শূন্য থেকে আসে প্রেম পর্ব ১+২

#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ১
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

আজ আমার বড় বোনের বিয়ে। যাকে এতদিন নিজের বড় বোনের হবু স্বামী হিসেবে জানতাম , আজ আমি তাকেই বিয়ে করে আমাদের বাড়ির গেটের সামনে দাড়িয়ে আছি। বিয়ে বাড়ির মানুষজন এত রমরমা পরিবেশের মধ্যে যখন জানতে পারবে তাদের বাড়ির ছোট মেয়েটি নিজেই তার আপন বড় বোনের সংসার ভেঙেছে তাহলে কিরকম লাগবে তাদের ? ক্ষণে ক্ষণে তা ভেবেই শিউরে উঠছি আমি। ওদিকে সৌরভ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে বাঁকা হেসে বলেন,

” কি হলো চলো ? একটু পরই তোমার বাড়ির লোকেরা তোমার সাথে কি ব্যবহার করবে তা জানার জন্যে আমি অনেক এক্সাইটেড। তারাতারি চলো। ”

উনার এই হাসি দেখে আমার শুধুই উনার প্রতি ঘৃনা জন্মাচ্ছে। ইচ্ছে করছে এখনই গলা টিপে মেরে ফেলি। কিভাবে পারলো এত নিষ্টুর কাজ করতে? আমার বোন তো আমার থেকেও অনেক সুন্দর দেখতে। তাহলে আমাকে কেনো ব্লেকমেইল করে বিয়ে করলো ? হটাৎ সৌরভ ভাইয়া আমার বা হাতের কনুই শক্ত করে ধরেন। আর আমি ব্যাথায় কুকীয়ে উঠি। উনি আমার দিকে তাকিয়ে কটমট দৃষ্টিতে বলেন,

” খবরদার , কোনো বুদ্ধি খাটাবে তো ? তোমার তো আবার বেশি বুঝার ক্ষমতা আছে। কিন্তু একটা কথা মাথায় ঢুকিয়ে নাও যদি কিছু উল্টা পাল্টা করেছো তো আমার চেয়ে খারাপ কেউ হবে না। আমি যা বলছি সেই অনুযায়ী কাজ করবে। বুঝেছ ? ”

লাস্টের কথাটা বলার সময় উনি আমার কপালে খুব জোড়ে টোকা দিলেন। আমি কিছু না বলে শুধু মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছি। উনি আমার থুতনি ধরে মাথাটা উপরে তুলে বলেন,

” By the way , তুমি কি তোমার ঐ চোখের জলে আমাকে ফাঁসাতে চাচ্ছো ? No way.এটা কখনোই হবে না। বুঝেছ তুমি ? ”

আমি উনার কথা শুনে আমার মুখটা উনার হাত থেকে এক ঝটকা মেরে ছাড়িয়ে নিয়ে রাগী কণ্ঠে বলি,

” কক্ষনো না মিস্টার চৌধুরী। আপনি আমার ভালোবাসার যোগ্যই নন। তাই ওসব ভুলে যান। ”

সৌরভ ভাইয়া একটা তাচ্ছিল্যের হাসি দিয়ে বলেন,

” আমি না, বলো তুমি আমার ভালবাসার যোগ্য নও। নাও গো। ”

বলেই আমার হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ির ভিতর নিয়ে গেলেন। যখনই আমরা বাড়ির ভিতর ঢুকি উনি আমার হাত ছেড়ে দিয়ে পুরো ভদ্র সেজে গেলেন। আর লুকিয়ে আমার হাতটা দিয়ে উনার হাতটা মুষ্টিবদ্ধ করালেন। আমি রেগে হাত টা সরাতে চাইলে উনি আমার দিকে তাকিয়ে এক বাকা হাসি দেন। আর আমি ভয়ে চুপসে যাই। বিয়ে বাড়ির লোকজন আমার হাতের দিকে একবার করে তাকিয়ে আবার আমার দিকে তাকায়। এরইমধ্যে কানাঘুষা শুরু হয়ে গেছে। আর সৌরভ ভাইয়া এমন এক ভদ্র ফেস বানিয়ে রেখেছেন যেনো এতে উনার কোনো দোষ নেই। সব দোষ আমার। আমি নির্জীব হয়ে আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আছি। একটা লোক তো বলেই ফেললো,

