শাহজাহান তন্ময় – ৮
শাহজাহান বাড়ির ভেতরটা নিত্যদিনের মতোই উজ্জ্বল ছিল। হঠাৎ সেই উজ্জ্বলতায় ছায়া প্রবেশ করল যেন! তন্ময় বাড়ি ফিরেছে মাত্র। তার ঢুকতে দেরি, ডাক পড়তে দেরি হয়নি। মোস্তফা সাহেব অত্যন্ত গম্ভীর এবং দাপুটে গলায় তন্ময়কে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে গিয়েছেন। তন্ময় সেই যে গিয়েছে এখনো ফিরেনি। দুজন পুরুষ মানুষ আধঘন্টা ধরে কী ধরণের আলাপ-আলোচনা করছে, তার বোধগম্য হচ্ছে না আনোয়ার সাহেবের। তিনি থমথমে পরিবেশে ব্যস্ত পায়ে পায়চারি করছেন লিভিংরুমে। ক্ষনে ক্ষনে নজর ফেলছেন দেয়াল ঘড়িতে। এখন ১১ : ৩৫। চিন্তায় ভ্রু-দুয়ের মাঝে ভাঁজ পড়েছে সূক্ষ্ম। আহ! এই বয়সে এতো স্ট্রেস তো নেওয়া যাচ্ছে না। বিড়বিড় করে কপাল ধরে সোফায় বসলেন। তার বড়ো ভাই, এতটাই গাম্ভীর্যের সহিত তন্ময়কে ডেকে নিয়ে গিয়েছে যে, আনোয়ার সাহেবেরই বুকের ভেতরটা তিরতির করে কাঁপছে। কপালে ছোটো ছোটো ঘাম জমেছে। বড়ো ভাইকে বড্ড ভয় পান কি-না! সম্মান ও তো কম করেন্ না। ভালোবাসাও অগাধ। সুমিতা বেগম চায়ের কাপটা এগিয়ে ধরলেন,
‘চা’টা নাও।’
‘গরম মাথায় গরম চা খেলে, মেজাজটাও গরম হবে। রেখে দাও। পড়ে খাব।’
সুমিতা বেগম ভ্যাবাচেকা খেলেন যেন,
‘গরম চায়ের সাথে গরম মেজাজের সম্পর্ক কীভাবে হয়?’
‘তুমি বুঝবে না সুমিতা। ম্যাথম্যাটিকসে তুমি দুর্বল।’
মুহুর্তে থমথমে হয়ে ওঠে সুমিতা বেগমের মুখমণ্ডল। বিড়বিড় করে বললেন, গরম চা আর গরম মেজাজের মধ্যে ম্যাথম্যাটিকস কীভাবে গুরুত্বপূর্ণ? অদ্ভুত!
ওহী সাহেব ছেলেকে রামধমক মেরে ওপরে তুলেছেন। ওপরে বলতে দোতলায়, নিজের রুমে পাঠিয়েছেন। ছেলের প্যানপ্যানানি-তে বদহজম হচ্ছিল একপ্রকার। এতো কুকর্মের কথাবার্তা বলতে পারে ছেলেটা! হাতের ঘড়িতে দৃষ্টি ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে হাসফাস করে ওঠেন। বড়ো ভাবীর দিকে তাকিয়ে বলেন,
‘থার্টি মিনিটস! এতক্ষণ ধরে নিশ্চয়ই মধু নিয়ে আলোচনা হচ্ছে না। সিরিয়াস ম্যাটার! ভাবী, আপনি কী কিছু জানেন?’
