#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৮|
সাদিয়া মেহরুজ
ঝড় হচ্ছে। গ্রীষ্মের তান্ডব তোলা ঝড়। ধূলি ঝড়ে চারিপাশ ধূলোয় আচ্ছাদিত। বজ্রপাতের গর্জন শোনা গেলেও বৃষ্টির দেখা নেই। কালশিটে অন্তরীক্ষ মেঘাচ্ছন্ন। মেঘেদের আড়ালে ঘাপটি মে রে বসে রূপবতী চন্দ্রা। অদূরে এক পশলা স্নিগ্ধ, কোমল বৃষ্টি হাত নাড়িয়ে জানান দিচ্ছে তাদের আগমনী বার্তা। ব্যাস্ত সড়ক ধরে মানুষেরা ছোটাছুটি আরম্ভ করেছে ইতিমধ্যে। এতসব ব্যাস্ত মানুষের মাঝে কেবল স্থির চিত্তে ব্রিজের রেলিং এর ওপর বসে রয়েছে দু’জন মানুষ। সারতাজ আর তার ঠিক পাশে তার আদরের ছোট ভাই শারাফ!
-” পায়ের এই হাল কেন শারাফ? ” কন্ঠনালী কম্পমান সারতাজের।
শারাফ চুপটি করে তাকিয়ে ছিল ঢেউ তোলা পানির দিকে। সারতাজের প্রশ্ন শুনে সে তার পায়ের দিকে তাকাল। তার বাম পা টা নেই! হাঁটু থেকে কে টে ফেলা হয়েছে। জমে যাওয়া কন্ঠে সে আওড়াল,
-” কে টে ফেলেছে ভাই। ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল তাই। ”
সারতাজ শারাফের মুখোমুখি হয়ে বসল। তার চোখ দু’টো কেমন লাল হয়ে আছে! অক্ষি কোটরে জলের উপস্থিতি হয়েছে সেই কখন। কেবল তার অনুমতি না পেয়ে গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে না। ঠোঁট কাঁপল সারতাজের।আশ্চর্য তো! তার দেহের এহেন কাঁপুনি কেন বন্ধ হচ্ছে না? সে কেন স্বাভাবিক হতে পারছে না? বক্ষ মাঝারে এমন উথাল-পাতাল ঝড় বওয়া কেন থামছেনা?
-” তুই কাইন্ডলি আমাকে সব খুলে বলবি শারাফ? এমন থম মে রে বসে আছিস কেন? আর তুই একা এসেছিস দেশে? শাহিন কোথায়? ও ভালো আছে তো? ”
শারাফ ম রা গলায় শুধাল, ” ও ভালো আছে ভাই। ও আসেনি আমার সাথে। আমার মতো বেইমানের সাথে অবশ্য আসার কথাও না। শাহিনের সাথে আমার যোগাযোগ বন্ধ অনেকদিন। যেদিন থেকে আমার সম্পত্তির ওপর লোভ জাগল, তোমার ভালোবাসা ভুলে আমি সম্পত্তির লোভে অন্ধ হয়ে গেলাম সেদিন থেকেই শাহিন আমার সাথে কথা বলেনা, দেখতে আসেনা। আমার যে এতো বড় একটা এক্সিডেন্ট হয়ে গেলো। কোনোরকম জান হাতে বেঁচে গেলাম কিন্তু ইনফেকশন হওয়ার জন্য আমার বাম পা টা একদম শেষ হয়ে গেলো ভাই! আমি পঙ্গু হয়ে গেলাম আজীবনের জন্য। ইথিশা আমাকে ডিভোর্স দিয়ে চলে গেছে ভাই। শাহিনকে ফোন করে এতোবার একটুখানি আসতে বললাম ও এলো না ভাই। লোভে পাপ, পাপে মৃ ত্যু! লোভের জন্য আমার লাইফটা বরবাদ হয়ে গেল ভাই। আমি তোমার ওপর যেই অবিচার, নি ষ্ঠু র তা করেছি প্রকৃতি তা আমায় শুধে আসলে ফিরিয়ে দিলো। আমায় মাফ করো ভাই! আমায় মাফ করে দাও নাহলে আমি বাঁচব না। ”
