মারিয়া
পর্ব:- ১৪
কলমে:- সায়ীদা নুহা।
~~~~~~~~~~~~~~
নিস্তব্ধ রাস্তায় নিয়ন আলোর বাতি জ্বলছে। পরিচিত পথ ধরেই কেউ একজন হেঁটে যাচ্ছে দ্রুত। তার মধ্যে ধীরতা নেই! পায়ের শব্দ হচ্ছে না। জুতার নিচে ছোটো কাপড় বেঁধে নিয়েছে সে, যেন কোনো প্রকার শব্দ না হয়!
বাড়ির পেছনের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে সোজা। ইট দিয়ে উঁচু করে পিলারে উঠে যায়। টপকিয়ে নিচে লাফ দেয়। শুকনো পাতার মর্মর আওয়াজ হলেও এদিকে কেউ আসবে না। তবুও সে দ্রুত অন্যপাশে বড়ো মোটা গাছটার পিছনে লুকিয়ে পড়ে। তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে আশপাশে নজর বুলায়। কেউ আসছে না তো আবার! তার দু’চোখের দৃষ্টি সতর্কতার সাথে চারিদিক পর্যবেক্ষণ করছে।
এগিয়ে যায় সে। গুটি গুটি পায়ে সেদিনের মতো বাড়ির পিছনের গেট পেরিয়ে সামনে চলে আসে। সদর গেটের সামনেই দারোয়ান বসে চা খাচ্ছে। তার গায়ে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে রাখা। ধীরপায়ে ইয়াসির দারোয়ানের দৃষ্টির আড়াল হয়ে ভেতরে ঢুকে যায়। সোজা স্টোররুমের দিকে ছুটে যায়।
~•~
মারিয়ার মুখের টেপ খুলে দিয়েছিল মর্গান। মেয়েটাকে নিয়ে সে শেষবার মহানন্দে খেলায় মেতে উঠতে চাইছে! তার জন্য তো পর্যাপ্ত শক্তি দরকার তাই না? এজন্যে দারোয়ানের স্ত্রীকে দিয়ে তার গা মুছিয়ে নিজের মেয়ের কাপড় পরিয়ে আবার এখানে নিয়ে আসা হয়েছে। চাচিকে বারবার মারিয়া অনুরোধ করছিল,
“চাচি, আপনি তো আমাকে অনেক আদর করেছেন। আপনিও কেন এমন করছেন? আমাকে যেতে দিন!”
মহিলা বিরক্তির সাথে বলল,
“হো তোমারে যাইতে দেই আর আমার গলা কাটুক?”
মারিয়া আর কিছুই বলল না। ওরাও হয়তো কোনোভাবে এই খারাপ কাজে আটকে গেছে। মহিলাটি মারিয়ার গা মুছে দেওয়ার সময় তাকে একবার দেখে নেয়। গায়ে রশ্নির লাল দাগ ফুটে উঠছে! এতক্ষণ বেঁধে রাখার কারণে সে হাত পা কিছুই ঠিকমতো নাড়াতে পারছে না। একটু জোরে কাপড়ের ঘষা দিতেই কাইকুই করছে। এসব দেখেও মহিলাটির মনে একবিন্দু মায়ার উদ্রেক হলো না। বরং সে দ্রুত তার কাজ শেষ করতে ব্যস্ত!
খাওয়ার পর আবার মারিয়াকে চেয়ারে এনে বেঁধে রাখে মর্গান। শুধু মুখে টেপ লাগায়নি। মহিলাটি চলে যেতেই মারিয়া মর্গানের দিকে শীতল চোখে তাকিয়ে বলল,
“এমন কেন করছেন? আমাকে এখানে কেন এনেছেন? আপনি কী চান?”
কানে এক আঙুল চেপে ধরে রাখে মর্গান। সে কারো টাকায় কেনা চামচা না যে, যার তার প্রশ্নের উত্তর দিবে। মারিয়া থেমে যেতেই সে কান থেকে আঙুল সরিয়ে নিজের মতো দাঁড়িয়ে রইলো।
মারিয়া এবার হিচকি দিয়ে কেঁদে উঠে,
“ছেড়ে দিন না আমায়? একটু দয়া করেন না?? আমি তো আপনার মেয়ের সমান!”
