসরি ডান্স দেখবো।

আদিত্য একটু থতমত খেয়ে বললো।
–সরাসরি? কিন্তু সরাসরি কে ডান্স করবে?

নূর সোজাসাপটা বলে উঠলো।
–কেন? তুমি করবে। চল ডান্স করো। আমি তোমার ডান্স দেখবো।

আদিত্য যেন এবার আকাশ থেকে পরলো। কি বলে এই মেয়ে, আমি আর ডান্স? মান ইজ্জতের ফালুদা করে ফেলবে মনে হচ্ছে। আদিত্য শুকনো ঢোক গিলে বললো।
–কি কিন্তু আমি তো তোমাকে খাইয়ে দিচ্ছি তাইনা? আমি ডান্স করলে তোমাকে খাইয়ে দিব কি করে।

নূর কিছুক্ষণ ভেবে মাথা নেড়ে বললো।
–হুমম,, তাও ঠিক। তাহলে কে ডান্স করবে?

আদিত্য একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। যাক ওতো বেঁচে গেছে।
নূর কিছুক্ষণ এদিক ওদিক তাকিয়ে দরজার কাছে দাড়ানো দুইজন গার্ড কে দেখিয়ে বললো।
–ওইযে, ওই দুই ডাকাত কে বলো ডান্স করতে।

আদিত্য নূরের ইশারা অনুযায়ী দরজার দিকে তাকালো। তারপর আর কোন উপায় না পেয়ে ওই দুই গার্ডদের কাছে ডাকলো। ওরা মাথা ঝাকিয়ে সামনে এসে দাঁড়াল। আদিত্য একটু গলা খাঁকারি দিয়ে বললো।
–শোন রফিক আর মুনির, তোমাদের ম্যাডাম তোমাদের ডান্স দেখতে চায়। চলো ফটাফট ডান্স শুরু করে দাও।

নূর বলে উঠলো।
–আরে ম্যাডাম না, বলো রানী সাহেবা।

–ও হ্যাঁ সরি। তো তোমাদের রাণী সাহেবা তোমাদের ডান্স দেখতে চান।

গার্ড দুটো যেন হতভম্ব হয়ে গেল। ওদের মনে হচ্ছে ওরা কানে বোধহয় ভুল শুনেছে। ওরা অপ্রস্তুত হয়ে আমতা আমতা করে বললো।
–জ্বি ডান্স? কিন্তু সার আমরা তো ডান্স পারিনা।

–আরে এমন কোন কঠিন কাজ না। চেষ্টা করলেই পেরে যাবে। চলো চলো শুরু হয়ে যাও।
আদিত্য আরেক সার্ভেন্ট কে ডেকে মিউজিক সিস্টেমে গান প্লে করতে বললো। নূর মাঝখান থেকে বলে উঠলো।
–বেবিডল গানটা চালাও।

নূরের কথামতো বেবিডল গান চালু করা হলো। গার্ড দুটো এখনো দাঁড়িয়ে আছে। ওরা বুঝতে পারছে না কি করবে। ওদের দাঁড়িয়ে থাকা দেখে নূর বলে উঠলো।
–এই দাঁড়িয়ে আছ কেন? ডান্স শুরু করো।

গার্ড দুটো আর উপায় না পেয়ে কোনরকম হাত পা চালাতে লাগলো। ওদের ডান্স দেখে মনে হচ্ছে ওরা ডান্স নয়,কারোর সাথে মারামারি করছে। এমন ডান্স দেখে সার্ভেন্ট দের পেট ফেটে হাসি পাচ্ছে। বেচারারা অনেক কষ্টে আটকে রেখেছে।

নূর ওদের ডান্স দেখে খুশি হয়ে তালি বাজাচ্ছে। আদিত্য এই সুযোগে নূরের মুখে খাবার ঢুকিয়ে দিল। নূর ডান্স দেখতে দেখতে খাবার শেষ করে নিল। আদিত্য যেন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ জয় করলো।

এরইমধ্যে বিহান ওখানে এসে দাঁড়ালো। গার্ডসদের এভাবে ডান্স করতে দেখে বিহান তাজ্জব বনে গেল। বিহান এখনো বোঝার চেষ্টা করছে ওরা আসলে করছে টা কি। বিহান গার্ড দুটোর কাছে গিয়ে বললো।
–ওই হালারা,তোরা কি করতাচছ (করছিস) এগুলা? মাথার ইচকুরু (স্ক্রু) কি ছব খুইল্লা গ্যাছেগা (গেছে)? পাগল গো লাহান (পাগলের মতো) এমতে (এমন) লাফাইতাছোচ ক্যালা(কেন)? প্যান্টের ভিতরে কি ইন্দুর হান্দাইছে নি (ঠুকেছে নাকি)?