সড়কে অবাধে ছুটে চলা মানুষের মাঝে কিছু মানুষ থামল আচানক কান্নার শব্দ শুনে। তারা ফ্যালফ্যাল করে তাকাল ব্রিজের দিকে। দেখল একটা বাম পা হীন ছেলে হাউমাউ করে কাঁদছে আরেকটার ছেলে কাঁধে ঝাপটে ধরে। ঝড় হলেও বাঙালির কৌতূহল দমল না। তারা এগিয়ে এলো। গুনগুনিয়ে কিছু বলল নিজেদের মধ্যে। কেও কিছু প্রশ্ন করতে নিবে অমনি সারতাজকে দেখে তারা সবাই ভীষণ চমকে গেল! শুরু হলো হুড়োহুড়ি। সবাই এক প্রকার ধৈর্য ফেলে চেঁচিয়ে উঠল,
-” আরে সারতাজ শাহরিয়ার! স্যার একটা সেলফি নিব আপনার সাথে স্যার একটু নেমে আসবেন আপনি? ”
সারতাজের নাম শুনে ভীড় ঠেলে ছুটে এলো এল দল উৎসুক তরুণী। সারতাজকে দেখে তারা হা করে বিষ্ময় প্রকাশ করলো। তাদের মধ্য হতে একজন দৌড়ে এসে সারতাজের গা ঘেঁষে দাঁড়াল।
-” স্যার। আপনার অনেক বড় ফ্যান আমি। একটা অটোগ্রাফ দিবেন প্লিজ? ”
উত্তেজনা, বিষ্ময়ের প্রকোপে এগিয়ে আসা একদল মানুষ বেমালুম ভুলে বসল তারা আসলে কেন এগিয়ে এসেছিল। তাদের পাশেই যে একটা ছেলে অসহায় আ র্ত না দ করে কাঁদছে ওদিকে তাদের ধ্যান – জ্ঞান বিন্দু পরিমাণ নেই। চলমান পরিস্থিতি দেখে প্রথমবার জনসম্মুখে চটে গেল সারতাজ। খেঁকিয়ে উঠে বলল,
-” এখানে যে একজন কাঁদছে তা কি আপনাদের চোখে পড়েনি? এই ব্যাক্তিটার কি হয়েছে? কেন কাঁদছে তা না জিজ্ঞেস করে আপনারা পড়ে আছেন অটোগ্রাফ, সেলফি নিয়ে? আমাদের মনুষ্যত্ব বোধ কি তবে আজ এতোটাই নিচে নেমে গেল! ”
মৌমাছির ঝাঁকের মতো গুনগুন চলছিল এতক্ষণ জনসম্মুখে। সকলে লহমায় সারতাজের কথা শুনে চুপসে গেল। কয়েকজন লজ্জায় জায়গাটা ছেড়ে গেল চুপিসারে। সারতাজের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়ে দু’টো চট করে দূরে সরল। ইতস্তত ভাব মুখোশ্রীতে ফুটিয়ে তারা চট করে কে টে পড়ল!
সারতাজ আশপাশে আর ধ্যান দিল না। সে শারাফ কে আলগোছে রেলিঙ থেকে নামতে সাহায্য করল। আশেপাশে তাকিয়ে একটা খালি রিকশা ডাক দিল। রিকশায় চড়ে দু’জনে ক্ষণিকের মাঝে স্থানটা ছেড়ে পাড়ি দিলো বহুদূরে। শারাফ পুরো ঘটনায় প্রতিক্রিয়াহীন ছিল, এখনো আছে। কান্না তার থেমে গেছে বেশ আগে। সে এখন কেবল পাথরের ন্যায় বসে রয়েছে। সারতাজ ভাইয়ের দিকে তাকাল। শারাফের মুখাবয়ব দেখে বুক চিঁড়ে বেড়িয়ে এলো তার তপ্তশ্বাস। ও তো শারাফের ওপর একটুও রাগ করেনি, শারাফের ব্যাবহারে কষ্ট পেলেও তা তো প্রকাশ করেনি। আল্লাহ তায়ালার নিকটও তো কোনো অভিযোগ করেনি। তবুও তার ভাইকে এতো টা কষ্ট পেতে হলো কেন?
