“লুকোচুরি”
পর্ব- ১২
(নূর নাফিসা)
.
.
পরদিন সকালে যখন অফিস যাওয়ার সময় রিজোয়ানাকে বলে যাচ্ছিলো, ইভানকে অন্যদিনের মতো স্বাভাবিক লাগছে না। রাতে ঘুমানোর সময় ফোন দিলেও কথা বলেনি। শুধু এটুকু বলেছে, “ঘুম পাচ্ছে, এখন ঘুমিয়ে থাকি। পরে কথা হবে, ঘুমাও।” এখনো কেমন গম্ভীরমুখে শুধু এটুকু বললো,
“রিজু, আসছি।”
রিজোয়ানা তাকে থামিয়ে বললো,
“এই শুনো?”
“হুম?”
“শরীর খারাপ?”
“না।”
“মন?”
“উহুম।”
“অন্যরকম লাগছে তোমাকে। কি হয়েছে?”
“কিছু না।”
“কিছু তো হয়েছে।”
“বললাম না, কিছু হয়নি। আসছি।”
সামান্য বিরক্তি নিয়েই কথাটা বলে গেলো ইভান। এভাবে ইগনোর করায় রিজোয়ানার রাগ হলো। স্থির করলো তার সাথে আর কথাই বলবে না। আবার শাস্তি দিবে তাকে। অযথা মেজাজ দেখানোর পরিণাম হারে হারে টের পাবে। কিন্তু একটু পরেই মাথা ঠান্ডা হলে ভাবতে লাগলো ইভানের হলো টা কি! তার সাথে তো কোনোভাবে রাগ না। যদি তার উপর রাগ করতো, তাহলে অফিস যাওয়ার সময় তাকে ডেকে বলে যাওয়ার প্রয়োজন মনে করতো না। ঘরে কিছু হয়েছে? মামী কিছু বলেনিতো! শিহান! শিহান থেকে তথ্য পাওয়া যাবে।
সারাটাদিন কেটে গেলো একটু পরপর জানালার বাইরে উঁকি দিতে দিতে। কিন্তু শিহানের দেখা আর পাওয়া গেলো না। দুপুরের দিকে অনলাইনে নক করলো, অনলাইনেও পাওয়া গেলো না। চিন্তায় চিন্তায় সন্ধ্যা নেমে এলো। কাজকর্ম শেষে যখন বারান্দায় এসে দাঁড়ালো, ইভানের বারান্দার লাইট জ্বালানো দেখতে পেল। তারমানে ইভান বাড়ি ফিরেছে। রিজোয়ানা ফোনটা হাতে নিয়ে বারান্দায়ই দাঁড়িয়ে কল করলো। ওপাশ থেকে কল কেটে দিলে কপালে সুক্ষ্ম ভাজ পড়ে গেলো। তার পরপরই কল ব্যাক করতেই কপালের ভাজ নিশ্চিহ্ন হয়ে মুখে হাসি ফুটে উঠলো। ভদ্রলোক বুঝতে পেরেছে তাহলে, বউ যে সত্যি সত্যিই বেকার! ভাবতেই ফিক করে হেসে উঠলো রিজোয়ানা। অতঃপর রিসিভ করে সালাম দিলো,
“আসসালামু আলাইকুম।”
“ওয়ালাইকুমুস সালাম। বলো?”
“ব্যস্ত নাকি?”
“নাহ। বলো?”
“কখন ফিরেছো?”
“এইতো, কয়েক মিনিট। ফ্রেশ হয়ে এলাম মাত্র। বলো কি বলবে?”
“কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ। তুমি কেমন আছো?”
“আলহামদুলিল্লাহ, ভালো। একটা কথা বলতাম আরকি।”
“আযব! কতো বারই তো বললাম, কি বলবে বলো?”
“যতবারই বলেছো, ব্যস্ততা প্রকাশ পেয়েছে। তাই বলার সাহস হচ্ছে না।”
“তেমন কিছু না।”
“আচ্ছা, তাহলে বলে ফেলি। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“বেশ, তো। বারান্দায় এসো।”
বলতে বলতে ইভান রুম ছেড়ে বারান্দায় চলে এসেছে। রিজোয়ানা প্রত্যুত্তরে বললো,
“উহু, আমি বারান্দায়ই আছি। আরও কাছে থেকে দেখতে ইচ্ছে করছে।”
“অয়ন নিয়নের পড়ায় ছুটি হোক, ওই বারান্দায় আসবো।”
“এতেও ইচ্ছে মিটবে না। ছাদে চলে আসো না…”
“সন্ধ্যায় ছাদে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। সকালে যেও।”
“প্লিজ। ওই মিয়া, প্লিজ…”
ইভান তার দিকে তাকিয়ে বললো,
“ওকে, চলো।”
বলার পরপরই কল কেটে ইভান বারান্দা ছেড়ে চলে গেলো। রিজোয়ানাও খুশি হয়ে বেরিয়ে যেতে লাগলে লুবনা বললো,
“কোথায় যাস?”
