#শুধু_তুই
—(সিজন২)
#পর্বঃ২৫
#Rifat_Amin
‘তোকে আমার লাগবে’ (প্রহর)
প্রহরভাইয়ের কন্ঠনালী হতে নিশ্রিত এই শব্দগুচ্ছে ঘোর লেগে গেলো আমার। মস্তিষ্কের নিউরনে নিউরনে অঘোষিত প্রেমের বার্তা ছড়ালো। চোখে মুখে স্বপ্নের লাল-নীল বাতি জ্বলে উঠলো। আমি সম্মোহন হয়ে সেই ভয়ংকর সুন্দর নেত্রপল্লবের উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ করলাম। আহা! কি ধারালো সেই দৃষ্টি! ওনার চোখ যেনো কত কথা বলছে। অথচ কখনো মুখে স্বীকার করেন না। করতেও চান না।
আমি ওনার থেকে ছাড়া পেতে যথেষ্টই চেষ্টা করলাম। কিন্তু কোনো ইতিবাচক ফল পেলাম না। অতঃপর উনি নিজে থেকেই আমার থেকে সড়ে দাঁড়ালেন। খুব দূরে নয়! আমি মাথা নিচু করে বললাম,
‘ আপনি চলে যান প্রহরভাই। কেউ দেখে ফেলবে। ‘ (আমি)
‘ বিয়ে হওয়ার পরও এসব কি ভাবিস তুই! হাহাহা’ (প্রহর)
কথাটা বলেই আরেকটু পিছিয়ে দোলনায় নিজের বলিষ্ঠ শরীর এলিয়ে দিলেন উনি। চোখে মুখে বৃষ্টি আছড়ে পড়লো। শরীরের সাদা শার্টটা ভিজে গিয়ে আর নিয়নবাতির মসৃণ আলোয় এই প্রথম উনার শরীরে অন্য কোনো কালারের শার্ট বলে অনুভব হলো। না! কালারটা পছন্দ হচ্ছে না। সাদা রং কেবল মাত্র উনাকে ঘিরেই সৃষ্টি।
বুকের বোতামগুলো খুলে দেয়া। উনি বরাবরই বৃষ্টি অপছন্দ করেন। ঠান্ডা লাগার ভয়। কন্ঠ খারাপ হয়ে যাওয়ার ভয়। ব্লা ব্লা। অথচ আজ কোনো ভয়ই উনাকে দমিয়ে রাখতে পারছে না। এই বৃষ্টিতে ভিজতে গিয়েই ছোটবেলায় উনার কাছে যে কত মা’ই’র খেয়েছি! আমি এগিয়ে গিয়ে উনার পাশে বসলাম। দোলানাটা একটু নাড়িয়ে দিয়ে উনার কপালে নিজের হাত রেখে দেখলাম শরীর খারাপ করছে কি না! আজ এতো অদ্ভুত আচরণ যে। বস্তুত উনি আজকাল কেমন জানি হয়ে যাচ্ছেন।
শরীর তো ভালো। আমার হাতের ছোঁয়ায় উনি চোখ খুললেন। অতঃপর শরীরের ভার আমার উপর ছেড়ে দিয়ে বললেন,
‘ আমাকে তোর কেমন লাগে? ‘ (প্রহর)
উনি কথাটা বলে আমার কোলে মাথা রাখলেন। আমি আজ অবাক হওয়ার সংখ্যা গুনছি। উনি এমন করছেন কেনো? কি চান উনি। আমাকে ভালোবাসেন? তা কি করে হয়! আমি উনার মাথায় হাত রেখে চুলগুলো ঠিক করে দিয়ে বললাম,
‘ আপনাকে আবার কেমন লাগবে! আপনি তো আমার পরম শত্রু। জঘন্য একটা মানুষ। ‘ (আমি)
‘ সত্যিই কি জঘন্য! ‘ (প্রহর)
আমি জবাব দিলাম না। বৃষ্টির ধারা কমে আসতেই উনি লম্বালম্বি হয়ে শুয়ে পরলেন দোলনায়। আমাদের দোলনাটা একটু বেশী বড়। প্রহরভাইয়ের মতো লম্বা-চওড়া মানুষও অকপটে যায়গা করে নিতে পারছেন। অতঃপর উনি যখন পাশ ফিরে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে শুলেন। তখন হার্টবিট দ্রুত হলো আমার। মাথা রিনরিন করে উঠলো। উনার তপ্ত নিঃশ্বাস আমার পেটের উপর আছড়ে পড়তেই উনাকে সড়িয়ে দিতে বললাম,
