রুপালির রূপ
সাইয়্যেদাতুন নেছা আফনান
পর্ব:০৮
ইকবাল হোসেন হানিফ সওদাগরের দিকে তাকিয়ে বললেন,
– ভাই, এই মেয়েই কি ফাহিমের ওয়াইফ?
– হুমমম।
ইকবাল হোসেন মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো,
– সে-কি বউমা! আমাদের দেখে তব্ধা মেরে দাঁড়িয়ে আছো কেন? ভিতরে আসতে বলবে না?
মোহনা কপালের ঘাম মুছে সরে দাঁড়ালো। ভিতরে এসে কপাল কুচকে ফেললো দু’জনই। বড় করে ছবি টানানো এক অপরিচিত ছেলের সাথে মোহনার। ফাহিমের ঘরে ফাহিমের ছবি থাকার কথা সেখানে অন্য পুরুষের কেন! ছবিতে থাকা পুরুষটা রান্নাঘর থেকে বের হতে হতে বললো,
– মোহনা কে এসেছে?
ইকবাল হোসেনের গায়ে পুলিশের পোষাক ছিল সেটা দেখে ছেলেটা বললো,
– স্যার কোনো সমস্যা? আমাদের বাসায় কেন?
ইকবাল হোসেন অবাক হয়ে বললো,
– আপনার বাসা মানে? এটা ফাহিমের বাসা না?
– ফাহিম? সে কে?
অবাক হয়ে মোহনার দিকে তাকালো হানিফ সওদাগর। মোহনার কাছে গিয়ে বললো,
– মোহনা, আমার ছেলে কোথায়?
মোহনার কপালের ঘাম কপোল চুয়ে পরতেছিল। হাতের উল্টোপিঠ দিয়ে ঘাম মুছে বললো,
– আপনারা কারা?
হানিফ সওদাগর যেন চমক নিতে পারছেন না! ধপ করে বসে পরেন ফ্লোরে। এগিয়ে আসেন ইকবাল হোসেন। আগলে নেন ভাইকে। ভাইকে ধরে মোহনার দিকে এগিয়ে গিয়ে বলেন,
– আমরা কারা চিনতে পারছো না? রিমান্ডে নিতে হবে দেখবি!
অপরিচিত ছেলেটা এগিয়ে এসে বললো,
– স্যার হয়তো ভুলে গিয়েছেন কোনো ওয়ারেন্ট ছাড়া কারো বাসায় ঢোকাও নিষেধ। সেখানে আমার ওয়াইফকে ধরে নিয়ে রিমান্ডেও নিতে চাচ্ছেন?
হানিফ সওদাগর বলে ওঠে,
– কি বললে? তোমার ওয়াইফ? মানে কি? ও তো আমার ছেলে ফাহিমের বউ!
অপরিচিত ছেলেটা অবাক হয়ে গেল। এগিয়ে গিয়ে বললো,
– আঙ্কেল আপনারা কারা এবং কি বলছেন আনি কিছুই বুঝতে পারছি না। একটু ক্লিয়ার করে বলুন দয়াকরে।
হানিফ সওদাগর একে একে সকল ঘটনা খুলে বললো ছেলেটাকে। সব শুনে এগিয়ে গেল মোহনার দিকে। ছেলেটাকে এগিয়ে আসতে দেখে মোহনা ভয় পেল। চোখে মুখে আতঙ্ক নিয়ে বললো,
– মারজান ওদের কথা বিশ্বাস করো না। আমি কাউকে চিনি না। কাউকে না।
– তাহলে ঘামছো কেন? ভয় পাচ্ছো কেন? তোমার হাত পা কাঁপছে কেন?
মোহনা অতিরিক্ত ভয়ে জ্ঞান হারালো। ছেলেটা আগলে নিলো মোহনাকে। হানিফ সওদাগর মেহনার ফোনটা চাইলেন। ব্যাকপার্ট খুলতেই একটা সীম পেল। সীমটা দেখে ভ্রু কুঁচকে ইকবাল হোসেন হাতে তুলে নিলেন। নিজের এক্সট্রা ফোনে সীমটা ঢোকালেন। নাম্বারটা দেখে অবাক হলেন, এটা তো ফাহিমের নাম্বার! মারজানকে নাম্বারটা দেখালে চিনলো না। মারজান মোহনার দিকে তাকিয়ে বললো,
– আপনারা শিউর তো? ও সেই মেয়ে?
– শিউর না হলে বাবা তোমাদের এত বিরক্ত কেন করবো বলো?
