#সন্ধ্যা_নামার_পরে
#আঠারো
গুড়িগুড়ি বৃষ্টির মতো বরফ পড়ছে। তুষার বৃষ্টি নিরার খুব প্রিয়। তার পরনে ওভারকোট, মাথায় শীত থেকে বাঁচার জন্য টুপি পড়া। চুলগুলো দুভাগ হয়ে বুকের দু’পাশে পড়ে আছে। ওভারকোটের পকেট থেকে হাত বের করে উঁচু করে তুষারপাত ধরার চেষ্টা করল। হাতে ধরতেই তা পানি হয়ে গলে পড়ে যাচ্ছে। গাছের প্রতিটি ডালে তুষার জমা হয়েছে। দেখতে বেশ লাগছে। হঠাৎ কারো ডাকে পেছন ফিরে তাকাল সে। কিয়ারা দৌঁড়ে আসছে তার দিকে। সে কিছু বলছে কিন্তু নিরা স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছে না। কিছুক্ষণের ভেতর কিয়ারা তার কাছে চলে এলো। বলল, “তুমি আজও ভিজতেছো? কী মজা পাও বলো তো লিরা?” কিয়ার মুখে বিরক্তি। বৃষ্টি বা তুষারপাত কিছুই তার পছন্দ নয়। জন্ম থেকে এসব দেখে দেখে বেশ বিরক্ত সে। তাই সে চায় না নিরা কখনো বৃষ্টিতে ভিজুক।
নিরা মৃদু হেসে বলল, “তুমি তো জানো কিয়া আমি বৃষ্টিতে বা তুষারপাতে ভিজতে খুব ভালোবাসি।”
কিয়া জানে এ মেয়েকে বুঝিয়ে লাভ নেই। তাই সে বলল, “তুমি কী জানো? তুমি একটা পাগল লিরা।”
“আজ জেনে নিলাম।” নিরা স্মিত হেসে বলল।
কিয়া সামনের মার্কেটের সামনে দাঁড়াতে চাইল। কিন্তু নিরার জন্য পারল না। তাই অগ্যতা তাকেও হাঁটতে হচ্ছে। দুজন পাশাপাশি হাঁটছে। মিনিট পনেরোর ভেতরে দুজন বাসায় চলে এলো। কিয়া তার পরনের কোটটা খুলে ফেলল। নিরাও তাই করল। নিরা যখন তার ওভারকোট খুলল তখন কিয়া বলল, “বাঙালি মেয়ে হয়েও তুমি বেশ সুন্দর দেখতে নিরা। তোমার শারিরীক গঠন একদম বিদেশিদের মতোন।”
চিপ চিপে দেহটার দিকে তাকিয়ে নিরা হাসল। কিয়া বুঝল এ মেয়ে অন্য সাধারণ মেয়েদের মতোন নয়। এর কাছে শরীর ফিটফাট থাকা খুব একটা ম্যাটার করে না। তারপরও সে ফিট। নিরা কিয়াকে বলল, “কফি চলবে?”
কিয়া বলল, “উঁহু আজ আমি তোমাকে কফি করে খাওয়াব।”
নিরা হেসে মাথা একপাশে কাত করে হ্যাঁ বলল। কিয়া রান্নাঘরে চলে গেল। নিরা তার বাসার বারান্দায় ছাতার নিচে এসে বসল। প্রকৃতি আজ বেশ সুন্দর। নিরা প্রায়ই ভাবে একটা দেশ এতটা সুন্দর কী করে হতে পারে! বাংলাদেশের মানুষ এখানে আসলে এ জন্যই যেতে চায় না। কিন্তু কিছু কিছু বিষয় নিরার কাছে বাংলাদেশই বেশি ভালো লাগে। বিশেষ করে খাওয়া – দাওয়া। এখানে সারাক্ষণ সেদ্ধ সবজি খেয়ে থাকতে হয়। আরও অনেক খাবার থাকলেও ভাত খাওয়ার মতো শান্তি সে কিছুতেই পায় না। নিজের দেশের আলু ভর্তা, ডাল আর ডিম ভাজি দিয়ে যে ভাত খাওয়া যায় এখানে এসব আধা কাচা সবজি বা মাংস দিয়ে সে সাধ কখনোই পাওয়া যাবে না। হঠাৎ তার মনে পড়ে অর্নব একদিন তাকে বলেছিল, “নিরা ভাত কম করে খাবা তুমি মুটিয়ে যাচ্ছো।”
খাবার টেবিলে এ কথা অর্নব বলেনি। বলেছিল ঘরে এসে যখন নিরা রাতে ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে হাতে লোশন মাখাতে মাখাতে তার হাত দুটো অর্নবের কথাটা শুনে থমকে গিয়েছিল। বলাই বাহুল্য একটু লজ্জাও লাগছিল তার। লোকটা তাকে দেখে তাহলে! সেদিন নিরা অবাক হয়েছিল খুব। কিন্তু তার কোনো প্রতিক্রিয়া মুখে ফুটতে দিল না। চুপচাপ সে নিজের কাজে মন দিল। সত্যি বলতে সে ভাবছিল ডক্টর তার সবদিকে খেয়াল রাখছে। তার ভালো লাগছিল বিষয়টা।
কিয়ারা তখনই দু’হাতে দুটো কফি মগ নিয়ে আসল। নিরার মুখোমুখি বসল। দুজনেই চুপচাপ বসে পরিবেশটা উপভোগ করছিল। এমন সময় পাশের ঝোপ থেকে কিছু একটার শব্দ পেল। চকিতেই দুজন দুজনের দিকে তাকাল। তার মানে দুজনেই শব্দটা শুনেছে। নিরা বলল, ” কাঠবিড়ালি হবে।”
কিয়ারা সায় দিল তার কথায়। কিয়া বলল, ” লিরা তোমার লেখা কতদূর? ”
“এইতো চলছে।”
“আমার অবাক লাগে লিরা তোমাকে দেখে।”
“কেন বলো তো কিয়া?”
