মায়ায় জড়ানো সেই তুমি পর্ব -০৫

#মায়ায়_জড়ানো_সেই_তুমি
#পার্ট_৫
জাওয়াদ জামী

তানিশাকে দেখে সবাই যেমন একদিকে অবাক হয়েছে, তেমনি ভিষণ খুশিও হয়েছে। কতদিন পর মেয়েকে কাছে পেল বাবা-মা। তানিশার দাদি তো থেকে থেকে কেঁদে উঠছেন। তানিশার বাবা তালিব শেখ মেয়েকে সেই যে জড়িয়ে ধরেছেন ছাড়ার নাম নেই। ছোট ভাই-বোনরা আনন্দে লাফালাফি শুরু করেছে।

এদিকে তানিশার মা ব্যস্ত ড্রাইভারের আপ্যায়নে। কারন কিছুক্ষণ পরই তিনি রওনা দিবেন।

” ও বোইন, তুমি এত শুকায় গেছো ক্যা? ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করোনা? ”
” সব ঠিকঠাক মতই করি দাদি। কিন্তু পড়ার অনেক চাপ। অনেক পড়তে হয়। ”
” তোমার শ্বশুর বাড়ির সবাই ভালা আছে? নাতজামাই আসলনা যে? ”
” সবাই আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে। তোমার নাতজামাই ব্যস্ত মানুষ। শুক্রবার ছাড়া কোন ছুটি নেই। তাও কোন কো শুক্রবারেও তো অফিস করতে হয়। তার কোথাও যাবার সময় নেই। ”
কথার মাঝখানে ফোন বেজে ওঠে। জামিল চৌধুরী ফোন করেছে তানিশা পোঁছেছে কিনা জানতে। পুরো রাস্তায় অন্তত দশবার ফোন করেছেন তিনি। তানিশা কিছুক্ষণ শ্বশুরের সাথে বলা বলে।

রাত বারোটা বেজে তিপ্পান্ন। পুরো গ্রাম ঘুমের দেশে পাড়ি জমিয়েছে। এ বাড়ির সবাই ঘুমিয়েছে সেই কখন। শুধু জেগে আছে তানিশা। একটু পরপর ফোন চেইক করছে। এই বুঝি সাদিফ ফোন করেছে। কিন্তু ও ভালো করেই জানে সাদিফ কখনো ওকে ফোন দিবেনা। তবুও মন আশা জাগায়। আসলে মনটা যে এমনই। শরীর বেঁধে মনকে কোনভাবেই বেঁধে রাখা যায়না। মন যেন এক পাগলা ঘোড়া। কোন বাঁধনই মানেনা। তানিশার মস্তিস্ক বলছে, সাদিফ কখনোই ফোন করবেনা। কিন্তু মন বলছে, তুই আশায় বুক বাঁধ
অধরা সুখ তোর কাছে ধরা দিবে। সাদিফ ফোন দিবে তোকে। মাঝরাত পর্যন্ত অপেক্ষা করে তানিশা। এরপর ভগ্নহৃদয় নিয়ে ঘুমিয়ে পরে।

সকালে অফিস যাওয়ার জন্য রেডি হচ্ছে সাদিফ। অন্যদিন তানিশা থাকতে হাতের কাছে সব গুছিয়ে রেখে দিত। সাদিফ আলমারি এলোমেলো করছে কিন্তু প্রয়োজনীয় কিছুই খুঁজে পাচ্ছেনা। রেডি হয়ে নিচে নামতে নামতে দশটা বেজে যায়। তার নিজের উপরই একরাশ রা*গ এসে ভর করে। এদিকে অফিস শুরু নয়টায়। আর দেরি না করে, না খেয়েই অফিসে চলে যায়।

