মেঘের পরে মেঘ -১৫
গত দুদিন যাবত রুপসা কলেজে যাচ্ছে না।কেন যাচ্ছে না সেই কারনটাও অজানা। কেমন গুম হয়ে থাকে। মনে হয় কি যেন ভাবছে।রুপসার মন খারাপ থাকলে শায়েরীর একটুও ভালো লাগে না।কেমন অস্থির অস্থির লাগে।মন ভালো করার জন্য নানান চেষ্টা চালিয়ে যাবে।এটা ওর পুরোনো অভ্যাস।যা নাবিল থেকে প্রাপ্ত।
দেড় বছরের সংসার জীবনে নাবিলের মান ভাঙানোর কোন চেষ্টা ওকে করতে হয়নি।নাবিলই সে কাজটা করে গেছে অক্লান্ত ভাবে।নানারকম প্রচেস্টা।কখনো ওর প্রিয় কোন রেসিপি রান্নার চেষ্টা করে।কখনো কোন গিফট এনে তো কখনো পেছন থেকে জড়িয়ে ধরে নানা কথার মাধ্যমে।শায়েরীর চুল গুলো ওর ভীষণ প্রিয় ছিলো।কথার ছলে কতোবার যে ওর চুলগুলো খুলে দিয়ে তাতে মুখ ডুবিয়েছে তার কোন ইয়ত্তা নেই।
নাবিলের কথা মনে হতেই একরাশ বিষন্নতা এসে ঘিরে ধরলো শায়েরীকে।কতগুলো বছর চলে গেলো তবুও স্মৃতি গুলো এখনো অমলিন।মনে হয় এই তো সেদিন।
মনের বিষন্নতা কে এখন আর তেমন পাত্তা দেয় না শায়েরী।সময়ের সাথে সাথে শায়েরী এখন আরো পরিপূর্ণ, আরো শক্ত মনোবলের অধিকারী। সবচেয়ে বড় কথা ও এখন একটা মেয়ের মা।যার জন্য হলেও নিজেকে আরো কঠিন পদার্থে পরিনত করেছে শায়েরী।
সেখানে নাবিলের কথা ভেবে সারাদিন বিষন্নতায় কাটিয়ে দেবে তা ভাবার কোন অবকাশ নেই।
মনের আকাশে যতটুকু মেঘ জমেছিল তা ঝেড়ে ফেলে ও উঠে দাঁড়ালো। খাবার টেবিলে নাস্তা সাজালো।রুপসার প্রিয় গরুর মাংস ভুনা আর খাস্তা পরোটা।সাথে আলু ভাজি আছে।পানির জগ টা রেখে রুপসার রুমের দিকে গেলো শায়েরী।
রুপসা কলেজে যাওয়ার জন্য তৈরি।শায়েরী অবাক হলো কিছু টা কিন্তু মুখভঙ্গিতে মোটেও প্রকাশ করলো না।হাসিমুখে বললো,
“তুই রেডি হয়ে নিয়েছিস?”
“হ্যাঁ,মা।কেন? কোন সমস্যা? ”
“সমস্যা কোথায় থাকবে?কোন সমস্যা নেই। এই দুদিন কলেজে যাসনি তাই ভাবলাম আজও হয়তো যাবি না।তাই আর কি।”
“আজ তো যেতেই হবে।আজ একটা ক্লাসটেস্ট আছে।এই দুদিন এমনিতেই যাই নি।শরীরটা ভালো লাগেনি।”
“শরীর ভালো লাগে নি?কেন?কি হয়েছে তোর?”
উদগ্রীব হয়েই জিজ্ঞেস করলো শায়েরী।
“না মা,তেমন কিছু না।শুধু একটু মাথা ব্যথা।তাই আর তোমাকে জানায়নি।”
“ঠিক তো?”
