মেঘের ওপারে মেঘ | চার
লিভিং রুমের ওপাশে একটা ঘর আছে। ঘরের দরজাটা পুরোপুরি খোলা। মেহেদি লিভিং রুমে বসে ও ঘরের দিকে চেয়ে আছে। ওখানে মাঝে মাঝে একটি মেয়েকে দেখা যাচ্ছে। উনিশ কুড়ি বছরের মেয়ে। ফোন কানে লাগিয়ে পুরো ঘর চক্কর কাটছে। মাঝে মাঝে খিলখিল করে হাসছে। এই একটু সময়েই বড়ো ভালো লেগে গেল মেয়েটিকে। মেহেদি মুনোযোগ সহকারে তাকিয়ে থাকল ও-ঘরের দিকে। জিন্নাতুন নুর হুট করে চলে এলেন চোখের সামনে। আর্তনাদ করে বললেন, ‘আরে আরে! কিছুই খাওনি দেখছি! লজ্জা করো না। তোমার জন্যই তো রেঁধেছি। তুমি না খেলে খাবে কে?’ তিনি থেমে আবার বলতে শুরু করেন, ‘তোমার ভাই থাকলে তার জন্যই রাঁধতাম। মেয়ের জামাইকে নিজ হাতে রেঁধে খাওয়াব; বড়ো শখ ছিল আমার। কিন্তু তা তো কপালে নেই। তুমিই খাও। পেট ভরে খাও, বাবা। লজ্জা করো না।’ কথাটুকু বলতে তার গলা ধরে এল। তিনি আড়ালে একবার চোখও মুছলেন।
মেহেদির চোখ তখনও ওপাশের ঘরটায়। মেয়েটা কে কে জানে! তবে বড়ো ভালো লাগে দেখতে। বড়ো ভালো লাগে শুনতে। জিন্নাতুন নুর আবার বললেন, ‘কী হলো বাবা? খাচ্ছো না যে?’
মেহেদি মুখ তুলে তাকায়, ‘আজকেই চলে যেতে হবে, মাউই। মা’র শরীর খুব একটা ভালো নেই।’
‘সে কি! আজকেই এলে। আজকেই চলে যাবে! তা কী করে হয়!’
‘মা’র শরীর খুব খারাপ। তা না হলে আজকের রাতটা আপনাদের এখানেই থাকতাম।’ কথা শেষ করে মেহেদি আবার বলে, ‘ভাবি তৈরি হয়েছে কি? কিছুক্ষণের মধ্যে না বেরোলে বড়ো দেড়ি হয়ে যাবে যে! শেষে না গভীর রাত হয়ে যায়!’
জিন্নাতুন নুরের মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তিনি থমথমে গলায় বলেন, ‘সায়রা যাবে না বলছে।’
‘ভাবি এক মাস আপনাদের এখানে থেকেছে। মা তাকে দেখার জন্য উতলা হয়ে উঠেছেন। তিনি উল্টোপাল্টা বকতে শুরু করেছেন। শরীরটাও যা খারাপ। আসার সময় বলে দিয়েছেন, ভাবিকে না নিয়ে গেলে ঘরে আমার জায়গা হবে না।’
কথাগুলো শুনে মেহেদির মনের ব্যথা কিছুটা হলেও বুঝতে পেরেছেন জিন্নাতুন নুর। আর তাই আরো একবার আশা জ্বেলে দিয়ে বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি বোসো। সায়রাকে বুঝাই গিয়ে।’
কিন্তু লাভ হলো না কিছু। সায়রা উল্টো শাসিয়ে দিয়েছে। যে বাড়িতে মূল মানুষটাই নেই সে বাড়িতে সে যাবে না। বেশি জোরজবরদস্তি করলে হিতে বিপরীত হবে, তা-ও জানিয়ে দিয়েছে। জিন্নাতুন নুর ব্যর্থ হয়ে ফিরে এসে অসহায় ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে রইলেন। যেন তার কিছু বলার নেই, কওয়ার নেই, করার নেই। মেহেদি হঠাৎ অবান্তর এক প্রশ্ন করে বসল, ‘ওই মেয়েটি কে?’
