শহরজুড়ে বিষন্নতা পর্ব -০৪+৫

#শহরজুড়ে_বিষন্নতা
সাদিয়া মেহরুজ

৪.

সকালবেলা অনিক উপস্থিত হয় মেহতিশার ফুপির বাড়িতে। সে বেশ কয়েকদিন যাবৎ মেহতিশাকে খুঁজে পাচ্ছেনা। তবে একটা চিঠি পেয়েছে যা মেহতিশারই লিখা। চিঠিটা পড়ার পর হতে রাগের প্রকোপে বি শ্রী গা লা – গা ল করেছে মেহতিশাকে। যেই মেয়েকে সে এতোটা ক ষ্ট করে হাসিল করলো, সেই কিনা তাকে বোকা বানিয়ে পালিয়ে গেল! অনিক এই পর্যন্ত যতো মেয়ে বি ক্রি করেছে তার থেকে সবচেয়ে বেশি দাম উঠেছিল মেহতিশার। মেয়েটা শ্যামলা হলেও সৌন্দর্যের অধিকারীনি ছিল। কি নিখুঁত সেই সৌন্দর্য! দেখলে আর চোখ সরাতে ইচ্ছে করেনা। মেহতিশাকে অস্ট্রেলিয়ার বিত্তশালী এক লোক কেনার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছিল। দাম হাঁকিয়েছিল ত্রিশ লাখ। অনিক বর্তমানে মেহতিশার ফুপির বাসায় এসেছে মেহতিশার খোঁজে। তবে যখন জানতে পারলো মেহতিশা এখানে আসেনি তখন থেকে সে ভাঙচুর করা শুরু করলো। অনিকের অবস্থা দেখে মেহতিশার ফুপি ফিরোজা কর্কশ গলায় বললেন,

-‘ এই ছ্যামড়া থাম, ফাইজলামি পাইছস? তোরে আমি মেহতিশারে তুইলা দিছি এখন মেহতিশারে দেইখা রাখার দায়িত্ব তোর। তুই কোন সাহসে এখানে আইসা ভাঙচুর করতাছস? ‘

অনিক ক্ষিপ্ত দৃষ্টিতে তাকালো। ফিরোজার কঠিন গলা শুকিয়ে এলো সে চাহনি দর্শন করে। পায়ের কাছে পড়ে থাকা চেয়ারে লা ত্থি মে রে অনিক দ্রুত পায়ে এগিয়ে এসে বলল,

– ‘ এই বুড়ি চুপ! সব তোর দোষ। তুই আমাকে আগে বলবি না তোর ভাতিজি কেমন? ওর ভিতর এতো সাহস দিলো কে? মেহতিশাকে খুঁজে এনে না দিলে তোকে আর তোর মেয়েকে জ্যান্ত পু তেঁ দেব! ‘

– ‘ দেখি কি করস। সাহস তো কম না তোর। বেশি প্যাকপ্যাক করলে তোর কু কী র্তি সব পুলিশের কাছে গিয়ে বইলা দিমু। মনে রাখিস। এখন আমার বাড়ি থেকে বাইর হ। ‘

– ‘ হু ম কি দেস আমাকে বুড়ি? তুই মনেহয় খুব ভালো মানুষ। নিজের ভাতিজিকে আমার কাছে বিক্রি করছস দুই লাখ টাকার বিনিময়ে। এখন কিন্তু আমি তোকে ফাঁ সা য় দিতে পারি। পারি না? ‘

-‘ যা করার কর গা। এখনি আমার বাড়ি থেকে বাইর হ নাইলে বাড়িওয়ালারে ডাইকা মাইর খাওয়ামু। ‘

অনিক ফুঁসতে ফুঁসতে বেড়িয়ে এলো। ফিরোজার ভরসা নেই। ইনি এই মূর্হতে তাকে জে লে পাঠাতে পারেন। পরবর্তীতে কোনো এক সময় ফিরোজাকে উচিত শিক্ষা দেবে মনস্থির করে সে চলল নিজের গন্তব্যে।

