#মায়াবতী
#পর্ব_৬
#সুলতানা_পারভীন
দেখতে দেখতে কয়েকটা মাস কেটে গেল। রাহাতেরও যেন তার মায়াবতীর ঘোর লেগে গেছে। আগে তার রাতটা কাটতো নাইট ক্লাবে বন্ধুদের সাথে ড্রিংকস আর আড্ডা এসব করে করে। আর দিনটা শুরুই হতো কোন কোকিল কণ্ঠীর কল রিসিভ করে৷ আজকাল এসব আর হয় না। সকাল হতেই নাস্তা করে অফিসে ছোটে রাহাত। রাতে ৯টা বাজলে মায়াকে নিয়ে বের হয় অফিস থেকে। ওকে ফ্ল্যাটে ড্রপ করে বাসায় যায়। আড্ডা, ড্রিংকস, মেয়ে, ক্লাব সব যেন পিছে ছেড়ে এসেছে রাহাত। শুধু এই মায়াবতীটার জন্য? ভাবতেই অবাক লাগে রাহাতের।
রাহাত অফিসে নিজের রুমে বসে এসব ভাবছে আর নিজের মনেই হাসছে। কি জাদু করেছে এই মেয়েটা ওকে? মেয়েটা সামনে না থাকলে যেন সময়টা কাটতেই চায় না। রাতটা যে কি করে কাটায় সে কেবল রাহাত নিজেই জানে। এই যে এখনও সময়টা কাটছে না। মেয়েটা কখন রুমে গেছে! আসে না কেন? রাহাত হাতের ঘড়িতে সময় দেখলো। আধা ঘন্টার কিছুটা বেশি হচ্ছে। এখন আসতে বললে না মেয়েটা রেগে যায়! বলা যায় না! এ মেয়ের যা রাগ! কথায় কথায় খালি ‘কাল থেকে আর অফিসে আসবো না’ বলে হুমকি দেয়। উফ!
রাহাত টেলিফোনটা কানে তুলে ১ প্রেস করলো। কলটা হতে হতে একসময় কেটে গেল। রাহাত ও মনের আনন্দে ১ থেকে ১০ পর্যন্ত গুনতে লাগলো। গোনা শেষ হতেই রাহাতের ভ্রু কুঁচকে গেল আপনাআপনিই। এর আগে এমন কখনো হয় নি৷ প্রতিবার রাহাত কল করে ১০ পর্যন্ত গুনে শেষ করার আগেই মায়া রুমে এসে হাজির হতো। আজ হঠাৎ কি হলো? আবার কল করবে কিনা চিন্তা করতেই ঠোঁটের কোণে বাঁকা হাসি ফুটে উঠলো রাহাতের।
ল্যাপটপটা অন করে মায়ার রুমের সিসিটিভি ক্যামেরার সাথে লিংক করায় মন দিল। মায়া যেদিন ফ্ল্যাটে উঠলো সেদিন অফিসে আসতে পারে নি। সেদিন মায়াবতীকে দেখার জন্য রুমে ক্যামেরা ইনস্টল করিয়েছে রাহাত। সময়ে অসময়ে মেয়েটাকে দেখতে পারার লোভে।
রুমের ফুটেজ চালু হতেই বুকটা ধ্বক করে উঠলো রাহাতের। কি দেখছে সে! মায়াবতীটাকে দেয়ালের সাথে জাপটে ধরে আছে কেউ একজন। আর মায়াবতী নিজেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করছে।। কিন্তু সামনের অমানুষটার থেকে নিজেকে কিছুতেই ছাড়াতে পারছে না। ধস্তাধস্তির আওয়াজের পাশে একটা শব্দ কানে এসে লাগলো রাহাতের।
-ছাড়ুন আমাকে।।
এক ছুটে রুম থেকে বেরিয়ে মায়ার দরজার সামনে চলে এলো রাহাত। দরজাটা লক করা ভিতর থেকে। রাহাত কয়েকবার দরজা জোরে জোরে ধাক্কালো।
-মায়া? মায়াবতী? দরজা খোলো?
কয়েক মিনিট পরে দরজাটা খুলে গেল৷ রাহাত দরজা ঠেলে রুমে ঢুকতেই মায়া একছুটে এসে রাহাতের পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুখ লুকালো। রাহাত মায়াকে একটু আড়াল করে সামনের দিকে তাকালো। ছেলেটার কপালের একপাশ ফুলে গেছে। আর ফ্লোরে একটা ফুলদানি ভেঙে পড়ে আছে। রাহাত গায়ের কোটটা খুলে মায়াকে পড়িয়ে দিল। এক সেকেন্ডের জন্য মায়ার মুখটায় চোখ পড়েছে ওর। চোখে মুখে আতঙ্ক। চুল এলোমেলো হয়ে আছে। আর গালে আঙুলের ছাপ বসে আছে। রাহাত এগিয়ে গিয়ে ছেলেটার শার্টের কলার ধরে টানতে টানতে বাইরে আনলো। সাথে চড়, থাপ্পড়, কিল, ঘুষি সব চলছে।
রাহাতের আওয়াজ শুনে অফিসের সবাই বসার রুমটায় এসে জোট হয়েছে। রাহাত টেনে এনে ছেলেটাকে সবার সামনে এনে ফেললো। ছেলেটা হুমড়ি খেয়ে সোফার উপর পড়লো। রাহাত রাগের চোটে কথাই বলতে পারছে না। কেউ ভয়ে ওর কাছে কিছু জিজ্ঞেস করারও সাহস পাচ্ছে না। রাহাত মায়ার রুমের দিকে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো।
-গার্ডস?? এ যেন এখান থেকে এক পা ও নড়তে না পারে–। ফাস্ট এইড দাও–। আমি আসছি একটু পরে-।
রাহাত রুমটার দরজা দিয়ে বের হতেই সবার কথা ফুটলো যেন। আলোচনা শুনে রাহাত থমকে দরজার বাইরেই দাঁড়িয়ে গেল।
-দ্বীপ স্যার? কি হয়েছে? আর রাহাত স্যারই বা এমন করছে কেন?