“এই যে মানুষ সবসময় নাম চায়। সে চায় তার নামটা মানুষ জানুক তার কাজের মাধ্যমে। বর্তমানে তুমি এমন এক জায়গায় পৌঁছেছো যেখানে মানুষ তোমার নাম শুনলেই শ্রদ্ধা করে। ভালোবাসে। আর তুমি কিনা একটা ছদ্মনাম ব্যবহার করছো!”
নিরা হাসল। আরাম করে কফিতে চুমুক দিয়ে বলল, “এই যে আমার বইয়ে যখন ইপ্সিতা রাহমান নামটা দেখি তখন তো আমার মন ভরে যায়। আমার নিরা হলেও মানুষ আমায় ঠিক ওই নামেই জানে। তারা ইপ্সিতা রাহমানের বই পড়তে চায়, নিরার বই না। তাহলে দিনশেষে আমি ইপ্সিতা হই বা নিরা লেখাগুলো তো আমার সৃষ্টি। আমি বিশ্বাস করি আমার সৃষ্টি আমারই থাকবে। সে আমার হাজারটা নাম থাকুক।”
“তোমার কখনো মনে হয় না মানুষ তোমাকে দেখুক। তোমাকে রাস্তায় দেখে অটোগ্রাফ নিতে আসুক। তোমার সাথে দেখা করতে আসুক?”
“না আমার এমন ইচ্ছে কখনো হয় না। আমার পরিচয় পাঠকের সাথে আমার লেখার মাধ্যমে। সেখানে আমি জরুরি নই। আমার লেখা তাদের কাম্য। একটা বইয়ের পর যখন তারা আরেকটি বই পড়ার আগ্রহ দেখায় তখন আমার প্রাপ্তির খাতা বরাট হয়ে যায়। যদি তারা আমার সৃষ্টিকে ভালো না বাসতো তবেই তো আমি ব্যর্থ হতাম। এই দেখো পেজে একটা লেখা দেয়ার সাথে সাথে হাজার হাজার রিয়াক্ট, কমেন্ট আসে এতে করে বুঝা যায় তারা আমাকে কতটা ভালোবাসে। এর চেয়ে বড় আর কী চাওয়ার থাকে একজন লেখকের?”
“কিন্তু তোমাকে তো তাদের দেখার ইচ্ছে হতে পারে। তোমার পার্সোনালিটি সম্পর্কে তারা জানতে আগ্রহী। সে সম্পর্কে তুমি কী বলবে?”