দরজার আড়ালে এতক্ষণ লুকিয়ে ছিল ফিরোজার একমাত্র মেয়ে ইলা। অল্পবয়সী মেয়ে। তবুও মাত্র ঘটে যাওয়া ঘটনা এবং কথা শুনে তার ঘৃ ণা য় বুক কেঁপে উঠল! তার বিশ্বাস করতে ক ষ্ট হচ্ছে ইনি কি আসলেই তার জন্মদাত্রী মা? তার অতি পছন্দের ব্যাক্তিটা? ইলা বিষ্ময় নিয়ে ঘরে ঢুকল। ফিরোজা মেয়েকে অসময়ে ফিরতে দেখে কপাল কুঁচকালেন! সন্দিহান গলায় প্রশ্ন করলেন,

-‘ তুই আজকে এতো তাড়াতাড়ি আইছস ক্যান স্কুল থ্যাকা? ‘

ইলা মরা গলায় শুধাল,

-‘ তুমি মেহতিশা আপুকে বি ক্রি করে দিলা মা? কি দো ষ করছিলো আপু? মাত্র দুই লাখ টাকার জন্য তুমি এইভাবে আপার জীবনটাকে ধ্বংস করে দিলা মা। কেমনে পারলা? আজ যদি মেহতিশা আপার জায়গায় আমি থাকতাম তুমি কি এই কাজ করতে পারতা? ‘

ফিরোজা মেয়েকে ধমকালেন,

-‘ উল্টাপাল্টা কথা বলিস না। তুই আমার পেটে ধরা মাইয়া। তোরে ক্যান বি ক্রি করতে যামু আমি? ‘

-‘ মেহতিশা আপুও তো একজনের পেটে ধরা সন্তান মা। একজনের বোন সে। নিজে পেটে ধরোনি বলে এমন নি/ষ্ঠু/র/তা? আল্লাহ সইবে না মা! আল্লাহ সইবে না এই অ/ন্যা/য়। ‘

-‘ চুপ কর ইলা। বেশি জ্ঞান দিবি না আমারে। যা করছি তোর ভালোর জন্য। বাপ নাই তোর ভাবছস কি হইবো আমগো? ‘

ইলা আ হ ত দৃষ্টিতে তাকাল। তার রুচি উঠে গেছে ফিরোজার সাথে কথা বলার। মেহতিশার মুখোশ্রী অক্ষিপটে ভেসে উঠতেই সে ক্রন্দন চেপে ছুটলো নিজের ঘরে। পৃথিবীর মানুষ কতো নি ষ্ঠু র বিধাতা!

_

দূ র্ব ল, ক্লা ন্ত পায়ে হাঁটছে মেহতিশা। সায়াহ্ন নেমেছে বাতাবরণে। সাথে ঝেকে বসেছে শীতের প্রকোপ। কি ভীষণ শীতটাই না লাগছে! দাঁতে দাঁত লেগে আসার উপক্রম। হাত – পা মৃদু কম্পমান। কয়েক প্রহর পূর্বে নামা ঝুম বৃষ্টি এখন শা য়ি ত সড়কের আনাচে কানাচে। পাতা বিহীন গাছ গুলো বৃষ্টির পানিতে সতেজতা ফিরে পেয়ে কেমন দাম্ভিকতা নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে। বঙ্গোপ-সাগরে নিম্নচাপের কারণে এই অসময়ের বৃষ্টি। অম্বর নিকষ আলো। যেনো জগতের সকল আঁধার টেনে নিয়েছে নিজের মাঝে।শব্দহীন পথটায় মাঝে মাঝে পাখিরা তারস্বরে ডেকে জানান দিচ্ছে নিজেদের উপস্থিতি। মেহতিশা যেতে যেতে খেয়াল করল, কত মানুষ কাঁপছে শীতে। জুবুথুবু হয়ে বসে আছে সিক্ত ফুটপাতে। তাদের চেহারা দেখে ভীষণ মায়া হলো তার, ক ষ্ট হলো! মেহতিশার নিজের শরীরেই তো পাতলা ওড়না। হাত শূন্য! সে চাইলেও তো আর পারবে না তাদের সাহায্য করতে। স্থানটা ছেড়ে আসার পূর্বে মানুষ গুলোকে চেয়ে দেখল একবার। তাদের মুখোশ্রী জুড়ে বহাল বি ষ ন্ন তা, কাতরতা! মেহতিশার মনে হলো শুধু তার আর এই মানুষগুলোর মাঝেই নয় এই শহরজুড়েই কেবল বিষন্নতার রাজ!