আদিত্য বলে উঠলো।
–আরে ওরা ডান্স করছে। নূর ডান্স দেখতে চেয়েছিল তাই ওরা ডান্স করছে।

বিহান বেকুবের মতো একবার আদিত্যর তাকালো তো একবার গার্ড দুটোর দুই তাকালো। তারপর হঠাৎ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। হাসতে হাসতে লুটপাট হয়ে যাওয়ার অবস্থা। নূর শুধু অবাক চোখে বিহানকে দেখছে। লোকটাকে এর আগেও দেখেছে নূর। কিন্তু লোকটা আসলে কে সেটাই বোঝার চেষ্টা করছে ও।
বিহান কোনরকমে হাসি থামিয়ে আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–কি কইলি তুই? এইডা ডান্স?
কথাটা বলে বিহান আবারও হাসা শুরু করলো। একটু হেঁসে আবার বললো।
–আর হাচাইছনা। এইডা যদি ডান্স হইয়া থাহে, তয় (তাহলে) আমি হইলাম ছাহরুখ খান (শাহরুখ খান)। এইডারে ডান্স কইয়া ডান্সেরে এমতে অপমান করন ঠিক হইতো না।
কথাগুলো বলতে বলতে বিহান চেয়ার টান দিয়ে বসে পড়লো।

নূর এখনো বিহানের দিকে তাকিয়ে আছে। আদিত্য ব্যাপার টা খেয়াল করে বললো।
–নূর, ও হলো বিহান। আমার বন্ধু+ভাই। তুমিও ওকে ভাইয়া ডাকবে কেমন?

নূর যথারীতি ভাবে ঘাড় কাত করে শিশুসুলভ ভাবে বললো।
–আচ্ছা।

বিহান আদিত্যের দিকে তাকিয়ে বললো।
–অফিছে কহন যাবি?

আদিত্য মিনু আন্টিকে ডাক দিয়ে বললো।
–আন্টি নূরকে রুমে নিয়ে যান। আর আমি না আসা পর্যন্ত ওর সাথেই থাকুন।

মিনু আন্টি মাথা ঝাকিয়ে নূরকে সাথে করে নিয়ে গেল। নূর যেতেই আদিত্য বলে উঠলো।
–ইয়ার আমি দুই তিনদিন অফিসে যাবোনা। নূর এই বাসায় নতুন এসেছে। ওকে এখানে একা রেখে যাওয়া ঠিক হবে না। ও একটু এই বাসায় কম্ফোর্টেবল হয়ে যাক, তারপর যাবো। আমি অফিসে ফোনে বলে দিয়েছি। ইম্পর্ট্যান্ট কোন মিটিং থাকলে আমি বাসায়ই করে নিবো।।

বিহান বললো।
–ঠিক আচে,তুই যেমতে ভালা মনে করচ।
_________

সকালের বেলা গড়িয়ে দুপুরে এসে ঠেকেছে। নূর কাল থেকে কিছু না বললেও আজ সকাল থেকে ওর মায়ের কথা মনে পড়ছে। সকাল থেকে আদিত্য নানান কথা বলে এটা ওটা দিয়ে ভুলিয়ে রাখলেও, এখন আর ভালো লাগছে না নূরের। বারবার শুধু ওর মায়ের কথা মনে পড়ছে। ঘন্টাখানিক আগে আদিত্য নূরকে ঘুম পারিয়ে দিয়েছিল। আদিত্যর একটা ইম্পর্ট্যান্ট মিটিং ছিল। নূরকে ঘুমুতে দেখে আদিত্য স্টাডি রুমে গিয়ে ল্যাপটপে মিটিং শুরু করে।