মারজান দীর্ঘশ্বাস ফেললো। সে এতিম। জীবনে বাবা-মায়ের ভালোবাসা পায় নি। মোহনার বাবা যখন মোহনাকে স্ব-ইচ্ছায় তার কাছে বিয়ে দিতে চাইলো তখন না করে নি কারণ জীবনে সঙ্গিনীর প্রয়োজন হয়। মোহনার সাথে এই ফ্লাট এবং চাকরিও দেয়। কিন্তু এর পিছনে যে রহস্য ছিল তা ভাবতেও পারে নি মারজান।
———–
রুপালি বাসায় এসেছে সন্ধ্যার দিকে। ভেবেছিল বাবার সাথে হয়তো ভাইও আসবে। মিসেস রেহানা অনেক আয়োজন করেছে। এতদিন বাদে ছেলে আসবে। রুপালি ফাহিমের ঘরটাকে সাজিয়েছে। যতই হোক ফাহিম আর মোহনার এই বাড়িতে প্রথম দিন।
হঠাৎ কলিংবেল বাজায় রুপালি দরজা খোলে। রাদকে দেখে চমকে ওঠে। ক্যারিংয়ে ভর দিয়ে দাঁড়ানো। মিসেস রাহি এবং মাহিও আছে সাথে। মাহি রুপালিকে দেখেই ঝাপটে ধরে।
ড্রয়িংরুমে বসে সবাই। মিসেস রেহানা মিসেস রাহিকে ধরে ঝাপটে ধরেন। অতিরিক্ত খুশিটা যেন উপচে পরছে তার। মিসেস রাহি বললেন,
– আপা, এত খুশি যে?
– আজ কতগুলো মাস পরে আমার ছেলেটা বাসায় আসবে সেই খুশিতে আপা।
– কি বলেন? ফাহিম আসবে?
– হ্যা ওর বাবা তো নিয়ে আসতে গেল। বাবাকে দেখে নিশ্চয়ই রেগে থাকবে না বলুন!
– যাক্ খুশিতে ভাগ বসালাম।
মিসেস রাহির কথায় হেসে ফেললেন মিসেস রেহানা। রুপালি নিজের রুমে চলে গেল। কেন যেন রাদের সামনে যেতে ইচ্ছে করে না। গেলেই সেদিনের কথা মনে পরে।
———–
মোহনার জ্ঞান ফিরেছে কিছুক্ষণ আগে। ইকবাল হোসেন থানায় ফোন করে দু’জন মহিলা কনস্টেবল ডাকেন। মারজান অনুমতি দিয়েছে।
মোহনা কেঁদেই চলছে। হেঁচকি উঠেছে। মারজান এগিয়ে গিয়ে কাছে বসলো। বললো,
– মোহনা সত্যটা বলো।
মোহনা কাঁদতে লাগলো। কিছুক্ষণ কেঁদে বললো,
– আসুন সবাই। আমি বলছি।
—-
সেদিন আপনাদের বাসা থেকে বের হয়ে ফাহিম সত্যিই আমাকে বাবার কাছে নিয়ে যায়। তবে ততক্ষণে দেরী হয়ে গিয়েছিল। আমি পালিয়েছি শুনে লোকজন বাবাকে অনেক অপমান করে। সেসব দাদু সইতে না পেরে হার্ট-এটার্ক করে। আমাদের দেখে বাবা শুরুতে অনেক রেগে যায়। আমাদের বাইরে রেখে তিনি ভিতরে যায়। ভিতর থেকে এসে হঠাৎ ভালো ব্যবহার শুরু করেন। আমি আর ফাহিম অবাক হয়ে যাই। ফাহিমকে বলে আজ আমাদের বাসায় থাকো। কাল তুমি চলে যেও যেয়ে তোমার গার্জিয়ান নিয়ে আসবে। আমরা অনেক খুশি হই। রাতে খাবার খাওয়ার সময় ফাহিমের মাথায় আঘাত করে চাচ্চু। আমি ফাহিমকে ধরতে গেলে আমাকে রুমে আটকে রাখা হয়। ফাহিমকে ওরা অনেক মারে।
মোহনা কান্নায় ভেঙে পরে সাথে হানিফ সওদাগরও।নিজের আদরের ছেলের এমন পরিনতির কথা এতদিন তিনি জানতেন না। ইকবাল হোসেন বলেন,
– ফাহিম জীবিত আছে?
– হ্যা আছে। আমার বাবা ওকে আটকে রেখেছে। আর আমাকে আপনাদের সাথে যোগাযোগ করতে দেয় নি। আমি এতদিন রুপালির সাথে গোপনে মাঝেমধ্যে যোগাযোগ করতাম সেটাও বাবা জেনে গিয়েছে। আমাকে বলেছে যোগাযোগ রাখলে ফাহিমকে মেরে ফেলবে সেই ভয়ে আমি কাউকে কিছু বলি নি। মারজানের সাথে আমাকে জোর করে বিয়ে দিয়ে দেয়। মারজানকে এতদিন কিছু বলি নি কারণ আমার ভয় হতো মারজানও যদি বাবার সাথে জড়িত হয় তাহলে ফাহিমকে মেরে ফেলবে। আপনারা প্লিজ ফাহিমকে উদ্ধার করেন। ও মরে যাবে ওখানে থাকলে। আমি সঠিক জানিও না ও বেঁচে আছে কীনা! ওকে বাঁচান আপনারা।
কান্নায় ভেঙে পরে মোহনা, হানিফ সওদাগর পাথর হয়ে বসে আছেন। বুকে যন্ত্রণা হচ্ছে তার। ইকবাল হোসেনকে বলতেই দ্রুত এম্বুলেন্স ফোন দেন তিনি।
———–
রুপালির ফোন বেজে ওঠায় ফোন ধরে দেখে ইকবাল হোসেন কল দিয়েছেন। ফোন ধরে কানে নিতেই ওোশ থেকে বললো,
‘ রুপা বি-আরবি হসপিটালে চলে আয় তোর আম্মুকে নিয়ে। ভাইজান অসুস্থ হয়ে পরছেন।
রুপালি স্তব্ধ হয়ে যায়। দ্রুত হিজাবটা পেচিয়ে মায়ের কাছে যায়।
ড্রয়িংরুমে বসে হাসি-তামাশ করছিলেন মিসেস রেহানা এবং রাহি। রুপালিকে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে দেখে মিসেস রেহানা বললেন,
– রুপা কি হয়েছে?
