ময়ূখ পর্ব -২৮+২৯

#ময়ূখ
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি
#পর্ব-২৮

৮২.
রিপ্ত শাপলাবিলের পাশে বসে একটানা সিগারেট টানছে। একটার পর একটা। চোখ দুটো লালবর্ণ তার। আজ প্রায় পনেরো দিন মৌন নিখোঁজ। কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি তাকে। রিপ্ত সামনে তাকিয়ে আছে। কালচে সবুজ পানির রং। রিপ্তের চোখ দুটো হঠাৎ অশ্রুতে ভরে গেছে। নীল শার্টের হাতায় চোখ মুছে রিপ্ত।
‘মৌনিরে তুই কই গেলি মৌনি।’

______________________

কাঁচের ল্যাম্পটা নিচে পড়ে ভেঙে গেলো। একে একে আসবাবপত্র সব ফ্লোরে ছুঁড়ছে নিভৃত। গত দুইদিন যাবত তাকে ঘরে আটকে রাখা হয়েছে। নিভৃত দরজার কাছে এগিয়ে গিয়ে জোরে জোরে দরজায় আঘাত করে।
‘আম্মু, দরজাটা খুলে দেও। প্লিজ আম্মু আল্লাহর দোহায় লাগে আম্মু।’

মিরা বাইরে বসে আছেন। দেয়ালে মাথা দিয়ে চোখ বন্ধ করেন তিনি। ছেলের এমন দশায় তিনি বড্ড ভেঙে পড়েছেন।
‘ও আম্মু, আম্মুগো। আমি শ্বাস নিতে পারছিনা তো! একটাবার খালি একটাবার আমার মৌনটাকে এনে দাওনা আম্মু।’

কোনো জবাব না পেয়ে নিভৃত ধপাস করে বসে পড়ে। বুকটা জ্বালা করছে। ভিষণ জ্বালা করছে। নিভৃত হঠাৎ অনুধাবন করলো তার এখন মেয়েটার শরীরের গন্ধ নিতে হবে। নয়তো সে মরে যাবে। তার শ্বাস বন্ধ হয়ে যাবে। নিভৃত দৌঁড়ে আলমারির কাছে যায়। পায়ে ভাঙা ল্যাম্পের কাঁচ ফুটেছে। সেসব খেয়াল নেই তার।

আলমারিতে মৌনের কাভার্ডে হাত বাড়ায়। একটা শাড়ি যদি পাওয়া যায়! একটু ঘ্রাণ যদি নেওয়া যায়! হঠাৎ শাড়ি টান দিতে গিয়ে একটা কালো ডায়েরি নিচে নিভৃতের পায়ের কাছটায় পড়লো। নিভৃত অবাক হয় খানিকটা। এটা কি মৌনর ডায়েরি? নিভৃত ডায়েরিটা উঠিয়ে খাটে নিয়ে বসে। অনেকটা পুরানো ডায়েরি। মাঝারি আকৃতির। কালো রঙের কভার। উপরে গুটি গুটি অক্ষরে লেখা ‘মৌন’। নিভৃত বিছানায় হেলান দিয়ে ডায়েরিটা খুলে। প্রথম পৃষ্ঠায় লেখা,
‘আমি এবং আমার প্রিয়।’

নিভৃত অনুধাবন করলো সে ঘামছে। বড্ড ঘামছে৷ তবে কি মৌনর মনে অন্য কারো বসবাস।

নিভৃত মনের কোণে প্রশ্ন জাগে। কে মৌনর প্রিয়?
নিভৃত ডায়েরিটা ফেলে দেয়। মাথা চেপে ধরে বসে থাকে অনেকটা সময়। তার মনটা যে বড়ই দুর্বল। অন্যকারো সাথে মৌনর সম্পৃক্ততা নিভৃত একদম মেনে নিতে পারবেনা। নিভৃতের শরীর শুকিয়ে গেছে। সারামুখে দাঁড়ি ভর্তি। চোখের নিচে কালো দাগ। কিছুক্ষণ থম মেরে বসে থেকে উঠে দাঁড়ায় নিভৃত। ডায়েরিটা উঠায় পাশ থেকে। তাকে যে জানতে হবেই!

