#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৫
ম্যাসেজের টোন বাজতেই বিদায় নিল গভীর তন্দ্রা। নিভু নিভু চোখে বালিশের পাশ থেকে ফোন তুললাম। ঘৃণায় গুলিয়ে উঠল দেহ। এতরাতে দেখা করতে হবে সেই আগন্তুকের সাথে। বারোটা ছাড়িয়ে একটা ছুঁইছুঁই। বালিশের ফাঁক থেকে ওড়না নিয়ে জড়ালাম। পাশেই ঘুমন্ত বাবুই। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলাম। আমাকে এখন যেতেই হবে, উপায়হীন। রাহাত স্যারের কথা মস্তিষ্কে হানা দিল। দ্রুত তার নাম্বারে একটা মেসেজ করলাম।
‘এই ঠিকানায় অতিদ্রুত চলে আসুন। আমি যাচ্ছি। লোকেশন অন করে রেখেছি। ঠিক পেয়ে যাবেন আমায়।’
এইটুকু মেসেজ করে ব্যাগ বের করলাম কাবার্ড থেকে। ধারালো ছু’রি রাখলাম ব্যাগে। পা টিপে টিপে সন্তর্পনে বেরিয়ে এলাম। রাস্তা ফাঁকা গাড়ি নেই। বাড়ির গাড়ি নেওয়া অসম্ভব। তাই বাবুইয়ের সাইকেলটা নিলাম।
___
“স্বাগতম মিসেস মহতাব, সুস্বাগতম। আসতে কোনো সমস্যা হয়নি তো?”
বলেই অন্ধকার থেকে আলোতে এসে দাঁড়ালেন একজন। বয়স পঁচিশের উর্ব্ধে। গায়ের রং ফর্সাও নয় শ্যামলাও নয়। মাঝামাঝি ধরলেন। চেনা লাগল। কোথাও একটা দেখেছি, কিন্তু কোথায় দেখেছি মনে করতে ব্যর্থ। বেশিক্ষণ দৃষ্টি নিবদ্ধ না করে সরিয়ে নিলাম দ্রুত। তার দিকে তাকাতেও নিজের উপর ঘৃণা লাগছে। তীক্ষ্ণ কণ্ঠে বললাম, “কে আপনি? কেন এইসব করছেন? এত নিকৃষ্ট কাজ করতে পারলেন কী করে?”
খুক খুক করে কাশি দিলেন। আমার চতুর্দিকে ঘুরে সামনাসামনি দাঁড়ালেন। বাঁকা হেসে বললেন, “এত সহজে ভুলে গেলি। সেদিন আমাদের ক্লাবে এসে আমাদের মে’রে গেলি। এত তাড়াতাড়ি ভুলে গেলি।”
অস্পষ্ট স্মৃতি স্পষ্ট হল। নটক নড়ে। এর মুখের মানুষটাকে ভুলে গেলাম কী করে? একেই তো ধ্রুব মে’রেছিল। পুরো গ্যাং জেলখানায় ছিল। বেরিয়ে এল কবে? অস্ফুট স্বরে শুধালাম,
“আপনি জেলে ছিলেন, বেরিয়ে এলেন কবে?”
“আমাকে জেলে রাখা এতই সহজ? অসমাপ্ত কাজটা সমাপ্ত করতে এসেছি।”
“তারমানে ট্রে ফেলে বাবুইয়ের পোশাক নষ্ট করাটাও আপনার প্লান ছিল? কী ক্ষতি করেছে ঐ বাচ্চা মেয়েটা, কেন করছেন এমন।”
“তোর বোনের ক্ষতি করার কোনো ইচ্ছাই আমাদের নেই। আজকে তোর সাথে সমস্ত হিসাব চুকিয়ে, ভিডিও ডিলেট করে দিবো। তবে ততক্ষণ তুই বাঁচতে পারবি না। তোর রুপের অহংকার গুছিয়ে এই নির্জন জায়গায় এসিডে ঝলসে দিবো মুখ। তারপরে পুঁতে দিব মাটিতে।”
তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বললাম, “আপনি জানেন আমি মিসেস ধ্রুব। তারপরেও এইসব করছেন। আগেরবার ধ্রুব আপনার কোনো ক্ষতি করেনি, এবার জানটা নিয়ে ফেরত যেতে পারবেন?”