“দেখো কিয়া কেউ আমাকে জানতে চাইলে আমার লেখার মাধ্যমে জানবে। একজন লেখকের লেখার মাধ্যমে তার ব্যক্তিত্ব ফুটে উঠে সে তার চেতনায় না হলেও অবচেতনে হতে পারে পুরোটা নয়। তারপরও কিছুটা নিশ্চয়ই বুঝা যায়।।”
নিরা থামল কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে। একটু সময় নিয়ে বলল, ” আর বাকি রইলো আমাকে দেখার কথা। তাহলে শোন যাদের কাছে আমি প্রিয় তাদের কাছে আমার একটা চিত্র নিশ্চয়ই এখন কল্পনায় চলে এসেছে। আমি সেটা আর ভাঙতে চাই না। একটা গল্প বলি তোমায় আমি যখন লেখালেখি শুরু করি তখন শুধু একজন আমার আসল পরিচয় জানত সে আমার পাঠক ছিল। জানি না কেন ধীরে ধীরে সে আমার আপন হয়ে উঠে। এবং সম্পূর্ণ অজানা, অচেনা একজন মানুষকে আমি বিশ্বাস করে ফেলি। নিজের পরিচয় নিজের ছবি সব দেই তাকে। আমি জানি সে বিশ্বস্ত। তখন সে প্রায় শুনতো অনেকেই আমার পেছনে বলত আমি যদি নিজের ছবি দেই তবে তাড়াতাড়ি জনপ্রিয় হতে পারব। আজকাল সুন্দরী লেখকদের নাকি পাঠক বেশি। তারা আরও বলত আমি লেখালেখিতে পিছিয়ে থাকব শুধু এই লুকিয়ে থাকার জন্য। কোনো প্রকাশক আমার বই বের করবে না কারণ আমি ছবি দেই না পেজে। এসব শুনে খুব হাসতাম আমি। সেই আপুকে বলতাম আমি ভাগ্যে বিশ্বাসী। যদি আমার বই বের হবার হয় তবে এমনিতেই হবে। এর জন্য নিজের ছবি দিতে হবে না।আপন বলতে সেই আপুটাই আমার লেখালেখির কথা জানে। আর কোনো আত্মীয়ও তা জানে না। এ থেকে একটা বিষয় বুঝা যায় মাঝে মাঝে আত্মার সম্পর্কও বড় হয়ে যায়।”
নিরা এত সুন্দর করে বুঝানো দেখে কিয়া হার মানল। সে বুঝল এ মেয়ের সাথে কথায় সে পারবে না। কিয়া বলল, “তোমার বই যে এখন বেস্টসেলার কেমন লাগে তোমার?”
“ভালো লাগে।” ছোট করে বলল নিরা।
“শুধু ভালো? ”
“হুম শুধু ভালো। তবে আরেকটা বিষয় বেশ লাগে আমার একদিন যে প্রকাশকরা আমার বই ছাপাবে বলে ঘুরিয়েছে। তারপর ভালো লেখার স্বত্তেও ফিরিয়ে দিয়েছে তারাই এখন অহরহ ম্যাসেজ করে আপু আপনার একটা পান্ডুলিপি লাগবে। এ বিষয়টা বেশ লাগে। এটা থেকে বুঝতে পারি জীবনের মোড় ঘুরে। সৃষ্টিকর্তা মানুষকে ফেরান না। সবকিছুই দেন যদি চাইতে জানে। তাই আমার বইয়ের প্রথম পাতায় নবীন লেখকদের জন্য লেখা থাকে হার মানতে নেই। আজ যে সময় অন্যের তা কাল তোমার হবেই। শুধু লেখালেখির জন্য নয়। জীবনের সব ক্ষেত্রে এটাই মানা উচিত। না এর জন্য আমার কোনো অহংবোধ নেই। আমাকে রিজেক্ট করেছে এমন প্রকাশনীকে আমি পান্ডুলিপি দিয়েছি তাদের কখনো ফিরিয়ে দেইনি। তাদের কথা রাখাটাই আমার ভালো লাগা”
কিয়া অবাক হয়ে দেখছে তার সামনে বসে থাকা মেয়েটাকে। বয়স ছাব্বিশ কী সাতাশ অতটাও বেশি নয় কিন্তু তার কথা বলা এতটা সুন্দর যে মুগ্ধ না হয়ে পারে না। কত সহজে কত কঠিন কথা বলতে পারে মেয়েটা। জীবন মানুষকে অভিজ্ঞ বানিয়ে দেয়। ঠোকর খেতে খেতে মানুষ শেখে। সে চাইলেও লিরার মতো করে ভাবতে পারবে না। কারণ লিরার জীবনবোধ অনেক বেশি জাগ্রত যা তার মতো আলালের ঘরের দুলালি মেয়ের হবে না।
কিয়া প্রসঙ্গ পাল্টে বলল, “লিরা তোমার স্বামীকে কেন বলোনি?”