“আসছি একটু।”
“কোত্থেকে আসছিস?”
“আহ, মা! তোমার মেয়ে বিবাহিত, অন্য কারো সাথে প্রেম করতে যাবে না। নিশ্চিন্তে থাকো।”
বলতে বলতে বেরিয়ে গেলো সে। মায়ের প্রতিক্রিয়া দেখার আর অপেক্ষা করলো না। ছাদে এসে তাদের ছাদ ফাঁকা পেলেও ইভানদের ছাদে ইভানকে দুজন ভাড়াটিয়া ছেলের সঙ্গে কথা বলতে দেখা গেলো। রিজোয়ানা তাই পায়চারি করতে লাগলো। ইভান তাকে দেখে ছেলে দুটোর উদ্দেশ্যে বললো,
“আচ্ছা, এখন যাও তাহলে। বাইরের মানুষ নিয়ে এখানে আড্ডা দিয়ো না। ছাদ তো মন ভালো করার জায়গা, বন্ধুবান্ধব ডেকে হাবিজাবি খেয়ে সুন্দর পরিবেশ নষ্ট না করাই উত্তম। এমন হলে ছাদের অতিরিক্ত চাবি কারো হাতে দেওয়া হবে না।”
ছেলে দুটো মাথা নত করে “ঠিক আছে” বলে চলে গেলো। ইভান রেলিং টপকে এপাশে চলে এসে হাই তুলতে লাগলো। রিজোয়ানা বললো,
“টায়ার্ড?”
“না। দেখেছো? মন ভরেছে?”
“ভরেছে বললেই বুঝি এখন চলে যাবে?”
ইভান জবাব না দিয়ে ব্রু সামান্য কুচকে ছোট ছোট চোখ করে তাকালো। তার দৃষ্টিই যেন জিজ্ঞেস করে বেড়াচ্ছে, “আজ খুব রোমান্টিক মুডে আছো নাকি?”
আর অনায়াসে তার দৃষ্টির ভাষা পড়ে নিয়ে রিজোয়ানা মুচকি হেসে ইভানের ডান হাতটা জড়িয়ে ধরে বললো,
“মন কেন খারাপ?”
“কোথায়?”
“আমি বুঝে গেছি তো৷ আর লুকিয়ে লাভটা কি? কি হয়েছে? হুম?”
ইভান সময় নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো,
“তেমন কিছু না। মায়ের সাথে একটু রাগারাগি করেছিলাম গতরাতে।”
“কেন?”
“তোমাকে নিয়ে।”
“আমাকে নিয়ে!”
“হুম, ইফতার করিনি কেন বাসায় তার জবাবদিহিতা চাইছিলো। বলেছি তোমাদের বাসায় ইফতার করেছি। তারপর কিছুক্ষণ বকাঝকা করলো। আমিও রেগে গিয়ে বলেছি দু’তিন কথা।”
রিজোয়ানার মুখটা মলিন হয়ে এলো। মুখে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। ইভান তার হাত ছাড়িয়ে রিজোয়ানার পেছনে হাত রেখে তাকে আরও কাছে টেনে বললো,
“কি ভাবছো?”
“কিছু না।”
“প্রেমের সঙ্গা বিশ্লেষণ করছো না তো?”
কথার সাথে সাথে মাথায় মাথা ঠুকলো ইভান। রিজোয়ানা মুচকি হাসলো। ইভান বললো,
“দেখবে বলেছো, তাকাচ্ছো না তো তেমন!”
“মন ভালো হয়েছে তোমার?”
“না হওয়ার কারণ তো দেখছি না।”
বলতে বলতে নিজের সাথে চেপে ধরলো রিজোয়ানাকে। রিজোয়ানা তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বললো,
“দিন দিন পাজি হয়েই যাচ্ছো তো হয়েই যাচ্ছো! যাও, নিচে যাও! আমার দেখা হয়ে গেছে।”
“কোথায় দেখলে! আবছা আলো, দেহে আবরণ! টিশার্ট খুলে ফেলি, ভালো করে দেখো।”
“অসভ্য!”
রিজোয়ানা খপ করে তার টিশার্ট ধরে টেনে সিড়ির দিকে যেতে লাগলো। ইভান যেতে যেতেই তাকে থামানোর চেষ্টায় বললো,
“আরে! ছাদের দরজা লাগাতে হবে!”