“ওকে দেখা যাক। ঐ ধর ওকে।”
বলতেই সঙ্গে সঙ্গে কতগুলো ছেলে এসে ঘিরে ধরল আমায়। হতবাক হলাম। কোথায় রাহাত স্যার। হাওয়ার বেগে ছুটলাম।
ফাঁকা রাস্তা দিয়ে প্রবল বেগে ছুটলাম। ছেলেগুলো পেছনে পেছনে আসছে। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসছে ক্রমশ। দৌড়াতে দৌড়াতে ফোনটার দিকে তাকালাম একপলক। রাহাত স্যার কেন আসছে না, বাড়ির থেকে বের হওয়ার সময় তাকে জানিয়েছিলাম। তবুও কেন?
দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ছুটলাম। নির্জন রাস্তাঘাট। চারিদিকে নেই মানবের ছায়া। রক্ত সঞ্চালন থেমে থেমে যাচ্ছে। হিম দিচ্ছে শরীর। তীক্ষ্ণ আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। লেপ্টে গেল চোখের পাতা। দৌড়ানোর গতি হ্রাস পেল। দ্রুত চোখের সামনে হাত রেখে তীক্ষ্ণ আলো তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলাম। ততক্ষণে গাড়িটা অতি নিকটে। পেছনে সাঁই সাঁই গাড়ি। ধাক্কা খেলাম গাড়ির সাথে। না! অ্যাক্সিডেন্ট হলনা। এলোমেলো চুলগুলো হুডের উপর ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ল। ভারি শ্বাস টানলাম। নেতিয়ে পড়েছে শরীর। নিভু নিভু চোখে সামনে দৃষ্টি দিলাম। দুহাতে সরিয়ে নিলাম এলোমেলো চুলগুলো। নিমিষেই ভয় উধাও হয়ে গেল। উঠলাম না। শরীরের সবটুকু ভর হুডের উপর দিয়ে নিশ্চল দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম ধ্রুবের পানে। কেন এসেছে ধ্রুব? এতরাতে এখানে কেন?
আমার ভাবনার মাঝপথে গাড়ি থেকে নেমে এলেন ধ্রুব। ঘনঘন শ্বাস নিয়ে ঝাপটে ধরলাম ধ্রুবকে। ফুঁপিয়ে উঠলাম মুহূর্তে। ধ্রুব ধরলেন না। ততক্ষণে পেছনে গার্ডরা এসে দাঁড়িয়েছে। ধ্রুব টেনে টেনে বললেন,
“এদেরকে এখান থেকে নিও যাও দ্রুত। আমার একটা কাজ আছে, সেটা শেষ করে আসছি।”
পায়ের শব্দ মিলিয়ে গেল হাওয়াতে। শো শো গাড়ির শব্দ নিরব হয়ে গেল। ধ্রুব সময় নিল না, তার বুক থেকে টেনে তুলল আমায়। কিছু বলার পূর্বেই সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসালো গালে। ছলছলিয়ে উঠল চোখ। অসম্ভব রেগে আছেন ধ্রুব, সে কোনো মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারেন সবকিছু। ভয়ংকর দৈত্যের সমান। আমি বোঝানোর উপায় খুঁজে পেলাম না। পুনরায় চড় পড়ল গালে। একের পর এক চড় সহ্য করতে হল। গালে দাগ পড়েছে নিশ্চয়ই। তবুও অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, “শুনুন আমার কাথাটা..