“তাকে বলার সেই সুযোগটাই আমি পাইনি। যখন ভেবেছি বলব তখন একটা ঝড় এসে সব এলোমেলো করে দিল। আমি জানি সেই মানুষটা আমার লেখালেখির কথা শুনলে কতটা খুশি হত। সে আমার লেখার ফ্যান অথচ আমি তাকে বলতে পারিনি ইপ্সিতা আসলে নিরা। এ না বলার যন্ত্রণাটা খুব বেশি কিয়া। আমাদের জীবন আমাদের নিয়ে কত রকমভাবেই না খেলে।”
নিরা থামল তার মনটা ধীরে ধীরে বিষন্নতায় ছেয়ে যাচ্ছে। একটু থেমে আবার বলল,”জানো কিয়া আজও সে যখন আমার লেখার প্রশংসা করে মাঝে মাঝে রিভিউতে আমার ভুলগুলো তুলে ধরে খুব ভালো লাগে। মনে হয় আমার অভিভাবক সে। যে আমার সব ভুলগুলো দেখিয়ে দিবে। যাতে ভবিষ্যতে আমি আরও অনেক দূর এগিয়ে যেতে পারি। আমার প্রতিটি বই প্রকাশের পর আমি অপেক্ষায় থাকি কখন অর্নব আমার বইয়ের রিভিউ দিবে। এমনিতেই তো কথা হয় না। কিন্তু তার রিভিউ বা মন্তব্যে আমি তাকে খুঁজে পাই, অনুভব করি।”
কিয়ার চোখ ছলছল সে বলল, “লিরা এত ভালোবাসার পর মানুষ দূরে কীভাবে থাকে বলো তো? কেনই বা থাকে?”
নিরা তুষারপাতের দিকে হাত বাড়িয়ে দিল। দুহাত ভরতি তুষার নিয়ে মুখে মেখে নিয়ে বলল, হয়তো এটাই প্রকৃতির নিয়ম কিংবা মানুষের বানানো নিয়ম। আমার মাঝে মাঝে কী মনে হয় জানো? প্রকৃতি মানুষের মনে তার প্রিয়জনের জন্য অগাধ ভালোবাসা দিয়ে, আবার দূর করে দিতে আনন্দ পায়। যখন আমরা একসাথে ছিলাম তখন আমরা আমাদের মনের অনুভূতি বুঝতে পারলাম না। ঠিক যখন বুঝলাম তখন বড্ড দেরি হয়ে গেল। চেয়ে বিগত হওয়া সময়গুলোকে আমরা পেলাম না। শুধু হাহাকার আর না পাওয়ার যন্ত্রণায় দগ্ধ হচ্ছি রোজ। মানুষের মনে ভালোবাসার সৃষ্টি করে, তা কেড়ে নেয়াই বোধহয় নিষ্ঠুর প্রকৃতির নিয়ম।”
নিরা একটু দম নিয়ে আবার বলল, “জানো কিয়া যদি আমার হাতে সুযোগ থাকত তবে আমি পুরো পৃথিবীর মানুষকে জানিয়ে দিতাম ভালোবাসাকে যেন ভালোবাসায় বাঁধে। ভালোবাসার মানুষের সাথে একটু মুহূর্ত যেন অবহেলায় হারিয়ে না পেলে। পরে খুব আফসোস হয়, খুব! ছোট্ট জীবনের সবগুলো মুহূর্তকে নিজের করে আপন করার মাধ্যমেই জীবনের সার্থকতা।” নিরার চোখের কোল বেয়ে বিন্দু বিন্দু জল গড়িয়ে পড়ছে। অথচ কথাগুলো বলার সময় ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক।
কিয়া বিস্ময় চোখে নিরার দিকে তাকিয়ে আছে। ভাবছে মেয়েটা অদ্ভুত! একটু বেশিই অদ্ভুত! কী দারুণ ভাবে সব কষ্টকে খুব যত্ন করে লুকিয়ে রাখতে জানে। কী দারুণভাবেই না ভালোবাসতে জানে। আবার সেই ভালোবাসাকে হৃদয়ের গহীন থেকে গহীনে আড়াল করতে জানে। পৃথিবীতে খুব কম মানুষকে এত শক্তি দিয়ে সৃষ্টিকর্তা পাঠান। এরা এত নিখুঁতভাবে নিজের যন্ত্রণাগুলোকে তুচ্ছ করে সামনে এগিয়ে যায়। কিয়ার একটা কথা এ মুহূর্তে মনে হচ্ছে গভীর ভালোবাসা শুধু কাছে টানে না। দূরেও ঠেলে দেয়। দূরে, বহুদূরে!
