রইলো তোমার নিমন্ত্রণ পর্ব -০৫

#রইলো_তোমার_নিমন্ত্রণ।
[০৫]

কুশন বুকে জড়িয়ে সুফায় শুয়ে টিভি দেখছে ভূমি। টিভিতে চলছে শাহরুখ খান আর দিপিকা পাডুকোনের এক রোমান্টিক গান। ভূমির দৃষ্টি টিভির স্কিনে থাকলেও ওর মনে চলছে সেদিন দুপুরের ঘটনা। আরাভ সেদিন ভূমিকে নিয়ে রেস্টুরেন্টে যায়। রেস্টুরন্ট এ যাওয়ার কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হয় বৃষ্টি। ইলশেগুঁড়ি। বর্ষার এই এক সমস্য কখন বৃষ্টি হয় বলা মুশকিল। ভূমিকে নিয়ে আরাভ এক্কেবারে সাইড টেবিলে বসে। আরাভ ওয়েটারের সাথে কথা বললেও ভূমির দৃষ্টি বাহিরে, স্বচ্ছ কাচ বেদকরে বয়ে চলা মুক্তোদানা মধ্যে। ইচ্ছে করছে হাত দিয়ে ছুইয়ে দিতে। ইশ যদি এই বৃষ্টি গায়ে মাখতে পারতো ভূমি। ঠোঁটে তার ফুটে উঠে হাসি। আরাভ ওয়েটারের সাথে কথা বলা শেষ করে ভূমির দিকে তাকিয়ে ভূমিকে একমনে বাহিরের দিকে তাকিয়ে থাকতে দেখে সেও তাকায় বাহিরে। বৃষ্টি বরাবরই অপছন্দ তার। দৃষ্টি ঘুড়িয়ে সামনে তাকায় আরাভ। ভূমির চোখের দিকে দৃষ্টি পরতেই সেটা স্থির হয়ে যায়। ভূমির হাস্যউজ্জল চঞ্চল চোখ দেখে আরাভের অধোর প্রসারিত হয়। এভাবে কতক্ষণ কাটিয়েছে জানানেই। ওয়েটারের ডাকে ঘোর কাটে আরাভের। টেবিলে খাবার পরিবেশন করা। আরাভ ভূমিকে ডেকে দুজনে একসাথে খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষের বিশ মিনিট পরেও যখন বৃষ্টি থামার নাম নেই তখন আরাভ নিজে বৃষ্টিতে ভিজে গাড়ি নিয়ে আসে রেস্টুরেন্টের একদম সামনে। তারপর ভূমিকে নিয়ে রওনা দেয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। হঠাৎ মাঝ রাস্তার গাড়ি থামিয়ে আরাভ কোথাও চলে যায়। ভূমিকে কিছু বলার সুযোগ-ই দেয় না। ভূমি চিন্তিত মনে বসে থাকে গাড়িতে। কিছুক্ষণের মধ্যে ভূমির চিন্তার অবসান ঘটিয়ে ফিরে আসে আরাভ। বৃষ্টির পানিতে কাকভেজা হয়ে গেছে সে। বাম হাতে চুল ঝাঁকতে ঝাকাতে ভূমির দিকে একটা আইসক্রিমের বাটি এগিয়ে দেয়। ভূমি অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,

” আইসক্রিম!”

” বাইরে কটকটে রোদ থাকুক বা অঝোর ধারায় বৃষ্টি, যে কোনটাই হতে পারে আইসক্রিম খাওয়ার উপলক্ষ। তবে মেয়েরা বোদহয় রোদের থেকে বৃষ্টির দিনে আইসক্রিম বেশী পছন্দ করে। তাই নিয়ে এলাম।”