“একদম চুপ অস’ভ্য মেয়ে। নিজেকে কী ভাবিস তুই, সবাই তোর পেছনে কুকুরের মত পড়ে থাকবে? ভালোবাসি বলে সব সহ্য করে নিবো।
যদি জানতাম রাস্তায় এই ছেলেগুলো তোকে ধরবে, তাহলে কক্ষনো আসতাম না।আমি শুধু তোকে জবাব দিতে এসেছি। আমাকে দিয়ে হয়না তোর, আরও লাগে? কান খুলে শুনে রাখ, রাহাতের অজান্তে ফোন থেকে সিমকার্ড খুলে আমার ফোনে অন করেছি। তাই সবটা জানতে পারলাম।”
আমি হতবাক হলাম। ধ্রুব রাহাত স্যারের সিমকার্ড খুলে নিয়েছেন। পরক্ষণেই আমার হাত ধরলেন শক্ত করে। টানতে টানতে গাড়ির ভেতরে নিয়ে গেলেন। ছুঁড়ে ফেললেন। ড্রাইভিং সিটে বসে গাড়ি স্টার্ট দিলেন। স্পিডে চালাচ্ছেন। ভয় করছে আমার। উপায়হীন হয়ে বললাম,
“ধ্রুব প্লীজ আস্তে চালান। আমার ভয় করছে।”
“আস্তে কেন? নাগরের সাথে যাওয়ার সময় মনে ছিলনা।”
“প্লীজ ধ্রুব।”
“রাখ তোর প্লীজ, মুখ থেকে একটা কথা বের হলে আমার চেয়ে খারা’প কেউ হবেনা।” চ্যাঁচিয়ে বললেন।
দমে গেলাম আমি। মাথা নত করে সিট চেপে ধরলাম।
গাড়ি থামতেই হন্তদন্ত হয়ে বেরিয়ে গেলেন তিনি। আমার হাত ধরে পুনরায় হাঁটা শুরু করলেন। তার বলিষ্ঠ পুরুষালি শক্তির কাছে আমি নিছক বাচ্চা! জোরে জোরে হাঁটার ফলে হাতে টান পড়ছে। ড্রয়িং রুমে আনতেই স্টার্ফরা ছুটে এলো। ধ্রুব চোখ রাঙাতেই পিছিয়ে গেল সব। রমিলা আন্টি আমাদের বাড়িতে। তিনি থাকলে আমাকে বাঁচাতে পারতেন।
ঘরে এনে ফেলে দিলেন। মাথানত অবস্থায় বললাম, “প্লীজ ধ্রুব, ট্রাই টু আন্ডার্সট্যান্ট!”
ধ্রুব গ্রাহ্য করলেন না। নিজের পড়নের শার্টটা খুলে ফেললেন। তার শরীর দেখার ক্ষমতা আমার নেই, ভয়ে কুপোকাত। কাঁচের গ্লাসটা টেবিলে আঘাত করে ভেঙে ফেললেন। এক খণ্ড নিয়ে পা টিপে টিপে কাছে এগিয়ে এলেন। আমি ঘামতে লাগলাম। বিছানায় ভর দিয়ে পিছিয়ে গেলাম। ঠেকে গেলাম দেয়ালে। ধ্রুব ওড়না টেনে নিলেন। বেঁধে দিলেন দুহাত। মুখের সামনে কাঁচের খণ্ড ধরলেন। মুখ গুঁজে দিলেন গলায়। এবার শব্দ করে কেঁদে দিলাম। ঝাপসা কণ্ঠে বললাম,
“আমি ভিডিওটির জন্য গিয়েছিলাম।”
ধ্রুব কাঁধ থেকে মুখ তুলে সন্দিহান স্বরে বললেন, “ভিডিও, কীসের ভিডিও।”
“বাবুইয়ের আপত্তিকর ভিডিও।”
“কী বলছ কী? মানে?”
আমি ধীরে ধীরে খুলে বললাম সবকিছু। তাজ্জব বনে গেলেন তিনি। না বোঝার স্বরে বলেন, “এতকিছু হয়ে গেল, আমাকে কেন জানাওনি?”
“আমি কাউকে জানাইনি।”
“রাহাত কী করে জানল?”