জিন্নাতুন নুর ওদিকে একবার তাকিয়ে একগাল হাসলেন। বললেন, ‘ওঁ আমার ছোটো বোনের মেয়ে। শান্তা। নাম শান্তা হলেও মোটেও শান্ত নয়। যতক্ষণ এ বাড়িতে থাকে, পুরো বাড়িটা একাই মাথায় তুলে রাখে। ওঁর বাবা ক্যানাডায় আছেন। তার সাথেই কথা বলছে। বাপ মেয়ের খুব ভাব। না হলে দেখতে, এতক্ষণে তোমাকে এটা ওটা বলে মাথা ধরিয়ে দিত।’
মেহেদি হয়তো সেটাই চাইছিল। বলল, ‘কতক্ষণ চলবে বাপ মেয়ের আলাপ?’
‘তা জানি না। তবে এ আলাপ সহজে শেষ হবার নয়। তুমি আরেকটা পিঠা নাও না।’
‘পেটে জায়গা নেই। না হলে সবগুলোই খেতাম। ভাবি রাজি হয়নি, না?’
‘হুঁ।’
‘আমি কি একবার বলে দেখব?’
‘বলছো?’
‘চেষ্টা করে দেখি।’
‘দেখ।’
জিন্নাতুন নুর এগিয়ে গিয়ে সায়রার ঘরটা দেখিয়ে দিলেন। সায়রা বিছানায় বসে ছিল। মেহেদিকে দেখে উঠে গিয়ে জানালার সামনে দাঁড়াল। যেন তার কারো সঙ্গে কথা বলার কোনো রকম ইচ্ছে নেই। মেহেদি একটুও অপমানবোধ করল না। বরং শান্ত হয়ে সায়রার পাশে গিয়ে দাঁড়াল, ‘ভাবি!’
‘উঁ?’ সায়রা জানালার ওপাশে তাকিয়ে কান পেতে রইল।
‘আপনাকে আমার সঙ্গে যেতে তবে। আজই। এক্ষুনি।’
‘অসম্ভব।’
‘কেন অসম্ভব, ভাবি? আপনি তো চাইলেই পারেন! মা অসুস্থ। খুবই অসুস্থ। বিছানা থেকে উঠতে পারেন না। গায়ে সে জোর নেই। তিনিই আপনাকে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন। তার সেবা করার জন্য সারাক্ষণ মিলি আছে। আমি আছি। আমরা দুই ভাই-বোনকে হাতের কাছে পেয়েও কেন যে আপনাকেই বারবার চাইছেন কে জানে! হয়তো বড়ো ছেলের বউ বলেই…’
সায়রা কথা বলে না। চুপ করে থাকে। মেহেদি আবারও বলে, ‘আমার সঙ্গে চলুন ভাবি। এক মাস তো বাপের বাড়ি বেড়ালেন। ভালো না লাগলে আবার বেড়াতে আসবেন। আমিই এসে দিয়ে যাব নাহয়। কিন্তু আজ আমার সঙ্গে আসুন।’
‘কার জন্যে আসব? যার জন্য বাড়ি ছাড়লাম, আপনজনকে পর করলাম সে-ই যদি না থাকে…’
‘তাই বলে ভাবি… ভাইয়া নেই তো কী হয়েছে? আমরা তো আছি। আমি, মিলি, মা। আমরা কি আপনার কেউ নই? আমরা কি বিপদের সময় আপনাকে কাছে পেতে পারি না?’
সায়রার মন একটু নরম হলো কি? তার ছলছল চোখের দিকে তাকিয়ে মেহেদি বলল, ‘এখনই ভেঙে পড়বেন না, ভাবি। মেয়ে মানুষ ভেঙে পড়লে চলে না। মেয়ে মানুষ হতে হয় শক্ত। বাইরে না হোক, ভেতরটা অন্তত শক্ত হওয়া চাই। যা কখনো ভাঙবে না, মচকাবে না। কোনো ঝড় তুফান যাকে তছনছ করতে পারবে না। মেয়ে মানুষ কীসের মতো, জানেন?’
