মেঘের পরে মেঘ-১

“আজ বিকেল ঠিক ৫ টার সময় আসবি।আমি অপেক্ষা করবো।যা শোনার তখনি শুনবো না হয়।আসিস কিন্তু। রাখলাম।”
বলেই কলটা কেটে দিলো নাবিল।

মোবাইলের টু টু আওয়াজ কানে বাঁজতে লাগলো শায়েরীর।
শায়েরী কি বলতে চায় তা না শুনেই ফোন রেখে দিলো! ছেলেটা এমন কেন?ও জানে যে শায়েরীর নিজের মোবাইল নেই।বাড়িতে দুটো মোবাইল।একটা বাবার অন্য টা ওর বড় ভাই ফয়সালের।বাবা বাড়িতে এলে মাঝে মাঝে একটু মোবাইলটা হাতে পাওয়া যায়।ভাইয়ার মোবাইল ধরা একদমই নিষিদ্ধ।কতো কস্ট করে বাবার ঘর থেকে মোবাইলটা যাও বা আনতে পারলো কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হলো না।নিজের মতো হুকুম জারি করে ফোন রেখে দিলেন জাঁহাপনা।
এখন কি হবে?বাড়ি থেকে বের হবে কিভাবে?
আজ দেখা না হলে কথাগুলো বলবেই বা কিভাবে।
নাবিল যখন ওর বিয়ের কথা শুনবে কি প্রতিক্রিয়া হবে ওর? ভাবতেই কেমন যেন লাগছে শায়েরীর।আবার নিজেকে সামলেও নিচ্ছে এই ভেবে নাবিলের প্রতি ভালোলাগা বা ভালোবাসা পুরোটাই ওর একান্তই নিজের অনুভূতি। এখানে নাবিলের প্রত্যক্ষ কোন অংশগ্রহণ নেই।

“শায়েরী?”
মায়ের জোর ডাকে চিন্তার জগৎ থেকে ফিরে এলো শায়েরী।

“আসছি মা।”
বলেই ছুটলো রান্নাঘরের দিকে।

খাদিজা বেগম মাছ কুটছিলেন।শায়েরীর বাবা বাড়িতে থাকলে ছোট মাছ খেতে চান।ছোট মাছের যেকোন চচ্চড়ি উনার খুবই প্রিয়।স্বামী বাড়িতে থাকলে তার প্রিয় খাবার গুলো সামনে হাজির করতে সবসময়ই চেষ্টা করেন তিনি।আজও তার ব্যতিক্রম ঘটেনি।বড় ছেলেকে বাজারে পাঠিয়ে কিছু ছোট মাছ, কচুর লতি,ছোট চিংড়ি, লইট্যাশুটকি আনিয়েছেন।আজ শুটকি ভুনা, ছোট মাছ চচ্চড়ি,কচুরলতি দিয়ে চিংড়ি আর পাতলা ডাল রান্না করবেন।সেই মতো সব আয়োজন করেছেন। চুলায় ডাল বসিয়ে দিয়ে তিনি মাছ নিয়ে বসেছেন।কিছু সময় পরই হুশ হলো জোর বাতাস বইছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।ছাঁদে অনেকগুলো কাপড় মেলে দিয়ে এসেছেন।সেগুলো যে ভিজবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
তাই মেয়েকে ডাক দিলেন।

“কি হয়েছে মা?”

“তাড়াতাড়ি ছাঁদে যা।সকালে এতোগুলো কাপড় মেলে দিয়ে এসেছি সব ভিজবে না হয়।”

“ভিজবে কেন?”

খাদিজা বিরক্ত হলেন কিছু টা।
“কোন জগতে আছিস?বৃষ্টি নামবে একটু পরেই।কি জোর বাতাস বইছে দেখছিস না?দৌড় দে।”

মায়ের কথায় বাইরের দিকে চেয়ে দেখলো একটু।সত্যি বেশ জোরেশোরেই বাতাস বইছে।

শায়েরী কাপড় গুলো নিয়ে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই আকাশ ভেঙে পরলো।
শুকনো কাপড় গুলো খাটের একপাশে রেখে বসে পরলো শায়েরী।
যেভাবে বৃষ্টি শুরু হয়েছে এতো শীঘ্রই কমবে বলে মনে হয় না।এখন কি হবে?নাবিলের সাথে দেখা হবে কি করে?এই বৃষ্টির মধ্যে তো কোন ভাবেই সম্ভব না।তাহলে কি কোন ভাবেই ও এই বিয়ে ঠিক হওয়ার কথা ওকে জানাতে পারবে না?