” কি ব্যাপার গো মাইয়া ? নিজের বোনের স্বামীর সাথে হাত ধইরা আছো কেন? ছাড়ো ওর হাত। ”

আমি হাত টা না ছাড়িয়ে মাথা নিচু করে রইলাম। সৌরভ ভাইয়া লোকটার দিকে তাকিয়ে অসহায় ফেস নিয়ে বললেন,

” চাচা , দেখেনতো আমার হাত এই অসভ্য মেয়েটা ছাড়তেই চাচ্ছে না । তুমি কিছু করো না। ”

আরেকজন লোক বললো,

” মেয়ের গলায় এই ফুলের মালা কেনো ? আর জামাই বাবাজির গলায়ও তো একই মালা। আর মেয়ের দুই হাতে দেখি দুইটা বালাও আছে। অবিবাহিত মেয়ের হতে বালা ! তার মানে কি ওরা বিয়ে করে নিয়েছে ? ছি ছি ছি। শেষ পর্যন্ত নিজেই আপন বড় বোনের সংসার ভাঙলো । ”

এদের এসব কথা শুনে লজ্জায় আমার মাথা কাটা যাচ্ছে। কিন্তু মুখ ফুটে কিছু বলতে পারছিনা। কারণ আমি কিছু বললে তা এখন আমার ফ্যামিলির উপর দিয়ে যাবে।এসব কথা এক কান দুই কান করে এটা আমার পরিবারের কান পর্যন্ত চলে গেলো। সৌরভ ভাইয়া আমাকে নিয়ে ঘরের ভিতর ঢুকলেন। ঢুকে দেখি বাবা মাথায় হাত দিয়ে বিষন্ন মনে সোফায় বসে আছেন। আর মা উনাকে সান্তনা দিচ্ছেন আর কাঁদছেন। আমরা ঢুকার পর ছোট চাচা আমাদের দেখে বাবার কানে কানে কিছু বললেন। তারপর বাবা উনাকে কিছু বলে ধীরে ধীরে আমাদের দিকে এগিয়ে এলেন। আমি রীতিমত এই ভেবে ভয়ে কাপছি যে এর পর আমার সাথে কি হবে ? বাবা আমার সামনে এসে আমাদের দুজনের দিকে শান্ত চোখে তাকালেন। এদিকে বিয়ে বাড়ির লোকজন নানা কথা শুনাতে লাগলো। কেউ বললো,

” বাবা মায়ের শিক্ষার অভাব তাতো দেখতেই পারছি। কি অলুক্ষণে কাণ্ড বলতো।”

আরেকজন মহিলা নাক মুখ কুচকে বললো,

” মেয়ের আর কোথাও নজর দেয়ার জায়গা পেলো না। শেষ পর্যন্ত নিজের বড় বোনের বরের উপর নজর দিল । আচ্ছা এই মেয়ের তো এনগেজমেন্ট হয়ে গেছ। নিজের ফিওন্সী থাকতে অন্যের বরের গলায় কিভাবে ঝুলে পরলো ? কি মেয়েরে বাবা। ”

আমি এসব তিক্ত কথা শুনে নিশব্দে নিজের চোখের জল ছেড়ে দিলাম। আর পারছিনা এসব শুনতে। সহ্যের বাহিরে যাচ্ছে একদম। বাবা এসব কথা শুনে এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে জোড়ে বলে উঠেন,

” সবাই একদম চুপ। আমি আমার মেয়ের সাথে কথা বলছি। তাই দয়া করে কেউ কোনো কথা বলবেন না।”

এতে মানুষজন যেনো আরো ক্ষিপ্ত হলো। কথা কমার বদলে আরো বেড়ে গেলো। বাবা এসব দেখে ক্লান্ত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