এদিকে নূর বিশ মিনিট পরেই ঘুম থেকে উঠে পড়ে। ঘুম থেকে উঠে ওর আর কিছুই ভালো লাগছে না। মায়ের কথা মনে পড়ছে শুধু। খুব খারাপ লাগছে। নূর ধীরে ধীরে কাঁদতে শুরু করলো। কাঁদো কাঁদো গলায় বলতে লাগলো।
–আম্মুউউ আম্মু,,,,,আম্মু কোথায়? আম্মু যাবো আমি। আম্মু চাই।
ধীরে ধীরে নূরের কান্নার গতি বাড়তে লাগলো।

স্টাডি রুমে আদিত্য হেডফোন লাগিয়ে মিটিং করছে। তাই ওর কান পর্যন্ত নূরের কান্না পৌঁছাচ্ছে না।

নূরের কান্নার আওয়াজ শুনে মিনু আন্টি সহ দুই তিনজন সার্ভেন্ট আদিত্যের রুমের দিকে গেল। ওরা যানে আদিত্য রুমে নেই মিটিং এ আছে। আদিত্য মিটিং শুরু করার আগে ওদের বলে গিয়েছিল, নূরের দিকে খেয়াল রাখতে।
সার্ভেন্ট রা রুমে এসে দেখলো, নূর বেডের ওপর বসে কান্না করছে। মিনু আন্টি নূরের কাছে এগিয়ে এসে বললো।
–কি হয়েছে রাণী সাহেবা কাঁদছেন কেন? শান্ত হন, আমাকে বলুন কি হয়েছিল?

নূর কাঁদতে কাঁদতে বললো।
–আম্মু চাই আমার।আম্মু যাবো। আম্মু এনে দাও।
নূর কাঁদতে কাঁদতে এবার হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগলো।

সবাই ওঁকে থামানোর চেষ্টা করছে কিন্তু, নূর কিছুতেই থামছে না। ধীরে ধীরে নূর অনেক হাইপার হয়ে গেল। কাঁদতে কাঁদতে হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারতে লাগলো। সার্ভেন্ট রা অনেক ভয় পেয়ে গেল নূরকে এভাবে দেখে। ওরা কি করবে বুঝতে পারছে না। ভয়ে ওর কাছে কেও যেয়ে সাহস পাচ্ছে না।

আদিত্য আরও দশ মিনিট পরে মিটিং শেষ করে বের হলো। স্টাডি রুমের বাইরে আসতেই হঠাৎ ওর রুম থেকে হইচই এর আওয়াজ শুনতে পেল। আদিত্যের বুকের ভেতর ধক করে উঠলো। নূর, আমার নূর ঠিক আছেতো? কথাটা ভাবতেই আদিত্য ওর রুমের দিকে দৌড়ালো।

রুমের সামনে এসে দেখলো সার্ভেন্ট রা দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে আছে। আদিত্য ওদের কাছে গিয়ে উত্তেজিত হয়ে বললো।
–কি হয়েছে? তোমরা এখানে দাঁড়িয়ে আছ কেন?

একজন সার্ভেন্ট ভীতু স্বরে বললো।
–সার, ম্যাম হঠাৎ করে অনেক হাইপার হয়ে গেছে। উনাকে কিছুতেই সামলানো যাচ্ছে না।

–হোয়াট??
আদিত্য তড়িঘড়ি করে ভেতরে ঢুকলো। ভেতরে ঢুকে দেখলো নূর এলোমেলো ভাবে পাগলের মতো সবকিছু ছোড়াছুড়ি করছে আর বলছে, আম্মু চাই আমার, আম্মু কই?