জবেদা বেগম চোখের ইশারায় জানালেন, কিছুই জানেন না। ওহী সাহেব ছটফট ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়ায়। ওমন সময় পশ্চিম দিক হতে চেঁচামেচির শব্দ ভেসে আসে। নিশ্চুপ পরিবেশে এই দু-একটা চেঁচামেচির শব্দ, বজ্রপাতের ন্যায়। আনোয়ার সাহেব তড়িঘড়ি করে সেদিকে ছুটলেন। ছুটতে নিয়ে পড়তে নিলেন। ওমনি নিজেকে সামলে পুনরায় ছুটলেন।
______
মোস্তফা সাহেবের মুখশ্রী রাগান্বিত। থরথর করে কাঁপছে ঠোঁট। তন্ময় ও আজ শান্ত নেই। ক্রোধে নয়ন জোড়া লালচে হয়ে আছে। গলার রগ নিল হয়ে বেড়িয়ে। ডান হাত কে-টেছে৷ র’ক্ত চুইয়ে পড়ছে মেঝেতে। কাঁচের গ্লাসটিও ভেঙেচুরে পড়ে আছে সেখানটায়। শব্দ তুলে দরজা ঠেলে ঢুকেন জবেদা বেগম। ঢুকেই কিংকর্তব্যবিমুঢ় তিনি। আর্তনাদ করে ওঠেন। দ্রুততম গতিতে এসে দাঁড়ান ছেলের পাশে৷ কম্পিত হাতে তন্ময়ের রক্তাক্ত হাতটা জাপ্টে ধরেন। চোখ অশ্রুসিক্ত। গলার স্বর উঁচিয়ে বলেন,
‘এসব কি করেছিস! অ্যাই তন্ময়! র…র-ক্ত পড়ছে। আল্লাহ!’
তন্ময় তখনো মোস্তফা সাহেবের দিক দৃষ্টি রেখে আছে। কণ্ঠনালি চেপে দৃঢ় স্বরে বলে,
‘আ..আই ওয়ান্ট হার। আমার মধ্যে কি প্রব্লেম? হোয়াট’স রঙ উইদ মি, হু? আমাকে বিশ্বাস কেন করতে পারছ না? আই নো হার ব্যাটার দ্যান ইউ বাবা। তাহলে কেন আমি ওর জীবনসঙ্গী হতে পারব না? হোয়াই দ্যা হেল নট?’
মোস্তফা সাহেব বাকরুদ্ধ। ঘনঘন শ্বাস ফেলে তিনি আঙুল তুলে স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন,
‘তোমার ছেলেকে বলো, আমারে পরিবারের ওপর নজর ফেলতে না। ও চাচ্ছে এই পরিবার ভেঙে যাক। আমার ভাইয়েরা আলাদা হোক। এটা আমি কখনো হতে দিব না। কক্ষনো না।’
জবেদা বেগম আতঙ্কিত গলায় চেঁচায়,
‘হয়েছে কী? কি নিয়ে কথা বলছেন?’
মোস্তফা সাহেব তেড়ে আসে। গলা নামিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,
‘তোমার ভদ্র ছেলে অরুকে বিয়ে করতে চায়। ওই ছোটো মেয়েটাকে। যাকে শাবিহার সমান ভালোবেসে বড়ো করেছি। নিজের মেয়ের ন্যায়। ছোটো থেকে ভাই-বোনের সম্পর্ক ওদের। আর.. আর কমপক্ষে ও অরুর দশ বছরের বড়ো। এসব ভাবে কীভাবে ও? আমাদের এই সুন্দর পরিবারের কি হবে এগুলো জানাজানি হলে, হ্যাঁ?’
স্তব্ধ ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে থাকেন জবেদা বেগম। বেশ-কিছুক্ষন চুপসে রইলেন। মোস্তফা সাহেব সন্তুষ্ট অনুভব করেন। ভেবে নিলেন স্ত্রী-ও অমত করছে। কিন্তু তার ধারণা পাল্টে জবেদা বেগম বলে ওঠেন অত্যন্ত গম্ভীর গলায়,
‘পুত্রবধূদের নিজের মেয়ের মতোই বড়ো করে। পরের বাড়ির মেয়ের মতো নয়। চাচাতো ভাইবোনের কী বিয়ে হয় না? একসাথে বড়ো হয়েছে তো কি হয়েছে? ছেলেমেয়ে দুজন দুজনকে পছন্দ করে। এরথেকে গুরুত্বপূর্ণ কী? আমার ছেলের থেকে ভালো জীবনসঙ্গী অরুর জন্য এই পৃথিবীতে নেই। ঘরের মেয়ে ঘরেই থাকবে সারাজীবন! আমি কোনো আপত্তির কারণ দেখছি না। আমার ছে…’
‘জবেদা!’
ধমকে ওঠেন মোস্তফা সাহেব,
‘তুমি কী আদোও বুঝতে পারছ কি বলছ? আমার পরিবার! আমার এতবছরের স্বপ্নের পরিবার ভেঙে যাবে এই তুচ্ছতাচ্ছিল্য কারণে। ছেলেমানুষী চিন্তাভাবনা পাশে রাখো! শুধু নিজেদের কথা ভাবছ! এই বিষয়টা আদোও আনোয়ার কিংবা সুমিতার ভালো লাগবে নাকি ভেবে দেখেছ? কতটা লজ্জাজনক পরিস্থিতি সৃষ্টি হবে বাড়ির মধ্যে ভেবেছ? আরও বাচ্চারা আছে জবেদা!
