লতাকরঞ্চ পর্ব ১৫

#লতাকরঞ্চ (১৫)

আবির আমার হাতটা এমনভাবে ধরে আছে যে আমার সারা শরীর ব্যাথায়,ভয়ে অবশ হয়ে অচেতন হয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। আমার দিকে তাকিয়ে সে যখন লোভাতুর দৃষ্টিতে ডুব দিলো তখন আমি ঘৃণায় কুঁকড়ে উঠলাম। কিছুক্ষন পর দেখলাম, কিশার ভাই এসেছে। আর অবাক দৃষ্টিতে আবিরকে বলছে,
– এত বড় স্পর্ধা তোমার! তুমি ওর হাত ধরে টানাটানি করছেন? সমস্যা কি?

তার কিছুক্ষন পরেই প্রান্ত ভাই ও আসলো।
প্রান্ত ভাই আসা মাত্রই আবির আমার হাতটা ছেড়ে দিলো। আমি লক্ষ্য করে দেখলাম আমার হাতের নতুন চুড়িগুলোর কিছু বাঁকা হয়ে গেছে,কিছু একদম চামড়ার ভেতরে ঢুকে গেছে। এত শক্ত করে ধরায় হাতের কিছু অংশ কেটে গিয়েছে, সেখান থেকে রক্তপাত ও হচ্ছে সামান্য।

কিশোর ভাই আর কিছু বলার প্রয়োজন মনে করলো না কারণ আবির হলো প্রান্তের গেস্ট। তাছাড়া মানুষজনের ভীড় উপচে পড়ছে। এখন কিছু না করাই শ্রেয়, এই ভেবে কিশোর ভাই কিছু বলছেনা।

প্রান্ত ভাই কিশোর ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললো,
– ভাই আপনি তো এসেই ঠাঁস করে একটা চড় ওর গালে মারতে পারতেন। তাইনা? দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ভালো ভালো কথা এখানেও? এভাবে চলবে? সব জায়গায় কি স্মার্টনেস ধরে রাখা লাগে?

কিশোর ভাই স্বাভাবিকভাবে বললো,
– না। আপনি ভুল বুঝতেছেন মিস্টার প্রান্তিক।
আমি আসছি এইতো কিছুক্ষন আগে। আমার আসার মিনিটখানেকের মধ্যেই আপনি চলে আসছেন। আসলে, আমি হতভম্ব হয়ে গিয়েছিলাম এই দৃশ্য দেখে।

প্রান্ত ভাই রাগী স্বরে ভ্রু কুঁচকে বললো,
– ও,এজন্য আপনি নীরব দর্শক সেজে বসে বসে দেখবেন; একটা বখাটে কিভাবে লতাকে হ্যারেসমেন্ট করছে… তাইতো?

কিশোর ভাই বললো,
– প্রান্ত, আপনি একটু বেশিই রেগে যাচ্ছেন আমার উপর। এই ছেলেটা আপনাদের গেস্ট, বিশেষ করে আপনার গেস্ট। তাই হুট করে কিছু বলিনি। তাছাড়া এত মানুষের ভীড়ে তো চিৎকার, চেঁচামেচি, মারামারি করা যায়না। আর আমি একে কিছু একটা করতে যাচ্ছিলাম কারণ আমার মাথাও ঠিক নেই এখন; ওর এই স্পর্ধা দেখে। হাউ ডেয়ার হি ইজ!

প্রান্ত ভাই এইসব হাবিজাবিই গিজগিজ করে বলছে। উনার রাগে বোধ হয় গা জ্বলে যাচ্ছে।

কিশোর ভাই যথেষ্ট ঠান্ডা মেজাজের মানুষ। উনার সব কার্যকলাপ ধীরে-সুস্থে। আজ ও তার কমতি নেই। প্রান্ত ভাইকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে কিশোর ভাই আমাকে বললো,
– এখানে একা একা কি করছিলা? কেন আসলা এখানে?