নূরের এমন অবস্থা দেখে আদিত্যর বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে উঠলো। এতটুকু সময়ের মধ্যে ওর পরীটার একই হাল হয়ে গেছে। আদিত্য নূরের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে বলতে লাগলো।
–নূর, মাই এঞ্জেল। কি হয়েছে? আমাকে বলো তুমি।

নূরের কোন হুঁশ নেই। ও শুধু বারবার আম্মু চাই আম্মু চাই বলে যাচ্ছে, আর হাতের কাছে যা পাচ্ছে তাই ছুড়ে মারছে। আদিত্য যখন কাছে আসতে নেয় নূর তখন হাতের কাছে একটা পেপার ওয়েট পেয়ে সেটা ছুড়ে মারে। আর সেটা গিয়ে আদিত্যের কপালে লাগলো। আদিত্যে ব্যাথা পেয়ে কপালে হাত চেপে ধরে হালকা আওয়াজ করে উঠলো।
–আহহ,

আদিত্যকে ব্যাথা পেতে দেখে নূর হঠাৎ করে থেমে গেল। ভয়ে জড়সড় হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো।
আদিত্য হাত সামনে এনে দেখলো কপাল ফেটে রক্ত বের হচ্ছে। আদিত্য সেদিকে তোয়াক্কা না করে আবার নূরের দিকে এগিয়ে যেতে লাগলো। কিন্তু আদিত্যের কপালের রক্ত দেখে নূর কেমন অন্য রকম হয়ে গেল। ওর চোখের সামনে আবছা আবছা কিছু ভেসে উঠলো। যেখানে শুধু রক্ত আর রক্তাক্ত কিছু মানুষ। নূরের শরীর প্রচুর পরিমাণ কাঁপতে শুরু করলো। কেমন শ্বাসকষ্ট হচ্ছে ওর। পুরো শরীর ঘামতে শুরু করলো।

আদিত্য কাছে এসে নূরকে ধরতে গেলেই, নূর ছিটকে সরে গেল। আর কাঁপতে কাঁপতে অস্বাভাবিক ভাবে বলতে লাগলো।
–র ররক্ত রক্ত,,,,

নূরকে এমন করতে দেখে আদিত্য আরও ভয় পেয়ে গেল। ওর এঞ্জেল টা হঠাৎ এমন করছে কেন? কি হচ্ছে ওর সাথে?

নূরের হঠাৎ প্রচুর মাথাব্যথা শুরু হয়ে গেল। চোখটা ঝাপসা হয়ে এলো।শরীর টা কেমন নিস্তেজ হয়ে যাচ্ছে। নূর আর দাঁড়িয়ে থাকার শক্তি পেলনা। আদিত্য কোন কিছু বুঝে ওঠার আগেই, নূর জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে লুটিয়ে পড়লো। আদিত্যর মাথায় তখন আকাশ ভেঙে পড়লো। কয়েক সেকেন্ডের জন্য অনুভূতি শুন্যে হয়ে গেল।

আদিত্য দ্রুত গতিতে নূরের কাছে গিয়ে নূরের মাথাটা দুই হাতে ধরে নিজের কোলের মাঝে নিয়ে পাগলের মতো বলতে লাগলো।
–নো নো নো,,,,, নূর, মাই এঞ্জেল। ডোন্ট ডু দিস টু মি। প্লিজ ওপেন ইউর আইজ, টক টু মি। নূর, নূর,,,, প্লিজ চোখ খোল না সোনা। আমি যে আর সহ্য করতে পারছি না।

নূরের কোন রেসপন্স না পেয়ে আদিত্য যেন বোধশক্তিহীন হয়ে গেল। নিজেকে পাগল পাগল মনে হচ্ছে ওর। একটু আগেও কত হাসিখুশি ছিল ওর এঞ্জেল টা। আর এখন কি থেকে কি হয়ে গেল।

তখনই বিহানও দৌড়ে রুমে ঢুকলো। আদিত্য আর নূরকে এভাবে দেখে অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলো।
–কিরে কি হইচে?

আদিত্য বিহানের দিকে তাকিয়ে করুন কন্ঠে বললো।
–দে দেখনা বিহান, নূরের হঠাৎ কি হয়েছে? ও কথা বলছে না। প্লিজ ডু সামথিং।

বিহান আদিত্যর কপালে রক্ত দেখে চমকে গিয়ে বললো।
–আদি তোর কপাল থাইক্কা তো রক্ত ঝরতাচে(পরছে)।

–তুই আমাকে ছাড়। তাড়াতাড়ি নূরকে ঠিক করার জন্য কিছু কর। সব আমার দোষ। আমার ওকে একা রেখে যাওয়াই ঠিক হয়নি। আমার জন্যই আজ ওর এই অবস্থা হয়েছে।

