#সন্ধ্যে_নামার_পরে 🔞
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-১৮
আয়মান লতিফদের বাড়ির সেই ঝোপঝাড় এর দিকে গেলো। যেখান দিয়ে যাতায়াত করা যায়। ঝোপের ভেতরে ঢুকে গেলো আয়মান। এগিয়ে গেলো সেই দোকানীর বাড়ির দিকে। এগিয়ে গিয়ে দেখলো লতিফদের বাড়ির পিছনের অংশ এবং দোকানীর বাড়ির পিছনের অংশ মাঝ বরাবর নেট দিয়ে সীমাবদ্ধ করে রেখেছে। দোকানীর বাড়ি যাওয়া আসার জন্য নেটের কিছু অংশ খুলে রাখা হয়েছে। এ পাশটায় এতটাই নিরব যে চেঁচালেও কেউ শুনবে না। আয়মান চারপাশ ভালো করে একবার দেখে নিলো। তারপর দোকানীর বাড়িতে পিছন থেকে উঠোনে এসে দাঁড়ালো। বাড়িতে কেউ আছে কিনা বলে বেশ কয়েকবার করে হাঁক ছুড়লেও কোনো সাড়াশব্দ পায়নি আয়মান। হুট করে কোথা থেকে এক পিচ্চি মেয়ে ছুটে এলো আয়মানের দিকে। মূলতঃ সে আয়মানকে দেখে আসেনি। মেয়েটি একটা রিক্সার চাকার টায়ার নিয়ে খেলছিল। হঠাৎ চাকা এদিকে মোর নিয়ে চলে আসে। চাকার পিছু ছুটে মেয়েটা এদিকে আসে।
মেয়েটা আয়মানকে দেখে একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলো,
“আফনে কি এই বাড়িতে নতুন আইছেন ?”
আয়মান বলল,
“ঠিক তেমনটা না। আমি এ বাড়ির মানুষদের খুঁজতে এসেছি।”
মেয়েটা বলল,
“এই বাড়িতে দুইডা পঁচা ব্যাডা থাকে। হেগো ক্যান খুজেন ? তাইলে আফনিও কি হেগো মতো খারাপ লোক ?”
আয়মানের মতো সন্দেহের বাসা বেঁধে গেলো মুহুর্তেই। আয়মান কিছুটা স্তব্ধ হওয়ার মতো কয়েক সেকেন্ড চুপ থেকে মেয়েটাকে বলল,
“এদের তুমি পঁচা কেনো বলছো ? এখানে কি কোনো মহিলা মানুষ নেই ?”
মেয়েটা মাথা নাবোধক নাড়িয়ে বলল,
“না নাই। ব্যাডা মানুষ ভালা না তো ব্যাডি মানুষ কেমনে বাড়িতে থাকবো ?”
আয়মান কিছুটা মুচকি হেসে বলল,
“তুমিতো এত ছোট মানুষ। তারা ভালো না খারাপ বা এ বাড়ির মহিলারা কেন এখানে থাকেন না সেসব উত্তর তুমি কিভাবে দিচ্ছো ?”
মেয়েটা বলল,
“হ আমি জানি। আহেন আমাগো বাড়িতে। আমাগো আম্মায় ভালো কইতে পারবো।”
আয়মান দ্বিতীয়বার না ভেবেই মেয়েটার সঙ্গে তাদের বাড়িতে চলে যায়। ছোট মেয়েটার নাম টুসি। টুসি ওদের বাড়িতে ঢুকতে ঢুকতে তার মাকে ডাকলো। মেয়ের ডাকে মা বের হয়ে এলেন। টুসি দৌড়ে গিয়ে একটা জলচৌকি এনে বসতে দিলো আয়মানকে। আয়মান নিজের পরিচয় জানালো টুসির মাকে। তারপর দোকানীদের বাড়ি সম্পর্কে জানতে চাইলো। টুসির মা বলল,
“ওই বাড়ির দুইডা ব্যাডা একটাও ভালা না। দোকানদার হাসেমের বউ দুঃখে-কষ্টে হাসেমরে ছাইড়া চইলা গেছে।”
“কিসের দুঃখ, কষ্ট ছিল ?”
