মেঘের পরে মেঘ -২৫
“মা অনেক দিন হলো কোথাও যাওয়া হয় না।চলো না কোথাও গিয়ে ঘুরে আসি।”
আবদার করে বললো রুপসা।
“কোথায় যেতে চাস?”
“সিলেট যাবো মা।সিলেটের এতো কাছে আমরা থাকি।সেখানে এতো এতো ঘোরবার জায়গা অথচ আমি একবারও যেতে পারলাম না।সেই ছোট থেকে ভাবি ওখানে ঘুরতে যাবো।কখনো তো যাওয়া হয় নি।চলো না
যাই।”
“আচ্ছা, যাবো।খুশি?”
মায়ের কথায় খুশিতে লাফিয়ে উঠে রুপসা।আর অন্যদিকে রুপসার আড়ালে দীর্ঘশ্বাস ফেলে শায়েরী।সিলেট। এই সিলেট জুড়ে কতো স্মৃতি, কতো কথা,কতো ঘটনা।সব যেন এখনো জীবন্ত। মনে হয় এই তো সেদিনকার কথা।কতো ঘোরাঘুরি করেছে ও আর নাবিল।নাবিলের বন্ধুরা।কতো আনন্দে কেটেছে সে সময় টা।তখন কি ঘুনাক্ষরেও ভেবেছিল আজকের দিনের কথা?নাবিলের সেই ঘোরলাগা ঘোলাটে দৃষ্টির আড়ালে বিশ্বাসঘাতকতা থাকবে তা কি বুঝেছিল শায়েরী?বুঝে নি।
রুপসা বহুবার যেতে চেয়েছে সিলেট।শায়েরীই রাজি হয়নি।কেন যেন পুরাতন ঘাঁ গুলোকে তাজা করতে মন চায়নি।এখন আর না করতে পারলোনা।আর কদিন ই বা আছে এখানে।এরপর চলে যাবে রাজশাহী। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেয়েছে রুপসা। আর মাস দেড়েক পর ক্লাস শুরু হবে।শায়েরী নিজের ট্রান্সফারটাও করিয়ে নিয়েছে সেখানকারই একটা স্কুলে। তাই রুপসার ইচ্ছে টাই পুরন হোক।আর যদি কখনো না আসা হয় সিলেট।
রুপসা লাফাতে লাফাতে জিজ্ঞেস করে,
“কবে যাবো মা?”
একটু ভেবে নিয়ে শায়েরী বলে,
“পরশু যাই।”
“ঠিক আছে মা।তাই হবে।তোমার ফোন টা একটু দেবে?”
“কি করবি?”
“মনিকাকে একটা কল দেবো।ওকে জানিয়ে দেই আমরা সিলেট যাচ্ছি। অনেক আগে একবার বলেছিলো আমরা গেলে ওকে যেন আমাদের সাথে নেই।”
“ঠিক আছে।বলে দেখ।যদি যায় তো যাবে।”
মোবাইল টা এগিয়ে দিয়ে বলে শায়েরী।
রুপসা মোবাইলটা নিয়ে বারান্দায় চলে আসে।প্রথমেই প্রলয়কে একটা মেসেজ দিয়ে জানিয়ে দেয় এ কথা।ফিরতি মেসেজে প্রলয় আফসোসের বার্তা দেয়।
এরপর মনিকাকে কল দেয় রুপসা।
মনিকা সবটা শুনে খুশিতে লাফিয়ে উঠে।
“সত্যি বলছিস?”
“সত্যি না তো কি?মা বলেছেন তুই যেতে চাইলে যেতে পারিস আমাদের সাথে। ”
“আমি তো অবশ্যই যাবো।পরশু ভোরবেলা আমি হাজির হয়ে যাবো দেখিস।”
“আঙ্কেল আন্টিকে তো এখনো বললিই না,সিওর বলছিস কিভাবে? ”
“তোর মায়ের সাথে যাবো শুনলে কখনো না করবে না।”
“তাহলে তো ভালোই। বিকেলে কাল বিকেলে তাহলে একটু বের হবো।কি বলিস?”
“কেন?”
“একটু কেনাকাটা করতাম।আমার হিজাব লাগবে আর টুকটাক কিছু কসমেটিকস। ”
“তোর আবার কসমেটিকস লাগে নাকি?”
“তোর মোবাইল টা নিয়ে আসিস।”
“জামাইয়ের সাথে কথা বলবি?”