–আইচ্ছা আইচ্ছা, তুই চিন্তা করিস না। নূরকে বিছনায় হোয়াইয়া (শুইয়ে) দে। আমি ডাক্তারকে আইবার কইতাছি।

বিহানের কথামতো আদিত্য নূরকে কোলে তুলে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিল।
____________

একঘন্টা পর নূরের জ্ঞান ফিরলো। তখন ডাক্তার এসে নূরকে চেকআপ করে গিয়েছিল। বলেছিল চল্লিশ/পঞ্চাশ মিনিট পরে নূরের জ্ঞান ফিরে আসবে। বিহান আদিত্যকে জোর করে ধরে ডাক্তারের কাছ থেকে কপালে ব্যান্ডেজ করিয়ে নিয়েছে।

নূর পিটপিট করে চোখ খুলে তাকালো। চোখ খুলে সামনে তাকাতেই ওর মাকে বেডের ওপর বসে থাকতে দেখে খুশি হয়ে গেল নূর। নূর হাসিমুখে উঠে বসে ওর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো।
–আম্মু তুমি এসেছ।জানো আমি তোমাকে এত্তো গুলো মিস করছিলাম। তুমি এসেছ এখন আমার অনেক খুশী লাগছে।

নূরের মা নূরকে আস্তে করে ছাড়িয়ে নিয়ে শান্ত ভঙ্গিতে বললেন।
–কিন্তু আমার মোটেও ভালো লাগছে না। আমি তোমার ওপর রেগে আছি।

নূর অসহায় কন্ঠে বললো।
–কেন? আমি কি করেছি?

–কারণ তুমি আর গুড গার্ল নেই, তুমি ব্যাড গার্ল হয়ে গেছ। আমি তোমাকে এখানে আসার আগে কি বলেছিলাম মনে আছে? আমি তোমাকে বলেছিলাম এখানে এসে তুমি গুড গার্ল হয়ে থাকবে। আর তোমার হিরোর সবকথা শুনবে। আর তুমি কি করলে,তার মাথা ফাটিয়ে দিলে। জানো তুমি কতো বড়ো পঁচা কাজ করেছ? আল্লাহর কাছেও তুমি ব্যাড গার্ল হয়ে গেছ।

নূর অপরাধী কন্ঠে বললো।
–সরি আম্মু। কিন্তু আমি কি করবো? আমার যে তোমার কথা অনেক মনে পড়ছিল।জানিনা কি হয়ে গিয়েছিল তখন। তাইতো এমন হয়ে গেল।

–তাই বলে তুমি এমন করবে? তুমি জানো হিরো তোমার কি হয়? সে তোমার স্বামী হয়। যেমন তোমার বাবা আমার স্বামী, ঠিক তেমনই। আর স্বামীর সাথে কখনো খারাপ ব্যবহার করতে নেই। আল্লাহ নারাজ হন। আমার কথা মনে পড়ছিল সেটা তোমার হিরোকে ভালোভাবে বললেই তো হতো। সে আমাকে তোমার সাথে ভিডিও কলে কথা বলিয়ে দিতো। তাহলেই তো হতো তাইনা?

–তোমাকে ছাড়া আমার ভালো লাগে না আম্মু। তুমিও আমার সাথে এখানে থাকোনা? নাহলে আমাকেও নিয়ে চলো তোমার সাথে।

–তা হয়না নূরিমা। তোমার এখন বিয়ে হয়ে গেছে । বিয়ের পরে একটা মেয়ে তার স্বামীর বাড়িতেই থাকে। আর মেয়ের স্বামীর বাড়িতে তার বাবা মা থাকতে পারে না। এটা ঠিক না।তোমার যখন ইচ্ছে আমরা ফোনে কথা বলবো।মাঝেমধ্যে তুমি হিরোর সাথে আমাদের বাড়িতে আসবে।আবার কখনো আমরা তোমার সাথে দেখা করতে আসবো। তাহলেই তো হলো। তুমি আমার গুড গার্ল না?