__________

বেলা দুটো বাজে। বাইরের বৃস্টির জোড় একটুও কমেনি।বরং থেকে থেকে বেশ বাড়ছে।খাবার ঘরে সবাই খেতে বসেছে।শায়েরী,ওর মা বাবা, বড় ভাই ফয়সাল।শায়েরীর বাবা আফজাল হোসেন একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন।কর্মক্ষেত্র ঢাকার বাইরে।পনেরো দিন পরপর বাড়িতে আসেন।যখন তিনি বাড়িতে থাকেন সবাইকে নিয়ে গল্প গুজব করে খেতে বসেন।যদিও এই সবাইর মধ্যে একজন উপস্থিত নেই।শায়েরীর ছোট ভাই আহসান।সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র। পড়াশোনায় ব্যস্ত সময় পার করছে এখন।

“বৃষ্টির দিন ছিলো খিচুড়িই করতে না হয়।সাথে গরুর মাংস আর ভর্তা।”
খেতে খেতেই বললেন আফজাল হোসেন।

“হ্যাঁ,মা।বাবা একদম ঠিক বলেছে।আজ না হয় তাই করতে।”
বললো ফয়সাল।

“রান্না অর্ধেক শেষ হয়ে গিয়েছিল তাই আর করিনি।রাতে
করে দেব না হয়।”
খাদিজা বেগমের প্রতুত্ত্যর।
“শায়েরী?”

“হু।”

“তুই খাচ্ছিস না কেন?”

“এমনি বাবা।ভালো লাগছে না।”

“শরীর খারাপ লাগছে? ”

“না।”

“তাহলে?”

“এমনি।এমনিতেই কেন যেন ভালো লাগছে না।”

“একটা কথা বলবি?”

“কি কথা বাবা?”

“তোর এ বিয়েতে কোন অমত নেই তো মা?মানে তোর যদি কোন পছন্দ থাকে তবে আমাদের বলতে পারিস।বিয়ের কথা শোনার পর থেকেই তোকে কিছু টা আপসেট লাগছে।কি সমস্যা? বলবি মা।”

শায়েরী মাথা নিচু করে প্লেটের ভাত নাড়াচাড়া করছিলো আর বাবার কথা শুনছিলো।কি বলবে বাবাকে? যে সম্পর্ক টা কখনো গড়েই উঠে নি তার কথা কি বলবে।নাবিল ভালো ছেলে।ভালো চাকরি করে।ফ্যামিলি ভালো।কিন্তু ও তো আর শায়েরীকে ভালোবাসে না।যে ওকে ভালোই বাসে না তার কথা পরিবারকে জানিয়ে শুধু শুধু কস্ট দেয়ার মানেই হয় না।তার থেকে বাবা মা যে টা চায় সেটাই হোক।
শায়েরী কে চুপ থাকতে দেখে ওর মা আলতো করে পিঠে হাত বুলালেন।

“কি রে কথা বলছিস না কেনো?তোর বাবা কি জানতে চায় উত্তর দে।”

শায়েরী আলতো করে হেসে উঠলো।
“না বাবা।তোমরা যা ভালো মনে করবে তাই হবে।আমার কোন আপত্তি নেই।”

__________

তুমুল বৃষ্টির পরে আকাশ টা এখন পরিস্কার। খানিকটা রোদ উঠেছে।গাঁঢ় নীল ঝকঝকে আকাশ দেখে বোঝার উপায় নেই ঘন্টা খানেক আগেও সেখানে কালো মেঘেরা খেলা করছিলো।
বারান্দার গাছগুলোকে দেখতে গিয়ে এমন ঝকঝকে আকাশ দেখে মন টা একদমই ভালো হয়ে গেলো শায়েরীর।যে তুমুল বর্ষণ শুরু হয়েছিল ও তো রীতিমতো চিন্তায় পরে গিয়েছিল কিভাবে বের হবে আজ।
এখান থেকে অফিসার্স কোয়ার্টার বেশ দুরে।নাবিল অপেক্ষা করবে তার পাশের ক্যাফেটেরিয়ায়।
কথাটা মাথায় আসতেই ঘড়ির কাঁটার অবস্থান জানাটা জরুরি হয়ে পরলো শায়েরীর জন্য।
দুপুরের খাবারের পর নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরেছিলো মনে পরছে না।
হাতঘড়ি টা নিয়ে সময় দেখলো শায়েরী।এখনো আধা ঘণ্টা সময় আছে । দ্রুত তৈরি হয়ে মায়ের রুমের দিকে গেলো।মায়ের ঘরের দরজা ভেজানো।মনে হয় ঘুমিয়ে আছে। বড় ভাইয়ের রুমের দরজাও লাগানো।
কাকে বলে যাবে?
পরক্ষনেই মনে হলো থাক।ও যাবে আর আসবে।নাবিল তো এতো ছটফটে স্বভাবের যে কখনো ওর সাথে একটানা এক ঘন্টাও কাটানো হয় নি।যাবে। এক কাপ চা, সাথে একটা কি দুটো সিংগাড়া খেতে খেতে কথা টুকু বলা হয়ে যাবে।এরপর চলে আসবে।সব মিলিয়ে একঘন্টা লাগারও কথা না।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দরজাটা সাবধানে লাগিয়ে বের হলো শায়েরী।