“কি জামাই জামাই করিস?বিয়ের খবর নাই।জামাই!এমনি একটু কথা বলবো।মায়ের মোবাইলে তো কথা বলতে পারি না।তোর মোবাইলটাই ভরসা।”
“দুদিন পর তো এ মোবাইলটাও পাবি না।দুরে চলে যাবি।তখন কিভাবে যোগাযোগ করবি?”
“দেখি কি হয়?মা তো বলেছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর আমাকে একটা মোবাইল কিনে দেবে।সেটা বাটন হলেও। ”
“এ যুগে কেউ বাটন সেট ইওজ করে?”
হাসতে হাসতে বললো মনিকা।
“তোর মতো তো আমার বড়লোক বাবা নেই।মায়ের ইনকামই সব।তাই মা যা দিয়ে খুশি থাকবে, আমিও তাতে খুশি থাকবো।”
“সরি রে।মন খারাপ করলি না কি?”
“না মন করিনি।কাল চলে আসিস তবে?”
“ঠিক আছে। ”
লাইন কেটে দিয়ে মোবাইল নিয়ে ঘরে ঢুকতে যাবে তখনি আরেকটা মেসেজ আসলো প্রলয়ের নম্বর থেকে।
“আমাদের প্রথম হানিমুনে ও আমরা সিলেট যাবো।পরে দুনিয়ার অন্য কোথাও।কেমন?”
ঠোঁটের কোনে একটু হাসি ফুটে উঠলো রুপসার।বিয়ে নিয়ে এই লোকটার কতো স্বপ্ন। মেসেজ টা সাথে সাথেই কেটে দিলো রুপসা।তারপর ঘরে ঢুকলো।
_________
দুদিন পর রুপসা আর মনিকাকে নিয়ে সিলেট এসে পৌঁছুলো শায়েরী।হোটেলে রয়্যাল প্যালেসে রুম নিয়ে উঠলো তাতে। হোটেলটা শাহজালাল এর মাজার শরীফের কাছেই অবস্থিত।একটা রুম,তাতে বেড একটাই। অবশ্য ওদের তিনজনের ওজনও কম। এক খাটে ঘুমাতে অসুবিধা হবে না তা বলাই যায়।
হোটেলে গিয়ে আগে কিছুসময় বিশ্রাম নিলো ওরা।এরপর রেডি হয়ে বেরিয়ে আসলো।
খাওয়া দাওয়া সেড়ে নিয়ে আলোচনায় বসলো তিনজন।যেহেতু আজ হাতে বেশি সময় নেই তাই সবথেকে কাছের জায়গাটায় যাওয়া হবে।শাহজালাল এর মাজারেই আগে যাবে বলে ঠিক করলো শায়েরী। আজ এখানেই ঘোরাঘুরি করবে।কাল শাহপরান এএর মাজার দেখে সোজা জাফলং চলে যাবে।সারাদিন সেখানেই থাকবে।
রুপসা মনিকাকে নিয়ে মাজারে প্রবেশ করলো শায়েরী।একরাশ শীতল বাতাস যেন ছুঁয়ে গেলো ওদের।শায়েরীর মন প্রশান্তিতে ভরে উঠলো।কতো বছর পর আবার আসা এখানে।সেই যে নাবিলের সাথে আসা,এখানকার প্রতিটি কোন ঘোরাঘুরি করা সবই স্মৃতি এখন।
“মা চলো মাজার টা দেখে আসি?”
বললো রুপসা।
“মাজারে মেয়েদের প্রবেশ নিষেধ। তোমরা চাইলে নামাজ পড়তে পারো।মেয়েদের জন্য আলাদা নামাজের ব্যবস্থা আছে এখানে।”
“আপনি আগে এসেছিলেন আন্টি? সবকিছু জানেন কিভাবে? ”
বললো মনিকা।
“হ্যাঁ,এসেছিলাম।বহু বছর আগে।আমাদের বিয়ের পর।”.
” আংকেল সাথে ছিল তাই না?”.
“হ্যাঁ,তাই।”
“খুব ভালো সময় কেটেছিলো নিশ্চয়ই। বিয়ের পর নতুন নতুন না কি সবই ভালো লাগে?”
“হু খুব ভালো সময় কেটেছিলো।তবে কি জানো, নতুন নতুন ভালো লাগা আর সারাজীবনের জন্য ভালো লাগার মধ্যে তফাৎ আছে।চলো ভেতরে যাই।”
নামাজের সময়টুকু বাদে সেদিনকার বাকি সময়টুকু ওরা শাহজালাল মাজারের গজার মাছ,কুপ দেখে কাটিয়ে দিলো।রুপসা কিছু মাছ কিনে এনে মাছগুলো খাওয়ালোও।মা, মেয়ে আর বান্ধবীর খুব ভালো সময় কাটলো।
________
“শফিক সাহেব?”
