#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_৪
কলমে রোকেয়া পপি।
ঠিক বারোটা বাজার দশ মিনিট আগে সজীব জলিকে নিয়ে ওদের বাসায় এসে উপস্থিত হলো।
ও খুব ভালো করে জানে এ সময়টা ওর বাবা সরফরাজ খান বাসায় থাকে না। দশটা বাজলেই দোকানে চলে যায়। এলিফ্যান্ট রোডে ওদের পরপর চারটা জুতার দোকান। চারটা দোকানে বারোজন কর্মচারী ও একজন ম্যানেজার থাকার পর ও সরফরাজ খান নিজেই সবকিছু তদারকি করেন। দুপুরে ঘন্টা খানেক সময় বাসায় এসে খাওয়া দাওয়া ও বিশ্রামের জন্য বরাদ্দ রাখলেও প্রায় দিনই উনি খাবার খেয়েই চলে যায় দোকানে।
সজীব মায়ের কাছে জলিকে রেখে সারাদিনের জন্য লাপাত্তা হয়ে গেল। সজীবের মা দিলারা বেগম ছেলের এমন হুট করে বিয়ে করাতে ক্রোধে ফেটে পড়তে চাইছেন। তার ইচ্ছে করছে মেয়েটাকে কঠিন কঠিন কয়টা কথা শোনাতে। তার বহুদিনের শখ তার একমাত্র ছেলের জন্য অনেক দেখে শুনে টাকা পয়সা আলা বড়ো ঘরের মেয়েকে বউ করে আনবেন।
অথচ এই মেয়েটা কোথা থেকে উড়ে এসে তার সোনার টুকরো ছেলের ঘাড়ে জুড়ে বসেছে।
ইচ্ছে করছে মনের স্বাধ মিটিয়ে মেয়েটাকে যা মন চায় তাই বলে দিলটাকে ঠান্ডা করতে।
কিন্তু অসম্ভব রূপবতী এই মেয়েটা কে দেখে সে বুঝতে পারছে না উল্টাপাল্টা কিছু বলবে কি বলবে না। চেহারা সুরত দেখে তো বড়ো ঘরের মেয়েই মনে হচ্ছে। ছেলেটাও এমন গাধা। বাপের ভয়ে সব সময় তটস্থ হয়ে থাকে। কোন কিছু ঠিক মতো না বলেই আগে পালালো!
মা এটা তোমার বৌমা। দেখো তো পছন্দ হয় কিনা।
জলিকে একটু আমার রুমটা দেখিয়ে দাও আর সবকিছু বুঝিয়ে দাও। আমি আসতেছি।
এটা কোন কথা হলো! তুই কাকে বিয়ে করলি? কি আচার বিচার তা বলবি না। আমার হয়েছে যতো জ্বালা!
দিলারা বেগম ভাবলেন থাক, আগেই কঠিন কথা শুনিয়ে কাজ নেই। আগে অবস্থা বুঝে নেই। এই মেয়ে তো যেন তেন সুন্দরী না, গল্প উপন্যাসের নায়িকাদের মতো সুন্দরী।
তিনি একটু ভাব নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এই মেয়ে তোমার নাম যেন কি?
জলি পায়ে হাত দিয়ে সালাম করা মাত্র দিলারা বেগম খুশি খুশি ভাব নিয়ে বললো, থাক থাক পায়ে হাত দেওয়ার দরকার নেই। আর মনে মনে বললো, যাক আদব কায়দা জানে মনে হচ্ছে। খুব একটা খারাপ হবে না।
মা আমার নাম জলি। ইসরাত জাহান জলি।
আচ্ছা ঠিক আছে তুমি এখন রেস্ট নাও। তোমার শশুর দুপুরে খেতে আসলে তোমার সাথে কথা বলে সবকিছু জেনে নিব খন।
জলি মাথা কাত করে সম্মতি জানালো।
দিলারা বেগম গলা ছেড়ে হাক দিলেন পুস্প পুস্প এদিকে আয়।
পুস্প বারো বছর ধরে এ বাসায় কাজ করছে। তার একটা দাপট তৈরি হয়েছে দীর্ঘ দিন এ বাসায় কাজ করতে করতে।
সে হাত মুছতে মুছতে ঢিল তালে এসে বললো, কি
বলবেন তাড়াতাড়ি বলেন। হাতে অনেক কাজ আছে। আর ফিসফিস করে বলল কথায় কথায় খালি চিৎকার করাব পারে।
ঐ ফিসফিস কইরা কি কস?