‘ উঠিন প্লিজ। আমার খারাপ লাগছে। ‘ (আমি)
‘ কিন্তু আমার ভীষণ ভালোলাগছে। তোর শরীর এত নরম! কোলবালিশ হিসেবে পার্ফেক্ট। ‘ (প্রহর)
‘ আশ্চর্য! আপনার ভালো লাগলেই হবে নাকি। আপনি প্লিজ উঠুন। ‘ (আমি)
উনি যেনো কথা শুনেও শুনলেন না। বরাবরের মতো উল্টা কাজ করে বসলেন। উনি আরো শক্তপোক্ত করে আমার কোমর জড়িয়ে ধরে মুখ লুকালেন। এদিকে আমার অবস্থা পুরাই খারাপ। উনার চুল টেনে ধরে বললাম,
‘ এই নির্লজ্জ মানুষ। উঠবেন প্লিজ। ‘ (আমি)
ইতোমধ্যে বৃষ্টি কমে গিয়ে হালকা হয়েছে। আকাশে এখন হালকা মেঘ ডাকছে। তবে সামান্য বিদ্যুৎের ঝলকানিও নেই। উনি এবার অতিষ্ট হয়ে আমাকে ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লেন। শার্টের বোতামগুলো খুলতে খুলতে বললেন,
‘ তুই বউ হিসেবে একদম পার্ফেক্ট না। কিন্তু আমার জন্য পার্ফেক্ট। ‘ (প্রহর)
আমার মাথার উপর দিয়ে গেলো কথাটা। মাঝে মাঝে যে কি বলেন। এদিকে উনি শার্ট অলরেডি খুলে ফেলেছেন। নিচে শুধু একটা সেন্টু গেন্জি। শার্টটা আমার মুখের উপর ছুঁড়ে বললেন,
‘ এটা ধুঁয়ে দিবি। ‘ (প্রহর)
শার্টটা মুখের উপর পড়তেই সুঘ্রাণে পুলকিত হলো আমার হৃদয়। এই ঘ্রাণ যে কত পরিচিত। সেটা যদি কেউ জানতো। উনি ইতোমধ্যে লম্বা পা ফেলে ছাদ থেকে চলে গেছেন। কিন্তু আমার পাপী মন শার্টটাকে নিজের শরীরে পড়ায় ব্যস্ত!
—-
অন্ধকার রুম। একদম ঘুটঘুটে অন্ধকার প্রায়। কিন্তু তার মাঝেই একটা ডিমলাইট জ্বলছে। পুরো রুমে শুধুমাত্র একটা চেয়ার আর একটা টেবিল রাখা। আর কিছু নেই। চেয়ারে বাঁধা অবস্থায় বসে আছেন কেউ। মুখটুকুও তাঁর শক্তপোক্ত কাপর দিয়ে বাঁধা। কথা বলার ওয়ে পাচ্ছেন না। এই ভয়ংকর রুমটাতে আদৌ কেউ আছে কি না তাও আন্দাজ করতে পারছেন না উনি। এর মাঝেই একটা নিয়ন বাতি জ্বলে উঠলো। পাওয়ার নিশ্চই দু’শোর কম হবে না। এই দু’শো ভোল্টের বাল্বটা সেই লোকটার মাথার মাত্র একহাত উপরে। কিন্তু সাথে সাথেই যেনো তাপে মাথা জ্বলে যাচ্ছে। রুমটাতে প্রবেশ করলো একটা লম্বা-চওড়া ছেলে। শরীরে কালো টিশার্ট। পরণে কালো জিন্স। সেই জিন্সের বেল্ট খুলতে আরাম্ভ করলো ছেলেটা। লোকটা ছটফটিয়ে আর্তনাত করছে। কথা বলতে চাচ্ছে ভীষণ। ছেলেটা আস্তে আস্তে পিছনে গিয়ে মুখের বাঁধন খুলে দিতেই বললো,
‘ ওয়েলকাম টু দ্য ডার্ক রুম অফ প্রহর ভিলা। কেমন আছেন? ‘ (প্রহর)
প্রহরের পিশাচময় হাসি প্রতিধ্বনি হলো পুরো রুম জুরে। লোকটা প্রহরকে দেখেই চমকে উঠলো। এটাতো সেই ছেলে। যে কিনা প্রেমের সাথে রেডিও স্টেশনে এসেছিলো। গানও গেয়েছিলো। সেই প্রহর খান!
