মেঘের পরে মেঘ -১৪
মাস দুই আগে রুপসাদের কলেজে নবীনবরণের জন্য সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছিল।সেখানে নতুনদের পাশাপাশি অনেক পুরোনো ছাত্র ছাত্রীও ছিল।প্রলয় ছিলো সেই ছাত্রদেরই একজন।বছর ছয়েক আগে এই কলেজ ছেড়েছে।কিন্তু এখনো মায়া কাটিয়ে উঠতে পারেনি। যখনি কলেজে কোন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান আয়োজিত হয়,তখনি প্রলয় ওর নতুন পুরাতন বন্ধুদের নিয়ে উপস্থিত হয়।যতোটুকু না আয়োজনে অংশগ্রহন করে তার চেয়ে বেশি বন্ধুদের নিয়ে ঘুরে বেড়ায় কলেজের এখানে সেখানে।
কখনো শহীদ মিনারের সিড়িতে বসে আড্ডা দেয়, তো কখনো কলেজের সামনে মেহগনি গাছের গুড়িতে বসে।
সেদিনও শহীদ মিনারের সিড়িতে বসেই আড্ডা দিচ্ছিলো প্রলয় আর ওর বন্ধুরা।আড্ডার মূল বিষয় কোন মেয়ে সবচেয়ে সুন্দরী।
নবীনবরণ উপলক্ষে সব মেয়েই সেজেগুজে এসেছে।বেশিরভাগই আটাময়দার গোডাউন নিয়ে এসেছে মুখ জুড়ে। প্রলয়ের বিরক্ত লাগে এসব সাজগোজ।মেয়েরা সাজবে এটাই ন্যাচারাল।কিন্তু সাজের মধ্যেও তো একটা আর্ট থাকবে।এদের দেখে মনে হচ্ছে বাড়ির সর্বশেষ ফেসপাওডার টুকুও আর অবশিষ্ট নেই।
হেন কোন রঙ নেই যা ওরা মুখে লাগায়নি। বাকি বন্ধুরা হা করে মেয়েদের দেখলেও প্রলয়ের বিরক্ত লাগছে।
কি লাভ এসব মেয়ে দেখে কে সুন্দরী সেটা বের করার?
সুন্দরী তো সেই, যার কোন মেকওভারের প্রয়োজন নেই।কিংবা প্রয়োজন থাকলেও তা খুবই নগন্য।
একটু কাজল,একটু লিপস্টিক আর কি দরকার সাজার জন্য।
“তোরা বস,আমি আসছি।”
প্যান্ট ঝাড়তে ঝাড়তে বললো প্রলয়।
“কোথায় যাস?”
বন্ধুদের একজন জিজ্ঞেস করে।
“আসছি।”
বলেই হাঁটা শুরু করলো প্রলয়।
কলেজের সামনেই একটা স্টেশনারি শপ ছিলো।যেখানে কোমল পানীয়ও বিক্রি হয়।সেখানে গিয়ে প্রলয়
দুটো দু লিটারের সেভেন আপ নিলো।টাকা দিয়ে ফিরতি টাকার জন্য অপেক্ষা করছিলো ও।হঠাৎই সেখানে লাল শাড়ি পরা একটা মেয়ে আসে।প্রলয় প্রথমে দেখেনি। মেয়েটির গলা শুনে তাকায়।দোকানীর কাছে কিছু একটা চাইছিলো সে।ব্যস্ত ভঙ্গি।
প্রথম বারের মতো প্রলয়ের চোখ আটকে যায় কোন মেয়ের উপর।একেবারে ন্যাচারাল বিউটি।
চেহারায় কোন অযথা সাজগোজের লেশমাত্র নেই।শাড়ির সাথে ম্যাচিং করে ঠোঁটে লাল লিপস্টিক। ব্যস এটুকুই।
কিন্তু এতেই যেন রুপ ঠিকরে পড়ছে। প্রলয় মুগ্ধ চোখে চাইলো।তাও অল্প সময়ের জন্য। কারন মেয়েটি যেমন দ্রুত এসেছিলো তেমন দ্রুতই চলে গেলো।
প্রলয়ের দিকে একবার তাকালো না পর্যন্ত।
এরপর প্রলয় সারা কলেজ খুঁজেছে মেয়েটিকে।কিন্তু সে যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।কোথাও পেলো না।
সাধারণত কলেজ অনুষ্ঠান শেষে প্রলয় ঢাকা চলে যায়।কিন্তু এই বার আর গেলো না।হারিয়ে যাওয়া মেয়ে টিকে খুঁজে পাওয়ার এক অদম্য তৃষ্ণা জাগে ওর মনে।