সায়রা উৎসুক ভঙ্গিতে চেয়ে থাকে। কিছু বলে না। মেহেদি বলতে শুরু করে, ‘মেয়ে মানুষ হলো গাছের ডগায় সাজিয়ে রাখা ঠুনকো পাখিন বাসার মতো। একদম ঠুনকো। পাতলা খড়কুটো দিয়ে তৈরি। দেখে মনে হয়, ফুঁ দিলে উড়ে যাবে। আসলে তা হয় না। কত ঝড় যায়, কত তুফান যায় এর উপর দিয়ে। অথচ, সেই অসময়ে পাখিরা দিব্যি নড়বড়ে ঘরটায় আশ্রয় নেয়। ডিম পাড়ে। ডিম ফুটে একসময় বাচ্চা বেরোয়। বাচ্চা পাখিগুলো একসময় বড়ো হয়ে উড়তে শিখে। আপনি হলেন সেই পাখির বাসা। দেখে মনে হয় নড়বড়ে। আসলে তা না। খুব শক্ত, মজবুত, পোক্ত। আর আমি, মিলি আর মা আমরা তিনটা মানুষ হলাম সেই পাখি। আমাদের উপর দিয়ে এখন ঝড় যাচ্ছে। এই অসময়ে আপনি একটু আশ্রয় দেবেন না আমাদের? বলুন ভাবি, দেবেন না?’
সায়রার ভেতরটা ফাঁকা হয়ে আছে। সে মেহেদির কথা কিছু বুঝতে পারছে না। তবে একটা ব্যাপার তার মাথায় কিছুতেই ঢুকছে না, মেহেদি তো এমন না। যথাসম্ভব সায়রাকে এড়িয়েই চলত। এমনকি যখন সায়রা তাদের বাড়ি থেকে চলে এল তখনও কিছু বলেনি। বিদায় পর্যন্ত জানায়নি। আজ এক মাস পর তার কী এমন পরিবর্তন এল যার জন্য এত সুন্দর করে কথা বলছে! এত বুঝাচ্ছে! কোনো কু-মতলব নয় তো!
‘কী হলো ভাবি? দেবেন না একটু ছায়া আপনার আঁচলে? আমরা তো বাচ্চা মানুষ। মা’র জন্য অন্তত দয়া করুন। ফিরে আসুন আমাদের মাঝে। ভাইয়া নিখোঁজ হওয়ার পর মা আপনার মাঝেই ভাইয়াকে খুঁজে নেয়। এ কথা তো আপনিও জানেন।’
সায়রা কিছু না বলেই এ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। মেহেদি তার যাওয়া পথের দিকে হাঁ করে তাকিয়ে রইল। এত কথা বলার পর সায়রা এমন নির্লিপ্ত ভাবে চলে যাবে তা সে ভাবতেও পারেনি।
হুড়মুড় করে একটি মেয়ে ঘরে ঢুকল। মেহেদি জানে, এই মেয়েটির নাম শান্তা। সায়রার খালাতো বোন। মেয়েটিকে দূর থেকে দেখতে বড়ো ভালো লাগে। কাছ থেকে আরো বেশি ভালো লাগছে। বলল, ‘আপনি মেহেদি তাই না?’
‘হুঁ।’
‘মেহেদি আমার খুব পছন্দের। আই লাভ মেহেদি।’
মেহেদি হাঁ করে রইল। শান্তা বলল, ‘গায়ে মাখার মেহেদির কথা বলছি। আপনি অমন হাঁ করে রইলেন কেন? মুখে মাছি ঢুকে যাবে তো!’
মেহেদি একটু লজ্জা পেয়ে বলল, ‘আপনি বুঝি শান্তা?’
‘হ্যাঁ, শান্তা। তবে শান্ত নই। ভীষণ উতপাত করি এখানে সেখানে। বকাঝকাও শুনি। তবে শিক্ষা হয় না।’
‘বকে কে আবার?’
‘কেন! আপনার ভাবি। সায়রা আপা।’
‘ভাবি বকাঝকা করে!’