৮৩.
দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় কিছুই লেখা নেই। আবার পৃষ্ঠা উল্টালো নিভৃত। তার কপালের পাশ দিয়ে সূক্ষ্ণ একটা ঘামের রেখা দেখা যাচ্ছে।

প্রিয়,
কি নামে ডাকবো তোমায়? রাজপুত্র বলে ডাকি? এই তুমি কি রাগ করবে? জানো আগামীকাল আমার দশম শ্রেণীর টেস্ট পরীক্ষা আর আমি তোমাকে নিয়ে লিখছি। আমি কি বড্ড পাগল? আজ থেকে দুইবছর আগে ব্যারিষ্টার বাড়ি গিয়েছিলাম। আরু, নিরু বললো তাদের নাকি কোন ভাই আসবে। আমি কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাইনি। আসলে আসুক আমার কি? কে জানতো সে ভাই আমাকে পাগল করে দিবে?

সবুজ রঙের টি-শার্ট পরনে একটা রাজপুত্র এলো ব্যারিষ্টার বাড়ি। আমি বড় জামগাছটার পিছনে লুকিয়ে কেবল একটা নজর দেখেছিলাম। বিশ্বাস করো, আমার বেহায়া চোখ আটকে গেলো তোমাতে। আমার হৃদপিণ্ডটা ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ করতে লাগলো। আমি চেপে ধরলাম বাঁ পাশটা। লোকে আওয়াজ শুনে ফেললে কি লজ্জা! কি লজ্জা!

নিভৃত হঠাৎই মুচকি হাসে। মৌন এত ছেলেমানুষ! পড়ায় মনোযোগ দেয় সে।

কতবার চেষ্টা করলাম। তোমার সামনে যাবো তোমাকে প্রাণভরে দেখবো। আমি পারিনি। কেনো পারিনি কে জানে? তারপর তুমি চলে গেলে। কেনো চলে গেলে? আমার ভিতরটা যে খা খা করে রাজপুত্র!

আর কিছু লেখা নেই। নিভৃত পৃষ্ঠা উল্টায়। কেবল লেখা রাজপুত্র ভালোবাসি। আমার স্বপ্নে রোজ এসে জ্বালানোটা কি খুব প্রয়োজন? পঁচা রাজপুত্র।

প্রিয়,
জানো আজ প্রায় দুইটা বছর তোমায় দেখিনা। এ কেমন জ্বালা দিয়ে গেলে আমায়। আমার কিশোরী মনে একোন আবেগ! আমি যে কইতেও পারিনা আর সইতেও পারিনা। তুমি আসোনা। আজ ভর পুর্নিমা। আকাশে কত তারা! তোমার সাথে আমি পূর্নিমার আকাশ দেখবো। কোনো এক বিস্তর মাঠে পাশাপাশি শুয়ে আকাশে ভরা জোৎস্না দেখবো। তোমাকে নাকি তোমার প্রিয় মানুষটা বাবুই পাখি ডাকে? আমি ডাকি। বেশি না একটু। একটু।

বাবুইপাখি, বাবুইপাখি, বাবুইপাখি পরের পাঁচটা পৃষ্ঠা কেবল এটাই লিখা। নিভৃত অবাক হয়। সে ঘুনাক্ষরেও জানতোনা তার একটা এমন পাগলাটে প্রেমিকা ছিল!

নিরুর মুখে শুনলাম তুমি নাকি আগামীকাল আসবে? আমি ঠিক কতটা খুশি আমি তোমায় কি করে বোঝাই? আচ্ছা, একটা উদাহরণ দেই? বিকালে কলেজ থেকে ফিরে উঠানে দাঁড়িয়ে কতক্ষণ একলা লাফিয়েছি। মা, ঝাড়ু নিয়ে ছুটে এসেছিলেন। আশেপাশে লোকজন জমা হয়ে গিয়েছিলো আমার লাফানো দেখে। জানো মা,বাবা মিলে রাতে হুজুর পর্যন্ত নিয়ে এসেছে! তাদের কি করে বোঝাই এই পাগলামী জ্বীনে ধরার পাগলামি না। এই পাগলামি আমার নিভৃতের জন্য করা পাগলামি। নিভৃত রহমান। দেখো তোমার নাম আর আমার নামে কতো মিল! নিভৃত, মৌন। দুজনের নামের অর্থই নিরবতা।