_
-” পা নামিয়ে বসো ছেলে! ” প্রান্তিকার বাবা পলাশ হাসান ধমকে উঠলেন। নেত্রে তার তেজী ভাব।
হেলদোল দেখা গেল না শাকিবের মাঝে। সে পূর্বের মতোই পায়ের ওপর পা তুলে ফোনে কথা বলায় ব্যাস্ত। পলাশের উঁচু গলা শুনে ও ঠোঁটে আঙুল দিয়ে তাকে চুপ করতে বলল। রাগে দাঁত কিড়মিড় করে তাকালেন পলাশ। শাকিব ফোন কা ট ল। বলল,
-” এতো চেঁচান কেন আঙ্কেল? এ বয়সে এতো জোর গলায় কথা বলা উচিত না। ” পা নামাল শাকিব।
-” নূন্যতম ম্যানার্স শেখায়নি তোমার বাবা – মা? বড়দের সামনে কিভাবে চলাফেরা করতে হয় তা জানো না? ”
-” জানি। গুরুজনদের সম্মান করতে শিখিয়েছে আমার বাবা মা কিন্তু মীর জাফরদের সম্মান করতে শেখায়নি। তাদের শাস্তি দিতে শিখিয়েছে। ” শীতল গলায় জবাব শাকিবের।
পলাশ অতি উত্তেজনায় উঠে দাঁড়ালেন। পুনরায় ধমকে উঠলেন,
-” তোমার সাহস তো কম না। তুমি আমাকে মীর জাফর বলছো? কতবড় বেয়াদব ছেলে! বের হও আমার বাসা থেকে। বের হও বলছি। ”
শাকিব উঠে দাঁড়াল। পলাশের হাত চেপে ধরে তাকে সোফায় বসাল। শীতল গলায় শুধাল,
-” আহা আঙ্কেল! বললাম না? এ বয়সে এভাবে রেগে চেঁচান ভালো না। আপনার স্বাস্থ্যের জন্য এটা ঠিক না। দেখা যাবে হার্ট অ্যাটাক করে নেটওয়ার্ক এর বাইরে চলে যাবেন। আমার আর প্রান্তিকার বাচ্চাকে না দেখিয়ে আমি আপনাকে কিভাবে ম রে যেতে দেই বলুন তো? ”
পলাশ হা করে রইলেন। হয়ত ভাবছেন কতোবড় বেয়াদব ছেলে শাকিব! মুখের ওপর কি উদ্ভট কথা বলে দিচ্ছে অনায়াসে। পলাশের প্রতিক্রিয়া দেখে শাকিব মনে মনে একচোট হাসল। সে দূরে সরে বসল কিছুটা। পকেট থেকে বের করল তার আর প্রান্তিকার বিয়ের রেজিস্ট্রি পেপার। সাদা কাগজে চোখ বুলিয়ে নিতে নিতে ও ভাবল, পলাশ হয়ত এই কাগজটা দেখে এবার সত্যি সত্যিই হার্ট অ্যাটাক করে বসবেন!
চলবে~
| ছোট পর্বের জন্য দুঃখিত। ২৪ ঘন্টার মধ্যে ১কে কমেন্ট প্লিজ। তাহলে টানা দু’দিন আমি গল্প দিব।#শহরজুড়ে_বিষন্নতা |১৯|
সাদিয়া মেহরুজ
প্রান্তিকা ফ্যাচফ্যাচ শব্দ তুলে কাঁদছে। পাশে বসা শাকিব নিরুত্তাপ, উদাসীন। সে গাড়ি চালাচ্ছে এক মনে। প্রান্তিকার পানে ধ্যান জ্ঞান দেয়ার সময় তার নেই। একই গলি এই নিয়ে বিশবার চক্কর দিল সে। বিষয়টা খেয়াল করেনি প্রান্তিকা। কান্নার হিড়িক কমে আসতেই ও খেয়াল করল ব্যাপারটা। তখনি কর্কশ গলায় চেঁচাল,
-” কি সমস্যা তোমার? একই জায়গায় বারবার ফিরে আসছ কেন? আজ রাত কি রাস্তাতেই থাকতে চাও নাকি? ”
শাকিব উদাস গলায় জবাব দিল,
-” তো কি করব? তুমিই তো বললে আমার বাসায় যেতে চাও না। তাহলে আর কোথায় বা যাব রাস্তা ছাড়া! ”
প্রান্তিকা তেতেঁ উঠল, ” আমি কখনোই তোমার বাড়ি যাব না শাকিব। তুমি আমাকে ধোঁকা দিয়েছ। কথা দিয়ে কথা রাখোনি। আই হেইট ইউ! ”