“ছিঃ ছিঃ ছিঃ, কি যে এক বিচ্ছিরি কাহিনি। বিয়া করছে এক ব্যাডায় কিন্তু লগে থাকতো দুই ব্যাডায়। মানে হাসেম আর হাসেমের ভাই কাশেম। মাইয়াডা অনেক চেরেস্টা করছিন নিজেরে সতী পুতি রাখবার লাগি। তয় এসব জঘইন্ন ব্যাডা মানুষের লাগি কি শান্তি আছে। দশজন জানলেও শরম। ওই বাড়ির আশেপাশে কেউ যায় না। কাশেম ব্যাডার স্বভাব একেবারেই ভালা না। বেডি মাইন্সের দিকে নজর তো দেয়ই, আবার সুন্দর পোলাগো দিকেও নজর দেয়। ছিঃ ছিঃ ছিঃ… আল্লাহগো এই ব্যাডাগোরে যেন উচিত শাস্তি দিয়া মারে।”
আয়মান আর বেশি ঘাটলো না। সেখান থেকে চলে আসলো। ফিরে চলে আসার সময় দেখলো হাসেমের দোকান বন্ধ। আয়মানের কাছে ব্যাপারটা ধীরে ধীরে পরিষ্কার হয়ে আসছে। তবে এসব কাজে তারাহুরো করতে নেই। তাহলে ভুল হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। আয়মান থানায় ফিরে গেলো।
__________
ফাইজার হাতের গরম গরম নুডলস খেয়ে সবাই জড়ো হয় রেসমির রুমে। যদিও এখানে রায়হানের থাকার কথা না। তবুও যেন তার সবখানেই থাকা চাই। মিদুল ফাইজার ভাই হলেও রায়হানের মনে কেমন ঈর্ষা জমাট বাঁধতে শুরু করেছে। মনের এই ঈর্ষা শেষ এ কোন রূপ নেবে সেটাই দেখার বিষয়।
মিদুল তার কর্মক্ষেত্র আর বাড়ির সবার কথা বলছিল। রায়হানের সেদিকে তেমন কোনো আগ্রহই নেই বললে চলে। রায়হান এক পর্যায়ে তার মায়ের ঘর থেকে বের হয়ে নিজের ঘরে চলে যায়। রেসমি ফাইজাকে বলল,
“আফরা, প্ল্যানিংটা কি এখন করবে নাকি পরে ?”
ফাইজা বলল,
“আম্মু, তুমি যা ভালো মনে করো সেটাই করো।”
রেসমি বলল,
“ঠিক আছে, তাহলে এখন প্ল্যানিং করা ক্যান্সেল। রায়হান দুপুরের পর যদি ঘুমোয়, তখন আমরা মিটিং এ বসবো। তবে বাহিরে, এখানে না।
ফাইজা মাথা ঝাকিয়ে সম্মতি জানালো। রেসমি মিদুলকে জিজ্ঞেস করলো,
“তোমার সাথে যে সিয়াম ছিল, সে কোথায় ? সে আসেনি কেন ?”
