#মেঘের আড়ালে চাঁদ ❤
#writer: মহসিনা মুক্তি
#পর্বঃ বাইশ
প্রান্ত হেলমেট খুলতে যায়, কিন্তু পারে না। তার আগেই ওদের দলের দুজন এগিয়ে এসে বাইকে জোরে লাথি দেয়। এতে বাইক কাত হয়ে পড়ে যায়। তুলতুল ব্যাঙের মতো লাফ দিয়ে এক কদম এগিয়ে মাটিতে পড়ে ওভাবেই ঝিম মেরে বসে থাকে। তার দুই হাত মাটিতে পড়ায় ঘেঁষা লেগে ছিলে গিয়েছে। আর প্রান্ত বাইক নিয়েই পড়ে যায়। তার একপা বাইকের নিচে চাপা পড়েছে। সে হাত দিয়ে বাইক উঁচু করে পা বের করতে চায় কিন্তু পারে না। সেই দুজন লোক লাঠি দিয়ে বাইকের ওপরে থাকা পায়ে জোরে জোরে আঘাত করে। প্রান্ত আর্তনাদ করে উঠে। আর বলে সে রাফসান নয়। তুলতুল প্রান্তের চিৎকার শুনে দ্রুত উঠে প্রান্তর দিকে গিয়ে ওদের থামতে বলে। কিন্তু ওরা থামে না। প্রান্তকে আঘাত করতেই থাকে। প্রান্ত নিজেও এমন ভাবে ফেঁসেছে যে কিছু করতেও পারছে না। তুলতুল কোনো উপায় না পেয়ে পাশ থেকে পিচ ঢালা রাস্তার ভাঙা কিছু অংশ উঠিয়ে একজনের দিকে ছুঁড়ে মারে। এতে লোকটির কপাল কেটে রক্ত বের হয়। ওরা প্রান্তকে মারা থামিয়ে দেয়। এতক্ষণ ওদের দলের প্রধান গাড়িতে হেলান দিয়ে তামাশা দেখছিল কিন্তু তুলতুল লোকটিকে আঘাত করায় নড়েচড়ে ওঠে তুলতুলের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তকায়। কিন্তু তুলতুল তা পাত্তা না দিয়ে প্রান্তের কাছে গিয়ে ওকে ধরে ওঠায়।
প্রান্তর একপায়ের অবস্থা পুরো খারাপ। ভালো করে দাঁড়াতে পারছে না। পুরো শরীর মারের চোটে ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। ও দ্রুত নিজের হেলমেট খুলে দূরে ছুঁড়ে মারে। মেজাজ খারাপ হয়ে গিয়েছে তার। এরমধ্যেই তুলতুল চিৎকার করে বলে ওঠে
-” সমস্যা কি তোদের? এতোগুলো লোকের চোখে কি ছানি পড়েছে? নাকি একজন বাদে সবগুলোই কানা যে সে বলেছে আর কোনো বাস বিচার না করেই ভুল লোককে রাফসান ভেবে পেটানো? নাকি এটা তোদের জন্মগত সমস্যা? জানোয়ার গুলো।” তুলতুলের এতো পযন্ত কথা ঠিক ছিলো কিন্তু শেষের কথায় দলের প্রধান চোখ রাঙিয়ে তুলতুলের দিকে তাকায়। আর প্রান্তর দিকে তাকিয়ে বলে
-” কি হয় রে তোর? জিনিস টা কিন্তু সেই।”
একথা শুনে প্রান্ত চিৎকার করে বলে
-” রুশান মুখ সামলে কথা বলবি। সব কিছু ছেড়ে দিয়েছি বলে ভাবিস না অন্যায় ও চুপ করে সহ্য করে যাবো। আর ওর দিকে নজর দিলে তোর চোখ তুলে নেব।”
-” আরে যা যা! কি দেখবি তা আমার বোঝা হয়ে গিয়েছে। নিজে তো ঠিকমতো দাঁড়াতে পারছে না আবার আমাকে দেখে নেবে। রাফসানকে পাইনি তো কি হয়েছে তোকে তো পেয়েছি। পুরনো কিছু পাওনা নাহয় মিটিয়ে ফেলি আজকে কি বলিস?” রুশান টিটকারি করে বললো।
প্রান্ত কোনোরকমে রুশানের দিকে গিয়ে ওর কলার ধরে বললো
-” তোর মতো কাপুরষ না আমি যে কাউকে বলার সুযোগ না দিয়ে বা পেছন থেকে আঘাত করবো। আমার হাতের মার নিশ্চয়ই ভুলে যাস নি তারপরেও তোর লজ্জা হয় না।”
রুশানের কলার ধরায় ওর লোকজন প্রান্তের দিয়ে সব রিভলবার তাক করে। এতে প্রান্ত হেঁসে ওঠে। তারপর বলে
-” সত্যি তোর আমাকে মারার সাহস আছে? জানিস তো এরপর কি হতে পারে?”