সন্ধ্যা নামার পরে
ঊনিশ
কিয়ারা হাতের আঙুল দিয়ে চোখের পানি মুছে নিরার দিকে তাকাল। নিররা কষ্টগুলো কেন যেন তাকে স্পর্শ করছে। সে জানে না কেন! তার থেকে দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, জাতীয়তা, এমনকি ধর্ম পর্যন্ত আলাদা একটা মেয়েকে কী করে এতটা ভালোবেসে ফেলেছে সে। খুব সাধারণ ছিল তাদের পরিচয়। প্রথম দিন শাড়ি পরা একটা মেয়েকে তাদের ভার্সিটিতে দেখে অবাক হয়েছিল সে৷ সচরাচর কোনো প্রবাসী মেয়েও এমন ড্রেস আপে চলাফেরা করে না। বিদেশের মাটিতে এসে সবাই নিজেকে এতটাই পাল্টে ফেলে যে তাদের ভিনদেশী বলে চেনা খুব ভার হয়ে যায়। যেখানে সবাই নিজেকে প্রতিনিয়ত আধুনিকতার ছোঁয়ায় এগিয়ে নিয়ে যেতে চায়, সেখানে নিজের দেশের সংস্কৃতিকে বিদেশের মাটিতে উপস্থাপন করার মত মনমানসিকতা নিরাকে দেখে অবাক হয়েছিল সে। অনেকটা কৌতূহল বশত নিরার কাছে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল সেদিন। দুজনেই গাড়ির অপেক্ষা করছিল। দুজনের চোখাচোখি হতেই দুজনেই সৌজন্য হেসেছিল। কিয়ারা অনেক চেষ্টা করেও নিজের কৌতূহল চেপে রাখতে না পেরে শেষ পর্যন্ত জিজ্ঞেস করে ফেলল, “কিছু মনে না করলে একটা কথা বলি?”
“অবশ্যই?” নিরা আগের হাসিটা ধরে রেখেই জবাব দিল।
“তুমি কোন দেশি? আসলে তোমার পরনের পোশাকটা আমার বেশ ভালো লেগেছে তাই জিজ্ঞেস করছি।”
“আমি বাংলাদেশি। আমাদের দেশের ঐতিহ্য বহন করে এই পোশাক। আমার খুব প্রিয়।”
কিয়ারা মিষ্টি হেসে বলল, “তুমি অনেক সুন্দর।”
কাউকে সুন্দর দেখালে সেটা বলে ফেলা এখানকার আর দশটা বিষয়ের মতোনই সহজ। এখানে প্রশংসাকে কেউ খারাপভাবে নেয় না। বাংলাদেশের মেয়েদের মধ্যে যেমন অন্যের রূপকে হিংসা করার প্রবৃত্তি রয়েছে এখানে তেমনটা নেই। নিরাও বলল, “তুমিও অনেক সুন্দর।”
সেই থেকে আলাপ। দুজনে কথায় কথায় জেনে গেল তারা একই ভার্সিটিতে পড়ে। তারপর প্রায় দেখা হওয়া থেকে টুকটাক কথা বলা। এর থেকেই সে জানতে পারল কিয়ারা একা তার বাবার কেনা বাড়িতে থাকে। তার বাবা ব্যবসায়ের কাজে এখান থেকে দূরে থাকলেও বাড়িটি প্রয়োজন হতে পারে বলে কিনে রেখেছিলেন। যখন কিয়ারা এখানে পড়াশোনা করবে বলে জানাল তখন উপর তলার ভাড়াটিয়াদের বিদায় করে দিল মেয়ের জন্য। এরপর থেকে কিয়া একা থাকে। যখন সে শুনল নিরা বাসা খুঁজছে তখনই সে নিরাকে তার সাথে থাকার অফারটা দিল। নিরা অনেক ভেবে জানাল সে তার বাসায় থাকতে পারে তবে তাকে ভাড়া নিতে হবে। কিয়ারা রাজি হলো। সেই থেকে দুই দেশের দুজন মেয়ে একসাথে থাকতে শুরু করল। ধীরে ধীরে একে অপরের আপন হয়ে উঠল। আজ কিয়ারার মনে হচ্ছে এ মেয়েটার ভেতর ঐশ্বরিক প্রদত্ত টান আছে, যার বলে সে মানুষকে নিজের দিকে টানতে পারে, আপন করতে পারে। তাই তো তার মতো আত্মকেন্দ্রিক মেয়েও কিনা জাদুবলে নিরাকে ভালোবেসে ফেলল! আরও একটি ভাবনা তার প্রায় হয় এত ভালো একটা মেয়ের ভাগ্য কী করে এতটা খারাপ হতে পারে! তবে কী পৃথিবীতে ভালো মানুষদেরই সৃষ্টিকর্তা বেশি কষ্ট দেন! আর কেউ না জানুক সে জানে ভেতর থেকে কতটা একা, কতটা অসহায় নিরা। প্রায় রাতে ঘুমায় না সে। বারান্দায় বসে কাটিয়ে দেয়। কখনো কখনো কান্নার শব্দ শুনতে পায় সে। বুঝতে পারে নিরা কাঁদছে। এত দারুণ একটা মেয়ের এমন অবস্থা দেখে যন্ত্রণা হয় তার। আড়ালে থাকা ঈশ্বরকে জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে কেন শুধু ভালো মানুষেরাই কষ্ট পায়? কেন দিন শেষে তারা একাই রয়ে যায়?