মিদুল বলল,
“সিয়াম বলেছে আজকে তার বোনের কলেজে যাবে বোনকে না জানিয়ে। সিয়ামের নাকি কিছু সন্দেহ হচ্ছে।”
ফাইজা গিয়ে রেসমিকে জড়িয়ে ধরে বসে পড়লো। অপেক্ষা এখন শেষ মিশনের।
________
দোলনকে শুইয়ে দেয়া হয়েছে খুঁড়ে রাখা মাটির গর্তে। দোলনের সমাপ্তি এখানেই হয়ে গেলো। দোলনের পোশাক, বইখাতা-ব্যাগ যা ছিল সব দোলনের সাথেই মাটি চাপা দিয়ে দেয়া হলো। দোলনের শেষ নিশ্বাস তখনো ছিল। কিন্তু তাকে পুরোপুরি একজন মৃত মানুষ হিসেবেই পুতে ফেলা হয়। শেষ বেলায় দোলন না পেলো আপন কারো দেখা, না পেলো শান্তি আর না পেলো জানাজা। নিজের ভাগ্যকে দোষ দেয়া ছাড়া এই মুহুর্তে আর কিছুই করার নেই। দোলনকে মাটিচাপা দিয়ে রেপিস্টগুলো বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে বের হয়ে গেলো। যেতে যেতে জামান সোহেলকে বলছে,
“কিরে ভাই, হাফ বেলা খেলাধুলা করেই এমন শেষ হয়ে গেলো ধুর। নেক্সট টার্গেটে রিষ্টপুষ্ট কাউকে জুগিয়ে নিস। এসব রেডিমেড জিনিস দিয়ে আর খেলা চলে নাকি।”
সোহেল বলল,
“নিজের জোগাড় নিজে করে নিলেইতো পারো।”
জামান কপাল কুচকে বলল,
“বেশি চাপা না নাচিয়ে কাজে লেগে পড়িস। নয়তো তোকেও ওই মাইয়ার মতো মাটি চাপা দিয়ে দেবো। বেশি বকবক করবি না।”
সোহেল কথা বাড়ালো না। বাড়ির সীমানা পাড় হওয়ার সময় সোহেল মাটিতে চাপা দেয়া দোলনের শেষ কীর্তির দিকে এক নজর তাকালো। মেয়েটার জন্য মনে হয়তো সরিষা দানা পরিমাণেও ভালোবাসার ছিটেফোঁটা ছিল না। যদি তা থাকতো তাহলে এমন নিকৃষ্ট কাজটা দোলনের সাথে করতে পারতো না।
কি এমন হতো, যদি দোলনকে বাচিয়ে রাখা হতো ? দোষ কি ছিলো তার ? মেয়ে হয়ে জন্ম নেয়া নাকি কাউকে অন্ধের মতো ভালোবাসা অপরাধ ছিল ? কেন তাকে এমন এক নিষ্ঠুরতার শিকার হতে হল ? কে দেবে এই জবাব, কে দেবে এর উত্তর ? নাহ কেউ কোথাও নেই।
মাটি চাপা দেয়ার সময় দোলনের চোখ বেয়ে পানি ঝড়ছিল। এই নোনা পানি এড়িয়ে গিয়েছে কঠিন হৃদয়ের মানুষগুলোর মনে। এরকম পরপর শখানেক মানুষ চোখের সামনে মারা গেলেও যেন তাদের কিছু আসে যায় মা। এই মানুষগুলোর এমন বিচ্ছিরি স্বভাবের কারণ তার পরিবার আর পারিপার্শ্বিক অবস্থা। এদের না আছে পরিবার থেকে পাওয়া কোনো সুন্দর শিক্ষা। এভাবে আর কতদিন নিপিড়ীত হতে হবে ? আর কতজন আর কতবার এভাবে প্রাণ হারাতে হবে দোলনের মতো মেয়েদের?