কিছু না আম্মা। কি করন লাগবো কন। আমার টাইম নাই।
এইটা তোর নয়া ভাবি। সজীবের রুমে নিয়ে যা।
আর দুপুরে একটু ভালো মন্দ রান্না করিস।
এইগুলান কি কন আম্মা! আমার রান্নার জোগাড় জয়ন্ত সব শেষ। এখন চুলায় বসামু আর নামামু। এখন এইডি কওন কি ঠিক আম্মা?
কেন সমস্যা কি?
যা রান্না করতেছিস তাই করবি। সাথে একটু পোলাও মাংস কর। হাজার হলেও বাড়িতে একজন নতুন মেহমান।
আম্মা ঘড়ি দেখছেন। সারে বারোটা বাজতে চলে। এখন আমি কখন মাংস ভিজামু আর কখন রানমু?
এতো কথা বলিস না তো পুস্প। যা বলছি কর। একদিন না হয় একটু দেরি করে খাব। প্রতিদিন তো আর বলি না।
এদের ঝামেলায় আজকের পর্বটাই মিস হলো।
দিলারা বেগম হন্তদন্ত হয়ে তার বেড রুমে চলে গেলেন সিরিয়াল দেখতে।
বুঝছেন ভাবিসাব। দিনরাত টিভির রিমোট টা হাতেই থাকে। আমার লগে একটু হাত মিলাইলেই রান্নাটা তাড়াতাড়ি হয়। তা করবো না। দেখব খালি সিরিয়াল।
পুস্পর কথা শুনে জলি ফিক করে হেসে দিয়ে বললো, চলো পুস্প আমি তোমাকে সাহায্য করতেছি।
পুস্প জিহ্বায় কামড় দিয়ে ছি ছি কি কন নয়া ভাবিসাব। আজকে আপনি রেস্ট নেন। আপনারে দিয়া কাম করাইছি শুনলে আম্মা আমারে জবাই করবো।
আসেন এইডা সজীব ভাইয়ের রুম। আপনি একটু রেস্ট নেন। আমি সরবত বানায় আনতাছি।
না না সরবত লাগবে না পুস্প। তুমি আমাকে এক গ্লাস ঠান্ডা পানি দাও। তাহলেই হবে।
সরফরাজ খান দুপুরে খেতে এসে দেখেন টেবিলে কোন খাবার সাজানো নেই। সজীবের মা শুয়ে শুয়ে সিরিয়াল দেখছে খুব মনোযোগ সহকারে। এটা নতুন কিছু নয়। এই মহিলার একমাত্র নেশা সিরিয়াল। পৃথিবীর সবকিছু একদিকে আর ওনার সিরিয়াল একদিকে।
উনি একটু রাগ দেখিয়ে শক্ত করে ডাকলেন পুস্প টেবিলে খাবার দেওয়া হয়নি কেন?
পুস্প আবার হাত মুছতে মুছতে এসে বললো, রান্না শেষ হয়নি তাই খাবার দেওয়া হয়নি।
তোর এতো কি কাজ শুনি। আমরা মানুষ মাত্র তিনজন। তারপরও খাবার দিতে তিনটা বাজে! সারাদিন করিসটা কি?
আফনে এগুলান কি কন খালুজান? আমগোরে কি আপনি গননায় ধরেন না। আমি সহ ঘরে অহন পাঁচ জন মানুষ।
পাঁচ জন পাইলি কোথায়?
আয় হায় খালুজান আফনে কিছু জানেন না। ভাইজান তো কাম ঘটাইছে। অখন থেইকা নয়া ভাবিসাব আমাগো লগেই থাকব।
মানে কি?
সজীব বিয়ে করছে?