শাহরিয়ার ভিলা আজ অতিমাত্রায় শান্ত, শব্দহীন। প্রথম প্রথম যে এ বাড়িতে আসবে সে নিশ্চিত ধরে নেবে বাড়িটায় কেবল ভুতদের বসবাস! বাহির থেকে বেশ চাকচিক্যময় লাগলেও ভেতরটা কেমন অন্তঃসারশূন্য, নিস্তব্ধ! মেহতিশার মাঝেমধ্যে মনে হয় এমন অমোঘ নীরবতা বিরাজের নিশ্চিত কোনো কারণ রয়েছে। ছোটবেলায় সে যখন এ বাড়িটায় আসত তখন কতোটাই না প্রাণোচ্ছল, আনন্দঘন ছিলো আর আজ? অতীত এবং বর্তমানের কতোই না পার্থক্য। মেহতিশা মেহজাকে খুঁজতে লাগলো কিন্তু মেহজার দর্শন পেল না কোথাও। সালমার ঘরেও সে চক্কর দিয়ে এসেছে অথচ মেহজা সেখানেও নেই।মেহতিশাকে কেমন অবিন্যস্ত দেখাল এই পর্যায়ে। সালমা ওয়াজিদ আজ বাড়িতে নেই। জরুরি প্রয়োজনে নিজের বোনের বাসায় গিয়েছেন। বাড়িতে তিনজন কাজের লোক, দারোয়ান, মেহজা সে আর সারতাজ উপস্থিত। সারতাজের কথা স্বরণ হতেই মেহতিশা ভাবল, মেহজা ঐ ছেলেটার কাছে যাইনি তো? অতঃপর এক কাজের লোক তার আশঙ্কাকে নিশ্চিত করল। মেহজা সারতাজের কাছে রয়েছে। কিন্তু কেন? মেয়েটা সে বারবার করে না বলে গেল ঘর থেকে বের না হতে!

-‘ আপা, আপা.. ‘

সারতাজ সিক্ত কাপড়ের টুকরো মেহজার কপালে দিলো। হাতের ঘড়ির দিকে দৃষ্টি ফেলে খানিকটা বিরক্তি নিয়ে কপালের চামড়া কুঁচকাল। মেহজার জ্বর এসেছে, মাত্রাতিরিক্ত! সে যখন বাড়ি ফিরল কাজ শেষে তখন সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় ছোট্ট মেহজার আ র্ত না দ তার কর্ণকুহরে এসে বাড়ি খায়। তারপর হতে মেহজা তার ঘরে। ঐ ছোট্ট আলো, বাতাসহীন রুমটায় থাকলে মেয়েটা আরো অসুস্থ হয়ে পড়বে এই চিন্তায় মেহজাকে সে নিজের রুমেই নিয়ে এসেছে। অপেক্ষা করছিল মেহতিশার আসার কিন্তু এতক্ষণ হয়ে গেল মেয়েটার কোনো খবরই নেই! বলে কয়ে মেহজাকে নিজ হাতে খাইয়ে ঔষধ খাওয়াতে পারলেও কিছুতেই কা ন্না বন্ধ করাতে পারছে না সারতাজ। মেহজা সেই কখন থেকে আপা, আপা করে কেঁ দে ই যাচ্ছে।

মেহতিশা হুড়মুড়িয়ে সারতাজের রুমে প্রবেশ করলো। বিহ্বল নয়নে তাকালো বোনের দিকে। মেহজা তাকে দেখেই ঠোঁট উল্টে এবার শব্দ করে কেঁদে দিয়ে হাত বাড়িয়ে তাকে কাছে ডাকল,

-‘ আপা…, আপা…,’

মেহতিশা এগিয়ে গিয়ে জড়তা নিয়ে বসলো বিছানায়। বোনকে আগলে নিয়ে সারতাজকে উদ্দেশ্য করে বলল,