‘বকে না বুঝি! আপা যা মেজাজি! আজ সকালেও বকল।’
‘কী বকেছে?’
‘তুই আমাদের বাসায় কেন এসেছিস? জ্বালাচ্ছিস কেন এত? ভাগ এখান থেকে। বেহায়া মেয়ে কোথাকার। এইসব।’ কথাগুলো বলে শান্তা নিরীহ ভাবে হাসল। সে জানে, সময়ে অসময়ে অনেকেই তার উপর বিরক্ত হয়। তবে সে ইচ্ছে করলেও নিজেকে কন্ট্রোল করতে পারে না।
শান্তা প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, ‘আপাকে নিয়ে যেতে এসেছেন?’
‘হুঁ। কিন্তু ভাবি রাজি হচ্ছে না।’
‘আমি কথা বলে দেখব?’
‘আপনার কথা শুনবে?’
‘শুনবে না কেন? আলবাত শুনবে।’ বলে মুচকি হেসে বেরিয়ে এল শান্তা। ছাদের এক কোণে সায়রা দাঁড়িয়ে আছে। শান্তা তার সামনে যেতেই সে শান্তাকে জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল, ‘খুব বকাঝকা করেছি তোকে। তোর খুব খারাপ লেগেছে, নারে?’
‘না না! আগে খারাপ লাগত। এখন লাগে না। অভ্যস্ত হয়ে গেছি তো!’ শান্তা মুচকি হেসে উড়িয়ে দিলো। তবে তার যে মন খারাপ সেটা আড়াল করতে পারল না। সায়রা চোখ মুছে বলল, ‘আকাশের কী খবর বল তো?’
‘কোন আকাশ? কার কথা বলছিস, আপা?’
‘শান্তা, আমার সঙ্গে ন্যাকামো করিস না। আমি কিন্তু সব জানি। বল বল।’
শান্তা লজ্জায় লাল হয়ে মাথা নিচু করে বলল, ‘সে তো এখন বড়ো মানুষ। ভার্সিটিতে পড়ে। আমার মতো কলেজে পড়া মেয়েকে মনে রাখা কি তার যায়?’
‘ধুর! ওভাবে বলছিস কেন! সত্যি করে বল।’
‘সত্যি তো বললাম। আকাশ এখন ভার্সিটির স্টুডেন্ট। কত মেয়ে ফ্রেন্ড তার। এখন আমায় মনে রাখার সুযোগ আছে?’
‘সেকি! তোদের কথা-টথা হয় না?’
‘নাঃ। আকাশের গার্লফ্রেন্ড হয়েছে। ওঁ-ই এখন আকাশের সব।’ বলে আড়ালে চোখ মুছল শান্তা। একটু হাসল। যেন কিছুই হয়নি। সে দিব্যি সুখে আছে।
‘তোকে ছেড়ে দিলো!’ সায়রা চেঁচিয়ে বলল।
‘ছাড়বে কী! আমিই তার থেকে দূরে সরে এসেছি। শুধু শুধু বেহায়ার মতো পিছে পড়ে থাকার মানে হয়?’
‘তোর খুব দুঃখ, নারে?’
শান্তা মাথা নেড়ে করুণ গলায় বলে, ‘না না! আমার আবার দুঃখ কীসের! আমি তো দিব্যি সুখে আছি।’ বলেই অন্য দিকে ফিরে তাকাল। দু’চোখ ভরে জল এসেছে। সেগুলো সায়রার আড়ালে মুছে নিল শান্তা। একটু হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। হাসতে চাইলেই কান্না আসছে। বুক ফাটা কান্না। এ সময় ছাদ থেকে লাফ দিয়ে মরে গেলে সে বেঁচে যেত। চিরকালের জন্য বেঁচে যেত। কিছু মানুষ মরে গেলেই চিরকালের জন্য বেঁচে যাবে। শান্তাও তেমন। সায়রার ব্যাপারটাও কি তেমনি? সে-ও কি মৃত্যুর মতো কঠিন সত্য মেনে নেওয়ার জন্যই বেঁচে আছে?
(চলবে)
মো. ইয়াছিন