‘ তুমি? তুমি এখানে কেনো? আর আমাকে বা ধরে এনেছো কেনো? ‘ (লোকটা)
প্রহর টেবিলটা কাছে টেনে নিয়ে উনার থেকে একহাত দূরে বসলেন। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
‘ আমারো একই প্রশ্ন। আপনি এখানে কেনো? আমি তো পাখি শিকার করতে যাইনি। বরং পাখি নিজে এসেই ধরা দিয়েছে। দয়া করে আমাকে দোষ দিবেন না। বাই দ্য ওয়ে, আপনার নাম জেনো কি? আপনি ইফতেখার উদ্দিনের পিএ না! ‘ (প্রহর)
‘ বলছি। তুমি আগে আমার মাথার উপর থেকে লাইটটা সড়াও। ‘ (লোকটা)
প্রেম কিছু বললো না। আপনা আপনি লাইটটা ছাদে গিয়ে অবস্থান নিলো। লোকটা বিষ্মিত হয়ে প্রহরের দিকে চেয়ে বললো,
‘ আ’আমার নাম নিছার উদ্দিন। আমি ইফতেখার উদ্দিনের চাচাতো ভাই। আমাকে ছেড়ে দাও প্লিজ। ‘ (নিছার)
‘ আপনাকে তো দেখি আমার থেকেও ১৫ বছরের বড় লাগে। আপনাকে মা’র’তে আমার খুব কষ্ট হবে। আপছোস!’ (প্রহর)
লোকটার কলিজা ধ্বক করে উঠলো। টেনশনে কপালের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঘাম ছুটলো। অতঃপর করুণ কন্ঠে বললো,
‘ কি চাও তুমি। ছেড়ে দাও প্লিজ’ (নিছার)
‘আপনি ছাড়া পাবেন না নিছার সাহেব। তবুও কিছু প্রশ্নের সঠিক জবাব দিবেন৷ আমি খুশি হলে আপনি বেঁচে যেতেও পারেন। তবে চান্স খুবই কম। ‘ (প্রহর)
প্রহরের কথা আবারো প্রতিধ্বনিত হলো রুমটাতে। লোকটার হার্টবিট দ্রুত হচ্ছে। কি করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না
অতঃপর করুণ দৃষ্টিতে চেয়ে বললেন,
‘ কি জানতে চাও ‘ (নিছার)
‘ প্রথমত আমাকে নিশ্চিই চেনেন। আমি প্রেমের মামাতো ভাই । আমার ফুফার একটা রেডিও স্টেশন ছিলো। সেটা এখন আপনাদের দখলে। সেটা কিভাবে আপনাদের হাতে এলো সেটা আপাতত জানতে চাচ্ছি না। তাছাড়া তখন আমি ভীষণ ছোট ছিলাম। একটু একটু মনে আছে সবকিছু। ফুফা-ফুফি মারা যাওয়ার পর আমার বাবা মা কেনো ঐ রেডিও স্টেশন নিয়ে মাথা ঘামালো না। আমি অনেকবার জানতে চাইলেও কোনো জবাব দেয়নি। আর আপনাদের ইনটেনশন যদি শুধু সম্পত্তির উপরই হতো৷ তাহলে প্রেমের পুরো বাড়িটার দখল নিলেন না কেনো? আচ্ছা যাই, এবার বলুন ফুফা-ফুফি এ’ক্সি’ডে’ন্ট করলেন কিভাবে। ‘ (প্রহর)
লোকটা ভয়ে ঠকঠক করে কেঁপে উঠলো। ভয়ভয় জবাব দিলো,
‘ আমি! আমি মা’রি’নি। বিশ্বাস করো। আমি মারিনি। ‘ (নিছার)
প্রহর কথাটা শুনামাত্র প্যান্টের বেল্টের খুলে লোকটার পিঠ বরাবর মা’র’তেই গগনবিদারী চিৎকার করে উঠলো নিছার। প্রহর ক্ষ্রান্ত হলো না। বেল্ট পাশে ছুড়ে ফেলে নিজের পেশিবহুল হাতের শক্তিশালী থা’প্প’ড়ে ঘায়েল করলো নিছারকে। অতঃপর ভদ্র শিশুর মতো শান্ত নয়ে বললো,