এদিকে শায়লা চৌধুরী ছেলের না খেয়ে চলে যাওয়ায় মনঃক্ষুণ্ন হয়। তার তো আর সেই ভোর থেকে রান্না করার অভ্যাস নেই। তানিশা আসার আগ পর্যন্ত আরেকজন রান্নার মেয়ে ছিল। তার কাঁধে এ বাড়িতে কে কি খাবে তার ভার ন্যাস্ত ছিল। কিন্তু সেই মেয়ে বিয়ের পর জামাইয়ের পরিবারের কাছে চলে যায়। তার দিন সাতেক পরই তানিশা বউ হয়ে এই বাড়িতে আসে। তারপর থেকে তানিশা সংসারের সবার দ্বায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়েছে।
” মম, আমার স্যালাড আর জুস কই? কত বেলা হয়েছে দেখেছো! নিয়ম করে না খেলে আমার চেহারা নষ্ট হয়ে যাবেনা! ” চিরাচরিত ন্যাকা স্বরে বলে সাইরা।
” স্যালাড তৈরী করা হয়নি। তুই আজ খিচুড়ি খেয়ে নে। কাল স্যালাড খাস। ”
শায়লা চৌধুরীর কথা শুনে ফুঁসে ওঠে সাইরা।
” মম! এসব কি বলছো! সকাল সকাল খিচুড়ি খেলে আমার ফিগার নষ্ট হয়ে যাবেনা! তুমি মম হয়ে এমন কথা বলতে পারলে! ”
” সাইরা, তুই নিজের জন্য সালাদ তৈরী করতে পারিসনা? তোর মা সকাল থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত আছে। আর তুই এসে ওকে হুকুম করছিস? তুই এতটাও ছোট নেই যে নিজের খাবার নিজে তৈরী করতে পারবিনা। ” জামিল চৌধুরী মেয়েকে একটু শাসায়।
” ড্যাড! এসব তুমি কি বলছো! আমি কি কখনো এসব করেছি না-কি! এসবে আমার মোটেও অভ্যেস নেই। ”
” অভ্যাস কারো থাকেনা, করে নিতে হয়। কি বলতো, বউমা নেই একদিন হলো, এতেই তোদের খাবারের ঘাটতি পরেছে। একজন না খেয়ে অফিস চলে গেল। আমার অফিস নয়টায় কিন্তু এখন দশটার বেশি বেজে গেছে। আর সামনে এই খিচুড়ি নিয়ে বসে আছি। তোদের মুরোদ কতটুকু আমার বোঝা হয়ে গেছে। তাই সময় নষ্ট না করে এখন থেকেই কাজ করার অভ্যাস কর। বউমার মত কাজের হ বুঝেছিস। ”
” ড্যাড! তুমি ঐ মেয়ের সাথে আমার তুলনা করছ! ঐ মেয়ের যোগ্যতা কি আর আমার যোগ্যতা কি তুমি ভেবে দেখছো? তুমি কার সাথে কার তুলনা দিচ্ছ। একটা গাঁইয়া মেয়ের জন্য নিজের সন্তানকে কথা শোনাচ্ছ। ”
” চুপ কর বেয়াদব মেয়ে। কাকে কি বলছিষ একবারও ভেবেছিস? ঐ গাঁইয়া মেয়ে তোর ভাবি এই কথা মাথায় ভালোভাবে ঢুকিয়ে নে। আর যোগ্যতার কথা বলছিস? তোর কি যোগ্যতা আছে? ঐ গাঁইয়া মেয়ের পাশে দাঁড়ানোর মত যোগ্য তুই? আজ যদি আমি মরে যাই কোন যোগ্যতার তুলনা দিবি তোরা? আমি ছাড়া তোরা তো শূন্য। আর ঐ মেয়ে নিজের যোগ্যতায় এ পর্যন্ত এসেছে। তুই এত……..
জামিল চৌধুরীর কথার মাঝেই শায়লা চৌধুরী বলতে শুরু করে, ” কি শুরু করেছ তুমি? তোমার মেয়ে সেই ছোটটি নেই সে কথা মাথায় আছে তোমার? এত বড় মেয়ের সাথে দুর্ব্যবহার করছ। পাগল হয়ে গেছো তুমি? একটা বাইরের মেয়ের জন্য তুমি অশান্তি করছ? ”
জামিল চৌধুরী ভালোভাবেই জানে এরা কেউই তানিশাকে পছন্দ করেনা। তাই আর কথা বাড়ায়না। তার ইচ্ছেও করছেনা এত নিচু মানসিকতার মানুষের সাথে ঝগড়া করতে। শুধু হালকা হেসে বলেন, ” তুমি নিজেও অমানুষ আর সন্তানদেরও অমানুষ হিসেবেই গড়ে তুলেছ। আমারই ভুল তোমার মত নিচ মানসিকতার মানুষকে এতদিন সহ্য করেছি। আল্লাহ না করুন এর ফল যদি ভোগ করতে হয়? পারবেতো ভোগ করতে? ” কাউকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে যায়। তার আর খাওয়া হয়না।
শায়লা চৌধুরী একদম স্তব্ধ। আজ পর্যন্ত তাকে এভাবে কেউ বলেনি!
সাইফ এতক্ষণ সিঁড়ির গোড়ায় দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। সে নিজেও অবাক! ওর বাবা এভাবে বলল! আজ এ বাড়িতে সকালটা যেমন ভাবে শুরু হয়েছিল বেলা গড়াতেই সময় তার রুপ বদলে দিল।