জে খালুজান। পরীর লাহান এক মাইয়া বিয়া কইরা আনছে।
কোথায় সেই মেয়ে।
ভাবিসাব ছাদে ।
এই ভর দুপুরে ছাদে কি করে?
আমনে জিগান ছাদে কি করে।
আমারে জিগান ক্যান? আমার রান্না শেষ। টেবিলে খাবার দিতাছি। আফনে হাত মুখ ধুইয়া বসেন।
সরফরাজ খান নিজের রুমে ঢুকে গমগমে কন্ঠে বললেন, দিলারা টিভিটা কি একটু বন্ধ করা যায়?
দিলারা বেগম চমকে উঠে ঝটপট করে টিভি অফ করে সোজা হয়ে বসলেন। আপনি কখন আসলেন সজীবের বাপ?
চলেন আগে খাওয়া দাওয়া শেষ করেন। পুস্পর কাছে নিশ্চয় এতোক্ষণে ঘটনা শুনে ফেলছেন। আগে খান। তারপর যা শোনার শুনবেন।
দিলারা বেগম খাবার তুলতে তুলতে বললেন পুস্প তোর ভাবিসাব রে ডাক দে।
জে আম্মা আমি ডাকতাছি।
জলি রুমে ঢুকে দেখলো সজীবের বাবা মা হাত গুটিয়ে বসে আছেন সামনে খাবার নিয়ে। হয়তো তার জন্যই অপেক্ষা। ও মাথায় কাপড় তুলে দিয়ে সজীবের বাবার পায়ের পাতায় হাত দিয়ে সালাম করলো।
থাক মা সালাম দরকার নেই। অনেক বেলা হয়েছে, খেতে বসো। খাওয়া শেষে তোমার সাথে কথা বলবো।
জলি দেখলো টেবিলে অনেক রকম খাবারের আয়োজন। পোলাও, সাদা ভাত থেকে শুরু করে মুরগি, গরু, কাবাব, বড়ো রুই মাছ, ঘনো ডাল ও লাল শাক। এতো অল্প সময়ের মধ্যে পুস্প মেয়েটা এতো কিছু করে ফেলেছে দেখে খুব অবাক হলো। তারচেয়ে ও বেশি অবাক হলো ওর জন্য এতো আয়োজন! নিজেকে খুব স্পেশাল লাগছে এই প্রথম। ও কখনো একসাথে এতগুলো আইটেম খায়নি।
দিলারা বেগম নিজের হাতে জলিকে খুব যত্ন করে সব খাবার তুলে দিলো। জলির চোখ পানিতে টলমল করছে। ও কখনো ভাবতে পারেনি এ বাড়ির মানুষ গুলো ওকে এত আপন করে নিবে এতো অল্প সময়ের মধ্যে।
জলির শশুর কোন রকমে খেয়ে উঠে তার নিজের রুমে চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বলে গেলেন দিলারা মেয়েটার খাওয়া শেষ হলে সাথে করে নিয়ে এসো।
আচ্ছা ঠিক আছে। আপনি যান একটু গড়ানি দেন।
ওমা বৌমা তুমি এমন হাত গুটিয়ে বসে আছো কেন? খাবার মজা লাগছে না বুঝি? মজা না লাগলেও কিছু করার নেই। কাজের লোকের হাতে রান্না, যা রাঁধে তাই খাই। আমার হাই প্রেশার। আগুনের তাপ সহ্য হয় না।
না না মা। সবগুলো আইটেম খুব মজা হয়েছে। বাবা মনে হয় আমার জন্য আন ইজি ফিল করছেন। ঠিক মতো না খেয়েই উঠে চলে গেল।
তোমার শশুর খাইতে খুব পছন্দ করে। কিন্তু খুব কম খায়। তার খাওয়াই ঐটুকু। এ নিয়ে তুমি ভেবো না।
তুমি আরাম করে খাও বৌমা।
জলি এ বাড়িতে নতুন এবং প্রথম খেতে বসলেও সে খুব তৃপ্তি সহকারে পেট ভরে খেলো।
তারপর তার শাশুড়ির বানিয়ে দেওয়া পানের খিলি পিরিচে করে নিয়ে তার শশুর কে দিলো।
সরফরাজ খান পানের খিলি মুখে পুরে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, এখন বলো তোমার ঘটনা কি?