“জ্বি স্যার।”
“আমি কিছুদিন অফিসে আসবোনা।সমস্ত কাজ দেখে, শুনে, বুঝে করবেন।আমি ফিরে এসে এর আপডেট নিবো।কেমন?”
“ওকে স্যার।কিন্তু স্যার আপনি যাচ্ছেন কোথায়?এই সময়টাতে তো আপনি ব্যাবসায়ের হিসেবগুলো দেখেন।কখনো কোথাও যেতে দেখিনি।এবার যাচ্ছেন? আবার না কি অনেক দিনের জন্য। তাই বলছিলাম আর কি?”
“আমার এক বন্ধু এসেছে লন্ডন থেকে।ওর বাড়ি সিলেটে। অনেকদিন ধরেই বলছিলো যাওয়ার জন্য যাইনি।তাই নিজেই ছুটে এসেছে আমাকে নিতে।তাই কাজকে ছুটি জানিয়ে আমাকেও ছুটতে হবে ওর সাথে। নইলে খুব রাগ করবে।কেন? আপনি কি সব হ্যান্ডেল করতে পারবেন না?”
“কেন পারবো না স্যার?অবশ্যই পারবো।আপনি নিশ্চিন্তে ঘুরে আসুন।”
সামনে রাখা ফাইলটায় ঝটপট সই করে দিয়ে শফিক সাহেবের দিকে ফাইলটা এগিয়ে ধরলো নাবিল।
তারপরই উঠে দাঁড়ালো।
” তো ভালো থাকবেন।আসি।”
“আমি কি আপনাকে এগিয়ে দেবো স্যার?”
“তার দরকার নেই।কবির নিচে গাড়ি নিয়ে বসে আছে।সাড়ে দশটায় ফ্লাইট। ”
“ভালো ভাবে যাবেন স্যার।হেভ আ সেইভ জার্নি।”
“থ্যাংক ইউ।”
_______
“কেমন আছো শায়েরী?”
চোখের সামনে দীপাকে দেখেও চিনতে একটু সময় লাগলো শায়েরীর।বেশ খানিকটা মুটিয়ে গেছে দীপা।আগের চেয়ে একটু কালোও লাগছে দেখতে। হকচকিয়ে গেছে একদম শায়েরী। এর জন্যই সিলেট আসতে চাইতো না।কখন নাবিলের পরিচিতজনদের সাথে দেখা হয়ে যায়।অস্বস্তি লাগছে।ওদিকে দীপা ওর দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে বলেই যাচ্ছে,
“তুমি তো দেখি একটুও বদলাও নি?সাথে কে এরা?তোমার মেয়ে না কি?কেমন আছো মা তোমরা?”
উত্তরে রুপসা মনিকা ভালো আছে জানালো।
“তোমরা সিলেট এসেছো আর আমি জানি না।কেমন কথা বলোতো।একটা বার যোগাযোগ করতেও মন চাইলো না?হুম।একদম ভুলে গেলে?নাবিল ভাই ও একটা মানুষ, সেই যে গেলো আর ভুলেও এমুখো হলো না।এখানে এসেছে তাও একবার খোঁজ করলো না।নাবিল ভাই কোথায়?উনাকে পাই একবার।”
” ও তো আমাদের সাথে আসেনি ভাবি।আসলে আমরা আর একসাথে থাকি না ভাবি।ও অন্য কাউকে বিয়ে করে ভালো আছে নিশ্চয়ই। আমার সাথে যোগাযোগ নেই।”
“কি বলছো?”
“আমি ভেবেছি এতোদিনে আপনারা বোধহয় সব জেনে গেছেন।”
“কিভাবে কি হলো?নাবিল ভাই তো তুমি বলতে পাগল ছিলো? ”
“পরে পাগলামি কেটে গেছে।এসব বিষয়ে আর কথা না বলি ভাাবি।আপনি ভালো আছেন তো?”
দীপা শায়েরীর কথার জবাব না দিয়ে জিজ্ঞেস করলো,
“কোথায় উঠেছো তোমরা?আমাকে ঠিকানা দাও।আমি কাল আসবো।”
শায়েরী নিজের হোটেলের ঠিকানা দিয়ে মেয়েদের নিয়ে ফিরে আসলো।পেছনে হতভম্ব হয়ে কিছুক্ষন দাঁড়িয়ে থেকে দীপা আস্তে আস্তে বাড়ির পথ ধরলো।ওর হিসেব মিলছে না।গোলমাল টা কোথায়?”
চলবে……..
মুনিরা মেহজাবিন।