চলবে…#সন্ধ্যে_নামার_পরে 🔞
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-১৯
সন্ধ্যে নেমে এলো, কিন্তু সিয়ামের কোনো খবর নেই। রেসমি বেগম, ফাইজা আর মিদুল মিলেই পরবর্তী কার্যক্রম এর জন্য পরিকল্পনা সেট করলো। সিয়ামকে অনেকবার কল করা যায়। বারবার রিং বেজে গেলেও ওপাশ থেকে কেউ আর কল রিসিভ করেনি। সিয়াম ফাইজার ক্লাসমেট ফ্রেন্ড। ভার্সিটিতে শুধু এই ছেলেটার সাথেই বন্ধুত্ব হয়। সেটাও খুব সহজে হয়নি। একদিন না হয় সিয়াম-ফাইজার বন্ধুত্ব শুরু হবার গল্প বলা যাবে।
সিয়াম আর মিদুল ফাইজাকে তার প্রতিশোধ নিতে সাহায্য করে। এরাই ছিল সেই দুই আগন্তুক। যারা ফাইজাকে সামনে এগিয়ে নিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে। এই প্রতিশোধ নেয়ার মূল মন্ত্রনা দিয়েছিলেন রেসমি বেগম। হয়তো ভাবছেন রেসমি কেন এসব করতে চাইবে ? চাইবে, কারণ কিশোরী বয়স পার হওয়ার আগেই রেসমি নিজেও এই জঘন্যতম খেলার শিকার হয়েছিলেন। তখন এত কিছু বুঝতো না। তার হয়ে পাশে দাঁড়ানোর মতো কেউ ছিল না। পারিবারিক বা সামাজিক, কোনো দিক থেকেই এক মুঠো শান্তনা ছিল না তার জন্য। বরং কটু কথার কষাঘাতে ওই বয়সেই নিঃশেষ হতে চলেছিল রেসমির জীবন। একসময় এই যাতনা অনেকটাই কমে আসে তার। বিয়ের বয়স হবার আগেই আলালের সাথে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয় রেসমির। লোকটা সব জানার পরেও রেসমিকে স্বযত্নে বুকে আগলে রেখেছে। যখন রেসমি ফাইজাকে তার মতো কুলোষিত এক অধ্যায় পার হয়ে আসতে দেখে, তখন সে সিদ্ধান্ত নেয় এই প্রতিশোধের। নিজের বেলায় কিছু না করতে পারলেও সেই তৃপ্তি ফাইজাকে দিয়ে পূরণ করিয়ে নিচ্ছে। আলাল তার স্ত্রীর সব ইচ্ছে-পূরণ করতে সদা প্রস্তুত।
সিয়ামের জন্য ফাইজার চিন্তা হচ্ছে। এমন কখনোই হয়নি যে, সিয়াম ফাইজার কল রিসিভ করেনি। এতবার কল করার পরেও যখন সিয়াম কল রিসিভ করছিলো না তখন ফাইজার শুধু চিন্তাই না, ভয়ও হচ্ছিলো। সে ভয় ভিষণ অদ্ভত রকমের ভয়। চিন্তিত ব্যক্তিদের তালিকায় রেসমি বেগম আর মিদুলও আছে। রায়হান শুধু ওদের কান্ডকারখানা দেখে যাচ্ছে।
ফোনটা টি-টেবিলের উপর রেখে সোফায় হতাশ হয়ে বসে আছে ফাইজা। তার ইচ্ছে হচ্ছে ফোনের ভেতর ঢুকে সিয়ামকে গিয়ে খুঁজতে যে সে এখন কোন প্রান্তে অবস্থান করছে। এসব অদ্ভুত সব ভাবনার মাঝে হঠাৎ কলিং বেল বাজে। ফাইজা এক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেখে আলাল সাহেব কাজ থেকে ফিরেছেন। ফাইজার কিছুটা মনক্ষুন্ন হলো। সে সিয়ামকে আশা করছিলো। তবুও অনিচ্ছাকৃত মুখে হাসি ফুটিয়ে বরাবরের মতো আলালের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিলো। আলাল মৃদু হেসে ভেতরে ঢুকে পড়লো। ফাইজা দরজা আটকাতে নিলে দেখতে পেলো সামনে সিয়াম দাঁড়ানো। সিয়ামকে দেখতে বিধ্বস্ত লাগছে। ফাইজা হুট করেই কোনো কথা না বলে সিয়ামের হাত ধরে হেঁচকা টানে ভেতরে নিয়ে এসে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিলো।