রুশান প্রান্তর কথায় মুচকি হেসে সামনে আগাতে আগাতে বলে
-“তোকে কিছু না করতে পারলেও তোর সাথে থাকা সুন্দরী কে তো কিছু করতেই পারি। তোকে কিছু করলে তো তোর পুরনো চামচারা আমাকে ছাড়বে না।”
রুশানের কথায় প্রান্ত পেছনে ফিরে তুলতুলের দিকে তাকায়। রাগের চোটে ওর কথা ভুলে গিয়েছিল। তুলতুলের মাথায় রিভলবার ঠেকিয়ে রেখেছে। প্রান্ত চিল্লিয়ে বলে -” রুশান খরবদার ওকে কিছু করার চেষ্টা করবি তো তোকে শেষ করে ফেলবো আমি।
কিন্তু রুশান কিছু না বলে তুলতুলের সামনে এগিয়ে গিয়ে ওকে সজোরে থাপ্পড় মারে। আর বলে
-” জানোয়ার বলেছো তো জানোয়ার গিরি দেখবে না?”
তুলতুলের ঠোঁট দাঁতের সাথে লেগে কেটে গিয়ে রক্ত পড়া শুরু করে। ও এতোক্ষণ বিস্ফারিত চোখে রুশান আর প্রান্তের কথা গুলো শুনছিল। কিন্তু রুশান তুলতুলকে থাপ্পড় মারায় তুলতুলের প্রচুর রাগ হয়। এতো মানুষের সামনে ওকে মারলো? ও পা দিয়ে রুশান কে লাথি দেয় জায়গা মতো। রুশান হাত দিয়ে চেপে ধরে ঝুঁকে পড়ে। আর প্রান্ত তা দেখে ফিক করে হেসে দেয়। আর রুশানের লোকজন বিস্ফারিত চোখে হাবার মতো দাঁড়িয়ে আছে। তুলতুল বলে
-” লজ্জা করে না বেয়াদব? মেয়েদের গায়ে হাত তুলিস।”
রুশান রেগে গিয়ে তুলতুলকে আবার থাপ্পড় মারতে যায় কিন্তু তার আগেই সে হাত ধরে আর্তনাদ করে উঠে। তুলতুল পেছনে তাকিয়ে দেখে রাফসান দাঁড়িয়ে আছে হাতে রিভলবার। আশেপাশে তার লোকজনও রয়েছে। রুশানের লোকজন তুলতুলের দিক থেকে পিস্তল সরিয়ে রাফসানের দিকে তাক করে। এতে রাফসান মুচকি হেসে চোখ থেকে সানগ্লাস সরিয়ে এগিয়ে আসে। এসময় প্রান্ত এগিয়ে এসে তুলতলকে ওখান থেকে সরিয়ে নিয়ে যায়। রাফসান এসে রুশানের থেকে একটু দূরে দাঁড়িয়ে বলে
-“আমাকে মারতে চুপিচুপি এসে গুলি ঠুকে দিয়ে চলে যেতে চাইবি আর এই খবর আমি জানবো না? তোর কাজ দেখে অবাক হই। অন্য একজন লোককে রাফসান ভেবে পেটানো? তোর কি মনে হয় তুই আসবি জেনেও আমি কোনো লোকজন ছাড়া বাইকে করে একটা মেয়েকে নিয়ে পালিয়ে যাবো? তোর মাথায় এটা আসে কিভাবে?”
-” তুই কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি করছিস রাফসান।” রুশান তার একহাত দিয়ে আরেকহাত চেপে ধরে বলে। তার হাত দিয়ে গলগল করে রক্ত পড়ছে।
-” তোর সাহস তো কম না তুই আমাকে মারতে আসিস? যে সব লিডারের লিডার তাকে তুই চুপিচুপি মারতে এসেছিস বাহ্। একটুও প্রান কাঁপলো না এতে তোর?”