আজ পহেলা বৈশাখ। জানো, আজ আমি লাল পাড়ে সাদা শাড়ি পরেছি, পায়ে আলতা দিয়েছি। হাতে কাঁচের চুরি পরেছি। তুমি আজ আসবে। তোমায় আমি মনের কথা বলবো। খুব করে বলবো। এই যে দেখেন, মিঃ নিভৃত আমি কিন্তু আপনার পাগলাটে প্রেমিকা। আচ্ছা, আমি কি খুব বেহায়া? তোমার ভালোবাসার মানুষ আছে শুনেও আমি এতোটা বেহায়া কি করে হতে পারি। থাক। থাকনা কিছু অজানা। যা কেবল আমি জানবো। মিরা আন্টি কি কিছু বুঝে গেলো? আমি বারেবারে তোমার ঘরে উঁকি দেই। একদিন তো হাতেনাতে ধরেও ফেলেছিলো আমি দৌঁড়ে প্রাণ বাঁচিয়েছি।

পরের পৃষ্ঠাগুলো ফাঁকা। নিভৃত আরো পৃষ্ঠা উল্টায়।

তোমার নাকি বিয়ে হয়ে গেছে? রুহানি আপু খুব সুন্দরী। বেশ মানিয়েছে তোমাদের। সেদিন তোমাদের বাড়ি ছুঁটে গিয়েছিলাম। মিরা আন্টিকে সামনে পেয়ে লাজ লজ্জার মাথা খেয়ে জিজ্ঞেস করেই ফেললাম তুমি কই। আন্টি বললো তুমি নাকি ব্রক্ষপুত্রের পাড় গেছো। আমাকে আর পায়কে। আমিও দৌঁড়ে গেলাম সেখানে। তুমি যখন রুহানি আপুর হাতে হাত রেখে পাড় ঘেঁষে হাঁটছিলে কি সুন্দর লাগছিলো! আমি কিন্তু দেখে ফেলেছি। তুমি যে রুহানি আপুর কপালের মাঝখানটায় চুমো খেয়েছো। আমি দেখেছি। হি হি হি।
ফিরে আসার সময় দেখলাম আমি হাঁটছি আর মাটি লাল হচ্ছে। আমার পায়ের ছাপ বসছে মাটিতে। জুতা খুলে দেখি একটা বড় কাটা ফুটেছে। গলগল করে রক্ত পড়ছে। এই রক্তক্ষরণ আমি বন্ধ করলাম। তবে আমার হৃদয়ের রক্তক্ষরণ?

৮৪.

তোমার সাথে নাকি আমার বিয়ে! আমি এমনটা কখনো চায়নি। বিশ্বাস করো রাজপুত্র। আমি এটা চাইনি।

পরের পৃষ্ঠা গুলো সাদা। নিভৃত উদভ্রান্তের মতো পৃষ্ঠা উল্টায়।

আমার খুব কষ্ট হয় নিভৃত। আমার সাথে কেন এমন করো তুমি?

রাজপুত্র, ও রাজপুত্র ভালোবাসি তোমায়।

আমাকে কি খুব ঝগড়াটে ভাবো তুমি? এই যে রাজপুত্র আমি কিন্তু মোটেও ঝগড়াটে নই।

আজ আমরা প্রথম মিলিত হয়েছি। আমার শত চিৎকার আর্তনাদ শুনোনি তুমি। আর দোষটা তুমি আমার দিলে নিভৃত?

তোমার সাথে ঘুরে বেড়ানো প্রতিটা মুহূর্ত আমার হৃদয়ের গহীনে স্বর্ণাক্ষরে লিখে রেখেছি। সিলেটে তোমার সাথে কাটানো প্রতিটা সময় আমি মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মনে রাখবো রাজপুত্র। আমার জন্য তোমার উদ্বিগ্নতা আমায় লজ্জা দিচ্ছে তো!

