মেঘের পরে মেঘ-১৭

মেঘের পরে মেঘ -১৭

রুপসার ভীষণ জ্বর উঠেছে।শায়েরী বেশ কয়েকবার শরীর মুছিয়ে দিয়েছে।ঔষধ দিয়েছে।কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না।এতো জ্বর কেনো আসলো?ডাক্তার তো এ ব্যাপারে কিছু বললো না।রাত একটা বাজে।এতো রাতে কি কোন ডাক্তার পাওয়া যাবে?চেষ্টা তো করাই যায়।একে তো মাথায় আঘাত তার মধ্যে এমন জ্বর।শায়েরীর একদমই ভালো মনে হচ্ছে না।বারবারই শুধু এটা সেটা ভাবনায় আসছে।মোবাইল টা হাতে নিয়ে সর্বপ্রথম জুনায়েদ কে ফোন দিলো।জুনায়েদ ওর স্কুলের জুনিয়র টিচার।সামনেই একটা মেসে থাকে।শায়েরীর খবর শুনে
বলেছিলো যে কোন প্রয়োজনে কল করতে।
রিং হচ্ছে কিন্তু কল রিসিভ করছে না।হয়তো মোবাইল সাইলেন্ট।
শায়েরী আরো কয়েকবার কল করলো।কিন্তু রিসিভ হলো না।
এরপর নিজের সহকারী শিক্ষিকা তানজিনাকে কল দিলো।প্রথম বার রিসিভ না হলেও পরেরবার রিসিভ হলো।

“হ্যালো তানজিনা?আমি শাহনাজ বলছিলাম।শুনতে পাচ্ছো?”

তানজিনা ঘুম ঘুম কন্ঠে উত্তর করলো।

“হ্যাঁ,আপু।শুনতে পাচ্ছি। বলো?”

“তুমি কি একবার তোমাদের গাড়িটা নিয়ে আমাদের এখানে আসতে পারবে?রুপসার শরীরটা ভীষণ খারাপ করেছে।হসপিটালে যেতাম একটু।”

“আরে আপু আর বলো না।গাড়ি টা নিয়ে মামুন ঢাকায় গেছে আজ রাতে।বাসায় থাকলে না হয় চলে আসতাম।”

“ওও।আচ্ছা ঠিক আছে।রাখি তাহলে।”

“কস্ট পেলেন আপু?”

“আরে না না।কস্ট কিসের।রাখছি।”

শায়েরী কলটা কাটার সাথে সাথে মামুন তানজিনাকে বলে উঠলো,

“কাকে বললে আমি গাড়ি নিয়ে ঢাকায় গিয়েছি?”

“হেডমাস্টারনীকে। ”

“কেন? ”

“ওনার মেয়ে অসুস্থ। আমাকে বলে গাড়ি নিয়ে ওনার বাসায় যেতে মেয়েকে নিয়ে হসপিটালে যাবে।কি আন্দাজ? এই রাত দুপুরে আমি গাড়ি নিয়ে যাবো ওখানে?কোন বিপদ হলে কে দেখবে?”

“ভালো করেছো।রাত-বিরেতেই গাড়ি টাড়ি বেশি চুরি হয়।”

“শুয়ে পরো।”

আর এদিকে কাউকে না পেয়ে শায়েরী ভীষণ ভেঙে পরলো।একা নিয়ে যাওয়া একদমই অসম্ভব ব্যাপার।কি করবে এখন?মোবাইল নিয়ে ঘাটাঘাটি করতে করতে প্রলয়ের নম্বর টা ওর সামনে আসে।মনে পরে ওর আশ্বাস।তবুও একটু দ্বিধা হয়।কলটা কি করবে?
সাতপাঁচ অনেক কিছু ভেবে শায়েরী সিদ্ধান্ত নেয় কল করার।
দুইবার রিং হতেই কল রিসিভ হলো।

“প্রলয় বলছো?”