খ্যাক করে তাচ্ছিল্যের সুরে হেসে উঠে মর্গান। মারিয়া থামে না। চিৎকার জুড়ে দেয়। মর্গানের মুখে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে ঠায় দাঁড়িয়ে মারিয়ার স্পর্শকাতর জায়গায় চোখ বুলাতে ব্যস্ত! সে যে এখনই পশুর মতো মেয়েটার উপর ঝাপিয়ে পড়ছে না তাই তো অনেক!
মারিয়ার আর্তচিৎকার তার মনোভাব এক ইঞ্চিও বদলাতে পারলো না। একটা সময় ক্লান্ত হয়ে মারিয়া হেলে পড়ে। শেষবারের মতো সে গোগণবিদারি চিৎকার দিবে। এরপর যদি মর্গান তাকে ছেড়ে দেয়, এক দৌড়ে সে সব ছেড়ে চলে যাবে। আর যদি কিছুই না হয়, সে অপেক্ষার প্রহর গুনবে…. মৃত্যুর!
জোরে নিঃশ্বাস নিয়ে চিৎকার দিতেই হুট করে কিছু বাড়ি খাওয়ার শব্দ হলো। চেয়ার বেয়ে রক্ত চুঁইয়ে চুঁইয়ে ফ্লোরে পড়ছে। মারিয়ার মাথা একপাশে হেলে যায়। কান থেকে গরম রক্ত পড়ছে। বাড়িটা মাথার একপাশে পড়েছে। মর্গান এত ঢং সহ্য করতে না পেরে হাতের কাছে থাকা কাঠের লম্বা জিনিসটা দিয়েই মারিয়ার মাথায় আঘাত করে। ভাগ্যিস, জিনিসটা কাঠের ছিল। কাঠের একটু অংশ ভেঙে মারিয়ার কপালের ভেতর দিয়ে ঢুকে লেগে আছে। জায়গাটায় সূক্ষ্ম ব্যথা! কেউ বুঝি সুঁই ঢুকিয়েছে!
“ফাকিং বাস্টার্ড” বলে বিশ্রী একটা গালি দিলো মর্গান। এরপর রুম থেকে বেরিয়ে চলে গেল।
মারিয়া এখনও ওভাবেই পড়ে আছে। মরে গেল না কেন সে? এখনও কেন তার নিঃশ্বাস উঠানামা করছে? এত ব্যথা, এত… তার তো মরে যাওয়ার কথা! কেন সৃষ্টিকর্তা তাকে দিয়ে এসব সহ্য করাচ্ছেন?
~•~
শব্দটা তো ভেতর থেকেই আসলো। ইয়াসির পিছন ফিরে তাকায়। মর্গান কি কিছু করেছে মারিয়ার সাথে? সে কি ভেতরে? এই মুহূর্তে ইয়াসিরের কি ভেতরে ঢুকা ঠিক হবে? কিন্তু যদি মারিয়ার সাথে খারাপ কিছু করা হয়?
ভেতরে ঢুকবে তখনই ইয়াসিরের কানে জুতোর শব্দ ভেসে আসে। কেউ এদিকেই আসছে বুঝতে পেরে সে অন্যপাশে লুকিয়ে পড়ে। এমনিতেও এই দিকটা অন্ধকার, রুমের বাতি সব নিভিয়ে রাখা। মর্গান কোনো কিছু লক্ষ না করে বেরিয়ে যায়। আজকে রাতে কোনো মজাই করা হলো না তার! শিট বলে বিড়বিড় করে বেরিয়ে যায় সে। মর্গান চলে যেতেই ইয়াসির রুমের ভেতরে ঢুকে। দৌড়ে মারিয়াকে যেখানে বেঁধে রাখা সেখানে গিয়ে দাঁড়ায়। হায় আল্লাহ্, এ কী দেখছে সে! “মারিয়া” বলে চাপাস্বরে ডাক দিলো সে।
মারিয়ার কানে হঠাৎ-ই চিরচেনা একটা কণ্ঠ ভেসে আসে। কোনরকম চোখ মেলে তাকায় সে। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা! কিছুই দেখতে পাচ্ছে না সে। শুধু অনুধাবন করতে পারছে, একটা অবয়ব তার দিকেই এগিয়ে আসছে। মারিয়ার অনুভূতি জাগ্রত হয়! ঠোঁটে খানিক হাসি ফুটে উঠে। অবশেষে সে কি তাকে বাঁচাতে এলো? সে স্পষ্ট বুঝতে পারে, কেউ একজন তার কপালে আঙুল ছুঁইয়ে দিচ্ছে। তার দিকে পলকহীন চোখে তাকিয়ে আছে। মারিয়ার ভ্রম হয়! নিজেকে দুনিয়া থেকে বহুদূরে সরিয়ে নেয়। তার মন মস্তিষ্ক কিছুই কাজ করছে না!