– মা, দ্রুত বোরকা পরো, আব্বু অসুস্থ হয়ে পরেছে, চাচ্চু হসপিটালে নিয়ে যাচ্ছে।
– কি বলিস! সুস্থ লোকটার কি হলো?
– আমি কীভাবে বলবো? তুমি দ্রুত রেডি হও।
মিসেস রাহি এগিয়ে এসে বললো,
– রুপালি তুমি যেয়ে কিছু করতে পারবে বলো? তুমি থাকো, আমি আর আপা যাই।
– না আন্টি, আমিও যাবো।
মিসেস রেহানা এগিয়ে এসে বললো,
– মা, তুই থাক্ তাছাড়া রাদ তো অসুস্থ, ও তো আর কোথাও যেতে পারবে না আর মাহিও ছোট মানুষ। তুই থাক আমি আর আপা যাই।
রুপালি মিসেস রেহানাকে হসপিটালের নাম বললেন। মিসেস রেহানা দ্রুত চলে গেলেন হসপিটালের উদ্দেশ্যে।
তারা যেতেই রুপালি রুমের দিকে এগিয়ে যেতেই রাদ ডেকে ওঠে। বলে,
– রুপালি এদিকে এসো।
রুপালি চুপচাপ এগিয়ে যায় রাদের দিকে। দু’জনকে কথা বলতে দেয়ার জন্য মাহি চলে যায় রুপালির রুমে। রুপালি সোফায় বসতেই রাদ বলে,
– আহা, খামোখা টেনশন করছো কেন? টেনশন করলে কি কোনো সমাধান হবে বলো? এর চেয়ে এক কাজ করো যা দুই পিস মাংস এনে দাও। আন্টির রান্না করা মাংসের ঘ্রাণে ক্ষুধা লেগেছে।
রাদের এমন খামখেয়ালি কথায় রুপালি ভ্রু কুঁচকে তাকায়।
মেজাজ খারাপ নিয়েই উঠে একটা পেয়ালায় কিছু মাংস নিয়ে আসে। রাদের দিকে এগিয়ে দিতেই রাদ বলে,
– যা বাবা, বুদ্ধি হলো কীভাবে? আমি ভেবেছিলাম পুরো মাংসের পাতিলটাই নিয়ে আসবে!
রুপালি বলে,
– আর কিছু বলবেন?
– হ্যাঁ অবশ্যই, আগে খেয়ে নিই। তুমি বসো, কিছু লাগলে নিয়ে আসবে।
রুপালি কিছু না বলে বসে পরে, ইকবাল হোসেনকে ফোন দেয়।
– চাচ্চু, আব্বার কি হয়েছে?
– তেমন কিছু না, বুকে ব্যথা করছিলো তাই হসপিটালে নিয়ে এসেছিলাম। এখন ঠিক আছে।
– ভাইয়ের বাসায় গিয়েছেন? ভাই আসবে?
– হ্যাঁ নিয়ে আসবো।
রুপালি খুশিমনে ফোন কেটে দেয়। দু’টো আনন্দের সংবাদ শুনে বেশ খুশি হয়েছে।
রাদ আড়চোখে রুপালিকে দেখছিলো। রুপালির মুখে হাসি দেখে বুঝে হানিফ সওদাগর ঠিক আছেন। রাদ স্বস্তির শ্বাস ফেলে। বলে,
– যাও এবার পানি নিয়ে এসো। টিস্যুও নিয়ে এসো।
রুপালি উঠে পানি নিতে চলে যায়।
———-
হসপিটালে এসে পৌঁছেছে মিসেস রেহানা। হানিফ সওদাগরকে দেখে ছুটে গেলেন। হাত ধরে বললেন,
– কি হয়েছে তোমার? ঠিক আছো?
– কিছু হয় নি, সামান্য বুকে ব্যথা হচ্ছিলো।
– ফাহিম কোথায়? তোমাকে দেখেও রাগ ভাঙে নি?
– ওর সাথে দেখাই হয় নি।
– চলো আমিও যাবো।
ইকবাল হোসেন এগিয়ে আসলেন। বললো,
– ভাবি, আপনারা বাসায় যান। একটু ঝামেলার ব্যপার আছে, বাসায় যেয়ে সব বলবো।
মিসেস রেহানা জোরাজোরি করলেন না। দুঃশ্চিন্তা নিয়ে ফিরে গেলেন বাসায়।
চলবে,