-‘ ওকে এই রুমে আনার প্রয়োজন ছিল না। ‘

সারতাজের গুমোট গলায় জবাব,

-‘ ঐ আলো, বাতাস ছাড়া ঘরটায় থাকলে ও আরো অসুস্থ হয়ে যেত। ‘

-‘ আমাদের অভ্যাস আছে। ‘

সারতাজের ক্লান্ত লাগছে। বড্ড বেশি ক্লান্ত!অলসতা নিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। সাইড টেবিল থেকে নিলো নিজের মানিব্যাগ, মুঠোফোন। রুম থেকে বেড়িয়ে যেতে যেতে বলে গেল,

-‘ আজকের রাতটা এখানেই থাকুন। মেহজা অসুস্থ। অসুস্থ মেয়েটাকে টানা-হেচড়াঁ করার দরকার নেই। আমি পাশের রুমে থাকব। ‘

রাত বাড়ছে তরতর করে। সাথে বাড়ছে মেহতিশার পেটের ক্ষুধা। ক্ষুধা নিবারনের তাড়না তার মাঝে দেখা গেল না। সে অবিরত হাতটা নাড়িয়ে যাচ্ছে মেহজার চুলে। কিয়ৎক্ষণ পর রুমের দরজা খুলে প্রবেশ করলো সারতাজ। হাতে থাকা খাবারের প্লেট টেবিলে রেখে বলল,

-‘ খেয়ে নিবেন।আর কোনো প্রয়োজন হলে আমাকে ডাকবেন। আমি সাবিনা খালাকে এখানে পাঠাচ্ছি। আপনাকে হেল্প করবে। ‘

মেহতিশা নাকচ করলো সারতাজের কথা। বলল,

-‘ দরকার নেই ওনাকে কষ্ট দেয়ার। দরকার হলে আমি ডেকে নিব। আপনাকে ধন্যবাদ। ‘

সারতাজ প্রতিত্তোর না করে বেড়িয়ে গেল। ফিরেও তাকাল না পেছনে। মেহতিশার বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে। না জানি সালমা ওয়াজিদ যখন জানতে পারবেন সে রাতে সারতাজের ঘরটাতে ছিলো, তখন ঠিক কিভাবে বিষয়টা নেবেন। অস্বস্তি, চিন্তায় গাটঁ হয়ে বসে রইল মেহতিশা।

_

নির্জন নিশীথ। দমকা হাওয়ার তোড়ে সারতাজের বিন্যস্ত করে রাখা কাগজগুলো উড়ে গেল লহমায়। সে বিরক্তি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। কাগজগুলো সঠিক স্থানে রাখার পর তার খেয়ালো আসলো এ ঘরে সে ল্যাপটপটা আনেনি। অথচ এটার গুরুত্ব এখন অপরিসীম! সারতাজ নিজের ঘরটার দিকে পা বাড়াল। ইচ্ছে করছেনা যেতে। ভীষণ প্রয়োজন না হলে সে কক্ষণো ঐ রুমে পা রাখত না এসময়ে। দরজা হালকা চাপিয়ে রাখা। সারতাজ দরজা ঠেলে সরালো। তার দৃষ্টিপাত পড়লো বিছানায়। মেহতিশা ঘুমোচ্ছে! গভীর তন্দ্রায় আচ্ছন্ন দু’জনে। সারতাজ কয়েকপল চেয়ে দেখল। পরবর্তীতে রুমে প্রবেশ করার সিদ্ধান্ত বাতিল করে ফিরে চলল। তার এই মূর্হতে যেতে ইচ্ছে করছেনা ঘরটায়। ব্যাপারটা অদ্ভুত দেখায় না? সে নিজেই তো তাদের রুমে থাকতে বলল এখন তাদের অজান্তে চুপিসারে ঘরে প্রবেশ করা ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিদায়ক! সারতাজ ফিরে যেতে যেতে ভাবল মেহতিশার কথা। মেয়েটা আলাদা ধাঁচের। একটু শক্তমনা! আচানক পদচারণ থামাল সে। আশ্চর্য তো! মেহতিশার কথা সে কেন ভাবছে হুট করে? সারতাজ বিড়বিড় করে নিজেকে সান্ত্বনা দিল,