রাত বাড়ছে। সড়কে মানুষের চলাচল কমে এসেছে। বিরান স্থানে গাড়ি চাপাল শাকিব। সিটবেল্ট খুলে ঝুঁকল প্রান্তিকার প্রতি। তার দৃষ্টি অন্যরকম। সেই দৃষ্টির অর্থ পড়ে শিউরে উঠল প্রান্তিকা। দূরে সরতে চাইল। তবে তা হতে দিল না শাকিব। প্রান্তিকাকে সন্নিকটে এনে ফিসফিস করে বলল,
-” আমার বয়স কতো হয়েছে জানো প্রান্তিকা? ৩৪। বুড়ো হয়ে যাচ্ছি আমি। আমার কোনো চাহিদা নেই নাকি? শারীরিক, মানষিক দু’টোর চাহিদাই আছে। তোমার জন্য অপেক্ষা করতে করতে আমি এখন ক্লান্তপ্রায়। আর সম্ভব হচ্ছিল না। তাছাড়া বিয়ের কথাটা তো একদিন না একদিন তোমার বাবাকে জানাতেই হতো। তবে আজ কেন নয়? আই নিড ইউ প্রান্তিকা! আই নিড ইউ। ”
এসি থাকা সত্বেও পুরোদমে ঘামছে প্রান্তিকা। দুই হাত দিয়ে বল প্রয়োগ করে ও শাকিবকে একটু দূরে সরাতে চেষ্টা করল। চেষ্টা বিফলে গেল তার! বলিষ্ঠ দেহের শাকিব তার হালকা ধাক্কায় বিন্দুমাত্র নড়ল না। ঠায়ঁ তার ওপর ঝুঁকে রইল। তপ্তশ্বাস ফেলে ফুঁ দিল চোখে। চোখ মুদে নিল প্রান্তিকা। টের পেলো তার অধর জোড়ায় একজোড়া তপ্ত ঠোঁট আধিপত্য বিস্তারে মরিয়া হয়ে উঠেছে। প্রান্তিকা কিয়ৎক্ষণের জন্য পিছের কথা বেমালুম ভুলে বসল। ভুলে গেল তার বাবার তিরস্কারের কথা, তাকে বাসা থেকে বের করে দেয়ার কথা। আরো ভুলে গেল বাবা তাকে ও বাড়িতে ফিরতে আজীবনের জন্য নিষেধ করে দিয়েছেন!
_
আদালত চত্বরে মনমরা হয়ে বসে মেহতিশা। তার মুখোশ্রী জুড়ে বিষন্নতার প্রলেপ। শূন্যে দৃষ্টি ফেলে ভাবছিল কিছু। তখন হুট করে কোথা থেকে যেন উদয় হলো সারতাজ। মেহতিশার মুখাবয়ব দেখে কেবল দীর্ঘশ্বাস ফেলল। নিঃশব্দে পাশে বসল ও। বলে উঠলো,
-” অযথা মন খারাপ করছেন মেহতিশা। আপনি কি বাংলাদেশ কে চেনেন না? এ দেশের আইনকানুন সব ভুলে বসে আছেন নাকি? কোন বিচারটা এই দেশে সঠিক ভাবে হয়েছে? কিংবা জলদি হয়েছে? প্রত্যেকটা জটিল থেকে নরমাল কেস এদেশে সলভ হতে লেগে যায় বিশ, ত্রিশ বছর। হতাশ হচ্ছেন কেন আপনি? এটলিষ্ট এটা ভেবে নিজেকে শান্ত করুন অনিক এখন জেলে। ও আর অপকর্ম করতে পারছে না। লাক্সারি লাইফ লিড করতে পারছেনা। জেলে থাকাটা অবশ্যই আনন্দের কিংবা শান্তির নয় তাই না? ”
শুনানির তারিখ পিছিয়েছে পুনরায়। এবার তারিখ পড়েছে প্রায় তিনমাস পর। অনিক যেন দিনকে দিন হাত ফসকে বেড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ খুঁজছে। এই ভাবে তারিখ পেছাতে থাকলে অনিক নিশ্চয়ই তার আইনজীবীর মাধ্যমে জামিনে বেড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টাটুকু করবে এবং সফলও হতে পারে। মেহতিশা তপ্ত শ্বাস ফেলল। আকাশে পূর্ণ দৃষ্টি ফেলে কেবল চুপ করে তাকিয়ে রইল। সে সারতাজের কথা শুনে নিজেকে শান্ত করতে পারছে না। আর তা সম্ভব কি?