জলি ঠিক বুঝতে পারছে না ঘটনা কি বলতে উনি ঠিক কি জানতে চাইছেন। জলি একবার চোখ তুলে চোখ নামিয়ে নিলো।
তুমি সজীব কে বিয়ে করেছো?
জলি মুখে কিছু না বলে মাথা দুবার ঝাঁকিয়ে হ্যা বললো।
কবে বিয়ে করেছো?
মুখ না তুলেই জলি বললো গতো কাল।
কি দেখে ঐগাধাকে তুমি বিয়ে করলা?
দিলারা বেগম খেকিয়ে উঠলেন। আপনি সবসময় আমার সোনার টুকরো ছেলে টাকে গাধা বলতে বলতে গাধাই বানায় ফেলছেন। শাড়ির আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বললেন এখন আবার নতুন একজন মানুষের সামনেও গাধা বলতেছেন। একদম ঠিক না।
আমার ছেলের কি কোন সন্মান নাই।
গাধা কে গাধা না বলে কি বিশিষ্ট ভদ্রলোক বলবো!
দিলারা বেগম আমার কথা বলার সময় তুমি আর কখনো বা হাত ঢোকাবা না। তোমার গুনধর পুত্রের বদনাম শুনতে খারাপ লাগলে তুমি ড্রয়িং রুমে গিয়ে সিরিয়াল দেখো।
দিলারা বেগম এবার নড়েচড়ে বসলেন। তিনি এই মজার আলাপ শোনা বাদ দিয়ে সিরিয়াল দেখতে পারেন না।
তা তুমি কি করো? পড়ালেখা করো নাকি আমার ছেলের মতো পড়াশোনা বাদ দিয়ে শুধু প্রেম করে বেড়িয়েছো?
বাবা আমি এইচএসসি পাস করে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছি।
বলো কি! তোমার রেজাল্ট কি?
জি পি এ ফাইভ।
আশ্চর্য! তোমার মতো সুন্দরী, মেধাবী ছাত্রী কি দেখে এই গাধার সাথে প্রেম করলো! গাধার চেহারা ছাড়া তো আর কোন গুন নাই।
না না ভুল বললাম। আরেকটা গুনতো অবশ্যই আছে। মেয়ে পটানোর গুন। তা না হলে তোমার মতো মেয়ে ঐ গাধাকে বিয়ে করতে পারেনা।
প্রেম করার আগে কি তুমি এই গাধার পরিবারের খোঁজ নিছিলা?
না বাবা।
এমন বোকাও হয় নাকি এ যুগের মেয়েরা! তুমি একটু খোঁজ নিলেই জানতে পারতে এই পরিবারে শিক্ষিত কেউ নেই। আমাদের বংশে প্রথম কেউ স্কুলের গন্ডি পার হয়েছে। আর সে হলো আমাদের গুনধর পুত্র সজীব। তাও কোনরকমে টেনেটুনে পাস। এতেই তার মা আহ্লাদে বাঁচে না।
জলির কান্না গুলো সব গলার কাছে চলে এসেছে। ওর ইচ্ছে করছে চিৎকার করে কান্না করতে। ছুটে বেরিয়ে যেতে এখান থেকে। কিন্তু ও কিছুই করতে পারছে না। মুখটা একটু বাঁকা করে রেখেছে। যেন কেউ ওর চোখের পানি দেখে না ফেলে। সে ওর কষ্টের নোনা জল কাউকে দেখাতে চায় না। এই কষ্ট শুধু ওর একার। ও জানে এই কষ্টের ভাগ কেউ নিবে না, কেউ না।
চলবে..…#মেঘে_ঢাকা_আকাশ
#পর্ব_৫
কলমে রোকেয়া পপি।