‘ আমি তো বলিনি আপনি মেরেছেন! ব্যাপারটা ‘ঠাকুর ঘরে কে? আমি তো কলা খাইনি ‘ এমন হয়ে গেলো না? ‘ (প্রহর)
লোকটার নাক-ঠোঁট ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়লো। মুখের রং পাল্টে গিয়ে বিবর্ণ রুপ ধারণ করলো। প্রহর আবারো শান্ত হয়ে বললো,
‘ প্রেমকে ফলো করছিলেন কেনো নিছার সাহেব? ‘ (প্রহর)
‘ ইফতেখারভাই নজর রাখতে বলেছিলেন ‘ (নিছার)
‘ কেনো? ‘ (প্রহর)
‘ গত পরশু প্রেমের আসল পরিচয় জেনে গিয়েছে ভাই। তাই আরকি! আমাকে মা’র’বে না প্লিজ’ (নিছার)
হঠাৎ রুমে প্রবেশ করলো প্রেম। শরীরে ঠান্ডা দিনের হুডি। পরণে ক্রিকেট খেলার প্যান্ট। রুমে প্রবেশ করেই বললো,
‘ ভাইয়া, রশ্নির নাকি জ্বর এসেছে। আমাকে এক্ষুণি বাসা ফিরতে হবে। তুমি এখানে থাকবে নাকি আমার সাথে যাবা? ‘ (প্রেম)
প্রহরের রুপ পরিবর্তন হলো। রুমে নিয়ন বাতির পরিবর্তে এনার্জি বাল্ব জ্বলে উঠলো। সাথে সাথে পরিবর্তন হলো রুমের কালার। ভয়ংকর এই রুম! প্রহর বাইরে থেকে গার্ডকে ডেকে বললো,
‘ উনাকে রুমে নিয়ে গিয়ে আজ রাতের থাকার ব্যবস্থা করো। ‘ (প্রহর)
নিছার নামের লোকটা বারবার নিজের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করছে! কেনো যে ইফতেখারের কথায় এখানে এসেছিলো। এই প্রহর যে কতটা ভয়ংকর তা ইফতেখার ভালো করেই জেনেছিলো। তবুও আমাকে পাঠালো। হায়রে লোভ! এই লোভ আমার মৃত্যু ডেকে আনলো।
—
প্রেম বরবারই প্রহরভাইয়ের রুপ সম্পর্কে ধারণা রাখে। কখন কিভাবে প্রহরভাইয়ের রুপ পরিবর্তন হয়ে যায়। তা বলা মুশকিল। প্রথম দিকে মেনে নিতে অনেক কষ্ট হতো। কিন্তু এখন সয়ে গেছে। আজ থেকে পাঁচবছর আগে উনি যখন দেশ ছাড়লেন। তার আগেও এসবে লিপ্ত ছিলেন । উনার সব কাজে আমাকে পাশে রাখতেন। যার কারণে আমার হৃদয়ে ভালোবাসার মতো পবিত্র শব্দ আসতে পারেনি। আস্তে আস্তে উনার ভয়ংকর রুপে নিজেকে পাথর বানিয়েছি। প্রথম দিকে কাঁদতাম। ভীষণ কাঁদতাম। চোখের সামনে মানুষের আর্তনাত শুনে রাতে ঘুম আসতো না। অথচ প্রহরভাই নিশ্চিন্তে ঘুমাতেন। ভাইয়া কেনো এমন হলো জানতে বড় ইচ্ছে হয়। বাইরে থেকে কেউ কখনো চিনবে না এই প্রহরকে। যার পরণে সাদার মতো পবিত্র রং ছাড়া কিছু থাকে না। তিনিই আজ থেকে পাঁচবছর আগে কালোকে নিজের আপন করে নিয়েছেন। আজও যদি কেউ কোনো যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করে। দেখবে ভীতরে অন্ধকার। বাইরের সাদা রং তো শুধু দেখানো মাত্র।
—