-‘ লেট ইট বি! মেয়েটা অন্যরকম তাই হয়ত তার কথা ভাবছিলাম। ‘

চলবে~#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |০৫|
সাদিয়া মেহরুজ

সবেমাত্র দুপুর পড়েছে। ধরিত্রীতে আজ বহুদিন পর সূর্যের আগমন। সূর্যরশ্মিতে নেই কোনো উত্তাপ। হলদেটে আলো গিয়ে পড়ে রয়েছে গাছের শুকনো, ম রা পাতায়। ঝলমলে পরিবেশ দর্শন মাত্র মেহজা খুশিতে লাফিয়ে উঠল। ছোট্ট মেহজার আনন্দম, আনন্দম মুখোশ্রী লক্ষ করে হাসলেন সালমা। সুস্থ হওয়ার পর এই প্রথম সে মেহজার হাস্যরত মুখোশ্রী দেখল। এতদিন এই প্রাণোচ্ছল মেয়েটা কেমন মনমরা, নিশ্চুপ ছিল। সালমা কাছে ডাকলো ওকে,

-‘ মেহজা, শুনে যা তো। ‘

মেহজা বাধ্য মেয়ের মতো সালমার কাছে এগোল। প্রশ্ন করলো,

-‘ জি আন্টি। ‘

-‘ তুই যে বললি তোর যখন জ্বর হয়েছিল তখন মেহতিশা তোর কাছে ছিল না। তাহলে তোকে ঔষধ খাইয়ে দিলো কে? সাবিনা? ‘

মেহজা মাথা নাড়ল। সে খুলে বলল সারতাজের তার মুমূর্ষু অবস্থায় সেবা করার কথা, আদর করে আগলে নেয়ার কথা। মেহজার সম্পূর্ণ কথা মন দিয়ে শুনল সালমা। অতঃপর আনন্দে তার নেত্রদ্বয় চকচক করে উঠল। তার প্রাণোচ্ছল, হাসি খুশিতে মেতে থাকা ছেলেটা কি তবে স্বাভাবিক রূপে ফিরে আসছে?

শুক্রবার হওয়াতে মেহতিশার আজ ছুটি। তাই সে বাসাতেই অবস্থান করছে আজ। সকাল থেকেই কোমড় বেধেঁ নেমেছে সে রান্নার কাজে। সালমার পছন্দের খাবার রান্না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সাথে সারতাজের জন্যও কিছু রান্না করতে বলেছিলেন সালমা। মাত্রই হাতের সকল কাজ সেড়ে গোসল করে বের হলো মেহতিশা। নামাজ পড়ে দুপুরের খাবারের জন্য ডাকতে চলল সালমা এবং মেহজাকে। বাগানে পৌঁছাতেই সে দেখল মেহজা ছোটাছুটি করছে। তা দেখে মেজাজ চটে গেলো তার। রাগান্বিত সুরে বোনকে উদ্দেশ্য করে হাঁক ছাড়ল,

-‘ মেহজা, কালই সুস্থ হলে আর আজ কেন এভাবে ছোটাছুটি করছিস? ঘরে আয়। ‘

সালমা এগিয়ে আসলেন। তাকে আজ অন্যরকম লাগল মেহতিশার নিকট। ভদ্রমহিলাকে আজ একটু বেশি বেশি খুশি লাগছে না? সালমা এগিয়ে এসে মেহতিশাকে শাসন করলো,

-‘ খবরদার মেয়েটাকে কিছু বলবিনা মেহতিশা। এই ক’দিন কেমন মনমরা হয়ে পড়েছিল। আর এখন দেখ কতোটা হাসিখুশি লাগছে। খেলতে দে। দৌড়াদৌড়ি করলে ওর আরো ভালো লাগবে। ‘