শুদ্ধর বাবা সাহাবুদ্দিন আহমেদ ভূমি মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব । শুক্রবার তিনি সবসময় নিজে বাজারে গিয়ে বাজার করেন। নদীর তাজা মাছ দেখে শুনে কিনেন। এই কাজটা করে তিনি খুব বেশি আনন্দ পান। তিনি নদীর তাজা মাছ কিভাবে চিনতে হয়, এটা শিখেছিলেন তার বাবার কাছে। তার বাবা সাপ্তাহিক বাজার সব সময় সাহাবুদ্দিন কে সাথে নিয়ে করতেন। প্রতিটা মাছ কেনার আগে কানসা ফাঁক করে দেখে নিতেন। সাথে সেই মাছ সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য সাহাবুদ্দিন কে দিতেন। এভাবেই বাবার সাথে বাজার করতে করতে তিনি এখন খুব ভালো বাজার করেন। কিন্তু তার একটাই দুঃখ তার ছেলে শুদ্ধ কখনো বাজারে যেতে চায় না।
তিনি সকালের পেপার পড়তে পড়তে ভাবছেন আজকালকার ছেলেমেয়েরা পড়া শোনাকেই একমাত্র ধ্যান জ্ঞান মনে করে। সংসারের কোন কাজে তো পাওয়াই যায় না , এরা কোন কায়িক পরিশ্রম করতে ও নারাজ। ভার্সিটি যাবে গাড়ি চাই। স্কুল কলেজ বাসার কাছাকাছি ছিল। তবুও কোন দিন একটু হাঁটতে দেখিনি।
অথচ আমাদের ছেলে বেলা ছিল কতো চ্যালেন্জিং। দুই চার মাইল হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। নদীতে সাঁতার কেটে গোছল করছি। গরু ছাগল ঘাস খাওয়াতে মাঠে নিয়ে যেতে হতো। ঝড় বৃষ্টিতে ভিজে সবকাজ করতে হতো। ফলাফল আমরা এখনো কতো সবল।
আর আমাদের বাচ্চারা একটুতেই নেতিয়ে যায়।
বাবা তোমার চা।
শুদ্ধর কথা শুনে সাহাবুদ্দিন আহমেদে চিন্তার জাল কেটে বাস্তবে ফিরে আসলেন। চায়ের কাপ নিতে নিতে হাসি মুখে বললেন তারপর ইয়াং ম্যান কি খবর তোমার? আজ এতো সকালে ঘুম থেকে উঠেছো যে?
এই তো বাবা খবর ভালো। তুমি আজ বাজারে যাবে না?
হুম যাবো তো। চা টা শেষ করেই বের হবো। তাজা ফ্রেস মাছ খেতে হলে খুব সকাল সকাল বাজারে যেতে হয় বাবা। তা হঠাৎ করে বাজারের খোঁজ খবর নেওয়া হচ্ছে যে?
বাবা আজ আমি তোমার সাথে বাজারে যেতে চাই। আমাকে নিবে?
সাহাবুদ্দিন আহমেদ ছেলের কথায় খুব মজা পাচ্ছেন। তিনি ঠোঁটে হালকা হাসি ঝুলিয়ে রেখে বললেন ওকে চলো ইয়াং ম্যান। আজ তুমি বাজার করবে। আমি সাথে থাকব।
বাবা কি যে বলো না। আমি কি বাজার করতে জানি নাকি! তুমি বাজার করবে আমি দেখব কিভাবে বাজার করো।
ওকে ওকে মাই সান। চলো তাহলে আমরা রওনা দেই।
আজকে শুদ্ধ যে মাছ সম্পর্কে জানতে চেয়েছে সেটাই সাহাবুদ্দিন আহমেদ কিনে ফেলেছেন। শুদ্ধ অবাক হয়ে বাবাকে বললো, বাবা এতো মাছ কিনলে মা রাগ করবে তো।
করুক রাগ। তোমার মাকে কি আমি ভয় পাই নাকি। আজ আমার একমাত্র ছেলে প্রথম বাজারে আসছে। আজকে তুমি যদি বাজারের সব মাছ মাংস কিনতে চাও, আমি তবে সব কিনে ফেলবো।
হয়েছে বাবা। অনেক হয়েছে। এবার চলো একটু গরুর মাংস কিনি।
ঠিক আছে চলো। গরু, মুরগি সব কিনব। এখন বলো তো হঠাৎ করে তোমার বাজার করার শখ হলো কেন?