“আমার অনুমতি না নিয়ে কালকে ফোন ধরেছিলেন রাহাত স্যার। তারপরে তিনি সবটা জেনেছেন। তাই তো কালকে ঘরের ঐ অবস্থা ছিল।”
বিরতিহীন ভাবে চেয়ে রইলেন। কাঁচের টুকরো ফেলে দিলেন দূরে। চুলগুলো কপালের কাছ থেকে সরিয়ে দিলে চুমু এঁকে দিলেন। অতঃপর দুইগালে অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দিলেন। হাত খুলে ওড়না জড়িয়ে দিলেন গায়ে। সরল ভাষায় বললেন, “এই সামান্য একটা ব্যাপার কেন লুকালে চড়ুই। আমি ঠিক সামলে নিতাম, একবার মুখ ফুটে বলে দেখতে।”
“আমি তখন বলতে চেয়েছিলাম!”
“তখন, যখন ধরা পড়েছ। আ’ম স্যরি চড়ুই। ভেরি ভেরি স্যরি। আ’ই ডিড নট আন্ডার্সট্যান্ট সো মাচ। ফরগিভ মি।”
মাথা নিচু করে রইলাম। প্রত্যুত্তর দিলাম না। তিনি অশান্ত গলায় বললেন, “আমি ভেবেছিলাম তুমি রাহাতের সাথে চলে যাবে কোথাও। ঐ ছেলেগুলোকে দেখে মনে হয়েছে, ওরা তোমার সাথে ..।
ভয় পেয়েছিলাম প্রচুর। তোমাকে হারাতে পারবনা চড়ুই।”
বাহুবন্ধন দৃঢ় করে নিলেন। মানুষটা বড়ই আজব। তবে অভিমানে জর্জরিত আমি। সত্যটা না যেনেই এই ব্যবহার। ছাড়িয়ে নিলাম দ্রুত। এখানে থাকব না, কিছুতেই না। তাছাড়া আজকে যা হল, ঐ ছেলেগুলো নিশ্চয়ই ভিডিও আপলোড করে দিবে। আমি ব্যাগটা বিছানা থেকে তুললাম। তখন হাত থেকে ফোনটা নিচে পড়েছিল।
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]#মেঘমিশ্রিত_পূর্ণিমা 🤎
#ইফা_আমহৃদ
পর্ব: ২৬
“চড়ুই কোথায় যাচ্ছ তুমি? স্যরি বলেছি তো আবারও বলছি, স্যরি। তবুও যেও না।”
ধ্রুবের অসহায় কণ্ঠে পাজোড়া স্থির হল। এক পলক তার মুখের দিকে তাকালাম। আকুতি ভরা চোখের পাতা। যেতে না দেওয়ার হাহাকার, কিন্তু থামানোর অধিকার নেই। আমি তোয়াক্কা করলাম না। থমথমে গলায় বললাম,
“এখানে আমি আসতে চাইনি। কেউ একজন জোর করে নিয়ে এসেছে। সমস্যা সমাধান হওয়ার পরিবর্তে আরও সমস্যার সৃষ্টি করল। সেটাই সমাধান করতে যাচ্ছি।”
ধ্রুব উচ্চ শব্দে ব্যঙ্গ করেন। অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। মাথা চুলকালেন। বিদ্রুপ করে বললেন, “ছেলেদের ভয়ে রাস্তা দিয়ে পাগ’লের মত দৌড়ানো পাবলিক যখন বলে, সমস্যা সমাধান করতে যাচ্ছি। তখন মনে হয়, সুপ্ত আগ্নেয়গিরি। যখন তখন বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।”
ভ্রু কুঁচকালাম। তীক্ষ্ণ দৃষ্টি আকর্ষণ করলাম। তিনি পিছিয়ে গেলেন। আমি ব্যাগ থেকে ছুরিগুলো বের করলাম। কয়েক কদম ফেলে ধ্রুবের গলায় ধরে বললাম,
“আপনি নিজেকে ওভার স্মার্ট ভাববেন না। আমিও কিছুটা জানি।”
ধ্রুব লেপ্টে গেল বিছানায়। সন্দিহান দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললেন, “তুমি এটা দিয়ে কী করবে? ওদের হাতে তুলে দিয়ে বলবে, এটার বিনিময়ে আমাকে যেতে দিন।”
ধ্রুব সোজাসাপ্টা বললেন। আমি ছুরিটা ব্যাগে রাখলাম। পিছিয়ে আসতে নিলেই থেমে গেলাম অতিশয় সূক্ষ্ম আঘাতে। সূচালো বাঁধল পায়ে। জ্বলে উঠল জায়গাটা। স্তব্ধ হয়ে স্থির রাখলাম দৃষ্টি। ধীরে ধীরে ঝাপসা হল সবকিছু। পা উঁচুতে তুলে নিলাম দ্রুত। এতক্ষণ জমিয়ে রাখা অশ্রুধারা এবার গড়িয়ে পড়ল। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে উঠল। স্পর্শ করল গাল। মাটি ভিজে উঠল রক্তে। হাতরে সেন্টার টেবিল ধরে সামলে নিলাম। পলক ফেলার পূর্বেই ধ্রুব জাপটে ধরল আমায়। হা হুতাশ করে বললেন, “কী হয়েছে চড়ুই?”