সিলেটে আমরা দ্বিতীয়বার মিলিত হয়েছি। তুমি আমার কাছে ক্ষমা চাচ্ছো কেন? আমি তো তোমার স্ত্রী!

তুমি বড্ড জটিল নিভৃত। তুমি একটা মায়াজাল।

তোমার বুকে একটু ঠাঁই কি আমি পাবোনা?

আমি একটা ভেসে বেড়ানো কচুরিপানা।

পরের পৃষ্ঠাগুলোতে কেবল এসবই লেখা।

বড় স্বাদ ছিলো তোমায় নিয়ে বাঁধবো ঘর।
তুমি বন্ধু আমায় করে দিলে পর!

আর কিছু লেখা নেই। নিভৃত পৃষ্ঠাগুলো উল্টায়। দুয়েকটা কবিতা, ছন্দ তাকে ঘিরে।

তবে শেষের পাতায় এসে হাত থমকে যায় তার। এটা কি? নিভৃত মনোযোগ দিয়ে দেখে। এটাতো একটা আল্ট্রাসনোগ্রাফির রিপোর্ট! নিভৃতের মনে হচ্ছে তার হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে যাচ্ছে। শ্বাস আটকে আসছে। তাহলে মৌন!

নিভৃত চোখ বুলায় নিচের লেখাগুলোতে।

তোমার বাবা তোমায় চায়না সোনা। তুমি যে তার ভালোবাসার ফল না। তুমি তার চাহিদার ফল। তোমাকে কখনো কষ্ট পেতে দিবোনা আমি। তোমার বাবাকে ছেড়ে আমরা চলে যাবো দূরে। তোমার বাবা তার রুহানিকে নিয়ে থাকুক। ভালো থাকুক। আমি তোমাকে নিয়ে চলে যাবো। তোমার বাবা খুব পঁচা। খুব খুব খুব।

আপনি কি পুরো ডায়েরিটা পড়েছেন নিভৃত? আমি জানতাম আপনি হয়তো কোনোদিন পড়বেন। যেদিন আমি আপনার থেকে বহুদূরে চলে যাবো। শুনোন, আপনি আমার কিশোরী বয়সের আবেগ, ভালোবাসা। দীর্ঘ সাড়ে পাঁচটা বছর আপনার জন্য জ্বলেছি। বিয়ের পর তা বেড়েছে দ্বিগুণ হারে। আপনি একটা স্বার্থপর নিভৃত। আপনাকে আমি ভালোবাসি। তাই হয়তো ঘৃণা করতে পারবোনা। নয়তো আমি আপনাকে ঘৃণা করতাম নিভৃত। অনেক ঘৃণা করতাম।

নিভৃতের হাত থেকে ডায়েরিটা খসে পড়ে। বাইরে ঝড় শুরু হয়েছে। এতো তীব্র ঝড়! আমগাছের মগডালটা ভেঙে ধরণী কাঁপানো আওয়াজ হলো। নিভৃতের সেদিকে খেয়াল নেই। সে স্তব্ধ, হতভম্ব, নিথর, নিশ্চল।
#ময়ূখ
#পর্ব-২৯
#লেখিকা_আনিকা_রাইশা_হৃদি

৮৫.
আজ প্রায় দুইমাস হয়ে গেলো। মৌনর কোনো খোঁজ নেই। নিভৃত এমন কোনো জায়গা নেই যে মৌনকে খুঁজেনি। কোথায় গেলো মৌন? কোথায় তার সন্তান?