প্রহরভাই বাসায় আসলো ঠিক রাত বারোটার পর। একটু আগে ডক্টর এসে দেখে গেছে আমাকে। বৃষ্টিতে ভেজার কারণেই এই ফল। প্রহরভাই রাগ করবেন না তো? উনি আমার রুমে ঢুকে দেখলেন আম্মি আমার মাথায় হাত বুলাচ্ছেন। আমি উনাকে দেখে চমকে উঠলাম। এই বুঝি রাগ করেন। কিন্তু করলেন না। আম্মির উদ্দেশ্যে বললেন,
‘ ডক্টর এসেছিলো? ‘ (প্রহর)
‘ তোকে জানতে হবে না। রাতবিরাতে বাইরেই থাক। বাড়িতে কেউ ম’রে গেলেও খবর নিবি না ‘ (আম্মি)
#শুধু_তুই
—-(সিজন২)
#পর্বঃ২৬
#Rifat_Amin
ঘড়িতে রাত ১ টা ছুঁই ছুঁই। বদ্ধ অন্ধকার ঘরে এখন পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে। অথচ কারো চোখে ঘুম নেই। আমি ঘুমানোর যথেষ্ট চেষ্টা করেও ঘুমাতে পারছি না। বাধ্য হয়ে চোখ বন্ধ করে রইলাম। মাথার উপর ঝুলে থাকা ফ্যানটা নিস্তেজ হয়ে পরে আছে। প্রহরভাই সেই ফ্যানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো,
‘ তোকে বৃষ্টিতে ভিজতে দেয়াই ভুল হয়েছে আমার। এখন বুঝলিতো জ্বর আসলে মাসে কয়দিন যায়? ‘ (প্রহর)
আমি কোনোরুপ জবাব দিলাম না। ভীষণ মাথা ব্যাথা করছে । শরীরটাও জ্বরের উত্তাপে পুরে যাচ্ছে। উনি আমার দিকে ঝুঁকে বললেন,
‘ ঘুমালি নাকি? আচ্ছা ঘুমা। ‘ (প্রহর)
কিন্তু আমার তো ঘুম আসছে না। যদিও উনি পাশে থাকলে সহজে ঘুম আসার কথাও নয়। অস্বস্তি কাজ করে। আমি চোখ খুলে উনার দিকে পাশ ফিরে বললাম,
‘ ঘুম আসছে না। আপনি আমার রুমে এসেছেন এটা আম্মি জানতে পারলে অনেক রাগ করবে। চলে যান। ‘ (আমি)
‘ আহ!! এত চলে যান যান করিস কেনো? একটু আসো জান, আসো জানও তো বলতে পারিস। ‘ (প্রহর)
‘ আপনি পাগল! যান বলছি। ‘ (আমি)
‘ জান, কলিজা, ফুসফুস। যাই বলিস না কেন
আমি নড়ছিনা। আচ্ছা একটা গল্প বলি শোন। ‘ (প্রহর)
‘ আপনাকে গল্প বলতে হবে না। ‘ (আমি)
উনি আমার কথা না শুনে গল্প শুরু করলেন,
‘ আমি যখন কলেজে পড়ি। তখন একটা মেয়ের সাথে আমার পরিচয় হয়, বুঝলি! ওর নাম ছিলো মেঘলা। নামটা যতটা না সুন্দর ছিলো। তাঁর থেকেও ওর চোখগুলো ছিলো ভয়ংকর সুন্দর। আমি ওকে দেখামাত্র ক্রাসিত হয়ে গেলাম। বুঝতেই পারছিস যে প্রহরখান যাকে দেখে একবার ক্রাশ খায়, সে কতটা সুন্দর হতে পারে! (প্রহর)
আমার মেজাজ গরম হয়ে গেলো। জ্বরের তাপের সাথে গরম মেজাজ বিক্রিয়া করে উনাকে বিছানা থেকে কিক দিয়ে ফালায় দিতে ইচ্ছে করলো। এই ভয়ংকর ইচ্ছেটা অতিকষ্টে দমিয়ে রেখে চুপচাপ পাশ ফিরে শুলাম। উনি বললেন,
‘ আরে শোন। গল্পটা অনেক ইন্টারেস্টিং। দেখবি গল্প শুনেই জ্বর পালাবে। ‘ (প্রহর)