“চুপচাপ নামো এদিক দিয়ে। ছাদের দরজা সিড়ি দিয়ে উঠে তারপর গিয়ে লাগাবে। দিনের বেলা যাও তো যাওই! রাতবেরাত এ ছাদ ওছাদ করা টোটালি অফ!”
“দাড়াও, শীঘ্রই রেলিং ভেঙে এক করে ফেলবো ছাদ জোড়া।”
“সে নাহয় পরে দেখা যাবে।”
রিজোয়ানাদের সিড়ি দিয়েই নেমে যেতে হলো ইভানকে। ফ্ল্যাটের দরজার সামনে এসে বলেছিলো ফ্ল্যাটে আসতে। ইভান বললো, “আজ নয়। অন্য সময়।” রিজোয়ানাও জোর করলো না কারণ গতকালের ব্যাপার নিয়েই মা ছেলের মধ্যে ঝামেলা বেঁধে গেছে।
রাতে যখন বিছানা গোছাতে লাগলো, অয়ন নিয়নের বারান্দায় শিহানকে ফোন হাতে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখলো। সে বারান্দায় এসেই ঝাড়ি মেরে বললো,
“এই, সারাদিন কোথায় ছিলে? হুম?”
শিহান ফোন থেকে মুখ তুলে মুচকি হেসে বললো,
“ইদানিং ভাইয়ার থেকে আমাকে বেশি মিস করছো দেখছি!”
“থাপড়ে সবকটা দাত ফেলে দিবো। তোর ভাইয়ার খবর তোর চেয়ে বেশি আর কে দিতে পারবে শুনি?”
“ওহ্! এই ব্যাপার! আমি তো আরও আশার আলো খুঁজে পেয়েছিলাম যে, কেউ তো আমাকে মিস করে!”
“ফাজলামোর জায়গা পাও না? কত মেয়ে লাইন লাগিয়ে রেখেছো, জানি না মনে করেছো?”
“জানতে তো হবেই। বড় ভাবি না তুমি!”
“হুম, তো এখন ফোনে এতো কি দেখছো?”
“কেন, তোমার জা কে।”
“ওরে, বাবা! দেখি দেখি!”
“কোনটা রেখে কোনটাকে দেখবা?”
“কয়টা আছে?”
“তার আগে বলো কয়টা থাকা দরকার?”
“অর্ধশত হলেই হবে।”
“বাহ! আমাকে টুকরো টুকরো করে প্রত্যেকে ভাগে এক কেজি করেও পাবে নাকি সন্দেহ! রক্ত আর মলমূত্রেই তো চলে যাবে কয়েক কেজি, বলো…।”
রিজোয়ানা খিলখিলিয়ে হেসে বললো,
“খুব চালাক, হুম?”
“আমার মতো বোকা পৃথিবীতে আছে নাকি!”
“ওই, স্মার্ট আছো বহুত ভালো আছো। ওভার স্মার্ট হওয়ার চেষ্টা করো না। হুম…”
শিহান শরীর কাপিয়ে হেসে বললো,
“আচ্ছা, বলো কিজন্য আমায় এতো তালাস করছিলে? ভাইয়া প্রেমটেম করে নাকি সেটা জানার জন্য?”
“সেটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে! প্রেম ছাড়া কিছু বুঝো না, না? তোমার ভাইয়ার মন খারাপ কেন, সেটা জানার জন্য। যাক, সন্ধ্যায় জেনে গেছি তোমার ভাইয়ার কাছ থেকেই।”
“ওহ্। আমি একটু বাসাবো গিয়েছিলাম ফ্রেন্ডদের সাথে। গেট টুগেদার ইফতার পার্টি হলো। কিছুক্ষণ আগে মাত্র ফিরলাম।”
কথা শেষও হয়নি, ওদিকে রুমের ভেতর বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে। চিৎকার, চেচামেচি, একজন অন্যজনকে গালি দেওয়া, থু থু মারা! সব মিলে এলাহি কাণ্ড! শিহান গিয়ে দুইটাকে থাপ্পড় ঠুসি লাগাতেই আছে। এরপর আবার দুইটা মিলে কান্না করতে করতে ঝাপিয়ে পড়েছে শিহানের উপর। ফেঁসে গেছে শিহান! তাদের থামাতে এসে এবার নিজেকেই জান নিয়ে পালাতে হচ্ছে মাকে ডেকে ডেকে। রিজোয়ানা তাদের কাণ্ডে হেসে ফিরে এলো নিজের রুমে। এই গুড্ডু সুড্ডু মহা পাজি। তবুও তার বড্ড ভালো লাগে তাদের। আর ইভানের কথা তো না বললেই নয়। এতোশত না ভেবে হঠাৎ করেই যেন মন দিয়ে দিলো। নাকি ইভানই ছো মেরে মন নিয়ে গেছে, বুঝে উঠা দায়!