মেহতিশা কন্ঠের খাদ নামিয়ে বলল,

– ‘ কালই তো সুস্থ হলো আন্টি। এখন এভাবে ছোটাছুটি করলে অসুস্থ হয়ে পড়বে তো। ‘

-‘ পড়বেনা। ‘

পুরুষালী ভারী কন্ঠস্বর। মেহতিশা পিছনে ঘুরলো। সারতাজ ট্রাউজারের দু পকেটে হাত ঢুকিয়ে এগিয়ে আসছে ধীরস্থ গতীতে। সে গিয়ে দাঁড়ালো মায়ের পাশে। ভারী কন্ঠে বলল,

-‘ ওকে ওর মতো থাকতে দিন। হাসিখুশি থাকলে বেটার ফিল করবে। ‘

মেহতিশা এ ব্যাপারে আর কথা বাড়াল না। নত মস্তকে দাঁড়িয়েই বলে উঠলো,

– ‘ আন্টি টেবিলে খেতে দিয়েছি। খেতে আসুন। ‘

মেহতিশা স্থান ছেড়ে চলে গেল। সালমা সারতাজের পানে তাকাল। ছেলেটা এক মনে সম্মুখে তাকিয়ে রয়েছে। দেখে মনে হবে যেন, পৃথিবীর সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টা নিয়ে সে আপনমনে গবেষণা করছে। তিনি এগোলেন শব্দহীন পায়ে। সারতাজের পাশে দাঁড়িয়ে বললেন,

-‘ অনেকদিন তো আমার সাথে বসে খাও না। আজ নাহয় এসো? ‘

প্রতিত্তোরের আশায় কয়েক প্রহর সালমা সেখানেই স্থির রইলেন। উত্তর এলো না। দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে ভিতরে যেতে নিতেই তার কর্ণকুহরে ভেসে এলো বহুল কাঙ্ক্ষিত সেই বার্তাটি,

-‘ আসছি মেহজাকে নিয়ে। ‘

সবাই একসঙ্গেই খেতে বসেছে। সারতাজের পাশে মেহজা। এই অল্প কয়েকদিনের ব্যাবধানে তাদের মাঝে বেশ ভালো সখ্যতা গড়ে উঠেছে। সারতাজের বাম পাশে সালমা বসেছেন। তিনি এক লোকমা খাবার গলাধঃকরণ করছেন তো আড়ালে বারংবার নেত্র কোণে জমে থাকা সুখের অশ্রুকণা মুছছেন। ছেলে তার পাশে বসে খাবার খাচ্ছে কতদিন হলো? তা জানা নেই সঠিক। আজ বহুদিন পর সারতাজ তার পাশে খেতে বসেছে। এর থেকে আনন্দ তার জীবনে আর কবে এসেছিল?

_

তিন সপ্তাহ পাড় হওয়ার পর মেহতিশা নিজের কর্মক্ষেত্রে এবার পুরোপুরি অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। আগের মতো তার এখানে আসতে অস্বস্তি বোধ হয় না। নতুন কয়েকজন বান্ধবীও জুটেছে তার। যারা তার মতোই ট্রেইনার৷ তবে ট্রেইনার হিসেবে সুনাম মেহতিশারই বেশি। তার হাতের কাজ অতি নিপুণ, সুক্ষ্ম এবং চোখ ধাঁধানোকর। সারতাজের বড় মামা তাকে প্রায়সই অনুপ্রেরণা দেন,

-‘ তুমি একদিন খুব বড় হবে মা। আমার বিশ্বাস! ‘

বড় মামার এরূপ কথা মেহতিশাকে দারুণ মনোবল জোগায়। আত্নবিশ্বাসী করে তোলে। বড় মামাকে তার ভীষণ পছন্দ। কি দারুণ একজন মানুষ তিনি!