‘ আপনার গল্প আপনার কাছেই রাখুন। এখন দয়া করে সেই মেঘলাকে বিয়ে করে আমার চোখের সামন থেকে বিদেয় হন ‘ (আমি)
উনি আমার কাঁধে হাত দিয়ে আমাকে টেনে পাশ ফিরিয়ে বললেন,
‘ তারপর কি হলো জানিস? আমাদের প্রেম হয়ে গেলো। শুধু প্রেম না। ভয়ংকর প্রেম যাকে বলে। কলেজের সব থেকে সুন্দরী মেয়ে আমার প্রেমিকা। ভাবতে পারছিস বিষয়টা! ‘ (প্রহর)
আমার ভীষণ কান্না পেলো। অধিক রেগে গেলে কান্না দমিয়ে রাখা কঠিন হয়ে যায়। ভাগ্যিস রুমটা আধো অন্ধকার। নাহলে উনি এই বিষয়টা নিয়েও ক্ষেপাতেন। আমাকে চুপ থাকতে দেখে উনি ছ্যাঁকায়িত কন্ঠে বললেন,
‘ তারপর কি হলো জানিস? তা..’ (প্রহর)
উনার এই নষ্টামার্কা কথাগুলো শুনে চোখের পানি আর ধরে রাখতে পারলাম না। মস্তিষ্কে প্রেশার না দিয়ে চিৎকার করে বললাম,
‘ বিয়ে করেছেন বুঝি! বাচ্চা হয়নি? ‘ (আমি)
আমার এত রাগ আর মন খারাপ কেনো আসলো বুঝতেই পারলাম না। তবে কি এই চরিত্রহীন লোকটার প্রেমে পরে গেলাম আমি! উনি হঠাৎ আমার হাত চেপে ধরে বললেন,
‘ বাচ্চা হওয়ার আগেই তো ব্রেকআপটা হলো। কিন্তু আপসোস। বাচ্চাটা আমার ছিলো না। ওর তিন নাম্বার বয়ফ্রেন্ডের ছিলো। ‘ (প্রহর)
তবুও আমার মন গললো না। চোখের কোণে মন খারাপের বৃষ্টি সুদৃঢ় হলো। আমার এমন অবস্থা দেখে উনি মুচকি হাসলেন। অতঃপর আমার মাথাটা উনার বুকে রেখে মাথায় আলতো হাত বুলিয়ে দিলেন। আমি কান্নারত অবস্থায় সড়ে যেতে চাইলেও উনি একবিন্দুও নড়তে দিলেন না। আমি কাঁদতে কাঁদতে বললাম,
‘ এসব কি সত্যি? ‘ (আমি)
‘ উহু। তোকে রাগাতে ভীষণ ভালো লাগছে। ‘ (প্রহর)
আমার রাগ হলো ভীষণ। এভাবে কেই আঘাত দেয়! এখনি আমার হার্ট এ্যা’টাক ফ্যাটাক হয়ে যেতো! আমি মাথা তুলেই উনাকে মা’র’তে শুরু করলাম। মা’ই’র খেয়ে হাসিতে গড়াগড়ি দেয়ার অবস্থা হলো উনার। অতঃপর নির্লজ্জের মতো যা বললো। তাতে আমার লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যেতে ইচ্ছে করলো। উনি যে কতটা খারাপ। তা আবারো প্রমানিত হলো,
‘ যেহেতু সেই মেয়েটা এখন নেই। না কখনো ছিলো! আর আমাকে বাবা হওয়ার সুযোগটাও সে দিলো না। তাহলে আমাকে বাবা বানানোর গুরুদায়িত্বটা তোর নেয়া উচিত, তাইনা? তবে দেখিস, বাচ্চার সামনে আমাকে আবার প্রহরভাই প্রহরভাই ডাকিস না। পরে দেখা গেলো আমাকে মামা ডেকে ভয়ংকর এক ছ্যাকা দিয়ে বসবে। ‘ (প্রহর)
আমি লজ্জায় উনার বুকে মুখ লুকালাম। পরম শান্তির স্থান। যেখানে শুধু হার্টবিটের আওয়াজ শোনা যায়। আমার অবচেতন মন ভেবে বসলো, এই শব্দগুলো আমার জন্যই সৃষ্টি!