” তুই কি সৌরভ কে বিয়ে করেছিস ? ”

আমি আমতা আমতা করে বলি,

” জ.জী , হ.হ্যাঁ। ”

বাবা আমার কথা শুনে ঠাস করে আমার গালে থাপ্পর বসালেন। আমি কিছু না বলে মাথা নিচু করে কাদতে লাগলাম। সৌরভের মা সৌরভকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে কড়া কণ্ঠে বলেন,

” তুই কি করেছিস মেয়েটার সাথে ? বল বলছি। কারণ আমি যতদুর ঈপ্সিতা কে চিনি ও এরকম মেয়ে নয়। বল কি করেছিস ওর সাথে ? ”

সৌরভ ভাইয়া তার মার দিকে তাকিয়ে শান্ত কণ্ঠে বললেন,

” আরে মা , আমি কি করবো ? আরেকজনের চরিত্রের দোষ তুমি আমার উপর কেনো চাপাচ্ছো বলো ? ঈপ্সিতা আমাকে ব্লাকমেইল করেছে ওকে বিয়ে করতে। তাই না ঈপ্সিতা ? ”

আমি উনার কথা শুনে করুন চোখে উনার দিকে তাকালাম। উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে অন্যদিকে ফিরে গেলেন। আমি ছোট্ট এক নিশ্বাস ফেলে উনার মার দিকে তাকিয়ে বলি,

” আন্টি, উনার কোনো দোষ নেই। যা করার আমি করেছি। ”

কথাটা বলার সাথে সাথে বাবা আমার গালে আরেক চর বসালেন। আমি গালে হাত দিয়ে আবার মত নিচু করে ফেলি। সৌরভ ভাইয়া উনার মার দিকে তাকিয়ে বলতে লাগলেন,

” মা আমি বলছি ও কি করেছে । ঈপ্সিতা আমাকে আজ ফোন দিয়ে বলে যে উত্তরা দেখা করতে। আমি এজ এ শালী ভেবে ওখানে যাই। গিয়ে দেখি ও কাজী অফিসের সামনে দাড়িয়ে আছে। আমি অবাক হয়ে ওকে বলি,

” তুমি আমাকে এখানে কেনো ডেকেছো ? ”

ঈপ্সিতা তখন বলে যে ও আমাকে বিয়ে করতে চায়। আমি চমকে বলি যে ওর বড় বোনের সাথে আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। তখন ও নিজের গায়ের উড়না সরিয়ে দেয়। আমি দেখি যে জায়গায় জায়গায় ওর জামা ছিরা- ফাটা। আমি এতে অবাক হয়ে ওর দিকে তাকাই। ও বলে যে আমি যদি ওকে এখন বিয়ে না করি তাহলে ও সব্বাইকে বলবে যে আমি ওকে রেপ করার চেষ্টা করেছি। আমি ওর কথা পাত্তা না দিয়ে চলে যেতে নিলে ও আমার গলায় ঝুলে পরে। আর চিৎকার করে লোকজন ডাকতে থাকে। আমি এতে ভরকে যাই। পড়ে লোকজন এসে ওকেই বিশ্বাস করে। আর জোরজবরদস্তি করে ওর সাথে আমাকে বিয়ে পরিয়ে দেয়।

উনি তারপর দুঃখী দুঃখি কণ্ঠে বলেন,

” আমি আর কি করতাম মা। আমাদের পরিবারের ইজ্জতের কথা ভেবে পরে বিয়ে করে নিয়েছি। এতে আমার কি দোষ বলো মা। ”