-” হ্যালো, মেতিশা..? ”
মেহতিশা চটপট সারতাজের পানে তাকাল। কপালে ভাজঁ ফেলল। ও খানিকটা রাগত গলায় শুধাল,
-” আপনি কেন সবসময় আমার নাম ব্যাঙ্গ করেন? ”
সারতাজ অবাক হওয়ার ভান করে জিজ্ঞেস করল,
-” মাই গড! কিসব বলছেন? আপনার নাম আমি ব্যাঙ্গ করতে যাবো কেন? আশ্চর্য! ”
-” মিথ্যে বলবেন না সারতাজ। আমার নাম মেহতিশা আপনি বরাবর আমাকে রাগিয়ে দিতে ” মেতিশা ” বলেন। ”
-” এ আর এমন কি? জাস্ট একটা “হ ” ই তো উচ্চারণ করিনি। আপনার এতো বড় নাম। একটা অক্ষর উচ্চারণ না করলে আপনার নাম নিশ্চয়ই শহিদ হয়ে যাবে না। ”
কথা বাড়াল না মেহতিশা। উঠে দাঁড়িয়ে হাঁটা ধরল। ঢাকা ফিরতে হবে। কর্মস্থলে বেশ ফাঁকি দিচ্ছে সে। এভাবে চললে তার চাকরিটাই না হাওয়া হয়ে যায়। যতই পরিচিত হোক গার্মেন্টস এর মালিক। তার কর্মক্ষেত্রে টিকে থাকার জন্য ও নিশ্চয়ই তৃতীয় পক্ষের কোনো হস্তক্ষেপ বরদাস্ত করবে না!
-” আরে আমার জন্য দাঁড়ান। একসাথে ফিরি? ”
সারতাজ পেছন হতে চেঁচাল। তাতে পদচারণ থামাল না মেহতিশা। হাঁটতে রইল। সারতাজ বুঝল মেয়েটা নিশ্চয়ই রাগ করেছে। করুক! এই রাগের প্রকোপে অনন্ত পূর্বের ঘটনাটা কিছুক্ষণের জন্য ভুলে থাকুক।
ফুটপাতে অসংখ্য মানুষের ভিড়। কেও সুস্থ দেহে বসে সাহায্য চাইছে তো অসুস্থ দেহ নিয়ে সাহায্য চাইতে এসেছে। বাংলাদেশে বর্তমানে এমন দৃশ্য অহরহ। দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পর থেকে অনেকের চাকরি চলে গেছে। অনেকে হয়েছে পথের ফকির। দরিদ্র মানুষেরা কাজ করতে না পেরে রাস্তায় থালা নিয়ে বসেছে সাহায্য চাইতে। অবশ্য এতেও তেমন লাভ হচ্ছেনা।কারণ দেশের সকলের অবস্থাই করুণ, সকলেই অসহায় এ লহমায়! খাবারের সঙ্কট বেড়েই চলেছে দিনকে দিন। রিজার্ভের অবস্থা ভালো না।
রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে মেহতিশা চারপাশ দেখল। বুক ভার হলো তার। সে কতো তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মন খারাপ করেছিল ভাবতেই লজ্জা পেল। তার দুঃখ তো কিছুই না এই মানুষ গুলোর তুলনায়। তার হাত শূন্য! বেতন যা পায় তা দিয়ে টেনেটুনে সংসার চলে। নয়ত সাহায্যের করার নূন্যতম চেষ্টা ও করত। বেতন এর পরিমাণ আগের থেকে কমে এসেছে অনেকটা তার।
পদচারণ থামাল সারতাজ। মেহতিশাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো,
-” মেহতিশা আমার জন্যও একটা টিকেট কেটে নিজের কাছে রাখবেন। আমি আসছি। ”
-” আপনার টিকেট আমি কা ট ব কেন? আপনি কোথায় যাচ্ছেন? ” প্রশ্ন ছুড়ল মেহতিশা।
-” আমি আসছি। ”
মেহতিশার হাতে টিকিটের টাকা গুঁজে ওকে ঠেলে ঠুলে পাঠিয়ে দেয় সারতাজ। সড়কে ক্রন্দনরত এক পাঁচ বছরের শিশুর নিকট এগোয় ও।
-” বাবু কাঁদো কেন? কি হয়েছে? ”
বাচ্চাটা দু’হাত দিয়ে তার চোখ মুছল। নাক টেনে অভিযোগ করল,