–হ্যাঁ।

–তাহলে আমাকে প্রমিজ করো,এরপর থেকে আর কখনো এমন করবে না। একদম গুড গার্ল হয়ে থাকবে। নাহলে কিন্তু আমি তোমার সাথে আর কথা বলবো না।

–না না আম্মু, আমি প্রমিজ করছি আর কখনো এমন করবো না। একদম গুড গার্ল হয়ে থাকবো।

–এইতো আমার লক্ষী মেয়ে।
কথাটা বলে নাজমা বেগম নূরকে জড়িয়ে ধরলো। মেয়েটার জন্য তার বড্ড চিন্তা। তখন আদিত্য ফোন করে তাদের আসতে বলতেই। তারা তারাহুরো করে এখানে চলে এসেছে।

একটু পরে নিলা ট্রেতে করে ছুপ নিয়ে রুমে ঢুকলো। নিলাকে দেখে নূর খুশি হয়ে বললো।
–আরে নিলা তুমিও এসেছ?

নিলা মুচকি হেসে বললো।
–হ্যাঁ আমিও এসেছি। এখন কেমন লাগছে তোমার আপু?

–ভালো।

নিলা ছুপটা নাজমা বেগমের হাতে দিলে,নাজমা বেগম সেটা নূরকে খাইয়ে দিল।
___

ড্রয়িং রুমে সোফায় মাথা নিচু করে দুই হাত দিয়ে চুল চেপে ধরে বসে আদিত্য। বারবার শুধু চোখের সামনে নূরের সেই জ্ঞান হারানোর দৃশ্য টাই ঘুরছে। কিছুতেই ভুলতে পারছে না সেটা।

একটু পরে নাজমা বেগম সিড়ি বেয়ে নেমে এলো। আদিত্যকে এভাবে বসে থাকতে দেখে, আস্তে করে তার পাশে গিয়ে বসলো। কারোর বসার আভাস পেয়ে আদিত্য মাথা তুলে তাকালো। নাজমা বেগম কে দেখে চিন্তিত সুরে বললো।
–আরে আন্টি আপনি এখানে? নূর ঠিক আছে তো?

নাজমা বেগম স্মিত হেসে বললো।
–চিন্তা করোনা নূরের জ্ঞান ফিরে এসেছে। ও এখন সুস্থ আছে।

আদিত্য একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো। এতক্ষণ যেন আত্মা টা গলায় চলে এসেছিল। আদিত্য নিচের দিকে তাকিয়ে অপরাধী কন্ঠে বলে উঠলো।
–আই এ্যাম সরি আন্টি। আমি আমার কথা রাখতে পারিনি। আমি আপনার মেয়ের খেয়াল রাখতে পারিনি। আজ আমার একটু অসাবধানতার কারণে নূরের এই অবস্থা হয়ে গেল। আমি জানি আপনি হয়তো আমার রেগে আছেন। আর এটাই স্বাভাবিক।

নাজমা বেগম শান্ত সুরে বললো।
–হুমম রেগে তো একটু আছি। তবে নূরের জন্য নয়। তোমার এই বারবার আন্টি বলার জন্য। আমি কি তোমার আন্টি হই? নূর যেমন আমার মেয়ে, তেমনি তুমিও তো আমার ছেলের মতোই তাইনা? জানো নূর হবার পর আমার একটা ছেলের অনেক শখ ছিল। কিন্তু সেটা আর পুরোন হয়নি। তবে আজ তোমার রুপে আমি একটা ছেলে পেয়েছি। তাহলে আমকে কি মা ডাকা যায়না?

আদিত্য অবাক চোখে নাজমা বেগমের দিকে তাকালো। চোখের কোনা চিকচিক করছে ওর। আজ কতো বছর পর ও মায়ের মমতা পাচ্ছে। কাউকে মা ডাকার সুযোগ পাচ্ছে। নূর সত্যিই একটা এঞ্জেল। নূর আদিত্যের জীবনের সব অসম্পূর্ণতা ধীরে ধীরে পূর্ণ করে দিচ্ছে। আদিত্য কোনরকমে নিজেকে সামলে নিয়ে বললো।
–অবশ্যই আন..সরি, আই মিন মা। সরি মা।