“জ্বি আন্টি।কোন সমস্যা? ”

“ঘুমিয়েছিলে নাকি?”

“এইমাত্র ই বোধহয় চোখটা লেগেছিল আর আপনি কল
দিলেন।”

“ডিসটার্ব করলাম বাবা?”

“না না। কি বলছেন? আপনি নিশ্চয়ই জরুরি কোন কাজের জন্যই কল করেছেন।রুপসা ঠিক আছে আন্টি? ”
অধীর হয়ে জিজ্ঞেস করলো প্রলয়।

”তুমি ঠিকই ধরেছো বাবা।জরুরী প্রয়োজনেই কল করেছি।রুপসার ভীষণ জ্বর উঠেছে। ঔষধ দিলাম কাজ হচ্ছে না।এখন কি করবো বুঝতে পারছি না বাবা।হসপিটালে নেবো? ”

প্রলয়ের বুকটা কেঁপে উঠলো।আশংকার ঝড় বইতে শুরু করলো যেন।কোনমতে বললো,
“ঘাবড়াবেন না।আমি এখনি আসছি।তারপর দেখছি কি করা যায়।”

“একটু তাড়াতাড়ি আসো বাবা।আমার ভয় করছে।এমন তো কখনো হয় নি।”

“আসছি।”
কলটা কেটে গায়ে শার্ট চড়ালো প্রলয়।এমনিতেই রাত দুটো পর্যন্ত জেগে ছিলো।ঘুমই আসেনি।ঘুরে ফিরে কেবল রুপসার কথাই মনে হয়েছে।
বেরুবার আগে শেষবারের মতো নিজের ওয়ালেটের ওজন বুঝে নিয়ে তারপর খুব আস্তে বেরিয়ে এলো ফ্ল্যাট থেকে।
ছাঁদে পৌঁছাতে পৌঁছাতে সময় নিলো দুই মিনিট।এই দু মিনিট যেন শেষই হচ্ছিলো না।
দরজায় টোকা দেয়ামাত্র খুলে গেলো।

“রুপসা কোথায় আন্টি? ”

“এই তো এখানে।”

শায়েরীর পিছুপিছু ঘরে ঢুকলো প্রলয়।খাটের মাঝখানে শুয়ে আছে রুপসা।কপালে জলপট্টি দেয়া।মাঝে মাঝেই কেঁপে উঠছে।

“কি করবেন এখন?”

“বুঝতে পারছি না।এতোরাত হয়ে গেছে কি করবো বলো তো?”

“আপনি রেডি হয়ে নিন।আমি গাড়ি বের করে আসছি।হসপিটালে যাই আগে।তারপর যা হওয়ার হবে।”

বলেই শায়েরীর উত্তর না শুনেই বেরিয়ে গেলো।মিনিট দশেকের মধ্যেই ফিরে আসলো প্রলয়।শায়েরী রেডি হয়েই ছিলো।প্রলয়কে বললো,

“তুমি যাও আমি রুপসাকে নিয়ে আসছি।”

“আপনি পারবেন না আন্টি। আমিই ওকে নিয়ে আসছি।”
শায়েরীর সম্মতির অপেক্ষা করলো না প্রলয়।রুপসাকে কোলে তুলে নিলো।খুব সাবধানে সিড়ি বেয়ে নেমে গাড়িতে বসালো।শায়েরী রুপসাকে জড়িয়ে ধরে বসলো।আর প্রলয় ড্রাইভিং সিটে।
আধঘন্টার মধ্যে বেশ আধুনিক একটি হসপিটালের সামনে গাড়ি থামালো প্রলয়।এ হসপিটালেই প্রলয়ের পরিবারের সবাই আসে।সেবার মান খুবই ভালো।সবথেকে বড় কথা ডাক্তার থেকে নার্স সবার ব্যবহারই ভালো।ওনাদের হাসিমুখের কথাই রোগীর জন্য বেশি উপকারী হয়।