সন্দেহের চোখে চেয়ে বললো শায়েরী।
“হ্যাঁ মা।একদম ঠিক।তুমি শুধু শুধু টেনশন করো না তো।”
মাকে আশস্ত্ব করে বললো রুপসা।
“খেতে আয়।”
বলেই শায়েরী টেবিলে গিয়ে বসলো।রুপসা যখন কিছু বলতে চাইছে না থাক।হয়তো আসলেই তাই। এ বয়সী মেয়েদের নিয়ে একটু যন্ত্রনাই।মুডের কোন ঠিক ঠিকানা নেই।এই ভালো তো এই খারাপ।
____
নিজেদের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে প্রলয়।এখান থেকে রাস্তা টা একদম পরিস্কার দেখা যায়।যদি রুপসা বের হয় তো সহজেই দেখতে পাওয়া যাবে।গত দুদিন ম্যাডামের কোন দেখা নেই।এই দুদিনে না হলেও দশবার ছাঁদে গিয়ে বসেছিল প্রলয়। ভেবেছিলো ছাঁদে অন্তত আসবে।কিন্তু কোন লাভ হয়নি।আসেনি রুপসা।একবারের জন্যও না।একপলক রুপসাকে দেখার জন্য মনটা উঁচাটন হয়ে আছে। রাতে একদমই ঘুমাতে পারেনি।কেবলই ওর দৌড়ে চলে যাওয়াটুকু মনে পরেছে।একটু বেশিই করে ফেলেছে।আফসোস হয় অনেক।কেন যে এমন করতে গেলো।
বন্ধুরা যে বলে একদম ঠিকই বলে।ওর সাথে কোন মেয়েই রিলেশনে জড়াতে চাইবে না।মেয়েদের সাথে ভাব জমানোর কোন গুনই ওর নেই।
মনে মনে রুপসাকে খুঁজে চলছে অবিরাম। দেখা পাওয়া মাত্রই সরি বলবে।
আর ওর কিনা দেখাই নেই।এর জন্য ও ভীষণ রেগে আছে প্রলয়।একবার শুধু ওর দেখা পাক,খবর করে ছাড়বে।
ভাবতে ভাবতেই রুপসাকে রাস্তায় দেখতে পেলো।কলেজ ইউনিফর্ম পরেই বেরিয়েছে।
আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে চুলে একটু চিরুনি চালিয়ে দৌড় দিলো প্রলয়।
রাস্তায় নামতেই রুপসাকে রিকশায় বসে চলে যেতে দেখলো।নিজেও একটা রিকশা ডেকে তাতে উঠে পরলো।
পৌঁছুতেই রুপসা নেমে গিয়ে হাঁটতে শুরু করলো।ও খেয়াল করেছে প্রলয় ওর পিছু পিছু আসছে।কিছুতেই আর ওর সামনে যাওয়া যাবে না।কিন্তু গেট টাও পেরুতে পারলো না।তার আগেই ওর নামে ডাক শুনতে পেলো।পেছনে না তাকিয়েও ও বুঝতে পারলো ও টা প্রলয়।
এক মুহূর্তের জন্য থামলেও এরপর আর দাঁড়ালো না রুপসা।সোজা হেঁটে নিজের ক্লাসে চলে গেলো।
পেছনে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইলো প্রলয়।কি হলো এটা?রুপসা শুনেও ওর ডাক অগ্রাহ্য করে চলে গেলো।
দোকানদার এটা দেখে ওর দিকে তাকিয়ে হাসছে।
প্রলয়ের লজ্জা করতে লাগলো।ছিঃ ছিঃ শেষে কিনা একটা দোকানদারও ওকে দেখে হাসছে।
শুধুমাত্র একটা মেয়ের জন্য। প্রেম কি মানুষ কে আসলেই নিচে নামিয়ে দেয়?
মনটা একটু খারাপই হলো।প্রায় চিৎকার করে দোকানদারের উদ্দেশ্যে বললো,
“এতো হাসির কি আছে?”
“চেতেন ক্যা?”
হাসতে হাসতেই বললো দোকানদার।
“চেতবো না তো কি করবো?নিজেকে সার্কাসের জোকার মনে হচ্ছে। ”
“এদিকে আসেন ভাইজান।এইখানে বসেন। দুইডা কথা কই।”
হাসি থামিয়ে বললো।
না চাইতেও প্রলয় সেখানে গিয়ে বসলো।দোকানী ওকে এক কাপ চা দেয়।
“নেন ভাইজান গরম গরম চা খাইয়া মাতাডা ঠান্ডা করেন।”
প্রলয় চায়ের কাপ হাতে নিলেও তাতে চুমুক দিলো না।
“কি বলবেন যেন বলছিলেন? ”
দোকানদার হাসলো।তারপর বললো,
“রাগ কইরেন না আপার লগে।পোলাপান মানুষ। তয় হে এমুনি।কলেজের প্রায় সব ম্যায়ারাই কম বেশি পেরেম পিরিতি করে।হেরে কুনদিন কারো লগে বাইরেও যাইতে দেহি নাই, পেরেম তো দুর।বরো বালো ম্যায়া।”
“ভালো বলেই তো পেছনে ঘুরছি।না হলে এসব প্রেম ট্রেম আমার জন্য না।এতোদিন তো এভাবেই কাটলো।কোন মেয়ের দিকে অন্য মনোভাব নিয়ে তাকাইনি পর্যন্ত।আর যাও একে ভালো লাগলো এতো পাত্তাই দিচ্ছে না।আমাকে দেখলেই পালায়।যেন খেয়ে ফেলবো।”
“লাইগা থাকেন।অইয়া যাইবো।”
“বলছো?”