—
সকাল ১০ টা। নিছার সাহেবের মরদেহ গাড়িতে তুলছে কালো পোষাকধারী গার্ডসগুলো। উনাকে কারেন্ট শক দিয়ে মা’রা হয়েছে। আর এই দুঃসাহসিক ভয়ংকর মৃত্যুটা দিয়েছে প্রেম নিজেই। অথচ নিজেই এখনো বিশ্বাস করতে পারছে না। হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। মস্তিষ্ক ফাঁকা ফাঁকা ঠেকছে। এটা ওর জীবনের প্রথম খু’ন। সে রকিং চেয়ারে বসে গার্ডগুলোর কাজ দেখছে। ওরা এমনভাবে কাজ করছে, যেনো এসব তাদের নিত্যদিনের সঙ্গি। তবে অনেকদিন অভ্যাস না থাকায় বড্ড ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে তাদের। প্রহর খান এখনো বাসা থেকে আসেনি। নিছারের মৃত্যুর খবর প্রহরভাই এখনো জানে না। জানলে যে কেমন রিয়েক্ট করবে সেটাই বুঝতে পারছে না প্রেম। ঘটনাটা ঘটেছে ঘন্টাখানেক আগে। প্রেম, প্রহরভাইয়ের কাছে গতকাল শুনছিলো ওর বাবা মায়ের মৃত্যুর সাথে নিছার সাহেব জড়িত আছেন। সেই কৌতুহল বসত আজ প্রেম নিছার সাহেবকে জিজ্ঞেসাবাদ করতে ঢুকেছিলো। উনাকে আঘাত বা শারিরীক কষ্ট দেয়ার মোটেও ইনটেনশন ছিলো না প্রেমের। কিন্তু যখন ওর বাবা মায়ের মৃত্যুর ঘটনাটা উনি বর্ণনা করছিলেন। তখন রক্ত টগবগ করে ফুটছিলো প্রেমের। ঠিক কি করবে ভেবে পাচ্ছিলো না সে। রাগটা হঠাৎ এতটাই বেড়ে দিয়েছিলো যে, নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারেনি প্রেম। টিবিলে থাকা রিমোট অন করতেই ইলেকট্রিক চেয়ারে থাকা নিছার মহুর্তেই বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে মারা গেলেন। প্রেমের এখন রীতিমতো ঘাম ছুঁটছে। সে জানে, প্রহর কখনই নিছারকে বাঁচিয়ে রাখতো না। তবে নিছারের মৃত্যুর সাথে অনেক রহস্য হারিয়ে গেলো। যা কোনোভাবেই ফিরে পাওয়া সম্ভব নয়।
—-
মনে হয় বাড়ির ছেলে-মেয়েদের উপর কেউ জাদু করেছে ভাইজান। হঠাৎ এই উদ্ভট মন্তব্যটা করে বসলেন আঙ্কেল (মামা)। তাঁর সামনেই সোফায় ভদ্র শয়তানের মতো বসে আছে পুলকভাইয়া আর তাঁর বাবা মা। তাঁরা ঐশীর জন্য বিয়ের সম্মোন্ধ নিয়ে এসেছে। আঙ্কেল-আম্মির এত তারাতারি মেয়ের বিয়ে দেয়ার মোটেও ইচ্ছে নেই। প্রথমে প্রেমের, তারপর আমার আর প্রহরভাইয়ের! এখন ঐশীরও যদি বিয়ে হয়ে যায়। তাহলে বাড়িটা একদম শুন্য হয়ে যাবে। যদিও প্রেমের বিয়েটা প্রহরভাইয়ের হস্তক্ষেপে হয়েছে। আর আমাদের বিয়েটা দূর্ঘটনা বসত। কিন্তু আঙ্কেলের ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে উনি রাজি হয়ে যাবে। এদিকে ঐশীও লজ্জায় দরজা দিয়ে বসে আছে। আমি ভদ্র মেয়ের মতো খাবার পরিবেশন করো রুমের ভীতর চলে আসলাম।
ঘড়িতে দুপুর ১২ বাজতে চললো। অথচ এখনো উনার উঠার সময় হলো না। প্রহরভাইকে এখনো ঘুম থেকে উঠতে না দেখে বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে গেলো আমার। তবে গতকাল রাতের কথা মনে পড়তেই লজ্জায় মিইয়ে গেলাম। থাক! উঠতে হবে না এখন। উঠলে আবারো আমাকে জ্বালানোর পায়তারা করবে। কিন্তু ঘরদোরের যে অবস্থা! একটা মানুষ ভীতরে ঢুকলে কি বলবে!