-” তুই জানলি কি করে যে আমি এসেছি? আর তোর বদলে অন্য কাউকে মেরেছি? ” রুশান অবাক হয়ে বললো
-” তুই কি মনে করিস রাফসানকে? সে এমনি এমনি গ্যাংস্টার হয়েছে, আর সব গুলো দলের নেতা হয়েছে? এটা জানা আমার জন্য অসম্ভব কোনো কাজ না, যে আমার আন্ডারে থেকে কেউ আমাকেই মারতে আসে। যাক তোকে বলেই দেই কিভাবে জানলাম। তোর দলের কেউই জানিয়েছে। অবশ্য সে না জানালেও সমস্যা ছিল না। আমার লোকই যথেষ্ট ছিল।”
ওদের কথা বলার মাঝেই আবির প্রান্ত আর তুলতুলের দিকে এগিয়ে আসলো। এসে বলে
-“আপনারা দুজন গাড়িতে গিয়ে বসেন। রাফসান ভাই গাড়িতে থাকতে বলেছে। এখানে ঝামেলা হতে পারে। ”
-“না তার দরকার হবে না। ভীতুর মতো লুকিয়ে গেলে কোনো কাজ হবে না।”প্রান্ত বললো।
-“এটাকে লুকানো বলে না। নিজের জীবন বা আপনজনের জীবন বাঁচাতে মাঝে মাঝে আড়ালে যেতে হয়। আর অস্ত্র ছাড়া লড়াই হয় না। আপনার কাছে কোনো অস্ত্র নেই যে ওদের আক্রমণ ঠেকাবেন। তারপরেও আপনার যাওয়ার প্রয়োজন না থাকলেও ওনার আছে। এখানে দুইজন শান্ত ভাবে কথা বললেও কিছুক্ষনের ভিতরই মারামারি শুরু হয়ে যাবে। আর মেয়েটিকে গাড়িতে একা বসিয়ে রাখাও ঝুকিপূর্ণ। ওরা দূর্বলতা হিসেবে ব্যবহার করতে চাইবে৷ আপনি ওর সাথে থাকলে একটু হলেও নিরাপদ থাকবে।” আবিরের কথা শেষ হওয়ার আগেই গুলির শব্দ পাওয়া গেলো। ওরা তাকিয়ে দেখে রাফসান রুশানের দলের একজনকে গুলি করেছে। প্রান্ত তুলতুলের জন্য হলেও গাড়িতে গিয়ে বসলো। আর আবির গাড়ি লক করে বাইরে চলে যায়।
প্রান্তর নিজেকে এখন অসহায় লাগছে। এসব সে ছেড়ে দিয়েছে অনেক আগেই। কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে তার পরিবারকে তার কাজের জন্য ভুগতে হয়। প্রান্তর এখন নিজের প্রতিই রাগ লাগছে। তার জন্য তুলতুলকেও মার খেতে হয়েছে। কতটা অপমান জনক এটা যে তার সামনেই তার বোনকে কেউ থাপ্পড় মেরেছে আর সে দাঁড়িয়ে শুধু দেখেছে কিছু করতে পারেনি। মরে যেতে ইচ্ছে করছে তার। আজ প্রথম বার তার আফসোস হচ্ছে যে কেন সে সব ছেড়ে দিয়েছিল। আজ যদি সে গ্যাং এরসাথে জড়িত থাকতো তাহলে তার সামনে কখনোই তার বোনকে মার খেতো না আর না সে নিজে মার খেতো। একসময় সে আর তিয়াস সবকিছু কাঁপিয়ে বেড়াতো আর এখন নিজেকে আর তার বোনকে রক্ষা করার জন্য লুকিয়ে অন্যের গাড়িতে বসে আছে। সে ঠিক করলো আবার এই পথে নামবে। ভালো হয়ে কোনো লাভ হয়নি তার। একটা ঘটনার পড়ে সব ছেড়ে দেয়। তার আপনজনকে যাতে আর ভোগান্তি পোহাতে না হয় এজন্য জন্য সে আর তিয়াস সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নিজেদের আড়াল করে রেখেছিল। কিন্তু এখন দেখছে তারা ভুল করেছে৷ খারাপ জিনিস এতো তাড়াতাড়ি মানুষের পিছু ছাড়ে না।
প্রান্ত তুলতুলের দিকে তাকায় দেখে তুলতুলে ওর দিকে চোখ ছোট করে তাকিয়ে আছে। তা দেখে প্রান্ত ভড়কালো একটু। আবার কোন আজগুবি প্রশ্ন করে না বসে। প্রান্ত দেখলো তুলতুলের গালে পাঁচ আঙুলের ছাপ পড়ে গিয়েছে। ঠোঁটের কোণ কেটে বের হওয়া রক্ত এখনো দৃশ্যমান। প্রান্ত পকেট টিস্যু বের করে তুলতুলর মুখ ধরে রক্ত মুছে দিতে গেলে তুলতুল ব্যাথায় সরে যায়। প্রান্ত দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো
-” আমি অনেক খারাপ ভাই তাইনা? তোকে কেউ মারছিল আর আমি দাঁড়িয়ে দেখছিলাম। আর আমার জন্যই তো তোকে থাপ্পড় খেতে হলো।”
তুলতুল রাগী ভাবে তাকিয়ে বললো
-“একদম এ কথা বলবে না। তুমি ওভাবে থাকতে বাধ্য ছিলে। কারন তুমি যদি এগিয়ে আসতে বা বাঁধা দিতে যেতে তো ওরা আমাকে গুলি করতো। আর এরজন্য তুমি নিজেকে দায়ী করছো কেন? এটায় তোমার কোনো হাত নেই ভাইয়া। আর তুমি আর তিয়াস ভাইয়া সবসময়ই আমাকে আগলে রাখো। তাওহী তো ছোট কিন্তু ও আমাকে একা বাইরে যেতে দেখলে আমার পিছুপিছু যায় কেউ কিছু বললে বড় ভাইয়ের মতো জবাব দেয়। আমি অনেক ভাগ্যবতী যে তোমাদের তিনজন পেয়েছি নিজের ভাই হিসাবে। আর তুমি নিজেকে খারাপ বলছো? আর বললে আমি আর তোমার সাথে কথা বলবো না। কিন্তু এখন বলো তুমি কি আগে গ্যাংস্টার ছিলে?”