-আর বলো না–। আমি কাজ করছিলাম–। নতুন পি.এ টা আমাকে রুমে যেতে বলায় আমি ওর রুমে গেলাম। মেয়েটা বদের হাড্ডি৷ দরজা বন্ধ করে নিজেই কাহিনী শুরু করেছে–। এর মধ্যে স্যার কেন এলেন কে জানে! স্যার আসতেই এই মেয়ের ভরং একেবারে বদলে গেল-। স্যারের কাছে আমাকে কালার করেছে—। স্যারকে তো জানো? উনি রেগে গিয়ে এসব—-।
রাহাত আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারলো না। মায়ার রুমে এসে দাঁড়ালো। মেয়েটা এখনো একই জায়গায় শকড হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাহাত আলতো করে তার মায়াবতীর গালে হাত ছোঁয়াতেই মায়া আঁতকে উঠে তাকালো রাহাতের দিকে।
-এই মায়াবতী? আমি তো—–?
-স্যার?
-এসো তো? এখানে বসো—।
রাহাত মায়াকে একটা চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে কি মনে হতেই উঠে দাঁড়ালো।
-তুমি ১ মিনিট অপেক্ষা করো? আমি এক্ষুণি চলে আসবো–।
——————————-
-ভয় নেই—। আর কেউ আসবে না—।
রাহাত নিজের রুম থেকে ফাস্টএইড বক্সটা নিয়েই ছুটে আবার মায়ার রুমে চলে এলো। মায়া মাথা নিচু করে কাঁদছে দেখে রাহাত হাঁটু গেড়ে মায়ার সামনে বসে পড়লো। মায়ার হাতটা আলতো করে তুলে ধরলো। হাতে আঁচড়ের দাগগুলো থেকে রক্ত ঝরছে দেখে রাহাতের নিজেরই চোখে পানি চলে এলো। মাথা নিচু করে মায়ার হাতে স্যাবলন লাগাতে শুরু করেছে রাহাত।
-মায়া? কি হয়েছিল?
——————————
-বলবে আমাকে প্লিজ? তোমাকে যে কষ্ট দিবে তাকে খুন করে ফেলবো আমি–। কিন্তু তার আগে সবটা জানা দরকার আমার——।
-আপনার দেয়া ফাইলটা চেক করছিলাম রুমে বসে–। মোটামুটি কাজ শেষের দিকে এমন সময় দ্বীপ স্যার রুমে আসেন—-। আজেবাজে কথা বলছিল আপনার আর আমার নামে—-। আমি উনাকে রেগে গিয়ে চলে যেতে বলেছি–। উনি চলে যাচ্ছিলেন–। পরে খেয়াল করলাম না গিয়ে উনি দরজা লক করে দিয়েছেন—।আমার সাথে জবরদস্তি করার চেষ্টা করে—। আপনার কলটা রিসিভ করতে পারি নি—-। আপনার দরজায় ধাক্কানোর শব্দ শুনে আর কিছু না ভেবে ফ্লাওয়ার ভাসটা হাতের কাছে পেয়ে মাথায় মেরে দিয়েছিলাম—–।
-মায়া? শান্ত হও প্লিজ?
-আমি আর অফিসে আসবো না কাল থেকে–। রেজিগনেশন দিয়ে দিব আজকেই–। সরি স্যার।
রাহাত আলতো করে মায়াবতীকে বুকে টেনে নিয়ে চোখ মুছিয়ে দিল। কিছু বলার ভাষা ওর নেই। কিছু একটা ভেবে উঠে দাঁড়িয়ে মায়ার হাতটা চেপে ধরলো রাহাত।
-চলো?
-কোথায় স্যার?
-চুপ একদম—। এসো আমার সাথে–।
রাহাত মায়াকে নিয়ে বোর্ডরুমে এলো। একটা মাইকে এ্যানাউন্স করলো সবাইকে এই মূহুর্তে বোর্ড রুমে আসতে। আর পিয়নকে বলে এসেছে ওর ল্যাপটপটা নিয়ে আসতে। সবাই একে একে রুমে আসছে। আর রাহাত নিজের ল্যাপটপটা প্রজেক্টারে কানেক্ট করছে। চোখ মুখ থমথমে হয়ে আছে। কেউ ভয়েই কিছু বলছে না। মায়াকে দেখেও সবাই নিজেদের মধ্যে কানাঘুষা করছে। মুখ তুলে একজনকে ইশারা করতেই দ্বীপকে নিয়ে এলে গার্ডরা। চোয়াল শক্ত করে প্রজেক্টরটা চালু করলো রাহাত। আর সবাই হা করে দেখছে কি হচ্ছে। সব থেকে বেশি ধাক্কাটা খেয়েছে দ্বীপ নিজে। এতোক্ষণের এতো কাহিনী এভাবে মাঠে মারা যাবে বেচারা ভাবতেই পারে নি।
চলবে