ওদিনের পর আরো কয়েকদিন ও এসেছে কলেজে কিন্তু সেই মেয়েটির দেখা পায় নি।বারবার খুঁজেও ব্যর্থ হওয়ায় প্রলয় ভাবলো মেয়েটি হয়তো এখানকার না।অনুষ্ঠান উপলক্ষে হয়তো এসেছিল।তাই আর অপেক্ষা করে না। ও ঢাকা চলে যায়।
গত দুই মাস ও ব্যস্ত থেকেছে নিজের পড়াশোনা নিয়ে।গত সপ্তাহে বাড়ি এসেছে।মাস্টার্স পরীক্ষার পর এবার লম্বা ছুটি পেয়েছে। ও ঠিক করেছে এবার এ সময়টা বাড়িতেই কাটাবে।
সেদিন দুপুরে ব্যালকনি তে দাঁড়িয়ে এক বন্ধুর সাথে মোবাইলে কথা বলছিলো প্রলয়।নিচের দিকে তাকাতেই
সেই মেয়েটাকে দেখতে পেলো।কলেজ ইউনিফর্ম গায়ে।যে কিনা ওদের বাড়ির গেট দিয়েই ঢুকলো।
প্রলয় দৌড়ে দরজার কাছে গেলো।দরজা খুলতে একটু সময় লাগলো।ততক্ষণে মেয়েটি ওদের ফ্ল্যাট ছাড়িয়ে উপরের দিকে উঠতে শুরু করেছে।প্রলয় ধীর পায়ে ওকে অনুসরণ করলো।
মেয়েটি ওদের ছাঁদের এককোনার ফ্ল্যাট টায় ঢুকলো।
যাকে এতোদিন ধরে খুঁজে মরছে সে কিনা এখানে?মনে মনে বেশ খুশি হয় প্রলায়। কিন্তু এই মেয়েটা এখানে কি করে? এই মেয়েটা কি ওদের এখানে ভাড়া থাকে?প্রশ্ন টা মনে উঁকি দেয়ামাত্র নিজের ফ্ল্যাটে ঢুকে মায়ের কাছে গেলো।মায়ের কাছ থেকেই জানতে পারলো।মেয়েটির নাম রুপসা।এবং নিজের মায়ের সাথে এখানেই ভাড়া থাকে।
প্রলয় প্রথম দুদিন রুপসাকে অনুসরণ করলো। ও কি করে?কোথায় যায়?কখন কলেজে যায়?কখন বাড়ি ফিরে?সব বিষয়ে খোঁজ নেয়।রুপসা নিজের কলেজ ছাড়া আর কোথাও যায় না।কলেজ শেষে সোজা বাড়ি ফিরে।বিকেলের দিকে মাঝে মাঝে ছাঁদে বসে গল্পের বই পড়ে কিংবা হাঁটাহাঁটি করে।
এসময় মূলত ও একাই থাকে।ওর মা বেশিরভাগ সময়ই
নাকি পাঁচটার পর ফিরেন।
তাই প্রলয় ঠিক করলো এ সময়টা এখন থেকে ছাঁদেই কাটাবে।সেই অনুযায়ী ও ছাঁদে যায়।গান টা খুব ভালোই
গায়।সেজন্য ভাবলো গান দিয়েই পরিচয় পর্ব শুরু করা যাক।গান শুনে রুপসা নিশ্চয়ই এগিয়ে আসবে ওর সাথে পরিচিত হতে।তখন কি কি কথা হবে মনে মনে একটা ছক কষেও রেখেছিল।
কিন্তু বিধি বাম। ও যেদিন থেকে ছাঁদে আসা শুরু করলো, সেদিন থেকেই রুপসা গল্পের বই পড়া ব্যস্ত হলো।
নিজের সবটুকু মনোযোগ ঢেলে দিয়ে ও গান গাইতে থাকে।যদি গানে মুগ্ধ হয়ে ও বেরিয়ে আসে আর কিছু কথা হয়।
বেশ কদিনের প্রচেস্টার অংশ হিসেবে আজও ছাঁদে এসেছিল প্রলয়।এসে দেখলো রুপসাদের রুমের সাথে একটা টি টেবিল পাতা।সেখানে প্লাস্টিকের কাগজের উপর ডালের বড়ি শুকাতে দেয়া।
মনে মনে ভাবলো গান শুনে না হোক এই বড়ি গুলো নিতে হলেও তো রুপসা আসবে।
গান শেষ করে ও আজ আর নিচে নেমে গেলো না।অপেক্ষা করতে থাকলো।আকাশে অনেক মেঘ জমেছে। যে কোন সময় বৃষ্টি নামবে।ঝোড়ো হাওয়াও বয়ে যেতে লাগলো।
অবশেষে অপেক্ষার অবসান হলো।রুপসা দরজা খুলে দ্রুত পায়ে বের হলো।
প্রলয় সামনে যেতে কি অবাক করা চাহনি! কি গভীর চোখ!