ওদিকে প্রান্ত ভাই আবিরের সাথে বোঝাপড়া করছে।

আমাকে কিশোর ভাই কথাটা বলার পর আমি বললাম,
– কিছুইনা। একটু রিলেক্সেশনের জন্যই আসছিলাম।
কিশোর ভাই আমার হাত ধরে বললো,
– চলো। ঐখানে চলো।
হাতটা ধরতেই আমি আস্তে করে ‘উহ্’ করে উঠলাম। চোখে পানি চলে আসলো। উল্টানো চামড়ায় আর কেটে যাওয়া স্থানে ঘষা পড়ায় জ্বলে যাচ্ছে একদম।

আমি উহ্ করে উঠতেই কিশোর ভাই থমকে গিয়ে চোখ বড় বড় করে ফেললো।
চোখ বড় বড় করেই বলছে,
– কি হয়েছে?
– আমি পুরোটা বললাম।

কিশোর ভাই এবার রেগে গেলেন।
উনি গিয়ে আবিরকে গিয়ে একটা থাপ্পড় দিয়ে দিলো।
প্রান্ত ভাই এটা দেখে মস্করা করে বললো,
– কি ভাই? এতক্ষন কি এই একশনটা ডুব দিয়ে ছিলো নাকি?

কিশোর ভাই আরো রেগে গিয়ে বললো,
– প্রান্ত, তোমার কমন- সেন্স আর বোধ-বুদ্ধি বলে কিছুই নেই। কথাটা জানো?
প্রান্ত ভাই হাসি দিয়ে বললো,
– জানি। আপনার জানানো আবশ্যক না।
কিশোর ভাই আবার বললো,
– তুমি জানো ছেলেটা কি করছে?
(এই বলে কিশোর ভাই সবটা বলে দিলো প্রান্ত ভাইকে।)
_______________
___________

কিশোর ভাই আমার হাতটা আলতো করে ধরে নিয়ে যাচ্ছে আর বলছে,
– কথাটা তোমার আব্বাকে বলার দরকার নেই। আমিই দেখছি কি করা যায়। এত মানুষ এখানে কাউকে দেইখো এগুলো বলতে যেওনা। মানুষ ‘অ’ কে ‘আ’ বানায়। মনে রাখবা।

আমি হেঁটে চলে যাচ্ছি।

প্রান্ত ভাই চোখ স্থির করে আমার চলে যাওয়া দেখছে হা করে।

কিশোর ভাইকে দেখছিনা অনেকক্ষন।
আমি মানুষের ভীড়ে মধ্যেই এক জায়গায় গুটিসুটি হয়ে বসে আছি। আম্মা এসে বললো, আপুর সাজগোজ দেখে দিতে, আপু নাকি ডাকছে।
আমার যাওয়ার ইচ্ছা নেই কারণ ওর জীবনে কারো কিছু পছন্দ হয়না। আমার সাজ যে ওর পছন্দ হবেনা সেটা তো জানা কথা। অবশ্য সেজেই আছে। আরো সাজবে।

শোভা আপু অনেক দামী ড্রেস পরে হাঁটাহাঁটি করছে। অনেক খুশি দেখাচ্ছে। কার বোনের এনগেইজমেন্ট আমার না বুঝতে সমস্যা হচ্ছে।

আমি লিমা আপুর কাছে গেলাম।
আপু ইনিয়ে বিনিয়ে বলছে,
– জানিস? আব্বা না আজকেই কাজী ডাকার পার্মিশন দিয়ে দিয়েছে।
আমি অবাক হয়ে বললাম,
– কেন? তোর না আজ এনগেইজমেন্ট?
এত তাড়াহুড়া কেন?
— আরে আব্বা তো আব্বাই। উনি এইসব এনগেইজমেন্ট টেনগেইজমেন্ট কিছু বুঝে? উনার নাকি বিশ্বাস হয়না এসব। তাই উনি উনার হবু বেয়াইকে কথাটা জানাতেই… উনি সম্মতি দিয়ে দিলো।

– আপু, আব্বা এনগেইজমেন্ট কি তা খুব ভালো করেই জানে। শুধুমাত্র তোর ভালোর জন্যই এত চিন্তা করে। আর আব্বা সেকালের বি এস সি, বি এড। না জানার তো কোনো মানে নেই। তাইনা?
— এই,তোর হাতে কি? কাটলি কিভাবে?
– আরে তুই জানিস না আ-আ…
মুখ ফসকে কথাটা এই পেট পাতলা লিমা আপুকে বলেই ফেলতে যাচ্ছিলাম।

— হ্যাঁ, বল?
– না মানে… হিল পরছিতো, তার উপর আবার এগুলোকে নাকি পেন্সিল শু বলে। পড়ে গিয়েছি আরকি। দরজার ইয়েতে লেগে কিভাবে যেন…
— আচ্ছা দাঁড়া আমি মঞ্জুকে ডাকছি।
– না না আপু। এখন থাক। আমি এইতো এখনি যাবো। আর ওয়াশ করেছিতো। কিশোর ভাই দেখে দিয়েছে। ব্যাথা নেই এখন, পরে ঔষধ নিয়ে নিবোনে।
— আচ্ছা। কিন্তু দেখ না… আব্বা এইটা কি করলো বলতো?