বাবা আজকে আমার এক বন্ধু কে খেতে বলেছি আমার সাথে। ও খুব সাধারণ। মাছ খেতে খুব পছন্দ করে। বিশেষ করে নদীর মাছ। কিন্তু ওদের আর্থিক অবস্থা খুব খারাপ। বড়ো মাছ খাবার কথা ওরা চিন্তা ও করতে পারে না। আজ ওর জন্মদিন। তাই ওকে দাওয়াত দিয়েছি আমার সাথে দুপুরের খাবার খেতে।
বাহ্ বেশ। তা বন্ধুটি কি ছেলে না মেয়ে?
বাবা সে আসলেই তো দেখতে পাবে।
ওকে ওকে আমি না হয় দুপুর পর্যন্ত অপেক্ষা করবো তোমার বিশেষ বন্ধুটীকে দেখার জন্য।
কিন্তু তোমার মম কি জানে?
না আমি কাউকে কিছু বলিনি। ও আসলে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিব, এটাই আমার ইচ্ছে।
তা তোমার বন্ধুটির জন্মদিন। তার জন্য তো একটা উপহার কিনতে হয় কি বলো?
বাবা আমি ওর জন্য খুব সুন্দর দেখে একটা জামদানী শাড়ি কিনে গতকাল উপহার দিয়ে দিছি। আজকে ও সেই শাড়ি পরেও… শুদ্ধ কথা শেষ না করেই জিভে একটা কামড় দিলো।
সাহাবুদ্দিন আহমেদ বাজারের মধ্যে শত শত লোকের মাঝে হো হো শব্দ করে হেসে উঠলো। সেই হাসি আর থামতেই চায় না। চারদিকে লোক জন বিস্ময় ভরা দৃষ্টিতে বাপ ছেলে কে দেখছে।
শুদ্ধ খুব লজ্জা পেলেও সাহাবুদ্দিন আহমেদ এতো বেশি মজা পেয়েছেন যে, কে তাকিয়ে আছে, না আছে। তাতে তার কিচ্ছুটি এসে যায় না যেন।
বাজার দেখে মমতা বেগম অগ্নিমূর্তি ধারণ করলেন। তুমি কয় মাসের বাজার করেছো শুনি?
মমতা মমতা প্লিজ রাগ করে না সোনা। আজকে আমার একজন স্পেশাল গেস্ট দুপুরে খাবে। যা যা এনেছি, সব আইটেম তুমি আজ রান্না করবে।
তোমার কি মাথা ঠিক আছে?
কেন কেন আমার মাথায় আবার কি হলো?
শুদ্ধ ওপরে ওঠার সময় বাবা মায়ের মিষ্টি মিষ্টি ঝগড়া দেখে হাসতে হাসতে ওপরে চলে গেল। আর মনে মনে ভাবছে, বাবা জেনে গিয়ে ভালোই হয়েছে। এখন বাবাই সব কিছু সামলাবে। আমি নিশ্চিন্ত।
আমার আর কোন ভাবনা নেই।
আমাকে কি তোমার মানুষ মনে হয় না। কোথায় ছুটির দিনে পরিবার নিয়ে ঘুরতে বের হবে, বাইরে খাবে। তা না উনি হাজারটা আইটেম রান্নার ভার বউ এর কাঁধে চাপিয়ে দিলো।
আহ্ মমতা মাথা গরম করছো কেন? দুই দুই জন সহকারী আছে। তারা সব গুছিয়ে দিবে। তুমি শুধু রান্না টা করবে।
শাহাবুদ্দিনের মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মমতা ব্যাঙ্গ করে বললো, তুমি শুধু রান্না টা করবে। কি সুন্দর কথা। এই সচিবকে বিয়ে না করে একজন স্কুল মাস্টার কে বিয়ে করলেও অনেক শান্তি হতো। জীবন টা আমার রান্না ঘরেই শেষ হয়ে গেল। এখন যাও মুখের সামনে সং সেজে দাঁড়িয়ে না থেকে টেবিলে নাস্তা দেওয়া আছে। বাপ ছেলে খেয়ে আমাকে উদ্ধার করো।
মলি আজ সকালে ঘুম থেকে উঠেই শ্যাম্পু করে গোসল করেছে। সকাল থেকে সে রুপ চর্চা নিয়ে মহা ব্যাস্ত। পলি নাস্তা খাওয়ার জন্য ডাকতে এসে দেখলো, বিছানায় খুব সুন্দর একটা জামদানী শাড়ি। ভেতরের জমিনটা কালো, পাড় কমলা। সাথে কালো পাথরের খুব সুন্দর একটা কানের গলার সেট ও।
মলি খুব যত্ন করে হাতে পায়ে কালো নেলপালিশ পরতেছে। পলির খুব অবাক লাগলেও এখন আর সেটা প্রকাশ করতে ভালো লাগে না।
ও নিরুত্তাপ গলায় জিজ্ঞেস করলো কোথাও যাবি?