কিয়ারা অনেকক্ষণ ধরে অনেক কথা ভাবল। তারপর নিরার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, “নিরা একটা প্রশ্ন করব উত্তর দেবে? এর আগেও অনেকবার করেছি উত্তর দাওনি তুমি। এখন দেবে প্লিজ?”
নিরা আজ চোখের জল মোছার চেষ্টা করল না। হাসার চেষ্টা করে বলল, “বলব। আগে কী জানতে চাও তা তো বলো?”
কিয়ারা বলল, “তোমাদের বিচ্ছেদের কারণ কী? আমি এতদিনে এটা বুঝতে পেরেছি তুমি তাকে খুব ভালোবাসো। তবে এত দূরত্ব কেন?”
নিরা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তারপর বলল, “ঠিক আছে তোমাকে সব বলব। তবে তোমাকে প্রথম থেকে ধৈরর্য নিয়ে শুনতে হবে। যদি মাঝখানে এসে বলো শেষটা বলে দিতে তাহলে সবটা বুঝাতে পারব না। আর আমিও বলব না। কিয়া খুশি হলো। সে বলল, ” যতদিন ইচ্ছে সময় নাও। তাও বলো?”
নিরা ঠান্ডা হয়ে যাওয়া কফি কাপে চুমুক দিয়ে বলল, “আমাদেr বিয়ের পর আমরা কাশ্মীর ঘুরতে গিয়েছিলাম। সেখানে থেকে যখন দেশে ফিরছিলাম তখনই সমস্যা গুলো একটু একটু করে বাড়ছিল। আমি জানতামই না, নিজের অজান্তে যে স্বপ্নগুলো আমি সবে মাত্র মনের কোণে সাজাচ্ছি তখনই সবকিছু ভেঙে দেয়ার জন্য আমার জীবনে আসবে কঠিন কিছু সত্যি যার সম্পর্কে আমি কোনোদিন কোনোকিছু বাস্তব তো দূর ভাবতেও পারিনি। জীবনের এমন অদ্ভুত মোড় সবকিছু বিধ্বস্ত করে দিবে তা কে জানত!”
নিরা থামল কফিতে আরেকটা চুমুক দিয়ে আবার বলল, “কাশ্মীর থেকে এসে আমরা খুশি ছিলাম। বাড়ির পরিবেশ যেমন রেখে গিয়েছিলাম তেমনই ছিল। ফিরতেই দিদান অনেকক্ষণ আমায় বুকে জড়িয়ে রেখেছিলেন। সেদিন বুঝেছিলাম মানুষটা আমায় সত্যি ভালোবেসেছে। ওহিও এসে জানাল আমাকে খুব মিস করেছে। আমার শ্বশুর জানালেন আমাকে ছাড়া উনার ঘর নাকি ফাঁকা ফাঁকা লেগেছিল। শুধু এক শ্বাশুড়ি ছাড়া সবাই আমার জন্য ছটফট করেছে। এ প্রথম আমি পরিবারের ভালোবাসা কী বুঝতে পারলাম। বুঝতে পারলাম পরিবার শব্দটির অর্থ কী!”
সেদিন সবার সাথে দেখা করে রুমে এসে দেখি অর্নব চেঞ্জ করছে। আমাকে দেখে মিটিমিটি হাসছিল। তা দেখে আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম, “আমাকে কী জোকার মনে হয়? আমাকে দেখে এভাবে হাসার কী হলো।” বলে রাখা ভালো আমাদের সম্পর্কটা তখন কিছুটা স্বাভাবিক ছিল।
আমার প্রশ্ন শুনে তার হাসি আরও উজ্জ্বল হলো। সে বলেছিল, “আমার বাড়িতে আমার থেকে সবাই দেখি তোমায় নিয়ে বেশি ভাবছে! কী ব্যাপার বলো তো জাদু-টাদু জানো নাকি?” অর্নবের প্রশ্ন করার ঢঙে নিরা হেসে ফেলল। বলেছিলাম, “নিরার কোনো জাদুর দরকার হয় না। নিরা এমন যে সবাই তাকে ভালোবাসে।”
অর্নব সেদিন আমার কনফিডেন্ট দেখে ঠোঁট টিপে হেসে বলেছিল, “এত কনফিডেন্ট?”