আমি প্রত্যুত্তর না করে সেভাবেই দাঁড়িয়ে রইলাম। ভর ছেড়ে দিলাম ধ্রুবের উপর। বাহুবন্ধনে আবদ্ধ করে নিলেন। কোলে তুলে বিছানার কিনারায় বসিয়ে দিলেন। পা হাঁটুর উপর তুলে দেখলেন। সংশয়িত গলায় বললেন, “কতটা কেটে গেল, দেখে শুনে হাঁটবে না? এই হাঁটা নিয়ে আবার..
শেষ করলেন না তিনি। উচ্চ স্বরে বললেন, “কে কোথায় আছো, দ্রুত ফাস্ট এইড বক্স নিয়ে এসো।”
ধ্রুব পুনরায় পা দেখতে মনোযোগী হলেন। স্টার্ফরা দরজার কাছে এসে দাঁড়িয়ে রইল নত হয়ে। ধ্রুব স্টার্ফদের পানে না চেয়েই বাজখাঁই গলায় বললেন,
“সমস্যা কী, বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? ভেতরে আসুন।”
ধ্রুবের বাক্য থামার পূর্বেই হনহনিয়ে প্রবেশ করল সকলে। ফার্স্ট এইড বক্স বিছানায় রেখে নতস্বরে বললেন, “স্যার সরুন, আমি দেখছি।”
“আপনাদের ওর পা দেখতে হবে না, দ্রুত কাঁচ পরিষ্কার করুন।”
স্টার্ফরা পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হল। ধ্রুব বক্স খুলে তুলো দিয়ে সাবধানে রক্তগুলো মুছলেন। কাঁচের টুকরো তুলতে রক্ত দ্রুত গতিতে প্রবাহিত হল। প্রচণ্ড আঘাতে আর্তনাদ করে উঠলাম। ধ্রুব দিশেহারা হয়ে পড়ল। ঘামতে শুরু করল। না! এটা তার দ্বারা সম্ভব নয়। ধ্রুব উঠে দাঁড়ালেন। স্টার্ফদের কড়া আদেশ দিলেন,
“আমি একটু বের হচ্ছি, কখন আসব ঠিক নেই। আপনারা ওকে দেখে রাখবেন। পা ব্যান্ডেজ করে কিছু খাইয়ে দিয়েন। কিছুতেই বাইরে যেতে দিবেন না।”
ধ্রুব কাবার্ড থেকে কাপড় মোড়ানো বস্তু সন্তর্পণে পকেটে নিলেন। বেরিয়ে যাওয়ার প্রয়াস করতেই তড়িগড়ি করে বললাম, “আমি যাবো।”
“ওরা সব আমার হাতে বন্দি। তুমি গিয়ে কী করবে শুনি? ভাঙা পা নিয়ে হা-ডু-ডু খেলে দেখাবে? যত্তসব!”