সিটবেল্ট বাধতে বাধতে জবাব দিলো আরাভ। ভূমির বিস্ফারিত চোখ। ড্যাবড্যাব করে ডাকিয়ে আছে আরাভের। তবে আরাভের এই ছোট্ট কেয়ার করটা বেশ ভালো লাগলো তার। ঠোট চেপে হেসে বাহিরের দিকে তাকালো। জানালার কাচবেদ করে পরা বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে থাকলো কিছুক্ষণ। শরীর কেমন শীতল হয়ে আসছে ক্রমশ। আজকের এই বৃষ্টিটা তার মনে এক ভালোলাগার শিহরণ জাগিয়ে তুলেছে। এই বৃষ্টি তার জন্যে, হ্যাঁ। ভূমির গান গাইতে ইচ্ছে করলো, ” আগে কত বৃষ্টি যে দেখেছি শ্রাবণে, জাগেনি তো এত আশা ভালোবাসা এমনে।” মৃদু হেসে ফেলল ভূমি। আরাভ ভূমির হাসির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। ভূমির অধোরে তখনি হাসি লেগে আছে। আরাভ প্রশ্ন করলো,

” হাসছো যে?

থতমত খেয়ে যায় ভূমি। আরাভের দিকে তাকিয়ে বলল,
” ক্ কই হাসছি।”
” আমি স্পষ্ট দেখলাম তুমি হাসছ।”
” ভুল দেখছেন আপনি।স্পষ্ট দিনের আলোয় উল্টাপাল্টা দেখেন। চোখের ডাক্তার দেখান।”
আরাভ গাড়ি স্টার্ট দিয়ে বলল,
” তুমি বলছো যখন তাহলে তো ডাক্তার দেখাতেই হয়। আইসক্রিম খাচ্চোনা কেন? নাকি তোমার আইসক্রিম পছন্দ নয়।”
” আইসক্রিম আমার ফেভারিট।
বলেই আইসক্রিম খেতে শুরু করলো ভূমি। আরাভ ড্রাইভ করার মাঝেই মৃদু হাসলো। আইসক্রিম খাওয়ার মাঝে ভূমি লক্ষ করলো আরাভের মাথা থেকে এখনো পানি পরছে। কপালে গালে বিন্দু বিন্দু পানির ছিটা। হাতের লোমের মাঝেও পানি জমে আছে। ভূমি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো আরাভের বৃষ্টিভেজা সিগ্ধ মুখের দিকে। তারপর নিচের দিকে দৃষ্টি নিয়ে বলল,

” মাথাটা মুছে নিন না হলে ঠান্ডা লেগে যাবে।”

“এটা বাড়ি নয় গাড়ি। এখানে মাথা মুছার কিছু নেই।”

ভূমি এদিক ওদিক তাকিয়ে খেয়াল করলো ওর উড়নাটা। হ্যাঁ এটা দিয়ে মুছা যাবে। তাহলে হয়তো আরাভের ঠান্ডা কিছুটা হলেও কম লাগবে। এই অবস্থায় মাথার পানি মুছাটা বেশ জরুলী। ভূমি প্রস্তাব রাখতেই আরাভ গাড়ি থামিয়ে দিলো। ভূমির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে গম্ভীর দৃঢ় কন্ঠে বলল,

” আমার তোমার উড়না ব্যবহার করার আগে একটা অধীকার একটা সম্পর্কের প্রয়োজন। আগে সেই অধীকার অর্জন করি। তখন তুমি না চাইলেও আমি জোর করতে পারবো।”

ভূমি কিছু বলল না। নিরব দৃষ্টিতে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে দৃষ্টি ঘুরালো বাইরের দিকে। আরাভ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ড্রাইভ এ মন দিলো। বাড়ির কাছাকাছি আসতেই আরাভের সেলফোনটা বেজে উঠলো। গাড়ির সামনেই মোবাইল রাখা। স্কিনে স্পষ্ট রেদওয়ানেনর নামটা জ্বলজ্বল করছে। আরাভ তাড়াতাড়ি কল রিসিভ করলো। ওপাশ থেকে কিছু বলতেই ” আসছি আমি।” বলে কল কেটে গাড়ির স্পিড বাড়িয়ে দিলো। আরাভদের এপার্টমেন্টের সামনে এসে গাড়িয়ে থামিয়ে অনিমা বেগমকে কল করলো আরাভ।

অনিমা বেগম ছাতা নিয়ে আসতেই আরাভ ভূমিকে গাড়ি থেকে নামতে বলল। ভূমি বিনা বাক্যে গাড়ি থেকে নেমে অনিমা বেগমের কাছে যায়। আরাভ অনিমা বেগমের উদ্দেশ্যে বলল,
” আমি আসছি মা।” ভূমির দিকে একপলক তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বলল, ” ফিরতে লেট হতে পারে।”