রুপসাকে নিয়ে হসপিটালে ঢুকতেই ওকে নিয়ে ডাক্তার নার্সদের ছোটাছুটি শুরু হয়ে গেলো।বেসিক প্রবলেম জেনে ওর চিকিৎসা শুরু করা হলো।
ডাক্তার ওদের কে খুব বেশি চিন্তিত দেখে অভয় দিলেন।বললেন,এটা তেমন বড় কোন সমস্যা না।ঠিক হয়ে যাবো।

_________

রুপসার পুরোপুরি সুস্থ হতে এক মাসের মতো সময় লাগলো।মাথার স্টিচ গুলো শুকোতেই সবচেয়ে বেশি সময় লেগেছে। এই একমাসে রুপসা প্রলয়ের ভালো লাগায় ডুবে গেলো পুরোপুরি।
প্রলয়ের ওর জন্য টান,ওর ভালো থাকাকে গুরুত্ব দিয়ে সবকিছু করা,ওর জন্য ছুটোছুটি করা,সময়ে অসময়ে এসে খোঁজ করা রুপসা কেমন আছে,এই সবগুলো বিষয়ই দায়ী রুপসাকে মুগ্ধ করার জন্য।
রুপসা এখন আর প্রলয়ের উপস্থিতিতে বিরক্ত হয় না বরং আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে ও কখন আসবে।
প্রায় প্রতিদিনই যখন তখন এসে হাজির হয়েছে প্রলয়।বিশেষ করে যখন শায়েরী বাড়িতে না থাকতো।এসে যে খোশগল্প জুড়ে দিতো তা নয়।আসতো,এসে জিজ্ঞেস করতো ও কেমন আছে,কোনকিছু লাগবে কি না?
উত্তর শুনে চলে যেতো।

এখন তো রুপসা সুস্থ। এখন কি আর আগের মতো আসবে প্রলয়?না আসাটাই স্বাভাবিক। এতোদিন তো একটা অজুহাত ছিলো।গতকাল থেকে সে অজুহাতও শেষ। ডাক্তার বলেছেন, রুপসা এখন পুরোপুরি সুস্থ। ও চাইলে এখন কলেজ এটেন্ড করতে পারে।

রুপসাও ঠিক করেছে আগামীকাল থেকে ক্লাস শুরু করবে।বই খাতা কোথায় কি আছে কে জানে?এ কয়েকদিনে তো ধারে কাছেও যাওয়া হয়নি।

পড়ার টেবিলে গিয়ে একটা একটা করে বই নেড়ে চেড়ে দেখতে থাকলো রুপসা।দরজায় টোকা পরলো তখনি।
রুপসা দরজা খুলে দিলো।প্রলয় দাঁড়িয়ে আছে।

“আসবো?”

“হ্যাঁ,হ্যাঁ।আসুন না।”

ধীর পায়ে ভেতরে ঢুকলো প্রলয়।সামনের সোফাটায় গিয়ে বসলো। রুপসা উসখুস করতে লাগলো।কেমন যেন অস্বস্তি লাগছে।কারন প্রলয় এক ধ্যানে ওর দিকেই তাকিয়ে আছে।

“আপনি বসুন।আমি আপনার জন্য লেবুর শরবত করে আনি।”

“কোথাও যেতে হবে না।এখানে বসো।কথা আছে।”

রুপসা বসলো।আস্তে করে বললো,

“বলুন।”

কোন ভনিতা না করে প্রলয় শুরু করলো। এমনভাবে সবটা বললো যেন মুখস্থ করে এসেছে।

“রুপসা আমি তোমাকে ভালোবাসি।তোমাকে বিয়ে করতে চাই।অনেক দিন ধরেই কথাটা বলতে চাইছিলাম কিন্তু বলা হয়ে উঠেনি।আজ বললাম।এখন তোমার সম্মতির প্রয়োজন।তুমি রাজি থাকলে আমি আন্টির সাথে কথা বলবো।”

রুপসা থ হয়ে গেলো।এভাবে কেউ কাউকে প্রপোজ করতে পারে ওর জানা ছিলো না।সেই সাথে বুকে হাতুড়ি পেটা শুরু হলো।কি বলবে ও?ও কি সত্যিই প্রলয়কে ভালোবাসে?
রুপসা উঠে দাঁড়ালো। প্রলয় অস্থির ভঙ্গিতে ওর হাত ধরলো।

“কোথায় যাও?”