মৌনর বইগুলো রাখা ডিভানের সামনে রাখা কাঠের টি-টেবিলের নিচে কাঠ দিয়ে বানানো পাটাতনে। নিভৃত কিছুক্ষণ আগে যোহরের নামাজ আদায় করে খাটের সাথে ঘেঁষে দ-আকৃতির পা করে মেঝেতে বসে আছে। এখনকার নিভৃত অনেক নিশ্চুপ, চুপচাপ। পাগলামি করেনা। খালি চেয়ে থাকে। নিশ্চল তার দৃষ্টি। আল্লাহর কাছে দুইহাত তুলে দোয়া চায় যেখানে থাকুক তার মৌন, তার বাচ্চাটা ভালো থাকুক। নিভৃত কি মনে করে মৌনর বইগুলোর দিকে এগিয়ে যায়। একটা একটা করে বইগুলোতে হাতবুলায় সে। মিটি উড়ে এসে তার কাঁধে বসেছে। নিভৃতের সাথে তার অনেক ভাব। হঠাৎ একটা বই উল্টানোর সময় কভার পেজের ভিতরের অংশে কিছু নাম্বার লেখা। উপরে লেখা
‘বান্ধবীরা’।

এক, দুই দিয়ে প্রায় সাতজনের মতো মেয়েদের নাম্বার লেখা। এদের মধ্যে পাঁচজনের সাথে নিভৃতের কথা হয়েছে। নাম দেখে চিনে ফেললো নিভৃত। তবে দুইজনকে চিনেনা সে। একজনের নাম লেখা সুমি, অপরজনের দোলা। নিভৃত খাটের উপর থেকে মোবাইলটা তুলে নিয়ে দোলার নাম্বারে কল লাগায়।
‘হ্যালো, আসসালামু আলাইকুম কে?’
‘ওয়ালাইকুম আসসালাম। আমি নিভৃত রহমান বলছি।’
‘জ্বি,বলুন।’
‘মৌন কি আপনার কাছে?’
‘কে মৌন?’
‘মৌনতা সুবহা মৌন। চিনেন না?’
‘ওহ্, আপনি মৌনতার কথা বলছেন। কিন্তু ওর সাথে তো আমার দেখা হয়না প্রায় চারবছর।’
‘সত্যি করে বলুন। মৌন আপনার কাছে নেই?’
‘আরে কি আশ্চর্য! আমি মিথ্যা বলবো কেন?’

হতাশ হয় নিভৃত। হতাশ কন্ঠে বলে,
‘আপনার কাছে যদি যায়। দয়াকরে আমাকে জানাবেন।
‘আপনি কে?’
‘মৌনর হাসবেন্ড।’
‘আচ্ছা, আমার কাছে আসলে কিংবা কোনো যোগাযোগ হলে আমি জানাবো।’

নিভৃত এবার সুমির নাম্বারে কল দেয়। অদ্ভুত কারণে তার বুকটা কাঁপছে। হৃৎস্পন্দনের হার বেড়ে গেছে নাকি?

কল রিসিভ হলে,নিভৃত জিজ্ঞেস করে,
‘হ্যালো…..

ঐপাশটা নিশ্চুপ। নিভৃত একটানা প্রশ্ন করে যাচ্ছে। তবে ফেরত পাচ্ছে নিস্তব্ধতা। হঠাৎ অপরিচিত একজন নারী কন্ঠ শোনা যায়।
‘কে আপনি?’

৮৬.
‘আমি নিভৃত। নিভৃত রহমান।’
‘কি কারণে ফোন দিয়েছেন?’
‘আপনি মৌনকে চিনেন?’

কিছুক্ষণ নিরবতা। তারপর জবাব আসে,
‘হ্যাঁ, মৌন নামে আমার একটা ফ্রেন্ড ছিলো।’
‘মৌন কি আপনার কাছে গেছে?’
‘না, আমার সাথে মৌনর যোগাযোগ নেই অনেকদিন ধরে।’
‘সত্যি করে বলুন।’
‘আমি মিথ্যে বলতে যাবো কেন?’
‘মৌন আপনার কাছে গেলে কিংবা কোনো যোগাযোগ করলে আমাকে জানাবেন দয়াকরে।’
‘জ্বি।’

ফোনটা কেটে দেয় সুমি। সামনের সোফায় বসে থাকা মৌনর দিকে তাকিয়ে বলে,
‘কাজটা কি ঠিক হচ্ছে? অন্তত পেটেরটার কথা ভাব।’
‘আমি কোনো স্বার্থপরের সাথে ঘর করতে চাইনা। উনি থাকুক উনার রুহানিকে নিয়ে। তাছাড়া উনি পেটেরটাকে চায়না।’
‘একবার বলে তো দেখা উচিত ছিলো।’
‘সুমি তুই সবটাই জানিস। দয়াকরে এসব ব্যাপারে আমাকে আর কিছু বলিসনা।’