– আবার কি করছে?
— বিয়েটা…
– কেন যার সাথে এনগেইজমেন্ট তার সাথেই তো তোর বিয়ে হবে। একদিন আগে পরে হলে তোরতো কোনো ক্ষতি হবেনা তাইনা? সমস্যা হবে কেন, বলতো?
— ক্ষতি মানে মহাক্ষতি। আমার শাড়ি,গহনা,ড্রেস কমে যাবে। বিয়েতে এক্সট্রা কতকিছু দেয় সব মিসড। কত বড় লোকসান, ভাবতে পারিস? হায় আল্লাহ….

আমি আর কথা বাড়ালাম না।
কারণ জানা কথা আর শুনতে ভালো লাগেনা।
ওর সব চিন্তাধারা এমনই হয়।
কিভাবে পারে এরা?

আপু ব্যাগ থেকে একটা মেহেদীর টিউব বের করে বললো,
— এই নে, এটা তাড়াতাড়ি লাগানো শুরু কর। তুই তো খুব ভালো ডিজাইন করতে পারিস।
– মেহেদী!
— হ্যাঁ। মেহেদী। আমার ব্যাগে ভাগ্যিস এই একটা ছিলো। নয়তো ওহ্!

– নয়তো কি? তুই এখন এটা লাগাবি? মাথা ঠিক আছে? গেস্টরা সব চলে আসছে..
— আরে তুই দেতো। ১০মিনিটের মধ্যে গর্জিয়াস করে দিয়ে দিবি একদম। তারপর আমি ৫মিনিট রাখবো। এত অল্প সময়ে নিশ্চয়ই শুরু হয়ে যাবেনা অনুষ্ঠান?
– আরে… কি বলবে মানুষ।
— ওসব বাদ দে তো! আমার তো সর্বনাশ হয়ে যাবে।
– মেহেদী না পড়লে সর্বনাশ হয়ে যাবে?

— হ্যাঁ হবে। সর্বনাশ না শুধু মহাসর্বনাশ হয়ে যাবে।
– কিভাবে?
— আরে, ঐ ফটোগুলো ফেবুতে আপলোড হবেনা? কত মানুষজন দেখবে। আমার ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাই, মঞ্জুর ফ্রেন্ড সার্কেলের সবাইও দেখবে। আমার তো প্রেস্টিজ বলে একটা কিছু আছে,তাইনা? নে লাগানো শুরু কর।
– আমি লাগিয়ে দিলাম।
ডিজাইনটা আপুর বেশ ভালোরকমভাবেই পছন্দ হয়েছে।

আপুর পাশেই বসে আছি। শোভা আপু এসে বললো,
– এই সরো। তুমি এবার এখান থেকে নামো। বাচ্চা নাকি? সারাক্ষন এখানে উঠে বসে থাকো কেন?
– আম্মা বলছে তাই।
– এখন একটু যাও। আমি পিক তুলবো লিমা আপুর সাথে।
লিমা আপু বললো,
– তোলো সমস্যা নেই। কিন্তু লতা থাক না, আমার ওকে দরকার পড়ে।

শোভা আপু গুরুত্ব দিয়ে বললো,
– কি দরকার তুমি আমাকে বলবা। আমি এখানে আছি। অনেকক্ষন ও এখানে ছিলো এখন আমি থাকবো। হুম?
লিমা আপু বললো,-আচ্ছা।
আমি নেমে আসলাম।

আসতে আসতে শুনলাম শোভা আপু বলছে,
– এই তুমি এত বোকা কেন আপু? আমি থাকতে তুমি লতাকে দিয়ে এসব করাচ্ছো? কেন? ওকি এগুলো আমার চেয়েও বেশি বুঝে না পারে? এগুলো কিছু বুঝে ও?
ছি:! কি বাজে, পুরাতন ডিজাইন দিয়ে দিয়েছে…

আপু চিন্তিত স্বরে বললো,
– সত্যিই?

চলবে…

#ফারজানা_রহমান_তৃনা।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here