-” মায় খাইতে দেয়না দুইদিন ধইরা। আমার অনেক ক্ষুদা লাগছে। ”
-” কি খাবে তুমি? আমাকে বলো আমি দিই। ”
-” ভাত খামু। ”
সারতাজ বাচ্চাটাকে কোল থেকে নামাল। পকেট থেকে টাকা বের করে দিল শিশুটির মায়ের কাছে। ইশারায় বলল কিছু যা বুঝল না মেহতিশা। কৃতজ্ঞতায় চোখ জ্বলজ্বল করে উঠল বাচ্চার মায়ের। তিনি হু হু করে কেঁদে উঠে বাচ্চাটাকে নিজের কাছে টেনে উঠে গেলেন সেখান থেকে। সারতাজ ফিরে এলো। ফেরার পূর্বে সেখানে বসে থাকা সকলের হাতে কিছু টাকা দিয়ে এলো। উপস্থিত সকলের মুখোশ্রীতে আনন্দের দ্যুতি ফুটে উঠল। ফিরে চলল সারতাজ। মেহতিশার নিকট পৌঁছাতেই মেহতিশা তার টিকেট হাতে ধরিয়ে দিল। তারা দু’জন বাসে উঠতে নেবে তৎক্ষনাৎ ফোন এলো সারতাজের। শাকিবের কল।
-” ভাই বলো। ”
অপাশ হতে ব্যাকুল কন্ঠে শাকিব শুধাল,
-” ভাই তুই কি ঢাকায় এসে পড়েছিস? ”
-” না ভাইয়া। মাত্র বাসে উঠলাম। ”
-” বাস থেকে নাম জলদি সারতাজ। মা ভায়োলেন্ট হয়ে বাসা থেকে বেড়িয়ে গেছে। নার্স ফোন দিয়ে জানাল মাত্র। আমি আসছি তবে আমার আসতে একটু লেট হতে পারে। চট্টগ্রাম আসা তো আর মুখের কথা না। তুই মা’কে একটু খোঁজ সারতাজ। জলদি কর! ”
সারতাজ ব্যাতিব্যাস্ত হয়ে উঠল, ” চিন্তা করো না দেখছি। ”
-” কি হয়েছে? ” মেহতিশার চিন্তিত কন্ঠস্বর।
সারতাজ বাসা থেকে নেমে যেতে যেতে জবাব দিল,
-” আমি এখন ঢাকা যেতে পারব না মেহতিশা। আপনি চলে যান। সাবধানে যাবেন। গিয়ে আমাকে একটা কল করবেন। ”
বাস ছেড়ে দিয়েছে ইতিমধ্যে। মেহতিশা জানালা দিয়ে মাথা গলিয়ে দিল বাহিরে। আবছা আলোয় দেখল সারতাজ ঝড়ের গতিতে ছুটে যাচ্ছে। চিন্তা হলো মেয়েটার! হলোটা কি আসলে? সারতাজটা কিছু তো বলেও গেল না।
_
নিলির সাথে ব্যাস্ত মেহজা। মেয়েটার পরিক্ষা শেষ হতেই সারাক্ষণ নিলিকে নিয়ে পড়ে থাকে। মেহজার সাথে নিলির বেশ ভাবও জমেছে। মেহতিশার বিড়াল তেমন পছন্দ ছিল না। ছোট বেলায় তার বাম হাতে বিড়াল বিশাল এক থা বা মে রে ছিল। তারপর হতে বিড়াল তার কাছে এক আতঙ্কের নাম। তবে নিলির আগমনের ওপর তার আতঙ্ক কে টে গেছে পুরোপুরি।
-” আপু তোমার কল এসেছে। ” ফোন এগিয়ে দিল মেহজা।
মেহতিশা ফোন হাতে নিল। রিসিভ করার পর অপাশ হতে কিছু বলা মাত্রই তার শ্যাম মুখোশ্রী জুড়ে নেমে এলো অমাবস্যা। আতঙ্কে, আ র্ত না দে অধরের হাসি বিলীন হলো। চট করে উঠে দাঁড়াল ও। মেহতিশার উষ্ণ কোল দখল করে শুয়েছিলো নিলি। মেহতিশা চট করে দাঁড়াতেই নিলি পাশে পড়ে গেল। মেহজা দুঃখী গলায় বলল,
-” এভাবে দাঁড়ালে কেন আপা? নিলি তো ব্যা থা পেল। ”
কোনো কথাই শ্রবণ করল না মেহতিশা। কানে ফোন চেপে ধরে পাশের ঘরে এলো কাঁপা পায়ে। কল কেটে দিয়ে ফোন ছুড়ল বিছানায়। টলমলে পায়ে ভূমিতে আঁটসাঁট হয়ে বসে মুখ চেপে কেঁদে উঠল। তার চেহারা জুড়ে শোভা পাচ্ছে অসহায়ত্ব, ভী তি!
চলবে~