“হুম এতটাই।”
“তাহলে একটা কথা বলো তো মা তো কিছুই বলল না। তাহলে মা কেন তোমায় ভালোবাসতে পারলেন না?”
আমি থমকালাম। তারপর হেরে যাচ্ছি ভেবে চোখেমুখে শক্ত ভাব এনে বলেছিলাম, “কিছুদিনের মধ্যে মা আমাকে ভালোবেসে ফেলবেন। এটা আমার চ্যালেঞ্জ।”
অর্নব তখন মিটিমিটি হাসছিল তা দেখে আমি ভ্রু কুচকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, “আবার কেন হাসছেন?”
“তুমি বলছো এ বাড়ির সবাই কিছুদিনের ভেতর তোমায় ভালোবেসে ফেলবে তাই তো?”
“একদম তাই।” খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছিলাম।
অর্নব বাঁকা হেসে বলেছিল, “সবাই?”
“হুম সবাই।”
“আমিও?”
“হুম আপনিও!” কথাটা বলার পর আমার মনে হয়েছিল এটা আমি কী বললাম! এ বজ্জাত, কাঠখোট্টা ডক্টর তাহলে এটা জানার জন্য এতক্ষণ আমাকে জেরা করছে! আমিই বা কেমন বোকার মতো বলে দিলাম সেও আমাকে ভালোবাসবে! তখন পাগলটার দিকে তাকিয়ে দেখেছিলাম কেমন বাঁদরের মতো হাসছে। আমার খুব রাগ হচ্ছিল।
সে আবার বলেছিল, “এত আত্মবিশ্বাস কোথায় থেকে আসে হুম?”
মনে মনে ভাবলাম না এ লোকের কাছে হেরে যাওয়া যাবে না। তখন বলেছিলাম আপনি কী আমাকে চ্যালেঞ্জ কুরছেন নাকি?”
“ধরে নাও তাই। আর হ্যাঁ আরেকটি কথা এ চ্যালেঞ্জটায় তুমি গোঁ হারা হারবে।”
কেন যেন অকস্মাৎ আমার খুব রাগ চেপে গিয়েছিল। রাগে মনে হচ্ছিল নিজেই হাওয়ায় ভাসছি। তাই তাকে বলে দিয়েছিলাম, “আপনাকে আমি চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছি। এমন একদিন আসবে যখন আপনি প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে মিস করবেন। আমাকে এক পলক দেখার জন্য আহাজারি করবেন কিন্তু চাইলেও পারবেন না। কারণ আমি আপনার থেকে অনেক দূরে চলে যাব। আপনার প্রতিটি রাত আমাকে ভেবে শেষ হবে। প্রতিটি সকাল শুরু হবে আমাকে খুঁজে।”
আমার কথাগুলো এতটাই শক্ত ছিল যে মানুষটার ঠোঁটের কোণে যে দুষ্টুমি খেলা করছিল তা মুহূর্তে সরে গেল। যেন সে ঈষৎ কেঁপে ওঠেছিল। তার সুকুমার মুখখানা আরক্ত, চোখের তাঁরায় বিস্ময়! অদ্ভুত ভাবে তাকিয়েছিল সে। তারপর তার ঠোঁট হালকা নড়ল কী কাঁপল বোঝা গেল না। শুধু একটা অস্পষ্ট শব্দ ছিটকে এলো, “আমাকে অভিশাপ দিও না নিরা।”
ঠিক তখন আমার চেতনা ফিরল। ভাবলাম হঠাৎ এমন রাগ কোত্থেকে উড়ে এলো! আর কেনই বা আমি এমন কথা বললাম! আমি জানি সে আমাকে বিয়ে করবে না। আমি জানি সে শুধু দিয়ার তবে এমন ভাবনাই বা কেন এলো আমার? সে বোধহয় আমার অবস্থা বুঝতে পেরেছিল। তাই পরিস্থিতি স্বাভাবিক করতে বলেছিল, “এমনটা কখনো হবে না মিস নিরা। আমি কখনো তোমাকে মিস করব না।”