ড্রয়িংরুমে সবাই একসাথে বসেছে। সিয়ামের অবস্থা দেখে ফাইজা কথ জিজ্ঞেস করতেই ভুলে গেলো। সিয়ামকে এক গ্লাস পানি দেয়া হয়েছিল। সিয়াম সেটা গটগট করে পান করে লম্বা এক নিশ্বাস ফেললো। হয়তো সারাদিন কিছু খায়ওনি সে। রেসমি সিয়ামের পাশেই বসেছিল। সিয়ামকে জিজ্ঞেস করেছিল দুপুরে বা সন্ধ্যার নাস্তা কিছু খেয়েছে কিনা। সিয়াম ধীর গতিতে মাথা নাড়িয়ে নাবোধক উত্তর দিলো। রেসমি সুইটিকে দিয়ে সিয়ামের জন্য খাবার আনালো। সিয়ামের সামনে খাবার রাখা হলে রেসমি তাকে খেতে বলল। রেসমি খেতে বলাতে সিয়াম ফুপিয়ে কেঁদে উঠে। উপস্থিত সবাই সিয়ামের এই হুট করে কেঁদে দেয়াতে হতভম্ব হয়ে পড়ে। রেসমি মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলো না। রেসমি একজন মা, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন যে কিছু একটা ঘটেছে। যা ঘটেছে তা অবশ্য বড় কিছুই হবে। মিদুল সিয়ামের পিছনে দাঁড়িয়ে সিয়ামের কাঁধে হাত রাখলো। এই যে মাথায় স্নেহের হাত বুলানো, কাঁধে ভরসার হাত রাখা একটা মানুষের কষ্টের সময় এই ব্যবহারটুকুই অনেকটা ব্যথা লাঘব করে ফেলে।
ফাইজা সিয়ামের পায়ের কাছে এসে হাঁটু গেড়ে বসে। ফাইজার এমনভাবে সিয়ামের সামনে বসে পড়া যেন রায়হানের কলিজায় ধুপ করে ভারি বস্তা পড়ে যাওয়ার মতো মনে হচ্ছে। বুকের উপর ভারি বস্তু যেন নিশ্বাস আটকে দিচ্ছে। অদ্ভুত এই অনুভূতি পীড়াদায়ক।
ফাইজা সিয়ামের বাম হাতের কনিষ্ঠ আঙুলটা আলতো করে ছুঁয়ে বলে,
“কাঁদছো কেন ? আমরা আছি তো। কি হয়েছে ?”
সিয়াম ফুপিয়ে কাঁদার ফাঁকে মাথা তুলে ফাইজাকে বলল,
“দোলনচাঁপাকে খুঁজে পাচ্ছি না।”
“কখন থেকে পাচ্ছো না ?”
“দুপুরে দোলনের কলেজে গিয়েছিলাম। ওর কিছু কলেজ ফি বাকি ছিল। সেটা দিতেই গিয়েছিলাম। ওর মর্নিং শিফটে ক্লাস। দুপুরে ছুটি হয়ে যায়। ছুটি হওয়ার আগেই আমি গিয়েছি কলেজে। কিন্তু ওর ক্লাসমেট ফ্রেন্ডরা বলল যে দোলন নাকি কলেজেই যায়নি। ভেবেছিলাম, ছুটির পর দোলনকে নিয়ে শপিং করে দেবো কিছু। সারাবছর তো তেমন কিছু দিতে পারিনা। তাই ভাবলাম আজ ওকে সাথে নিয়ে ওর মনের মতো কেনাকাটা করে দেবো। কিন্তু সব উলটে গেলো। ওর ফোনটাও সুইচ অফ। কোনোভাবে যোগাযোগ করতে পারছি না।”
রেসমি বলল,
“মিদুল বলল, তুমি নাকি কিছু সন্দেহ করছো দোলনের ব্যাপারে ?”