মলি একটু থতমত খেয়ে কেঁপে উঠলো।
ও বড়োপা। কখন আসলে? আমি ঠিক খেয়াল করিনি।
যে পরিমাণ মনোযোগ দিয়ে নেইল পালিশ করছিস। তাতে খেয়াল না করাই স্বাভাবিক। তা নাস্তা কি খাবি? আজকে খিচুড়ি আর বেগুন ভাজা করেছি। খাবার ঠান্ডা হতে চললো।
আপা তুমি মাকে নিয়ে খেতে বসো। আমি আসছি। আর দুটো আঙ্গুল বাকি আছে, দিয়েই আসতেছি।
পলি চলে যাওয়ার পর মলি উফ করে বড়ো একটা শ্বাস ছেড়ে দ্রুত নেইল পালিশ দিয়ে বের হয়ে আসলো।
টেবিলে এসে দেখে আপা প্লেটে খাবার সাজিয়ে বসে আছে। আর মা চুপচাপ খেয়ে যাচ্ছে।
মলির একটু বুকের মধ্যে কেমন যেন ধুকপুক করছে। ও খুব ভালো করেই জানে ওর আপা যদি জানতে পারে ও প্রেম করছে, তাহলে খুব কষ্ট পাবে।
ও মাথা নিচু করে টেবিলে বসতে বসতে বললো, আপা তুমি শুধু শুধু বসে আছো কেন?
তোর জন্য অপেক্ষা করছি। তোদের রেখে কি কখনো খেয়েছি আমি?
আসলে আপা আজ তো আমার জন্মদিন। আমি জানি গরীবের আবার জন্মদিন কিসের। এ বাড়ীতে এগুলো কেউ ভুল করে ও মনে করে না। বা মনে থাকলেও মাথা ঘামায় না।
আমি নিজেও মনে রাখি না।
কিন্তু হয়েছে কি আপা।
থাক না মলি। এতো কথা কেন বলছিস? তুই ঢাকা ভার্সিটির সেরা ছাত্রী। নিজের ইনকাম আছে।
তুই তোর বন্ধুদের নিয়ে জন্মদিন উদযাপন করতেই পারিস। আমি তো কোন জবাবদিহিতা চাইনি। এখন চুপচাপ খা।
মলি ভয়ে ভয়ে মায়ের মুখের দিকে তাকালো একবার। ভাবখানা এমন এ সংসারে কোথায় কি হচ্ছে তার এসব নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। কি সুন্দর আপন মনে খেয়ে যাচ্ছে।
আপা আসলে বিষয়টা ঠিক তা না। আমার এক বন্ধুর বাসায় দুপুরে আমার নিমন্ত্রণ আছে। আমি তো জন্মদিন পালন করিনা। তাই ওর বাসায় আমার জন্মদিন উপলক্ষে দাওয়াত।
পলি মুখ না তুলেই খাবার মুখে দিতে দিতে বললো ভালো তো।
চলবে….