–সরি কেন বলছ? আর নিজেকে অপরাধী ভাবার কোনো দরকার নেই তোমার। আসলে আমাদেরই ভুল ছিল। তোমাকে সেদিনই সবকিছু ভালোভাবে বুঝিয়ে দেওয়া উচিত ছিল। তাহলে আর এসব হতোনা। আসলে নূর মাঝেমধ্যেই ছোট খাটো এমন ব্যাপার নিয়ে হঠাৎ করে এমন হাইপার হয়ে যায়। তখন ওকে সামলানো অনেক মুশকিল হয়ে যায়। ও যেটা চায় সেটা ওকে সাথে সাথেই দিতে হয়, নাহলে ও এমন হয়ে যায়। তবে সবচেয়ে বেশি সমস্যা হয়, কোথাও রক্ত দেখতে পেলে। এক্সিডেন্টের পর থেকে কোথাও রক্ত দেখতে পেলেই ওর এমন প্যানিক অ্যাটাক শুরু হয়ে যায়। তাই এই বিষয় টা বেশি খেয়াল রাখতে হয়। আর যতটা সম্ভব ওকে একা না ছাড়াটাই ভালো।

–ঠিক আছে মা।আমি এরপর থেকে এসব জিনিস খেয়াল রাখবো।

–আচ্ছা ঠিক আছে। এখন যাও নূরের সাথে দেখা করে আসো।

আদিত্য একটু আমতা আমতা করে বললো।
–কিন্তু মা ও যদি আবার,,

আদিত্যের কথা শেষ হওয়ার আগেই নাজমা বেগম মুচকি হেসে বললেন।
–চিন্তা করোনা এখন আর ভয় করবে না নূর। আর এমনিতেও তুমিতো এখন ব্যান্ডেজ করেই নিয়েছ।

আদিত্য বলে উঠলো।
–ঠিক আছে। তবে কিছু মনে না করলে একটা কথা বলার ছিল।

–হ্যাঁ বলো।

–আসলে বলছিলাম যে, আপনি নাহয় এখানে কিছুদিন থেকে যান। তাহলে নূরের ভালো লাগবে।

–না বাবা তা হয় না। নূরের বাবার অফিস থাকে। আর তার শরীর টাও বেশি ভালো নেই। তাই আমাকে তার কাছে থাকতে হবে। আর তাছাড়া, এখানে থাকলে নূরের সেটা অভ্যাস হয়ে যাবে। আমি চলে গেলে নূর আবার পাগলামি করবে। তাই এখন থেকেই নূরকে আমাকে ছেড়ে থাকার অভ্যাস করাতে হবে। তাহলেই ও এই থাকতে পারবে।

আদিত্য কিছুক্ষণ ভেবে আবার বললো।
–ঠিক আছে মা। তবে একটা কথা। দু চারদিন পরে তো আমাকে অফিসে যেতেই হবে। আর তখন নূরের পাশে থাকার মতো তেমন লোক নেই। তাই বলছিলাম আপনি না থাকলেও নিলা নাহয় কিছুদিন আমাদের এখানেই থাকুক। নূর যতদিন পুরোপুরি ভাবে এই বাসায় কম্ফোর্টেবল না হয়ে যায়। ততদিন নিলা এখানেই থাকলে ভালো হতো। আমিও একটু নিশ্চিত হয়ে অফিসে যেতে পারতাম। আই প্রমিজ নিলার কোন সমস্যা হবে না এই বাসায়।

নাজমা বেগম একটু ভেবে বললেন।
–হ্যাঁ এটা করা যায়। করোনার জন্য নিলার কলেজও আপাতত বন্ধোই আছে। তাই ওর তেমন সমস্যা হবে না। ঠিক আছে আমি ওর সাথে কথা বলে নেব। ও নূরের কাছে থাকলে আমারও একটু চিন্তা কম হবে।

–থ্যাংক ইউ সো মাচ মা।

–ঠিক আছে যাও, নূরের কাছে যাও।

আদিত্য মাথা নেড়ে উঠে গেল।

নাজমা বেগম পেছন থেকে তাকিয়ে রইলো। তার মেয়ের ভাগ্যটা যে এতো ভালো তা জানা ছিলো না তার। ছেলেটা কেমন পাগলের মতো ভালবাসে মেয়েটাকে।একটু অসুস্থ হওয়ায় কেমন পাগলের মতো হয়ে গেছে। আল্লাহ যেন ওদের ভালো রাখে।

চলবে……

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here