ফুটপাতে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহতিশা। তার পাশেই দাঁড়িয়ে আয়েশা। তার কলিগ। মেয়েটা মিষ্টি বেশ। চটপটে হলেও চমৎকার মনের অধিকারী। রিকশার জন্য দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে বিরক্ত ধরে বসলো মেহতিশাকে। সে বিরক্তি নিয়ে শুধালো,

-‘ চলো আয়েশা, আজ বরং হেঁটে যাই। ‘

আয়েশা মন খারাপ করে বলল, ‘ হু চলো। আজ তো রিকশা পাচ্ছিই না। অন্য সময় হলে তো ‘ আপা চলেন, আপা চলেন ‘ করে করে কানের পোকা বের করে ফেলতো। আজ কোথাও উধাও হলো কে জানে। ‘

হাঁটা ধরলো দু’জন।ইদানীং তারা রিকশার যাতায়াত
শুরু করেছে। দু’জনে ভাড়ার সমপরিমাণ টাকা ভাগ করে ভাড়া মিটিয়ে দেয়। আয়েশা নানান ধরনের কথা বলছে। মেহতিশা শুনছে তো চারপাশেও নজর রাখছে। বাসা খোঁজা শুরু করেছে সে ইতিমধ্যে। মাস শেষ হতে বেশি দেরী নেই। প্রথম মাসের বেতন পেলেই সালমার বাসা ছাড়তে হবে। অর্ধেক পথে আসার পর আয়েশা তাকে বিদায় জানিয়ে চলে গেল নিজের গন্তব্যে। মেহতিশার বাকি পথটা একা যেতে হবে ভেবেই মন খারাপ হলো! এই রাত বিরাতে একাকী চলতে তার ভালো লাগে না। একটুও না!

হীম শীতল বাতাবরণ। সমীরে বইছে নাম না জানা মাদকীয় পুষ্পের ঘ্রাণ। সড়কপথে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে সোডিয়ামের হলদেটে আলো। কিয়ৎ দূরে আঁধারের মাঝে ছোটাছুটি করছে ঝোনাকি পোকা। কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়েছে পুরো শহর। অদূরে বিশাল বড় অট্টালিকা লুকোচুরি খেলছে যেন কুয়াশার সাথে। দমকা সমীরনের ঘন ঘন ছুটে চলা অদূর পর্যন্ত। ক্ষীণ দূরে কিঞ্চিৎ রশ্মির প্রতি দৃষ্টিপাত ফেলে দ্রুত পায়ে এগোচ্ছে মেহতিশা। রাতে শহরে ঘুরে বেড়াতে মন্দ লাগে না আর তা যদি হয় শীতের রাত। তবে সে মেয়ে! একাকী মেয়ে। এ শহরে লুকিয়ে রয়েছে অজস্র হা য়ে না। নিকষ আঁধারের মাঝে গা ডুবিয়ে রেখেছে তারা। সুযোগ পেলেই ছুটে আসে। এই মানুষরূপী হা য়ে না গুলোকে ঘৃ ণা করে সে! বড্ড বেশি। তাই তো রজনীতে তার শহরে বের হতে এতো দ্বিধা, সঙ্কোচ।
গন্তব্যের শেষ সীমানায় প্রায়। তৎক্ষনাৎ ঘটলো এক অঘটন! তার সম্মুখে আকস্মিক উপস্থিত হলো তার অতি অপছন্দের ব্যাক্তিটা, অনিক।

অনিক বি শ্রীভাবে হাসছে। তার হাসির শব্দে যেন চারপাশও কেমন গুমোট রূপ ধারণ করেছে। রাত বেশি নয়! কেবল আটটা বাজল। তবুও আশপাশের অমোঘ নীরবতা সাথে অনিকের উদ্ভট হাসি দেখে মেহতিশার কেমন যেন গা কা টাঁ দিলো। অনিক লম্বা পা ফেলে এগোল।দাঁড়াল মেহতিশার সন্নিকটে। ফের গা জ্বালানো হাসিটা হেঁসে বলল,

-‘ কি গো জান? আমারে ফালাইয়া কই যাও তুমি? ‘

মেহতিশা অনিককে ফেলে এগিয়ে যাওয়ার বৃথা চেষ্টা করলো। কিন্তু সেই চেষ্টা বিফলে গেল। অনিক তার পথরোধ করে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘ এতো সহজে যেতে দিব? তুমি আমার চল্লিশ লাখ টাকার মাল। পালায় এসে ভাবছ পাড় পাবা? এতো সহজ অনিক খন্দকারের হাত থেকে ছোটা? হু জান? ‘