সিয়াম মৃদু নাক টেনে বলল,
“দোলনের ব্যাবহার পালটে যাচ্ছিলো। পড়াশোনার ব্যপারেও উদাসীনতা দেখেছি। মাঝেমধ্যেই রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেলে ওর ঘর থেকে ফিসফিস করে কথা বলার আওয়াজ পেতাম। খুব সঙ্গোপনে কারো সাথে কথা বললে যেমন হয় তেমন। হাতেনাতে ধরার জন্য সুযোগ খুঁজছিলাম। আজকে দোলনের কলেজে যাওয়ার এটা আরো একটা কারণ ছিল।”
মিদুল বলল,
“সিয়াম ভাইয়া, দোলনের ব্যাপারে যা সন্দেহ করেছিলে তা কি সঠিক ছিল ?”
সিয়াম বলল,
“হ্যা সঠিক। দোলনের এক বান্ধুবীকে জিজ্ঞেস করেছিলাম। সে-ই বলল, দোলনের নাকি বয়ফ্রেন্ড আছে, নাম সোহেল। তবে ছেলেটা সুবিধার নয়। আমি নিশ্চিত, দোলন ওই সোহেলের সাথেই গিয়েছে। কারণ সোহেল নিজেও আজ ক্লাস মিস দিয়েছে। এটাও বলেছে যে, ওরা নাকি এরকম মাঝেমধ্যেই ক্লাস বাংক করে।”
ফাইজা বলল,
“ছেলেটার পরিচয় বা ঠিকানা জানতে পেরেছ ?”
সিয়াম মাথা ডান-বামে নাড়িয়ে নাবোধক জানালো। তারপর বলল,
“কলেজ কর্তৃপক্ষের কাছে তেমন কোনো তথ্য নেই। ক্লাসমেটগুলোও তেমন তথ্য দিতে পারেনি। আমি আগামীকাল আবারো যাবো কলেজে। ছেলেটার সাথে সাক্ষাৎ পাওয়া জরুরি।”
রেসমি বলল,
“ঠিক আছে, যেও। চিন্তা করো না, আমরা আছি তোমার পাশে। এখন খেয়ে নাও।”
সিয়াম দোলনের জন্য মনে প্রাণে দোয়া করে যাচ্ছে যাতে তার আদুরে বোন দোলনচাঁপার কোনো ক্ষতি না হয়। যতই পজিটিভ চিন্তা করতে চাচ্ছে না কেন, সিয়ামের মনে যেন নেগেটিভ চিন্তায় বারবার হানা দিচ্ছে। জীবনে এই একটা বোন ছাড়া আর কেউ নেই। বাবা-মা গাড়ি দূর্ঘটনায় মারা যায়। যদিও সবাই বলে এটা দূর্ঘটনা ছিল, কিন্তু সিয়াম বিশ্বাস করে এটা একটা সুপরিকল্পিত মার্ডার ছিল। যা তার চাচা নিজ হাতে করেছে। মা-বাবা মারা যাওয়ার পর অন্য আত্মীয়রাও খোঁজখবর নেয়া ছেড়ে দিলো। কতটা অসহায় আর দারিদ্রতায় দিনাতিপাত করেছে তা সিয়াম ছাড়া আর কে জানে। একমাত্র বোনটাকে যথাসাধ্য ভালো রাখার চেষ্টা করেছে। মাধ্যমিক দেয়ার পর পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে দিনরাত কাজে যুক্ত হয়ে গিয়েছিল। বছর দুই এক গ্যাপ দিয়ে আবারো কাজের সাথে সাথে পড়াশোনা শুরু করে। তার কিছুটা অবদান আলাল সাহেবেরও ছিল। সিয়ামের পড়াশোনার দায়িত্ব নিজে নিয়ে নেয়। এ বিষয়ে এখনো রেসমি জানেনা। সিয়ামের গলা দিয়ে খাবার নামছে না। এখন খাবার খাওয়া একেবারেই অসম্ভব। কিভাবে সম্ভব হবে, যেখানে কলিজার টুকরা বোনটা মিসিং। সিয়াম এখনো এটা জানেনা যে তার ফুলের ন্যায় বোনটা আর তাকে ভাইয়া বলে ডাকার জন্য দুনিয়ার বুকে নেই। দোলনচাঁপা নামক সদ্য ফোটা ফুলটাকে একদল হায়েনা গোড়া থেকে উপড়ে ফেলে দিয়েছে। কি হবে যখন সিয়াম জানবে যে, দোলনচাঁপা আর তার সুরভি ছড়িয়ে দিতে আর বেঁচে নেই ?
