রঙ বেরঙের খেলা পর্ব -০৪

#রঙ_বেরঙের_খেলা
#আলিশা
#পর্ব_৪

দেহ জুড়ে প্রসাধনীতে রঞ্জিত সাবিহা বসে আছে তার ঘরের টেবিলের সম্মুখের এক চেয়ারে। ঘরে তার এসি। ডার্ক ব্লু জর্জেট থ্রি পিস পরা সে। লম্বা সরল সোজা কোমর পেরিয়ে যাওয়া চুলগুলো খোলা। বেশ সাদাসিধা তার সাজসজ্জা। মেকআপ করলেও তা লিমিটেড। গা থেকে ভেসে আসছে কড়া পারফিউমের সুবাস। আস্ত এক পরী কণ্যা যেন টুপ করে আসমান থেকে জমিনে নেমে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। সভ্যর সারাদেহ উত্তাপ ছড়িয়ে গেছে দুশ্চিন্তায়। কুল কুল করে ঘেমে উঠছে শরীর। কপল চুইয়ে আসছে ঘাম। সাবিহার এখন লাইভ শুরু হবে। গতকাল দেওয়া কথা অনুযায়ী সে আজ সন্ধ্যায় লাইভের আয়োজন করেছে। তার মাঝারি রুমটায় জ্বলছে মোট ত্রিশটা আলোর দীপ। উপর দিকে তাকালেই চোখ বন্ধ হয়ে আসে গোল গোল আলোর দাপটে।

— আপনি আরো একটু সরে বসুন সভ্য ভাই।

সভ্য সাবিহার কথায় ভারি কাঠের চেয়ারটা নিয়ে ল্যাপটপের পেছনের দিক হয়ে বসলো। সাবিহা সব পর্যপেক্ষণ করে ঠিকঠাক হয়ে বসে পরলো তার চেয়ারে। ল্যাপটপ অন করার মুহূর্তে সে তার পাতলা মোহনীয় ঠোঁট বাকিয়ে হাসলো। দরজার ছিটকিনি লাগিয়ে দেওয়া। সভ্যকে তার মূল্য বোঝাবে বলে সে লাইভ করার আগ মুহূর্তে ডেকে এনেছে। দেখে যাক সে, সাবিহার রূপের জন্য কত ছেলে পাগল আর তারা সভ্যর চেয়ে কত উঁচু পর্যায়ের।

— লাইভ শেষে তিন তালাক দিয়ে এই ঘর থেকে বের হবেন।

সাবিহার কঠিন কন্ঠ। সভ্য মাথা তুলে চাইলো। তার বুকটা দুরুদুরু করছে। চ্যালেন্সে সে হেরে যাবে না তো? সত্যিই তো সাবিহা রূপের রাণী। অনেক ছেলেই পাগল হবে তার জন্য। গত কালের অডিও লাইভেই তুমুল ঝড় উঠেছে প্রেমের। কমেন্ট বক্স জুড়ে শুরু ‘তোমাকে চাই’ লেখা। শেয়ার হয়েছে লাইভটা 90K। এরমধ্যে দেখা গেছে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিল্পপতি আনোয়ার হকের একমাত্র সুদর্শন পুত্র তাহমিদ আহমেদ যে বাউণ্ডুলে, বখাটের শীর্ষক নেতা একজন মাফিয়া সেও লাইভ করে নিজের পেইজে জানিয়ে দিয়েছে সাবিহাকে সে চায়। দু’বছর আগে যে ছেলেটা মেডিক্যালের ভর্তি পরীক্ষায় সর্বোচ্চ নাম্বার পেয়ে দশ বছরের রেকর্ড ভাঙলো সে পর্যন্ত আজ একটু আগে সাবিহাকে ফোন করেছিল। তার উদ্দেশ্যও একই। সাবিহা তাকে দেখিয়েছে ম্যাসেঞ্জার, হটস অ্যাপ, ইনসট্রাগ্রাম অনই করা যাচ্ছে না। টেক্সটের উপর টেক্সট। যেন ফোনই হ্যাং হয়ে যাবে। সভ্য ভাবতে গিয়ে চিন্তায় পরলো। তবুও মুখে হার মানার এতোটুকু ছায়াও পরতে দিলো না। উপরন্তু কড়া আত্মবিশ্বাস নিয়ে সাবিহার কাছে জানতে চাইলো

— যদি চ্যালেন্সে হেরে যাও তাহলে?