প্রান্ত এতক্ষণ সব ভালোভাবেই শুনছিল। কিন্তু শেষের কথা শুনে থতমত খেয়ে তুলতুলের দিকে তাকায়। ও যেটায় ভয় পাচ্ছিল সেটাই হলো। এখন তুলতুলকে বোঝাবে কে? এক জিনিস মাথায় ঢুকলে আর তা এতো সহজে ভুলবে না। এখন কাটিয়ে নিলেও পরবর্তীতে আবার জিজ্ঞেস করবে। যা ভেজালের মা হয়েছে। প্রান্ত একটা হাসি দিয়ে বলে
-“ইয়ে মানে তুই যা…
প্রান্ত আর বলতে পারে না। ওর কথা বলার মাঝেই গাড়ির সামনের কাচে গুলি লেগে প্রচন্ড শব্দ হয়। প্রান্ত তুলতুলকে নিয়ে নিচু হয়ে বসে সিটে। বাইরে গোলাগুলির শব্দ আসছে। নিশ্চয়ই দুপক্ষের ভেতর মারামারি লেগেছে। প্রান্ত তুলতুলের মাথার দুপাশে হাতদিয়ে কান চেপে ধরে। অনেকক্ষণ পরে মনে হয় সবকিছু স্বাভাবিক হয়। প্রান্ত ঠিক হয়ে বসে তুলতুলকে নিয়ে। তুলতুল তার গায়ে হেলান দিয়েই ঘুমিয়ে গিয়েছে।
প্রান্ত হাসলো, এতোকিছুর ভেতরও ঘুমিয়ে গিয়েছে। হয়তো ভেবেছে যাই হয়ে যাক না কেনো তার ভাই তাকে কিছু হতে দিবে না। সে নিরাপদেই আছে। পাশে ভরসা করার মতো কেউ আছে। প্রান্ত তুলতুলের মাথায় হাত বুলালো। তার আপন বোন নেই কিন্তু তুলতুলকে আপনের মতোই ভালোবাসে।
রাফসান রেগে গাড়ির ভেতরে প্রবেশ করে। সাথে আবিরও এসে পাশে বসে। রাফসান রেগে বলে
-” আজও রুশান পালিয়ে গেলো আবির। বেঁচে গেলো আমার হাত থেকে। কিন্তু এরপরে এমন কোন কাজের চেষ্টা করলে ওকে তো আমি ওর আস্তানায় গিয়ে মেরে ফেলবো।” বলে গাড়ি স্টার্ট দেওয়ার সময় দেখে সামনের কাঁচে গুলি লেগে কাচ ফেটে রয়েছে। এটা দেখে তার রাগ হয়।
-” শিট! শালার ভাই শালা শুট করার আর জায়গা পায়নি।” বলে গাড়ি স্টার্ট দেয়। হঠাৎ করেই তার সামনের মিররে চোখ পড়ে। দেখে প্রান্ত ঘুমিয়ে থাকা তুলতুলের ঠোঁটের রক্ত টিস্যু দিয়ে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। কেনো জানি তার খুব রাগ হয় এটা দেখে। রাফসান স্টিয়ারিং এ ঘুষি দিয়ে গাড়ি জোরে ড্রাইভ করতে লাগে।
চলবে..