মেহতিশা অনিকের গালে চ ড় মা র ল। একটা না দুইটা না পরপর পাঁচটা চ ড় পড়ল অনিকের গালে। অনিক ক্রোধান্বিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে। মেহতিশার হাত সে মুচড়ে দেয়ার উদ্দেশ্যে ধরতেই মেহতিশা উল্টো তার হাত চট করে ধরে মুচড়ে দেয়। তিক্ত কন্ঠে বলে উঠে,

-‘ আমার হাত ধরা এতোই সোজা? ‘

হাতের ব্যা থা য় আ র্ত না দ করে উঠল অনিক। যতটা সহজ ভেবেছে মেহতিশাকে উঠিয়ে নিয়ে যাবে তা হবে বলে মনে হচ্ছে না। অনিক পকেট থেকে ধা রা লো অস্ত্রটা বের করলো। কর্কশ গলায় বলল,

-‘ চুপচাপ আমার সাথে যাবি নাহলে এখনি পেটের ভিতর ঢুকিয়ে দিব। ‘

-‘ মানুষের হাতের মা র না খেতে চাইলে তুই এক্ষুনি আমার চোখের সামনে থেকে দূর হবি শয়তান। নাহলে আমি এক্ষুনি চেঁচিয়ে মানুষ ডাকব। ‘

-‘ তাই? ‘ অনিক তাচ্ছিল্যে ভরা কন্ঠে বলল!

অনিককে এগোতে দেখে মেহতিশা এবার তার দুই পায়ের মাঝ বরাবর লাথি মে রে বসল সজোরে। দু হাঁটু ভে ঙে অনিক বসতেই মেহতিশা সড়কে পড়ে থাকা ইট তুলে এনে তার মাথা বরাবর মা র ল। ফের নিয়ে এলো লাঠি। অনবরত আঘাত চলল! মাথা এবং স্প র্শ কাতর অঙ্গে ব্যা থা পেয়ে অনিক টু শব্দ অব্দি করতে পারলো না। চেয়ে চেয়ে দেখলো শুধু মেহতিশার রণমুর্তি রূপ। মেয়েটা এতো কঠিন? এতো সাহস বুকে? অনিক ভীরু মনে মেহতিশাকে থামতে বলল। মেয়েটা থামল না। আচানক পেছন থেকে সারতাজ কোথা থেকে যেন দৌড়ে এলো। সে বাড়ি ফিরছিল। রাস্তায় এ দৃশ্য দেখে হতভম্ব! ছুটে গিয়ে মেহতিশাকে থামিয়ে প্রশ্ন করলো,

-‘ স্টপ মেহতিশা! কি করছেন এসব? ওনাকে এভাবে আঘাত করছেন কেন? ‘

মেহতিশা ঘন ঘন শ্বাস টানছে। হাত জোড়া কাঁপছে প্রবল। নেত্রপল্লব কম্পমান। ঘোলাটে চাহনি সম্মুখে ছুঁড়ে দিয়ে শুধালো,

-‘ আমাকে থামালেন কেন? কেন থামালেন? ওকে আজ আমি মে রে ফেলব! স্বামী নামে কলঙ্ক ও। মিথ্যা কথা বলে বিয়ে করেছে। বিয়ে করেছে কেবল নারী ব্য ব সা য়ীদের কাছে বিক্রি করার জন্য। ‘

অনিক ছুটে পালিয়েছে। সারতাজ উঠে দাঁড়িয়ে বলল,

-‘ রিলাক্স মেহতিশা।এভাবে মে রে কি লাভ? ওনাকে শা স্তি দিতে হবে। আমাকে খুলে বলুন ব্যাপারটা। হয়তো আপনাকে সাহায্য করতে পারবো। ‘

ঘোর থেকে বেড়িয়ে এসে মেহতিশা বিহ্বল দৃষ্টিতে তাকাল। এ কি করলো সে? বিষয়টা নিতান্তই গোপন রাখতে চাইছিল। সারতাজ, সালমা কিংবা অন্য সকল মানুষদের থেকে। কিন্তু আজ কিনা মুখ ফসকে সত্যিটা বলেই দিল?

চলবে~

| রিচের অবস্থা করুণ। সকলের রেসপন্স আশা করছি।|

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here