সভ্যর কথা শুনে সাবিহা ঝট করে চাইলো সভ্যর পানে। চোখে চোখ পরলো। সভ্যর গভীর চোখের দৃষ্টির সাথে সাক্ষাৎ হলো সাবিহার তীক্ষ্ণ দৃষ্টির। সভ্য তার বড় চোখের ভারি পল্লব সামান্য উঁচু করলো। প্রতীক্ষায় আছে সাবিহার কথা শোনার। সাবিহা বলে উঠলো

— আপনি জিতবেন এই আশা করা আপনার জন্য বিলাসিতা। অলরেডি কন্ডিশন আপনি দেখেছেন। গেস করতেও পারছেন কি হবে। তারপরও জানিয়ে দেই আপনাকে, আপনি জিতলে আমি আপনার পা ধুয়ে দেবো আমার চুল দিয়ে। এবং আপনি বললে সেই পানি খেতেও রাজি আমি।

সভ্য হাসলো সাবিহার কথার পিঠে। সাবিহা বেখেয়ালি মনে নিজের ট্যাবটা চালু করে সভ্যর হাতে ধরিয়ে দিলো। হাত বাড়িয়ে নিলো সভ্য। সাবিহা শেষ বারের মতো আয়নায় নিজেকে দেখে নিলো। তারপর আবার কিছু ভেবে আলমারি থেকে একটা সাদা গাজরা নিয়ে এলো। খোলা চুলের উপর নিয়ে মাথায় জারবেরা ফুলের গাজরাটা পরে নিলো। চূড়ান্ত হতে চূড়ান্তে উঠে গেলো তার সৌন্দর্য। চোখা নাক মুখের সাথে বেশ উঁচু হাইটের এই মেয়েটাকে এবার ভয়ঙ্কর সুন্দরের সাথে বড্ড বেশি স্নিগ্ধ লাগছে। সভ্য চোখ ফিরিয়ে নিলো। সাবিহার নাক মুখ, ঠোঁটেরই প্রতিরূপ হবে সভ্যর নাক মুখ ঠোঁট। তেমনই আকর্ষণীয়। শুধু তফাৎটা রঙে। সভ্য মায়ের রং আর বড্ড বেশি গভীর চোখ পেয়েছে। গড়নটা হয়েছে বাবা চাচার মতো। আর সাবিহা হয়েছে বাবার মতো। ওমনই ছিপছিপে, চোখ ধাঁধানো সুন্দর।

সাবিহা পুনরায় বসে গেছে চপয়ারে। ল্যাপটপ অন করে সে ইউটিউবে লাইভ শুরু করলো। সে পুরোদমে বিশ্বাস করছে সে জিতবে। এতবড় জেদটা সে করতো না। জানে পাবলিকের ফালতু, মেজাজ মন নষ্ট করা অনেক কথা শুনতে হবে তার। কিন্তু সভ্যর নিলামে তোলার কথা শোনার পর সে ঠিক নেই। নিলামে তোলার কথা বলে সভয় তাকে বড় অপমান করে ফেলেছে।

সাবিহা হাসিখুশি মুখে লাইভে কথা বলে যাচ্ছে। তার সাথে ফোন কলে যুক্ত হচ্ছে ক্রমে ক্রমে অনেকেই। ব্লুটুথ দু’টোর একটা সভ্যর কানে আরেকটা সাবিহার কানে। প্রথমেই যে কলে এলো সে নিজের পরিচয় জানালো। ঢাকা ভার্সিটির একজন স্টুডেন্ট। বাসা ঢাকাতেই। সে রঙ চঙ ভঙ করে সাবিহাকে প্রেম নিবেদন করলো। সভ্য চোখ রেখেছে ট্যাবের স্ক্রিনে। হাত তার ওঠানামা করছে ক্রমশ। অনেক কমেন্ট, অনেক রিয়্যাক্ট। সভ্য ক্রমশ ঘেমে যাচ্ছে ফুল পাওয়ার এসির মধ্যে থেকেও। সাবিহা লাইভের সাথে আড়চোখে দেখছে সভ্যকে। মিটিমিটি হাসি তার ঠোঁটে। বিশ মিনিটের বেশি সাবিহা লাইভে থাকলো না। টুংটাং ম্যাসেজ আসছে আর কল আসছে বড় বড় সেলিব্রিটি আর হাই কোয়ালিটির মানুষ দের থেকে। লাইভে তো থাকবে শুধু হয়াংলা পাতলা পোলাপান। সাবিহা লাইভ থেকে বেরিয়ে প্রথমেই সভ্যর দিকে প্রশ্ন ছুড়ে দিলো।

— সাবিহা সুলতানার ডিমান্ড বোঝা গেলো?