উনার কথা শুনে চারিদিক থেকে লোকজন আমাকে ছি ছি করতে থাকে। আর আমি উনার নির্জীব হয়ে উনার দিকে তাকিয়ে আছি। কিভাবে এত সাজানো গুছানো মিথ্যে বললো উনি ? উনার মা স্থির দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে থাকে। হয়তো সৌরভ ভাইয়ার কথা বিশ্বাস করতে উনার একটু কষ্ট হচ্ছে। বাবা শুধু আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। চোখের কণায় জল চিকচিক করছে উনার। আর আপু দূরে দাড়িয়ে জাস্ট তামাশা দেখছে। যেনো উনার এতে কোনো যায় আসে না।এদিকে আমার ফিয়োন্সি অভ্র আমার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। হয়তো বিশ্বাস করতে পারছে না এই অনাকাঙ্খিত ঘটনা। আসলেই ছেলেটা আমাকে বড্ড ভালোবাসতো। কিন্তু আমি কখনো ওর ভালোবাসার মর্যাদা দেয়নি। আর আজ তো ওকে সোজা হৃদয়ে আঘাত করেছি আমি। হটাৎ অভ্র এসে আমার হাত টা ধরে আমার দিকে তাকিয়ে করুন কণ্ঠে বলে,

” ইপ্সী, আমি জানি তুমি এরকম মেয়ে নও। ওরা সবাই মিথ্যে বলছে। প্লিজ আমি তোমার সাথে আছি। আজ অন্তত একজন বন্ধু ভেবে আমাকে সত্যিটা বলো। প্লিজ। ”

আমি ওর হাত ঝটকা মেরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে চিৎকার করে বলি ,

” বিশ্বাস কেনো করো না তুমি ? কি বলেছি আমি অবিশ্বাসের ? হ্যা , হ্যা , সব দোষ আমার। সব আমার জন্যে হয়েছে। বুঝেছো তুমি। ”

আমার কথা শুনে অভ্র আহত ভঙ্গিতে আমার দিকে তাকায়। আর কিছু না বলে চোখের পানিটা মুছে সেখান থেকে চলে যায় ও। হয়তো এখানে আর যা হবে তা ওর দেখার ক্ষমতা নেই। সৌরভের বাবা সৌরভের দিকে তাকিয়ে গম্ভীর কণ্ঠে বলেন,

” একবার ভেবে দেখছো যে এখন ইনায়ার কি হবে ? ”

সৌরভ ভাইয়া আমার দিকে ইশারা করে বলেন,

” সেটা তোমার বেস্ট ফ্রেন্ড এর ছোট মেয়েকে জিজ্ঞেস করো। ”

আঙ্কেল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

” যেহেতু তোমাকে জিজ্ঞেস করেছি তাই তুমিই
বলো। ”

উনি ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে বললেন,

” আমি পারবনা বলতে। যাকে জিজ্ঞেস করতে বলেছি তাকে জিজ্ঞেস করো নয়তো চুপ থাকো। ”

আঙ্কেল উনার কথা শুনে চোখ রাঙিয়ে উনার দিকে তাকান। কিন্তু উনি এসবের কোনো তোয়াক্কা না করে মুখ ফিরিয়ে অন্যদিকে তাকালেন। এসব দেখে আঙ্কেল এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে আমার দিকে তাকান। আমি উনার দিকে করুন দৃষ্টিতে তাকাই। বলি,

” আম.আমি জ.জানিনা আঙ্কেল। ”

আমার কথা শুনে সৌরভ ভাইয়া আমার বাবার দিকে তাকিয়ে বলেন ,

” আমি একটা সলিউশন দিতে পারি। জানি এটা তোমাদের পছন্দ হবে। আফটার অল এটা আমার আইডিয়া। ”

উনার কথা শুনে সবাই আগ্রহী দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকায়।
#শূন্য_থেকে_আসে_প্রেম
#পর্ব – ২
#আভা_ইসলাম_রাত্রি

” আমি একটা সলিউশন দিতে পারি। জানি এটা তোমাদের পছন্দ হবে। আফটার অল এটা আমার আইডিয়া। ”

উনার কথা শুনে সবাই আগ্রহী দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকায়।

” এই রিফাত , এদিকে আয়। ”

সৌরভ ভাইয়ার ডাক শুনে একটা ইয়াং লম্বা করে ছেলে ভিতরে ঢুকে। ছেলেটাকে দেখে আপুর চোখ মুখ খুশিতে ঝিলিক দিয়ে উঠে। কিন্তু কেনো আমি জানিনা। সৌরভ ভাইয়া ছেলে টাকে সাথে নিয়ে বাবার সামনে গিয়ে দাঁড়ান। বলেন,