_________

“কি রে এতো জরুরি তলব?”
শার্টের হাতা গুটাতে গুটাতে বললো নাবিল।

নাবিলকে দেখেই কেমন যেন কস্ট হচ্ছে শায়েরীর।কিন্তু নিজেকে সামলে নিল তাড়াতাড়িই।
“তলব আমি করলাম না আপনি?”

“কথা তো তুই বলতে চেয়েছিস?”

“হ্যাঁ।কিন্তু কোথাও আসতে তো চাইনি।”

“আচ্ছা। হয়েছে হয়েছে। বাদ দে।কি খাবি?সমুচা না সিংগাড়া? ”

“আজ আপনি অর্ডার করুন। আজ আপনার পছন্দসই খাবার খাবো।”

“বাবাহ,এতো উন্নতির কারন কি?তুই তো কখনো আমাকে অর্ডার করতে দিস না।আমার কাজ বিল দেয়া।”

নাবিলের কথায় মন টা আবার খারাপ হতে শুরু করলো শায়েরীর। বেশ ধীর গলায় বললো,
“কারন আজকের পর আর কখনো আপনার সাথে এভাবে বসে খাওয়া হবে না।তাই ভাবলাম আজকে আপনাকে একটু সুযোগ দি।”

নাবিল একটু হোঁচট খেলো যেন।একমুহূর্তের জন্য বুকটা কেঁপে উঠলো। ঠান্ডা গলায় বললো,
“ফাজলামো কিন্তু আমি একদম পছন্দ করি না।জানিসই তো।”

“হ্যাঁ।জানি তো।আমি ফাজলামো করছি আপনাকে কে বললো?”

“তাহলে এসব কথার মানে কি?এমনভাবে বলছিস যেন কোথাও চলে যাচ্ছিস। ”
খানিকটা রেগে গিয়ে বললো নাবিল।
“যাচ্ছিই তো।”

“কোথায়?”

“শ্বশুরবাড়ি।”

“মানে?”

“মানে আমার বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। সামনের বৃহস্পতিবার আমার গাঁয়ে হলুদ।শুক্রবার বিয়ে।সেই বিয়ের দাওয়াত দিতেই আপনাকে কল করেছিলাম।আপনি তো আমার কথা ভালোভাবে শোনারও প্রয়োজন বোধ করেন না কখনো।আজও করলেন না।তাই আসলাম আপনার কাছ থেকে বিদায় নিতে।”
একনিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে দম নিলো শায়েরী।

নাবিল হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে ওর দিকে।যেন অভাবনীয় কোন কথা শুনছে।শায়েরীর বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে। এসব কি শুনছে? মনে মনে যাকে এতোটা বছর ধরে ভালোবেসে আসলো তার নাকি বিয়ে! এখন কি করবে ও?কিভাবে সব ঠিক করবে?বিয়ে তে শায়েরীরও মত আছে বলেই মনে হয়।কেমন উৎফুল্ল হয়ে খবর টা দিলো একদমে।অবশ্য ওরই বা কি দোষ।নাবিল তো কখনো ওর কাছে নিজেকে প্রকাশই করে নি।বরং শায়েরী প্রেম ভালোবাসা সংক্রান্ত কোন কথা উঠালেই হেঁসে উড়িয়ে দিয়েছে। সবসময় বলেছে, “এ্যাই তুই চুপ থাক তো।কি বলছিস এসব?বেশি পেকে গেছিস।পিচ্চি মানুষ। তুই প্রেম ভালোবাসার কি বুঝিস?আর যেন এমন কথা কখনো তোর মুখে না শুনি।”আর আজ কি শুনছে?ওর এই পিচ্চি টারই না কি আর মাত্র ছয় দিন পর বিয়ে।তবে কি এতোদিনের সব স্বপ্ন এভাবে মাঠে মারা যাবে?
মনের ঝড় টুকু আগলে রেখে মুখে জোর করেই হাসি টানলো নাবিল।
” বলিস কি রে,এতো কেলেংকারিয়াস ব্যাপার হয়ে গেলো।তোর বিয়ে?”

“হ্যাঁ।আর আপনার দাওয়াত। আসবেন কিন্তু। ”

চলবে………

মেঘের পরে মেঘ-১

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here