সভ্য তাৎক্ষণাত কিছু বলল না। ফোন, ট্যাব আর ল্যাপটপ জুড়ে তখন ম্যাসেজ, কলের ঝড়। মাতামাতি বুঝি হয়েই গেছে ইতিমধ্যে অনলাইনে। সভ্য রয়ে সয়ে মুখ তুলে চাইলো সাবিহার দিকে। হঠাৎ বলে উঠলো

— পানি আনো। আর আমার পা ধোয়ার জন্য প্রস্তুত হও।

সভ্যর ঠাট করে বলা কথা। সাবিহা গরম তেলে যেমন পানি দিলে ছ্যাত করে ঠিকই ওভাবেই ছ্যাত করে উঠলো। বসা থেকে দাড়িয়ে গিয়ে বলল

— মানে? কি বলতে চাইছেন আপনি? আমি হেরে গেছি? এখন অব্দি আপনার সামনে ফোন কল আসছেই। থিয়েটারের হিরো, বড় বড় মডেল, এমন কি মুভির হিরো আবরার পর্যন্ত অফার করছে। তাদের তরফ থেকে ফোন আসছে। এক্ষুনি দেখবেন, গায়ক, হিরো, টিকটকাররা আমার দরজায় এসে দাড়িয়ে গেছে। এটা ওটা পাঠাচ্ছে পার্সেলে। আপনি নিজেও গত কাল দশবার দরজা খুলে বারোটা পার্সেল দরজার ওপাশ হতে নিয়ে এসেছেন।

— তো? যারা তোমায় অফার করেছে তাদের মাঝে এমন একজনকে দেখাও দেখি যার ব্যাকগ্রাউন্ট ভালো। টিকটকার সবগুলো তো মেয়েবাজ। মুভির নায়ক আবরার প্রতি বছর সবার চোখের সামনে দিয়ে মেয়ে নিয়ে ফূর্তি করতে যায় বিদেশ এটা সবাই জানে। গতকাল যে গায়কটা তোমায় পার্সেল পাঠিয়েছে তার চেহারা কি প্রিন্সের মতো? বাকি যারা প্রপোজ করছে তারা কি বাংলাদেশের সবচেয়ে ধনী ব্যাক্তি?

উঁচু নয় সভ্যর গলার আওয়াজ। তবে বেশ শক্ত কন্ঠ। সাবিহা আচমকা দমে গেলো। খন্ডানো যাচ্ছে না সভ্যর যুক্তিগুলো। সাবিহার নুইয়ে পরা ভাব দেখে সভ্য সুযোগ লুফে নিলো। সেও উঠে দাড়িয়ে সাবিহার কানের কাছে বলল

— বলেছিলাম। খোলা জিনিসের উপর আকর্ষণ কম থাকে। তোমার মতো মেয়েগুলো দিয়ে সবাই মজা নিতেই চায়।লাইফ পার্টনার হিসেবে চায় না। যাও প্রপোজ করা লোকগুলোর কাছে। দু’মাস কাছে রেখে ছুড়ে ফেলে দেবে টিস্যুর মতো।

— তবুও আমি আপনার মতো কালো মানুষের সাথে সংসার করবো না।

চোখে চোখ ফেলে নির্লজ্জের মতো বলে উঠলো সাবিহা। সভ্য সময় নিয়ে পরখ করলো নিজের বউকে। স্বামী স্বামী একটা ভাব জরো হলো মনে। সেই সাথে জেদ আর অপমান গুলোও। হুট করে সে আেপে ধরলো সাবিহার এক হাতের বাহু। খুব কাছাকাছি দাড়িয়ে বলে উঠলো

— অহংকার কমবে না তোর তাই না?

তুই সম্বোধন শুনে বিস্ফোরিত নয়নে তড়িৎ গতিতে সাবিহা সভ্যর দিকে চাইলো। কিছু বলতো সে কিন্তু সেই সুযোগ না দিয়েই হুট করে সভ্য সাবিহার ওড়নাটা গা থেকে টেনে মাটিতে ফেলে দিলো। সাবিহার এবার ভয়ে আত্না কেঁপে উঠলো। সভ্য বলছে

— আজকে যা হবে তারপর দেখবো ক’জন আর এই বাসি রূপে পাগল হয়।

বলেই এক ধাক্কা। সাবিহা ঠাস করে পরে গেলো বিছানায় কিছু আঁচ করার পূর্বেই। ভয়ে কাঁপন ধরলো শরীরে। সে কি জোরাজোরি করে নিজেকে ছাড়াতে পারবে একটা পুরুষের হাত থেকে?

চলবে…….

( ভুল ত্রুটি ক্ষমা করবেন)

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here