“হ ভাইজান। কইতাছি।আপনে তো দেখতে মাশাল্লাহ।আপায় নিশ্চয়ই আপনেরে পছন্দ করবো।”
“তোমার কথাই যেন সত্যি হয়।”
বলেই হাতে ধরা ঠান্ডা চায়ে চুমুক দিলো।
________
এ কদিন অনেক ভেবেছে রুপসা।ভেবে ভেবেই একটা সিদ্ধান্তে এসেছে।এ্যাই ছেলেকে কোন ভাবেই পাত্তা দেবে না।মায়ের ভরসাকে কোন ভাবেই ভেঙে যেতে দেবে না।মায়ের কত স্বপ্ন ওকে নিয়ে। একটা ছেলের জন্য তা কিছুতেই পন্ড হতে দিবে না।
যদিও প্রলয়ের জন্য ওর মনে গাঁঢ় কোন অনুভূতির জন্ম হয়নি।তারপরেও মনের মধ্যে প্রলয়ের জন্য যতটুকু আবেগ জমা হয়েছিলো তা চাপা দিয়ে দিয়েছে।
প্রলয়ের ডাকাডাকিতেও সাড়া দেয় না।
প্রলয় যখন কলেজের সামনের দোকানে বসে থাকে ও ভুলেও সেখানে পা দেয় না।সব জায়গায়ই সতর্কতা অবলম্বন করেছে।যেন কোনভাবেই প্রলয়ের সামনে পরতে না হয়।
অবশ্য প্রলয়ও এখন ওকে ডাকাডাকি থামিয়ে দিয়েছে। পেছনে পেছনেও আসে না।এমনটাই জানে রুপসা।তাই নিশ্চিন্ত কিছুটা এখন।
কিন্তু সত্যি টা হলো প্রলয় এখনো ওর পিছু পিছুই আসে
কিন্তু রুপসার চোখের আড়ালে থেকে ওকে অনুসরণ করে। ওর হাসি দেখে গোপনে নিজেও হাসে।
আজও তাই হয়েছে। রুপসা কলেজে এসেছে। কিন্তু ক্লাস শেষের দিকে তুমুল বৃষ্টি শুরু হলো।ছাত্রছাত্রীও তেমন একটা নেই।বেশির ভাগ ছাত্র ছাত্রী রাই শেষ পিরিয়ডের আগেই বাড়ি চলে গেছে।রুপসা কখনো ক্লাস মিস দেয় না।সেই মতো সে আজও ছিলো।
কিন্তু এখন একি বিপদ!
এই বৃষ্টি কখন থামবে আর কখন ও বাড়িতে যাবে।
ঘন্টা খানেক কেটে যাওয়ার পরেও বৃষ্টি থামার কোন নামই নেয় না বরং আকাশ যেন আরো কালো মেঘে ছেয়ে যাচ্ছে। রুপসা চিন্তায় পরে যায়।
কিভাবে বাড়ি ফিরবে সেই চিন্তায় যখন অধীর হয়ে যাচ্ছিলো তখনই কলেজ ক্যাম্পাসে একটা সিএনজি ঢুকলো।চারিদিকে ভারী পলিথিনের কাগজ দেয়া।
সিএনজি টা ওর ক্লাসের সামনে এসে থামলো।
“এখানে রুপসা নামের কেউ আছে?”
সিএনজি ড্রাইভার বলে উঠে।
রুপসা এগিয়ে যায়।
“আমি রুপসা।”
“আপনাকে নিতে এসেছি।উঠে আসুন।”
“কে পাঠালো আপনাকে?”
“আপনার মা।”
রুপসা এর পরে আর কথা বাড়ালো না।গাঁ বাঁচিয়ে কোন রকমে সিএনজিতে উঠে পরলো।সিএনজি চলতে শুরু করলো। নিজের কাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে পাশে তাকাতেই ভুত দেখার মতো চমকে উঠলো রুপসা।প্রলয় বসে আছে ওর পাশে।
ভয় পেলো রুপসা।ওর ব্যাপারটা সহজেই বুঝতে পারলো প্রলয়।নরম গলায় অভয় দিলো রুপসাকে।
“এতো ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আমি তোমার কোন ক্ষতি করবো না।”
প্রলয়ের গলায় কিছু একটা ছিলো।রুপসা আর কথা বাড়ালো না।চুপচাপ একপাশে বসে রইলো।
চলবে……
মুনিরা মেহজাবিন।