অনিমা বেগম বললেন,
” তাড়াতাড়ি ফেরার চেষ্টা করবি। ভূমি মা-কে তো বাড়ি ফিরতে হবে।”

” চেষ্টা করবো। ভূমির দিকে তাকিয়ে বলল, “আসছি, টেক কেয়ার।”

গাড়ি নিয়ে চলে যায় চোখের আড়ালে। ভূমি তাকিয়ে থাকে যতক্ষণ দেখা যায় আরাভের গাড়ি। সেদিন সারাদিন আরাভদের বাসায় কাটালো অথচ একবারের জন্যেও আরাভের দেখা পায়নি। ভূমি যতক্ষণ ও বাড়িতে ততক্ষণ অপেক্ষা করছে আরাভকে একনজর দেখার। মনে হচ্ছিলো তার চক্ষে হাজার জনমের তৃষ্ণা। আরাভকে এজনম ভরে দেখলেও তার চোখের এ তৃষ্ণা শেষ হবার নয়। সন্ধা নামার পরেও যখন আরাভ বাড়ি ফিরে নি তখন একরাশ মব খারাপ নিয়ে অনিমা বেগমকে সাথে করে ও বাড়ি থেকে ফিরে আসে ভূমি।

রোজিনা হোসাইনের চিৎকার শুনে ভাবনার জগৎ থেকে বেড়িয়ে আসে ভূমি। সুফা ছেড়ে রান্নাঘরের দিকে যায় সে। ভূমি রান্নাঘরে যেতেই রোজিনা হোসাইন তার কানটেনে ধরে। ” মা লাগছে তো। কানটা ছাড়ো না।” বলেই ছুটাছুটি করার চেষ্টা করে ভূমি। রোজিনা হোসাইন মেয়ের কানে আরো জোরে চেপে ধরে বললেন,

” তুই কি করতে এসেছিলি রান্নাঘরে? তোকে কতবার বলেছি আমার রান্নাঘরে তুই আসবি না। কি অবস্থা করে রেখেছিস সব। দেখে মনে হচ্ছে রান্নাঘর কালবৈশাখী ঝড়ের শীকার।”

” চা করতে এসেছিলাম। তন্ময়ের জন্যে।”

” ভাইয়ের জন্যে চা করেছিস ভালো কথা তাই বলে রান্নাঘরের এই অবস্থা করবি। নে এখন তুই এসব পরিষ্কার করবি।”

” মা,, মা,,,গো। ছেড়ে দাওনা। এরপর থেকে সবকাজ গুছিয়ে করবো। আজকের মতো মাফ করে দাও।”

” আগে এইসব পরিষ্কার করবি তারপর এখান থেকে যাবি।” রোজিনা হোসাইন ভূমির কান ছেড়ে দরজার কাছে গিয়ে দাঁড়ালেন। ভূমি অসহায় মুখে একবার তার মায়ের দিকে তাকালো। মায়ের থেকে কোন পাত্তা না পেয়ে রান্নাঘর গুছানোর কাজে মন দিলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বয়স পনেরো ষোলের একটা যুবক এসে দাঁড়ালো রান্নাঘরের সামনে। হাতে তার পানির বোতল আর চায়ের কাপ। রোজিনা হোসাইন যুবকটার দিকে তাকিয়ে বলল,

” কি চাই এখানে?

” আসলে মা আমার রুমে পানি শেষ হয়ে গেছে তাই এসেছিলাম।”

রোজিনা হোসাইন একটু সাইড হয়ে দাঁড়ালেন। যুবকটা রান্নাঘরে ডুকে কাপটা টেবিলের উপর রেখে ভূমির দিকে তাকিয়ে বলল,

” চা-টা তুই খুব ভালো বানাস। তোকে দিয়ে তো আর কোন কাজ হবে না। ভাবছি মানিক চাচাকে উঠিয়ে ওই দোকানে তোকে বসাবো। তোমার বানানো চায়ের দাম পাঁচটাকা বেশী হবে।”