মৌন উঠে নিজের ঘরে চলে যায়। সুমি সেদিকে তাকিয়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। রাতের গভীরে ঠিকই তো কান্নার আওয়াজ সে পায়।

______________________

মৌন ফজরের নামাজ পড়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা কামিজ পরনে। মাথায় লম্বা করে ঘুমটা টানা। সারা শরীর ঢেকে রেখেছে উড়নাটা। পাঁচমাসের পেটটা উঁচু হয়েছে খানিকটা। মৌন বাইরে বিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে আছে। হাতে একটা তসবি। হঠাৎ পরিচিত, চিরচেনা কেউ একজন পিছন থেকে জড়িয়ে ধরলো তাকে। নিজের কাঁধে গরম গরম অশ্রুর ফোঁটা অনুভব করলো মৌন। লোকটা তাকে ছাড়ছেনা। এমনভাবে ধরে রেখেছে যেন ছেড়ে দিলে মৌন কোথাও হারিয়ে যাবে। মৌন নিশ্চল হাতে খানিকটা চেষ্টা করে লোকটাকে সরিয়ে দেওয়ার। তবে সে পারেনা। সামনে তাকিয়েই বলে,
‘কেন এসেছেন?’

৮৭.
লোকটা জবাব দেয়না। মৌনকে সামনে ফিরিয়ে মেঝেতে বসে পড়ে সে। তার হলদে পরীটা মোটা হয়েছে অনেকটা। গালদুটো ফুলেছে। কি স্নিগ্ধ, সুন্দর লাগছে। তবে কিসের যেনো বিষণ্ণতা। উড়নাটা সরিয়ে মৌনর উঁচু হয়ে যাওয়া পেটে চুমো খায় নিভৃত। একটা, দুইটা, তিনটা অসংখ্য। মৌন একদৃষ্টিতে চেয়ে আছে কেবল। শরীরটা শুকিয়ে গেছে, চোখের নিচে কালোদাগ, গাল ভর্তি দাঁড়ি। এ কোন নিভৃত! মস্তিষ্ক বলছে সরিয়ে দে আর মন বলছে থাক না।

নিভৃত আলতো করে কোমরটা জড়িয়ে ধরে কান পাতে পেটে। কি শুনেছে কে জানে। বিরবির করে বলে,
‘বাবা পঁচা তাইনা পুঁচকো। বাবুটাকে কত কষ্ট দেয়?’

নিভৃত আবার ঠোঁট ছুঁয়ায় মৌনর পেটে। মৌন অনেকক্ষণ সহ্য করেছে এসব আহ্লাদ। এবার নিভৃতকে ছাড়িয়ে পাশে দাঁড়ায় মৌন। শক্ত কন্ঠে বলে,
‘একদম আহ্লাদ করতে আসবেন না নিভৃত। আমার বিরক্ত লাগছে। আর কিসের বাবা? এতোদিন বাবার প্রয়োজন পড়েনি আর সামনেও পড়তে দিবোনা। সুমি কাজটা ঠিক করলোনা।’
‘প্লিজ মৌন তোমার দুইটা পায়ে ধরি বাসায় চলো। আমার বাবুটা বাবাকে চায় মৌন।’
‘বাবার অধিকার দেখাবেন না একদম। সন্তান তো বাবা-মায়ের ভালোবাসার ফসল হয়। আমার সন্তান তো আপনার ভুলের ফসল।’
‘মৌন!’
‘আমার নাম আপনার মুখে নিবেন না। আপনার তো বাচ্চা চাইনা? সেদিন তো এজন্য মারলেনও আমাকে। আজ এতো দরদ উতলে উঠছে কেন?’
‘আমি ক্ষমা চাচ্ছি মৌন। আমি ভুল করেছি। আমাকে ক্ষমা করা যায়না?’
‘না, যায়না।’