তোয়াক্কা না করে উঠে দাঁড়ালাম একপায়ে। পরবর্তী পা ফেলার পূর্বে ধ্রুব ইশারা করলেন। তৎক্ষণাৎ ধরে ফেললেন হাত। ধ্রুব ধপাধপ পা ফেলে চলে গেলেন। ধরে রাখার ফলে যেতে পারলাম না। বসে পড়লাম বিছানায়। ওরা ধীরে ধীরে ব্যান্ডেজ করে দিল। পায়ে তিল পরিমাণ ব্যথা অনুভব করলাম না, অতি যত্নে কাজ শেষ করলেন। কিছু হলে ধ্রুবের কাছে তাদের জবাবদিহিতা করতে হবে।
ধ্রুব যাওয়ার মিনিট দশেকের মাথায় মামুনি আর রমিলা আন্টি এলেন। আমি হাঁটুতে মুখ গুঁজে বসে ছিলাম। জোর করে পায়ে ব্যান্ডেজ করে দিলেও জোর করে খাওয়ানো সম্ভব নয়। আন্টির ডাকে বাস্তবে ফিরি,
“কি হয়েছিল এখানে?”
স্টার্ফরা ধীরে ধীরে বলল, “আমরা এতকিছু জানি না। স্যার ম্যামরে টানতে টানতে ধরে এনেছে। ভয়ংকর রেগে ছিল। আমরা এসে দেখি, ম্যামের পা থেকে রক্ত ঝরছে। গালে চড়ের দাগ। জিনিসপত্র ভাঙা। স্যার মা’রছে মনে হয়।”
তারা এক কথা অন্যভাবে উপস্থাপন করলেন। হ্যাঁ, ধ্রুব আমাকে চড় দিয়েছে। কিন্তু ঘরের জিনিসপত্র ভয় দেখাতে ভেঙেছে, আর পা আমার দোষে কেটেছে।
মামুনি ছুটে এলো। এলোমেলো চুলগুলো গুছিয়ে দিলেন। তেজ নিয়ে বললেন,
“আপনার ছেলে তো এখন মানুষ নাই। বউ মা’রতেও দ্বিধা করে না। কোন কারণে এমন করল? আমি এক্ষুনি চড়ুইকে নিয়ে যাবো, ও থাকবে না এখানে। সত্যি সত্যি এবার ওর বিয়ে দেবো।”
রমিলা আন্টি থমথমে গলায় বললেন, “ধ্রুব আসুক আজ, বিদেশ থেকে এই শিক্ষা নিয়ে এসেছে..
দু’জনের কথপোকথন শুনে বললাম, “আন্টি ধ্রুব..
“চুপ! তুই ঘুমা।”
___
চিৎকার-চ্যাঁচামেচির আওয়াজে ঘুম ভাঙল আমার। সূর্য নেই, মেঘলা আকাশ। থমথমে পরিস্থিতি। গাঁ হিম দেওয়া আবহাওয়া। বারোটা ছাড়িয়েছে অথচ তেমন হেলেদুলে নেই প্রকৃতির। ঠিক নেই কিছু। নিভু নিভু চোখে অবলোকন করতেই অজানা অচেনা পরিবেশে আবিষ্কার করলাম নিজেকে। দেয়ালে দেয়ালে ধ্রুবের ছবি। বড় করে বাঁধানো আমার ছবি। সম্প্রতিক সময়ের। বই পড়ছি লাইব্রেরীতে। আগেরবার যখন এসেছি, এমন কিছু দেখতে পাইনি। তখন অন্য একটা ঘরে তাকে থাকতে দেখেছি। একদম ভিন্ন। ধীরে ধীরে মনে পড়ল কালকে রাতের ঘটনা। ধ্রুবের কথা। পায়ের দিকে তাকালাম। ব্যান্ডেজের উপরেও রক্ত শুকিয়ে আছে। বিন্দু পরিমাণ নড়লেই ব্যথায় অস্থির হয়ে যাচ্ছি। আমি কম্বল ভাঁজ করে রাখলাম। বালিশ ঠিক করে বিছানা গুছিয়ে নিলাম। এক পায়ে সম্পূর্ণ ভর এবং ব্যথার্ত পায়ের আঙুলে স্বল্প ভর দিয়ে অগ্ৰসর হলাম সামনের দিকে। নিচে রমিলা আন্টি কাঁদছেন। মামুনি তাকে শান্ত করছেন। আমি একপায় ভর দিয়ে হাঁসফাঁস করে বললাম, “কী হয়েছে, কাঁদছেন কেন আন্টি?”