হয়তো আনোয়ার আমার মুখের কথা ফেলতে না পেরে, এই বিষয়টা মেনে নিলো। তারপর.. তারপর কি হবে? যদি ভবিষ্যতে ওদের মধ্যে সমস্যা হয়? এই বয়সের ব্যবধানের কারণে যদি ওদের সম্পর্কের ভাঙন ধরে? তখন শুধু ওদের নয়, আমাদের পরিবারের মধ্যেও ধরবে। অনেক, অনেক সমস্যা আছে। ভেবেচিন্তে…. ‘
জবেদা বেগম অবাকের চূড়ান্তে যেন,
‘এই চেনো তুমি আমাদের ছেলেকে? তন্ময়… ‘
‘আমি এই বিষয়ে আমার বাড়িতে আর একটা শব্দ শুনতে চাই না। তোমার ছেলেকে বলো, আমার বাড়িতে থাকতে হলে আমার মতামত মেনে থাকতে হবে।’
তন্ময় শক্ত গলায় বলে,
‘থাকব না। আপনার মতামত মানব না আর বাড়িতেও থাকব না। এই বাড়িতে সেদিনই ফিরব যেদিন অরুকে আমার হাতে তুলে দেবেন।’
গটগট পায়ে বেরিয়ে যায় তন্ময়। দেখা হয়ে চাচ্চু-চাচিদের সঙ্গে। সবাই দাঁড়িয়ে। তন্ময় দ্রুতপায়ে ইতোমধ্যে ওপরে উঠে গিয়েছে। মোস্তফা সাহেব শব্দ করে সোফায় বসেন৷ পাশে বসেন জবেদা বেগম। গলার স্বর নামিয়ে তিনি বলতে নেন,
‘ছেলেটা অরুকে সত্যিই… ‘
কথাটুকু শেষ করতে পারেননি পূর্বেই খুব বাজে ভাষায় চেঁচিয়ে ওঠেন মোস্তফা সাহেব। রাগান্বিত তার মুখে যা এসছে বলে ফেলেন। ওদিকে স্বামীর কাছ থেকে কখনো এমন ব্যবহার না পাওয়া জবেদা বেগমের, পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল। মুখ চেপে ডুকরে কেঁদে ওঠেন,
‘কি হবে এই বাড়িতে না থাকলে? কিছু হবে না। থাকুন আপনি আপনার স্বপ্নের পরিবার নিয়ে। এই স্বপ্নের পরিবারের কেউ নই আমি, আমার ছেলে।’
অপমানিত মুখশ্রী নিয়ে ল্যাগেজ গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন৷ নিজের বাবার বাড়ির জিনিসপত্র ছাড়া কিছুই নিলেন না। খুবই হালকা ওজনের ল্যাগেজ হাতে বেরিয়ে গেলেন। মোস্তফা সাহেব এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন মেঝের র-ক্তের পানে। স্পষ্ট শুনছেন ভাই-ভাই বউদের আর্তনাদ। তন্ময় – জবেদা বেগমকে থামানোর আপ্রান চেষ্টা তাদের। চোখের কোণ ঘেঁষে গড়িয়ে পড়ল একফোঁটা জল। ওহী সাহেব দরজায় করাঘাত করছে সমানে,
‘ভাই.. ভাইয়া। ভাবী আর তন্ময় এসব কি করছে! ওরা বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে চাচ্ছে। আপনি কেন কিছু বলছেন না?’
পাথরের ন্যায় জবাব দিলেন মোস্তফা সাহেব,
‘যেতে দে।’
থমকে গেল শাহজাহান বাড়ি। সবকিছু স্তব্ধ, বিমুঢ়। হুটহাট হেঁচকি তুলে মেয়েলি কান্নার স্বর ছাড়া আর কিছুই শোনা গেল না।
চলবে –
চলুন মোনাজাত ধরে প্রার্থনা করি, নাবিলা ইষ্ক নামের থার্ডক্লাশ মহিলাটি যেন নিয়মিত গল্প দিতে পারে। সবাই বলি… আমিন!