ইয়াসির কাঁপা কাঁপা হাতে মারিয়ার বাঁধন খুলে দেয়। কপালে লেগে থাকা কাঠের কঞ্চিটা বের করে আনে। নিজের শার্ট খুলে মারিয়ার মুখে গলায় লেগে থাকা রক্ত মুছে দেয়। এই সময় সে নির্বাক! তার ভেতর পুড়ছে। কিন্তু সে বোকা বনে আছে। কী করবে কিছুই বুঝতে পারছে না সে। মারিয়ার দিকে তাকিয়ে শুধু বলল,
“আর একটু সহ্য করো। আমি তোমাকে এখান থেকে নিয়ে যাব!”
মারিয়ার মুখেও কোনো কথা নেই। সে চোখ বুজে ইয়াসিরকে ইশারা করলো; সে ভীষণ ভরসা করে তাকে!
ইয়াসির উঠে দাঁড়ায়। সময় নষ্ট না করে সে বাড়ির বাহিরে ছুটে আসে। ভেতরে একটুও নেটওয়ার্ক নেই! সেই সিবিআইয়ে কর্মরত আঙ্কেলকে ফোন করে। একমাত্র তিনিই যা করার করতে পারবেন। এত রাতে ফোন পেয়ে তিনি কিছুটা ঘাবড়ে যান। ফোন রিসিভ করে সব শুনতেই বললেন,
“ইয়াসির তুমি আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা করো। আমি এখনই পুলিশ ফোর্স পাঠাচ্ছি, আর আমি নিজেও আসছি।”
লোকেশন শেয়ার করে ইয়াসির আবার ভেতরে চলে যায়। মারিয়ার সামনে হাঁটু গেড়ে বসে। গালে হাত চেপে বলল,
“ভাগ্যিস, আমার সন্দেহ ঠিক ছিল!”
মারিয়া ফিক করে হেসে দেয়। হাসির দমক আসতেই তার গলা দিয়ে রক্তের দলা বেরিয়ে আসে। ইয়াসির হাতে চেপে ধরে। মারিয়ার শরীর ছেড়ে দিচ্ছে। ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে সে। ব্র্যান কাজ করা থামিয়ে দিচ্ছে। ধীর কণ্ঠে ইয়াসিরকে কাছে আসতে বলে সে, ইয়াসির এগোয়। মারিয়ার মুখের কাছে কান পেতে ধরে।
মারিয়া ফিসফিস করে বলল,
“খুব ভালো আপনি। চলে যান। পাগলটা এসে পড়বে। আমি চাই না আপনার কিছু হোক!”
বসা থেকেই ইয়াসির শক্ত করে মারিয়াকে বুকে চেপে ধরে। মারিয়া চোখ বুজে। হয়তো সময় নেই! তার হাত পা অসাড়ের মতো লাগছে। পুরো শরীরের ভর ইয়াসিরের বুকে ছেড়ে দেয়। ইয়াসির চেয়ার থেকে নামিয়ে নেয় তাকে। নিজে ফ্লোরে বসে মারিয়াকে জড়িয়ে রাখে। হুট করে কেন তার ভেতর কাঁপছে সে জানে না! তার প্রেয়সী মারিয়াকেও কখনও সে এত কাছ থেকে ছুঁতে পারেনি! দুরত্ব ছিল… খুব বেশি! মর্গানের ভয়ে মারিয়া সবসময় তটস্থ থাকতো। দু’জনের মাঝে ঢের দুরত্ব বজায় ছিল!
ইয়াসিরের মুখে একটা কথাও ফুটছে না। ইচ্ছে করছে চিৎকার করতে। কিন্তু তাও পারছে না। মারিয়াকে অনেক, অনেক কথা বলতে মন চাইছে। কিন্তু পরিস্থিতি অনুকূলে! ভাবনার রেশ কাটে ইয়াসিরের। বাহিরে বুট জুতোর দপাদপ আওয়াজ হচ্ছে। তার চোখে উজ্জ্বলতা বৃদ্ধি পায়। আশার আলো ফুটে মনে! এইতো, তারা এসে পড়েছে।
চলবে…
(এইটাও কি ছোটো হয়ে গেছে?!)