” এই হলো রিফাত। পেশায় একজন সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার। ছেলে হিসেবে অনেক ভালো। একদম আপনার জামাই হওয়ার উপযোগী। আমার খুব ক্লোজ ফ্রেন্ড। আমি আপনাকে গ্যারান্টি দিচ্ছি আঙ্কেল আপনার মেয়ে ওর কাছে খুব সুখে থাকবে। পারলে লিখে নিতে পারেন কথাটা। ”

বাবা একঝলক ছেলেটার দিকে তাকান। চোখ চশমা , চুলগুলো এলোমেলো , নম্র ভাবে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা ওর দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে আবার চোখ মুখ শক্ত করে বলেন,

” এভাবে আমি তোমার কথাতে আমার মেয়েকে অপরিচিত কারো হাতে তুলে দিতে পারিনা , সৌরভ। আর আজ তুমি যা করেছে তারপর তো আরো না। ”

সৌরভ ভাইয়া বাবার দিকে শান্ত চোখে তাকিয়ে আবার চোখ ফিরিয়ে আপুর দিকে তাকান। আপু ভয়ে একজায়গায় জড়োসড়ো হয়ে আছে। সৌরভ ভাইয়া অতি নরম গলায় ডাক দেন আপুকে। আপু মাথা নিচু করে সৌরভ ভাইয়ার কাছে এসে দাঁড়ান। ভাইয়া নিজে সরে এসে আপুকে রিফাত নামের ছেলেটার কাছে দাড় করিয়ে বাবাকে নরম গলায় বলেন,

” আমার কথা না হয় নাই মানলেন। কিন্তু আপনার মেয়ের কথা ? ওটাতো নিশ্চই মানবেন তাইনা আঙ্কেল ? ”

বাবা প্রশ্নবিদ্ধ চোখে তাকালেন আপুর দিকে। আপু আমতা আমতা করে বলে,

” ব..বাবা , আম.আমি রিফাত কে প.পছন্দ করি। ”

বাবা আপুর মুখ থেকে এই কথা টা শুনার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন না। তাই অত্যন্ত আহত গলায় বললেন,

” তা আমাকে কি এই কথা আগে বলা যেত না ? আমি ছোটোবেলা থেকে তোদের কে ফ্রিডম দিয়েছি। সবসময় তোদের প্রয়োজন পূরণ করেছি। একজন বাবা হিসেবে নয় , বন্ধু হিসেবে তোদের কে আগলে রেখেছি। আর আজ তোরা আমার ভালোবাসার এই মূল্য দিলি ? ”

আপু কিছু না বলে টলমল দৃষ্টিতে বাবার দিকে তাকিয়ে রইলেন। সৌরভ ভাইয়ার মা বাবার দিকে এগিয়ে এসে বললেন,

” ভাইয়া , মেয়েটা হয়তো আপনার ভয়ে ওর ভালোবাসার কথাটা বলেনি আপনাকে। মনে কষ্ট নিবেন না ভাইয়া। বাচ্চা মানুষ ভুল করে ফেলেছে। এখন কি করবেন তাই চিন্তা করুন। ”

বাবা এক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

” আমার ব্যর্থতা যে আমি আমার ২ মেয়েকে মানুষ করতে পারিনি। কি আর করার। এখন ওদের ২ জনকে আবার বিয়ে দিয়ে আপদ বিদেয় হোক এ বাড়ি থেকে। ”

আমি বাবার কথা শুনে চমকে তাকালাম। আমরা বাবার জন্যে এখন ” আপদ ” হয়ে গেছি। এতটাই নিকৃষ্ট আমি ? সব ওই জানোয়ারটার জন্যে হয়েছে। না চাইতেও চোখ দিয়ে একফোটা জল গড়িয়ে পড়ল আমার। সৌরভ ভাইয়া আমার দিকে তাকিয়ে আমার হাতটা শক্ত করে ধরলেন। আমার কেনো জানি মনে হচ্ছে এই স্পর্শটা ভরসার স্পর্শ। কিন্তু উনি কেনো আমাকে ভরসা দিবেন ? মা বাবার কাছে এসে নাকটা টেনে বললেন,