নিভৃত অসহায় চোখে তাকিয়ে থাকে। কোথাও যেতে ইচ্ছে করছেনা তার।
‘আপনি চলে যান নিভৃত। আমি আপনাকে সহ্য করতে পারছিনা। প্লিজ চলে যান।’

নিভৃত তবুও দাঁড়িয়ে থাকে। মৌন নিভৃতের বাম হাতটা ধরে টেনে নিয়ে যায় টিনসেড বিল্ডিংয়ের দরজার কাছটায়। তারপর মেইন দরজাটা মুখের উপর বন্ধ করে দিয়ে দরজার পাশটায় বসে পড়ে। বুকটা এতো জ্বলছে কেন? সুমি বাইরে থেকে সবই দেখছে। তবে সে কিছু বলবেনা বলে ঠিক করে। স্বামী-স্ত্রীর মনোমালিন্যে অন্যদের নাক না গলানোই উত্তম। সময় পেরিয়ে যায়। নিভৃত দুপুরের কড়া রোদে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনে। তার অসহায় চোখজোড়া স্থির স্টিলের দরজার দিকে।

মৌন কাঁদতে কাঁদতে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। ঘুম ভাঙে অনেকটা সময় পর। দুপুর বোধহয় ১টা। মৌন হকচকিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দরজা খুলে বের হবে তখন শুনে নিভৃত ফোনে কথা বলছে। বিচলিত তার কন্ঠস্বর।
‘হ্যালো, আম্মু। বাবার কি হয়েছে?’
‘………..’
‘কি!’
‘কোন হসপিটালে নিয়েছো? আমি এখনি আসছি।’

নিভৃত সব ছেড়ে গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। বাবা নামক মানুষটাকে বড্ড ভালোবাসে নিভৃত।

‘সুমি, আমার ঢাকা যেতে হবে!’
‘কেন?’
‘বাবার বোধহয় কিছু একটা হয়েছে সুমি।’
‘এই অবস্থায় কিভাবে যাবি। ডাক্তার না বললো বেডরেস্টে থাকতে। জার্নিটা কি ঠিক হবে?’
‘ঠিক ভুল জানিনা সুমি। আমাকে নিয়ে চল।’

অনেকটা পথ পেরিয়ে রাত প্রায় বারোটার দিকে ঢাকা পৌঁছায় মৌন, সুমি। ‘একগুচ্ছ সুখ’ নামক বাড়িটাতে প্রায় তিনমাস পর আবার পা বাড়ায় মৌন। বাড়িতে কেবল দিলারা,জুলখা আছে। সোফায় চিন্তিত ভঙ্গিতে বসে দুজনে। দিলারা বারেবারে চোখ মুছছেন। মৌনকে দেখে অবাক হোন দিলারা।
‘বাবা, কোন হসপিটালে?’

মৌনর ক্লান্ত বিচলিত কন্ঠস্বর। জুলেখা বলে,
‘আপালো হাসপাতালো নিসে বললো।’

সুমিকে নিয়ে মৌন ছুটে যায় এপেলো হাসপাতাল। রিসিভশনে নাম বললে তারা কেবিন দেখিয়ে দেয়। মৌন অনেকটা দৌড়ে সেদিক পানে যাচ্ছে। পিছনে সুমি।

‘বাবা’

হঠাৎ মৌনর কন্ঠ শুনে মিরা দরজার দিকে তাকান। সাদা বেডে নাজমুল শুয়ে ঘুমিয়ে আছেন। মৌন মিরার দিকে এগিয়ে আসে। মিরা হঠাৎ চিৎকার করেন। মৌন নিচে তাকিয়ে দেখে তার নিচটা রক্তে ভরে যাচ্ছে। লাল রক্তের বন্যা বইছে যেনো। সাদা রঙা সেলোয়ার-কামিজ লাল বর্ণে রঙিন হয়ে যাচ্ছে। নিভৃত বাইরে ঔষধ আনতে গিয়েছিলো। ফিরে এসে মৌনকে দেখে ‘মৌন’ বলে চিৎকার করে কোলে তুলে নেয় সে। জ্ঞান হারায় মৌন।

(চলবে)…..
(চলবে)…..

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here