উনাকে ঘুম থেকে তোলার জন্য একটা টেকনিক ইউজ করলাম। এসির পাওয়ার বাড়িয়ে দিয়ে বিছানার কম্বলগুলো উনার শরীরের উপর উঠিয়ে দিলাম। অতঃপর দরজা জানালা বন্ধ করে এসিটাও অফ করে বের হয়ে আসলাম। এবার বুঝবে মজা।
রুমের বাইরে এসে ড্রইংরুমে বিয়ের আলাপের দিকে মনোযোগ দিতেই ভীতর থেকে প্রহরভাইয়ের কর্কশশব্দ কানে আসলো। আমি দরজা খুলে ভীতরে প্রবেশ করতেই আবারো লজ্জায় পরলাম! উনার শরীরে একটা থ্রির কোয়ার্টার প্যান্ট ছাড়া কিছুই নাই। লজ্জায় মাথা নিচু করতেই উনি রাগী স্বরে বললেন,
‘ দিলি তো আমার সুন্দর ঘুমটার বারোটা বাজিয়ে। তোর মাথায় কি শয়তানি বুদ্ধি ছারা কিছু নাই। উফফ! কি গরম। ‘ (প্রহর)
‘ আপনার ঘুমের বারোটা না বাজালে ঘড়িতে তেরোটা বেজে যেতো। তারাতাড়ি ফ্রেস হয়ে নিন। এদিকে, আপনার বোনের বিয়ে হয়ে যাচ্ছে। ‘ (আমি)
উনি ডন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে একটা হোয়াইট টিশার্ট শরীরে দিয়ে বললেন,
‘ কার বিয়ে? ‘ (প্রহর)
‘ ঐশীর সম্মোন্ধ এসেছে৷ মনে হয় বিয়ে টা হয়ে যাবে। ‘ (আমি)
প্রহরভাই খানিকটা গম্ভীর হয়ে কিছু একটা ভাবলেন। অতঃপর গম্ভীর কন্ঠেই বললেন,
‘ আচ্ছা কম্বলটা দে সরি তোয়ালেটা নিয়ে আয়তো ‘ (প্রহর)
উনার গম্ভীর কন্ঠ শুনে ভাবলাম শয়তানি চিন্তা ভাবনা বোধহয় লোপ পেয়েছে। কিন্তু তা কি আর হয়! চোরের মুখে ধর্মের কথা মানায় না, তার জলজ্যন্ত প্রমান পেলাম। আমি ভদ্র মেয়ের মতো তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমের সামনে যেতেই উনি শক্তহাতে হাত টেনে ধরে ওয়াশরুমের ভীতরে ঢুকালেন আমায়। আর মহুর্তেই ঝর্ণার পানিতে পুরো শরীর স্নান হলো আমার! উনি খিলখিলিয়ে হাসছেন আর বাচ্চাদের মতো আমার সাথে ভিজছেন। আমার অবাক হওয়া ছাড়া কিছু করার রইলো না।
চলবে?
চলবে?