” দেখো যা হয়েছে ভুলে যাও। এখন বাড়ির মেয়েকে তো আর খালি হাতে ফিরিয়ে দিতে পারিনা। হয়তো আমাদেরই দোষ । আমরাই মেয়েদের ভালো শিক্ষা দিতে পারিনি। কি আর করার। এখন ভালোই ভালোই ওদের একসাথে বিয়েটা দিয়ে দাও। কি দরকার আর লোক হাসানোর। এমনিতেই অনেক কথা ফুটেছে লোকদের মুখে। আর না। ”

বাবা কিছু না বলে একজন বুড়ো লোকের কাছে গিয়ে গম্ভীর কন্ঠে বলেন ,

” কাজী সাহেব , নিকাহ নাম রেডী করুন। ২ টা বিয়ে হবে এখন। ”

আমি শুধু পাথর হয়ে এসব দেখছিলাম। কি থেকে কি হয়ে গেল আমার জীবনে। মাত্র একদিনেই আমার জীবন সম্পূর্ণ উলোট পালোট হয়ে গেলো। আর আপু ? আপু যে রিফাত ভাইয়াকে ভালোবাসি সেটা কি আমাকে একবারো বলা যেতনা। আপু তো সব কথাই আমার সাথে শেয়ার করে । তাহলে এটা কেনো করলো না ? আমার এখন সবকিছু একটা গোলকধাঁধার মত লাগছে।

কিছুসময় পর আপু , রিফাত ভাইয়া আর আমি , সৌরভ ভাইয়াকে একজায়গায় বসানো হলো বিয়ে পড়ানোর জন্যে। কবুল বলার মুহূর্তে আমার বুক যেনো ফেটে আসছিল। বারবার মনে হচ্ছিল আমার জীবনটা এর পর থেকে নরক হয়ে যাবে। সব শান্তি , সুখ শেষ হয়ে যাবে। শেষ পর্যন্ত বলেই দিলাম সেই ভারী তিন অক্ষরের শব্ধ। আর বেধে গেলাম কারো নিকৃষ্ট জীবনের সাথে।

রিফাত ভাইয়ার বাবা মাও এসেছিলেন ভাইয়ার সাথে। তারা আপুকে ওদের বাড়ি নিয়ে গেলো। যাওয়ার সময় আপু অনেক কেঁদেছিল বাবার গলা জড়িয়ে। কিন্তু বাবা সেই মুহূর্তে চোখ মুখ শক্ত করে দাড়িয়ে ছিলো। আর আমার ক্ষেত্রে ? আমার বেলায় ত বাবা আমার থেকে মুখ ফিরিয়ে সেখান থেকে চলেই যায়। এক কালে আমি আপুর থেকেও বাবার কাছে বেশি আদরের ছিলাম। আর আজ সব শেষ। সব। গাড়িতে উঠার সময় আমার চোখগুলো শুধু অভ্র কে খুঁজছিল। কিন্তু ওকে কোথাও দেখলাম না । হয়তো নিজেকে সামলাতে ব্যাস্ত এখন। আমার ওর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে। এই পৃথিবীতে বাব মার পড়ে যদি আমাকে কেউ ভালোবেসে তাহলে তা হলো অভ্র
কিন্তু ওকে আমি কখনো ভালোবাসিনি। কিন্তু বাবা, মার জন্যে এই বিয়েতে রাজি হয়েছিলাম। আমি সারাজীবন ওর কাছে অপরাধী হয়ে থাকবো ভাবতেই আমার বুকটা খুব ভারী ভারী লাগছে। সবার কাছে ঠিক বিদায় নেওয়ার পর সৌরভ ভাইয়া আমাকে গাড়িতে তুলে দিয়ে নিজে আমার পাশে বসে গেলেন। আমি জানালার দিকে তাকিয়ে নিরবে অশ্রু ঝরাচ্ছি। গাড়ি চালু হলে হটাত সৌরভ ভাইয়া আমাকে নিজের দিকে ফিরিয়ে এনে। আমি চমকে উনার দিকে তাকাই। উনি আমার বাহু দু হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে চোখে চোখ রেখে রাগী গলায় বলেন,