তানিশা একমনে ক্ষেতের আইলের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। কতদিন পর এভাবে হাঁটছে। দুইপাশের ক্ষেতের ধান ছুঁয়ে উড়ে আসা ঠান্ডা হাওয়া তানিশার শরীরে কাঁপন ধরাচ্ছে। ওড়নাটা ভালোভাবে জড়িয়ে নেয় শরীরে। ওর গন্তব্য দত্ত কাকার পুকুর পাড়। সেখানে কিছুক্ষণ পা ডুবিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করছে।

ইশানের আজ চাকরির ইন্টারভিউ চলছে। ফুলবাবু সেজে ওয়েটিং রুমে বসে আছে। একে একে প্রার্থীরা ভেতরে যাচ্ছে আর কিছুক্ষণ পর বের হচ্ছে। এখানে আসার আগ পর্যন্ত নিজের উপর আত্মবিশ্বাস ছিল হাই লেবেলে। কিন্তু এত প্রার্থী আর তাদের ইন্টারভিউ শেষে বেরিয়ে আসার পরের চেহারা দেখে সব আত্মবিশ্বাস ফুসসসসস। নিজেকে স্বাভাবিক রাখতে লম্বা করে শ্বাস নেয়। কিন্তু এতে কোন কাজ হয়না। অগত্যা পকেট থেকে ফোন বের করে।
শাহানা সিদ্দিকা নিজ রুমে জায়নামাজে বসে আছে। ছেলেটা ইন্টারভিউ দিতে গেছে তাই সব কাজ ফেলে নফল নামাজ আদায় করছে। সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতেই ফোনের রিংটোন বেজে ওঠে। ইশান ফোন দিয়েছে!
” হ্যালো মাদার বাংলাদেশ। আমার ভিষণ টেনশন হচ্ছে। একটু মাথায় ফুঁ দাওতো। সব টেনশন হাওয়ার মত নাই হয়ে যাবে। ”
শাহানা সিদ্দিকা ছেলের কথায় মুচকি হেসে বলে, ” বাপ আমি কি এখন তোর সামনে আছি যে ফুঁ দিব। আমি এমনিতেই দোয়া করছি, তুই ঠিক পারবি। ”
” উঁহু তা বললে তো হবেনা। আমি ফোন মাথায় ধরছি তুমি ফটাফট ফুঁ দাও। কুইক মাদার বাংলাদেশ। আমি ফোন মাথায় নিলাম। ”
ছেলের এমন পাগলামিতে শাহানা সিদ্দিকার মনে সুখের জোয়ার বয়। তিনি কয়েকটা দোয়া পড়ে ফোনেই ফুঁ দেন। বেশ খানিকক্ষণ ইশান মাথায় ফোন ধরে রাখে। শাহানা সিদ্দিকাও ফোন কানে চেপে রেখেছে।
” মাদার বাংলাদেশ এবার আমার শান্তি লাগছে।তুমি দেখো আমার ইন্টারভিউ ঝাক্কাস হবে। তোমার ছেলে ইন্টারভিউ না দিলেও ফার্ষ্ট হবে। ” ইশান ফোন কেটে দিলে শাহানা সিদ্দিকা একমনে প্রার্থনা করতে থাকে ছেলের জন্য।