কেউ কোনো জবাব দিলনা। উপায়হীন হয়ে পুনরায় জিজ্ঞেস করলাম, তবুও নিশ্চুপ। স্টার্ফদের জিজ্ঞাসা করলাম কী হয়েছে? তারা সংক্ষেপে বলে, ধ্রুবকে পুলিশে ধরে নিয়ে গেছে।
তাদের কাছে ফোন থাকার কারণে পুলিশে ফোন করে জানায়, তবে তেমন সুবিধা করতে পারেনি। ধ্রুব ইচ্ছামত মেরেছেন। সবাই ইমার্জেন্সিতে ভর্তি। পুলিশ এসে ধ্রুবকে থানায় নিয়েছে। মামা ও রাহাত স্যার উকিলের কাছে গেছেন। জামিন করতে পেরেছেন কি-না জানা নেই।
একটা জিনিস উপলব্ধি করলাম, কেউ আমার সাথে তেমন কথা বলছে না। সবাই নিজেদের কাজে ব্যস্ত। ঘরে এসে গুটিয়ে রইলাম। কী অপরাধ করেছি আমি? কেন সবাই এড়িয়ে যাচ্ছে আমায়।
_______
গালে ঠান্ডা স্পর্শ পেতেই নড়েচড়ে উঠলাম। তন্দ্রার ছেদ ঘটল। চোখের পাতা মেললাম না। উল্টো কাত হলাম। কম্বলটা টেনে শরীর ঢেকে ঘুমানোর প্রয়াস করলাম। সম্ভব হচ্ছে না, ওপাশের মানুষটা শান্তি দিবে না। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাতেই ধ্রুবকে দেখে লাফিয়ে উঠলাম। চোখ পরিষ্কার করে পুনরায় তাকালাম। না দৃষ্টিভ্রম নয়। মুখ ফিরিয়ে ধীরে ধীরে বললাম, “তিনি কখন এলো। তিনি তো থানায়!”
টাওয়াল দিয়ে ভেজা চুলগুলো মুছতে ছিলেন তিনি। পড়নে ঢিলেঢালা টি শার্ট ও ট্রাউজার। মাত্র শাওয়ার নিয়েছেন, বুঝাই যাচ্ছে। তবে কখন এসেছেন? নিশ্চয়ই অনেক আগে, ডাকেনি কেন আমায়? আদৌও বাবুইয়ের ভিডিও ডিলেট করতে পেরেছেন তিনি?
মৃদু শব্দে বললেও ধ্রুবের কর্ণদ্বয়ে ঠিকই পৌঁছালো, কিন্তু কোনোরুপ প্রতুক্তি করলেন না। ব্যাপারটাকে পুরোপুরি অগ্ৰাহ্য করলেন। বালিশ নিয়ে পাশে শুয়ে পড়লেন। চোখ বন্ধ করলেন। মাথায় হাত দিয়ে আড়াল করলেন মুখশ্রী। কথা বলছেন না কেন? সবাই কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে?
গম্ভীর গলায় বললেন, “ভিডিওটা তোমার ফোনেই আছে শুধু, যেই মানুষটা করেছে সে নেই। ডিলেট করার দরকার নেই।”
“আপনি থানায় ছিলেন, কখন এলেন? ডাকেননি কেন?”
“তুমি ঘুমিয়ে ছিলে।” রিনরিনে গলায়।
অশ্রুসিক্ত কণ্ঠে বললাম, “কী করেছি আমি? কী করেছি? দোষ কোথায় আমার, সবাই কেন আমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে, কিছু জিজ্ঞাসা করলে উত্তর দিচ্ছেনা।”
“কে তোমাকে এড়িয়ে যাচ্ছে চড়ু..
বাক্য থেমে গেলেন। তবে শব্দ থামল না। চাপা আর্তনাদ করলেন। পিঠ ধরে উঠে বসলেন। পিঠ থেকে টাওয়াল সরিয়ে বললেন, “একটু মলম লাগিয়ে দিবে?”
বেসামাল হয়ে শুধালাম, “কীভাবে শরীরের এই অবস্থা হল? এত কালচে দাগ কেন?”
[চলবে.. ইন শা আল্লাহ]