ওই চোখেই যে এখন ডুবে মরতে চায় প্রলয়।
_______
“তুই হাসছিস যে?”
বিরক্ত হয়ে বললো রুপসা।
“হাসবো না?”
বললো মনিকা।
সেই দিনের ছাঁদে দেখা হওয়ার পরও আরও কয়েকবার প্রলয়ের সাথে দেখা হয়েছে রুপসার।ব্যাপারটা কাকতালীয় না কি ইচ্ছেকৃত তা জানে না রুপসা।কিন্তু যতবারই দেখা হয়েছে রুপসা এড়িয়ে যেতে চাইলেও পারেনি।প্রলয় ডেকে ডেকে কথা বলেছে। মানা করলেও শুনেনি।গতকাল থেকে কলেজের সামনের দোকানে বসছে টাইম করে। রুপসা বাড়ির পথে হাঁটা ধরলে সেও আসতে থাকে।যেন ও রুপসার বডিগার্ড। যদিও কোন রাফ বিহেব করে না ওর সাথে। তবুও কেমন যেন লাগে রুপসার।কেমন করে যেন কথা বলে
উনি।রুপসা বেশির ভাগ কথারই কোন উত্তর খুঁজে পায় না।
আজ বান্ধবীদের নিয়ে ঝালমুড়ি খাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিছুক্ষনের মধ্যে ঝালমুড়ি তৈরি হয়ে যায়।টাকা দিতে যাওয়ার সময় বাঁধে বিপত্তি। ঝালমুড়ি ওয়ালা টাকা নিবে না।কেন নিবে না জিজ্ঞেস করলে বলে দোকানে বসা ভাইজান দিয়া দিসে।
দোকানে তখন প্রলয় বসা ছিল।রুপসা রেগে গেলো।এরকম দৌড়ে গেলো সেখানে।
“এসব কি?”
প্রলয় যেন কিছু জানেই না এমন ভাবে জিজ্ঞেস করলো,
“কোন সব?”
“আপনি ঝালমুড়িওয়ালাকে টাকা দিয়েছেন কেন?”
“এমনি দিয়েছি।কোন সমস্যা? ”
“আমি আপনার টাকায় খাবো না।”
“টাকার গায়ে কি লেখা আছে ওটা আমার টাকা?”
“লেখা না থাক।আমি নেবো না।”
নিজের ব্যাগ থেকে বিশটাকার নোট বের করে প্রলয়ের সামনে ধরলো,
“নিন।”
প্রলয় শান্ত চোখে রুপসার দিকে তাকালো। তারপর বিকট জোরে একটা ধমক দিলো,
“বেয়াদব মেয়ে।কতবড় সাহস আমাকে টাকা সাধে।যাও সামনে থেকে।”
রুপসা ভীষণ চমকে উঠলো। তারপর এক দৌড়ে কলেজে ঢুকে গেলো।বান্ধবীরাও ছুটলো পর পিছু পিছু।
কমনরুমের বেঞ্চে বসে কেঁদেই দিলো রুপসা।
“ছেলেটা কে?আর তোর সাথেই বা এমন ব্যবহার করলো কেন?”
মনিকা জিজ্ঞেস করলো।
রুপসা বেশ কিছু সময় কাঁদলো।ক্লাস শুরু হওয়ায় মনিকাকে ওর সাথে রেখে বাকি বান্ধবীরা চলে গেলো। মনিকার উপর্যুপরি জিজ্ঞাসায় রুপসা ওকে সবটা বললো।সব শুনে মনিকা হাসতে শুরু করলো।
রুপসা বিরক্ত হলো ওর এমন ব্যবহারে।
“এখানে হাসির কি আছে?”
হাসি থামিয়ে চেহারায় কিছু টা সিরিয়াসনেস এনে বললো,
“প্রথমে তুই বল, তোর কি মনে হয়, উনি তোর সাথে এমন কেন করেন?”
“কি জানি?বলতে পারবো না।”
“আমি বলি।”
“বল।”
“উনি তোকে ভালোবাসেন মনে হয়।”
“ধুর কি বলিস।এমন কিছুই না।”
অবাক হয়ে বললো রুপসা।
“এমন কিছুই। ছাঁদে বসে গান গাওয়া,তোর পিছু নেওয়া,তোকে ডেকে ডেকে কথা বলা আর এখন এই কলেজের সামনে বসে থাকাতেই প্রমানিত হয় ওনি তোকে ভীষণ পছন্দ করেন।”
রুপসা কান্না ভুলে মনিকার দিকে তাকিয়ে রইলো।বিরবির করে বললো,
“মা একদম মেরে ফেলবে আমাকে।”
চলবে……
মুনিরা মেহজাবিন।