কাঁপা কাঁপা কন্ঠে রুপসা বললো,

“আমি পানি খাবো।”

মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে রুপসা।মুখের ভাব বোঝা যাচ্ছে না।কিন্তু ও যে কাঁপছে একটু একটু করে তা প্রলয় বুঝতে পারলো। ও রুপসার হাত ছেড়ে দিলো।
মৃদু হাসলো প্রলয়।
“তুমি বসো।আমি পানি আনছি।”

বলেই ঘরের ভেতর ঢুকে এক গ্লাস পানি এনে রুপসাকে দিলো।
“নাও।পানি খেয়ে এবার চটপট হ্যাঁ বলে দাও।আমি চলে যাই।”

রুপসা পানিতে চুমুক দিলো না।মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলো।প্রলয় এগিয়ে এসে ওর সামনে দাঁড়ালো।একটু ইতস্তত করেও রুপসার মুখটা আঁজলা ভরে দু হাতের মুঠোয় আনলো।রুপসা চোখ বুঁজে আছে।ভীত হরিণীর ন্যায় শরীর থরথর করে কাঁপছে।

“রুপসা?”
কোমল কন্ঠে রুপসাকে ডাকলো প্রলয়।কিন্তু রুপসা চুপ।ও যেন বোবা হয়ে গেছে। হাত পা যেন অবশ হয়ে আসছে।আবারো ডাকলো প্রলয়,

“রুপসা তুমি কি সত্যিই আমাকে চাও না?একবার বলো।যদি না চাও আমি আর কখনো তোমাকে বিরক্ত করবো না।ভাববো তোমার চোখের ভাষা আমি পড়তে পারি নি।বলো রুপসা?”

“জানি না।”
কোনমতে এটুকু উচ্চারণ করতে পারলো রুপসা।

“তার মানে তুমি সব জানো।বলো?”

“আমি পারবো না।”

প্রলয় একটু থামলো।রুপসার মুখটাকে মুক্ত করে বললো,
“ঠিক আছে।বলতে হবে না।আমি আসছি।আর কখনো তোমার সামনে আসবো না।”

কথাটুকু শুনে রুপসা চোখ মেলে তাকালো।প্রলয় দরজা পর্যন্ত চলে গেছে।রুপসার খুব ইচ্ছে হলো বলে,প্লিজ যাবেন না।কিন্তু বুক ফেটে যাচ্ছে তবুও মুখে আনতে পারছে না কথাটা।রুপসার দুচোখ ঘোলা হতে হতে জলের ধারা বাঁধ ভেঙে পরলো।
প্রলয় দরজা বাইরে চলে গিয়েও আবার ফিরে এসেছে এটা রুপসা খেয়াল করেনি।এসেই একটানে রুপসাকে বুকের মধ্যে নিয়ে শক্ত বাঁধনে বাঁধলো।ঘটনা আকস্মিকতায় রুপসা হতবাক।কি হচ্ছে বুঝতে বুঝতেই, বুঝতে পারলো কারো তীব্র আকাঙক্ষার আগুনে ওর অধরজোড়া পুড়ে গেলো হঠাৎই।
সম্মোহনী জাল থেকে মুক্তি পাওয়ার আগে কিছু কথা ওর কানে আসলো।

“যাচ্ছি। এবার বসে বসে ভাবো আমাকে লাগবে কি না?লাগলেও আর আসবো না।”

চলবে…….

মুনিরা মেহজাবিন।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here