জানি না কেন সেদিন তার এ কথাটি আমার বক্ষস্থলকে ক্ষত – বিক্ষত করে তুলেছিল। একটু আগের রাগটা উড়ে গিয়ে থোকা থোকা দুঃখ এসে দখল করে নিচ্ছিল আমার হৃদযন্ত্রের চারপাশে। কেমন একটা ব্যথা অনুভব করছিলাম পুরো শরীরে। অর্নব টি -শার্ট গায়ে জড়িয়ে নিচে চলে গেল। আমি সেদিন আর রুম থেকে বের হইনি। আমার শরীর ভীষণ খারাপ লাগছিল। হয়তো এ কয়দিনের জার্নির জন্য ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু তখন আরও একটি বিষয় খেয়াল করলাম পুরোটা পথ অথবা বাড়ি এসেছি অবধি এতটুকু খারাপ বা ক্লান্ত লাগেনি। তবে এখন কী হলো যে পুরো শরীর জুড়ে ক্লান্তি নেমে এলো! তারপর নতুন একটা বিষয় আবিস্কার করলাম। মানুষ শরীরের পরিশ্রমে যতটা না ক্লান্ত হয়, তারচেয়ে বেশি ক্লান্ত হয় মানসিক পরিশ্রমে। যখন মন ভালো থাকে শরীর তখন সহজে ক্লান্ত হতে চায় না।
মানুষের শরীর থেকে মনের দিকে বেশি খেয়াল রাখা উচিত।
ফ্রেশ হয়ে এসে শুয়ে পড়লাম। ওহি এসে খেতে ডেকেছিল। মাথা ধরেছে বলে কাটিয়ে দিলাম। দিদান মেডিসিন আর খাবার উপরে আমার রুমে পাঠিয়ে দিলেন। খাবারটা সেভাবে রেখেই ঘুমিয়ে পড়লাম। ঘুম যখন ভাবে তখন রাত নয়টা। দেখলাম ঘর অন্ধকার শুধু ড্রিম লাইটের নীল আলোয় পুরো ঘরে ছড়িয়ে আছে। দেখলাম আমার পাশে শুয়ে ফোনে কিছু একটা করছে অর্নব। আমার নড়াচড়া বুঝতে পেরে সে বলেছিল, “ঘুম ভাঙলো? মাথা ধরা গিয়েছে?”
“হুম গিয়েছে।” ছোট করে উত্তর দিলাম
“ফ্রেশ হয়ে নাও। খেতে হবে। এসেছো পর্যন্ত কিচ্ছু খাওনি। আরও বেশি মাথা ব্যাথা করবে।”
আমার তখন মুখ তেতো তেতো লাগছিল। কিছুই খেয়ে ইচ্ছে করছিল না। তাই বলেছিলাম, “খাব না।”
“আচ্ছা ফ্রেশ হয়ে এসো তাহলে।” তার সোজাসাপটা উত্তর।
আমি উঠে ফ্রেশ হয়ে এলাম। যখনই আবার ঘুমাতে যাব তখন সে আমার হাতটা খপ করে ধরে ফেলল। তারপর আঁতকে উঠে বলেছিল, “তোমার শরীর পুড়ে যাচ্ছে জ্বরে। বলোনি কেন নিরা?”
“আমি আসলে বুঝতে পারিনি।”
“বুঝতে পারোনি মানে?” তার গলা চড়ল।
তারপর আমি হাতটা তার মুঠোয় থেকে ছাড়িয়ে নিতে গেলে সে আরও বেশি শক্ত করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলেছিল, “একটা টু শব্দও করবে না। যা বলব শুধু তাই করবে।”
তারপর আমাকে খাটে বসিয়ে পাশের টেবিল থেকে খাবার নিয়ে আমার সামনে রাখল। আমি খাব না বলায় নিজেই খাবার তুলে আমার মুখের সামনে ধরেছিল। আমি চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকালাম। তার চোয়াল শক্ত। চোখ ভাবলেশহীন। এমন একটা ভাব যে না খেয়ে পারলাম না। এ প্রথম আমি স্বামীর যত্ন পেলাম। না অর্নব আমাকে কখনো অযত্ন করেছে তা নয়। আমাদের সম্পর্কের বাঁধা ধরা গণ্ডির ভেতর যা করার তাই করেছে। খুব সতর্কতার সাথে। আমাকে সম্মান করেছে। কিন্তু এভাবে এত কাছ থেকে স্বামীর হাত থেকে সেই প্রথম বারের মতো খেয়েছিলাম। সেদিনই প্রথম জেনেছিলাম জ্বরের তেতো মুখেও খাবার এতটা সুস্বাদু হয়! সেদিন জেনেছিলাম স্বামীর যত্ন এতটা সুখের হয়! সেদিনই জেনেছিলাম স্বামীর শাসন এতটা ভালো লাগার হয়!
শুধু জানিনি সেই প্রথম এবং শেষবারের মতো সেসব সুখগুলো আমার জীবনে এসেছিল। ক্ষণিকের জন্য! যার স্মৃতির আজও বয়ে বেড়াচ্ছি আমি।
চলবে
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা
চলবে
প্রজ্ঞা জামান দৃঢ়তা