” আর এক ফোঁটা চোখের জল ঝরলে আমার চেয়ে খারাপ আর কেউ হবে না। আমার মনে হচ্ছে তোমাকে কেউ জেলখানায় নিয়ে যাচ্ছে যেই ভাবে কাদছ। রিডিকিউলাস। ”

বলেই আমাকে ছেড়ে অন্যদিকে ফিরে গেলেন উনি। আর আমি উনার রাগী গলা শুনে চট করে কান্না থামিয়ে চুপ করে গেলাম। কিন্তু অবাধ্য জল তো নিরবে আমার গালে বয়েই চলেছে। আমি কান্নাভেজা গলায় উনাকে বলি,

” একটা নিকৃষ্ট মানুষের সাথে সারাজীবন থাকা কি জেলখানার থেকেও কম কিছু ? ”

আমার কথা শুনে সৌরভ ভাইয়া আমার দিকে একবার তাকিয়ে নিরবে আবার মুখ ফিরিয়ে রইলেন। আর আমিও উনার উত্তরের অপেক্ষা করলাম না। কি দরকার আর দহন বাড়ানোর। আমি কিছু না বলে জানালার দিকে তাকিয়ে রইলাম। গাড়িতে ড্রাইভার , আর শুধু আমরা আছি। তাই উনার এসব তিক্ত ব্যাবহার আর কারো নজরে পড়বে না। হটাৎ সৌরভ ভাইয়া আমার কোমর খামচে ধরলেন।খুব জোড়ে খামচি দেওয়ায় আমি টলমল দৃষ্টিতে উনার দিকে ফিরে তাকালাম। সৌরভ ভাইয়া আমাকে আর শক্ত করে ধরে নিজের দিকে টেনে নিয়ে দাতে দাত চেপে বলেন,

” নিকৃষ্ট বলো আর জানোয়ার বলো , থাকতে তো তোমার আমার সাথেই হবে। মাথায় ঢুকিয়ে নাও কথাটা। ”

বলেই আমাকে ধাক্কা মেরে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নিয়ে অন্যদিকে তাকান উনি। আর আমি টলমল চোখে উনার দিকে তাকাই। আর কত কষ্ট দিবে উনি ? হয়তো মৃত্য পর্যন্ত উনার থেকে এই অবহেলা সহ্য করে যাবো আমি। আমি মাথাটা একটু নুইয়ে আমার কোমরের দিকে তাকালাম। পুরো ছিলে গেছে চামড়া। আর রক্ত না পড়লেও জায়গাটা লাল হয়ে আছে। আমি এক নিশ্বাস ফেলে কোমরে শাড়ির আঁচলটা নামিয়ে দিলাম। না হলে আবার বাড়ির লোকজন নানা কথা বলবে। এমনিতেই তাদের মুখে আজকের কাহিনীর জন্যে বুলি ফুটেছে। আমিতো এখন থেকেই ভয়ে গুটিয়ে আছি যে উনার বাড়িতে গেলে কি হবে ? সবাই হয়তো অপেক্ষা করছে আমার বড় বোনকে বরণ করার জন্যে। আর এখন সেই জায়গায় আমাকে দেখে তাদের রিয়াকশন কি হবে ? আমি উনার দিকে একবার তাকালাম। ভয়ংকর রেগে অপরপাশের জানালার দিকে তাকিয়ে আছেন। কিন্তু কেনো ? কিসের এত রাগ উনার আমার প্রতি?

চলবে…..
চলবে…

[ নতুন আরেকটা গল্প নিয়ে চলে আসলাম। আশা করি ভালো লাগবে আপনাদের। ভুল ত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন ]

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here