তানিশার মা কয়েকরকম পিঠা তৈরী করেছে। বাড়ির মুরগী জবাই করেছে। নিজেদের ক্ষেতের কালো জিরা চালের পায়েসও করেছে। ছোটবেলা থেকেই তানিশার পায়েস খুব পছন্দের।
তানিশা এত আয়োজন দেখে হেসে ফেলে।
” ও মা, তোমার মেয়ে রাক্ষস নাকি! এত কিছু একদিনেই করেছ! নাকি আমাকে তারাতারি তাড়ানোর চিন্তা করছো? ”
” দেখতো মেয়ের কথা! কতদিন পর তুই আইলি ক দেখি? আমার মনে চায়না তোরে ভালমন্দ রান্না করে খাওয়াই। মুখটা কেমন শুকায় গেছে। ঠিকমত খাওয়া-দাওয়া করিসনা তা আমি বুঝছি। ”
তানিশা কথা ঘুরিয়ে বলে, ” একটু পায়েস দাওতো মা খেয়ে দেখি। আর তিয়াসা, তৃষ্ণা, তানিম ওরা কোথায়? ভাই-বোনেরা মিলে একসাথে খাব কি না। ওদেরই পাত্তা নেই। ”
আয়েশা খাতুন বাটিতে পায়েস তুলে মেয়ের কাছে দেয়।

রাতেও ভাঁপা পিঠা তৈরী করছে আয়েশা খাতুন। ছেলে-মেয়েরা চুলার চারপাশে বসে আছে। তানিশার দাদি বারান্দায় বসে নাতি-নাতনীদের দেখছে। কার্তিক মাসের শেষের দিকে হালকা শীতের আমেজ পাওয়া যাচ্ছে। ঠান্ডা বাতাস মাঝে মাঝে শরীরে ধাক্কা মারতেই ওরা শিউরে উঠছে। আবার একটু কিছুতেই হেসে কুটিকুটি হচ্ছে। পিঠা বানানো আর খাওয়ার পর্ব রাত এগারোটা পর্যন্ত চলতে থাকে।

রাত সাড়ে এগারোটায় সাদিফ বাড়ি ফিরে। রহিমা খালা দরজা খুলে দেয়। কেউ ওর জন্য অপেক্ষা করছেনা দেখে অবাক হয়।
” আব্বা ফেরেশ হইয়া আসেন। আমি খাওন দিতাছি। ”
” খালা ওইটা ফেরেশ না ফ্রেশ হবে। ”
” আমি মুরুক্ষ্যু মানুষ আব্বা। অতকিছু জানিনা। আপনে তারাতারি আসেন। ”
আচ্ছা খালা।

রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করতেই অন্ধকার গ্রাস করে সাদিফকে। দেয়াল হাতড়ে সুইচ অন করে।
হাতের ব্যাগ রেখে সোজা বাথরুমে ঢোকে। সময় নিয়ে ফ্রেশ হয়।

খাবারের প্লেটের দিকে তাকিয়ে আছে সাদিফ। এক লোকমা ভাত মুখে দিয়েই খাওয়ার ইচ্ছে মরে গেছে। তরকারিতে বেশ ঝাল হয়েছে। সাদিফ মোটেও ঝাল খেতে পারেনা। প্লেটেই হাত ধোয় সাদিফ। এদিকে ক্ষুধায় পেটে ইঁদুর-বিড়াল খেলছে। ফ্রিজ থেকে দুইটা আপেল নিয়ে রুমে আসে।

আপেলে কামড় দিতে দিতে ল্যাপটপ নিয়ে বসে। অফিসিয়াল কাজ করতে থাকে। কিন্তু কিছুক্ষণ পর আর কাজে মনযোগ দিতে পারেনা। কেমন যেন লাগছে। কিন্তু বুঝতে পারেনা। ল্যাপটপ অফ করে শুয়ে পরে। কিন্তু তবুও ভালো লাগছেনা।
অথচ গতকাল তানিশা যাওয়ার পর ভেবেছিল, কয়েকদিনের জন্য নিজের মত করে থাকতে পারবে। এই রুমে, খাটে, ওয়াশরুমে, বারান্দায় কেউ ভাগ বসাতে পারবেনা। এখনতো তানিশা নেই তবুও এমন অস্থির লাগছে কেন!

চলবে…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here