ভূমির হাতে একটা মগ ছিলো। সেটা পরিষ্কার করছিলো সে। ছেলেটার কথা শেষ হতেই সেটা ছুড়ে দিলো। ছেলেটা সে কেচ করে বলল,
” এবার দেখছো মা কে বেশী ঝগড়া করে।”

রোজিনা হোসাইন কটমট চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। ছেলটা কিছু না বলে ভূমির দিকে তাকিয়ে চোখের ইশারায় কিছু বলল। রাগে ভূমির দাত কটমট করে বলল, ” এখান থেকে আগে বের হই তারপর তোকে দেখাবো মজা।” নিজের কাজে মন দিলো ভূমি। আর ছেলেটা পানি নিয়ে চলে গেলো।

_______________________
আজ পাঁচদিন হলো সিলেট এসেছে দিগন্ত। ছোট বড় পাহাড়ি মেয়েদের নিঃসংশ ভাবে খুনের কেইসটা লড়ছে চারদিন ধরে। প্রথম দিকে কোন ক্লু না পেলেও এবার তার কাজটা অনেক এগিয়ে গেছে। আর মাত্র দু এক দিন তারপরেই হয়তো এই কেইসের সমাধান হয়ে যাবে। তারপর? তারপর সে ফিরে যায় ঢাকায়। দিগন্তের ঢাকায় ফেরার উত্তেজনা বেড়েছে গতকাল থেকে। গতকাল-ই সো জানতে পেরেছে তার ছোট্টবেলার সেই প্রাণপ্রিয় বন্ধুটি ঢাকা শহরের বাসিন্দা। এতগুলো বছর, এতগুলো দিন যাকে কাছে পাওয়ার জন্যে দিনরাত ছটফট করেছে তাকে দেখতে পাবে সে। উত্তেজনায় শরীর কেপে উঠে দিগন্তের। আচ্ছা সে এখন দেখতে কেমন হয়েছে? ছোট্ট বেলার সেই পুতুলের মতোই আছে। না সে তো এখন বড় হয়েগেছে। অনেক বড়। কেমন হয়েছে দেখতে? বউ বউ লাগবে তাকে? অধোর কামড়ে হাসে দিগন্ত। বউ? মনে পরে সেই ফেলা আসা অতীত। মেয়েটার দুটো পাখি ছিলো। লার্ভবার্ড। ওরা নাকি বউজামাই ছিলো। মেয়েটা সারাক্ষণ পাখি দুটো নিয়ে খেলতো। তাদের আদর করতো, ভালোভালো খাবার খাওয়াতো। মেয়ের হাতে যখন পাখি কামড় দিতো, মেয়েটা তখন খিলখিল করে হাসতো। দিগন্ত দূর থেকে দেখতো। ওর এসব সহ্য হতো না। পাখি নিয়ে এত মাতামাতির কি আছে। কষ্ট হতো। মেয়েটা কেন ওর সাথে এভাবে হাসে না। ওকে সময় দেয়না। রাগে কষ্টে কান্না করতো। তারপর একদিন কি হলো। মেয়েটা স্কুলে গেলো। দিগন্তের তখন পিএসসি পরিক্ষা শেষ। মেয়েটা স্কুলে যেতেই সে লাভবার্ড দুটো ছেড়ে দিলো। ওরা পাখি, ওরা আকাশে উড়ে যাক। অনেক দূরে। মেয়েটার থেকে অনেক দূরে। মেয়েটার কাছে থাকবে শুধু সে। আর কেউ না। ওকে নিয়ে কথা হবে, ওর সাথে খেলা হবে। ওর সাথেই সব হবে। মেয়েটা যখন বাড়ি ফিরলো। পাখি না পেয়ে সে কান্নাজুরে দিলো। দিগন্ত গিয়ে মেয়েটার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বলল,

“কাঁদলে তোকে আরো সুন্দর লাগে, বিয়ে বাড়িতে বউরা কাঁদলে যেমন লাগে তেমন। এখনও তোকে ওরকম লাগছে। একদম বউ বউ লাগছে। আমাকে অনেক বড় হতে হবে না হলে তোকে এখুনি বিয়ে করতাম।”

চলবে,,,,,

Mahfuza Afrin Shikha.

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here