#সন্ধ্যে_নামার_পরে 🔞
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-২০
রাতের খাবার কারো গলা দিয়ে নামেনি। সিয়ামের বিষন্নতা ছেয়ে গেছে সবার মাঝে। বোনের জন্য আহাজারি যেন সবার কলিজায় গিয়ে গেথে দিচ্ছে। সিয়ামের পাশ থেকে নড়েনি রেসমি। ছেলেটার মাতৃত্বের ছায়া ভিষণ প্রয়োজন। বিপদে যারা পাশে থাকে তারা প্রিয়জন। সুখের সময় তো সব শুভাকাঙ্ক্ষীদের আনাগোনা। প্রিয়জনের প্রয়োজন বিপদেই বোঝা যায়। সিয়াম একা থাকলে এখন হয়তো পাগলামীর পর্যায় ছাড়িয়ে যেতো। কিন্তু এই মানুষগুলো কোনো রক্তের সম্পর্কে সম্পর্কিত না হয়েও আগলে রাখছে ছেলেটাকে। এটাইবা কম কিসে ? ছেলেদের কাঁদতে মানা, এই নিয়ম ভেঙে সিয়াম দোলনচাঁপার জন্য কাঁদছে। কারণ তার মন খারাপ কিছু ঘটে যাওয়ার ইঙ্গিত দিচ্ছে।
সময় পেরিয়ে মাঝরাতে ছুলো। সিয়াম রেসমির উরুর উপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়েছে। ক্লান্ত চোখ, রেসমির হাতে মায়ের স্নেহময় হাত বুলানোর ফলে ঘুম চলে এলো সিয়ামের চোখে। মিদুল আজ বাড়ি ফিরেনি। ফিরতে পারবে না বলে বাড়িতে খবর জানিয়ে দিয়েছে অনেক আগেই। ফাইজা সিয়ামের বিপরীত সোফায় বসে হেলান দিয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। মিদুল তার বোনের পাশেই হেলান দিয়ে বসে আছে। আলাল বসে আছে প্রিয়তমা স্ত্রীর পাশেই। রায়হান নিজ ঘরে চলে গিয়েছে অনেক আগেই। এসবে থেকে তার কাজ নেই।
_______
আয়মান বিকেলের দিকে হাসপাতালে গিয়ে কোহিনূরকে একবার দেখে এলো। জ্ঞান ফিরেছে কোহিনূরের। কিন্তু কথা বলার মতো অবস্থায় নেই। মেয়েটা এখনো শকে আছে। আয়মান কথা বাড়ায়নি। আরেকটু সুস্থ এবং স্বাভাবিক হলে তবেই সে কোহিনূরের জবানবন্দি নেবে। জবানবন্দি নিতে পারলে কাজটা একটু সহজ হয়ে যেতো। যেহেতু কোহিনূর এখনো স্বাভাবিক হয়নি সেহেতু আয়মান নিজের মতো করেই কেস নিয়ে এগোতে থাকবে।
তোহা ঘুম ভেঙে দেখলো আয়মান ল্যাপটপে কিছু টাইপিং করছিলো। তোহা মাথা উঁচু করে তুলে বলল, “কিগো বুড়ো, এই মাঝরাতে এখনো জেগে আছেন ?”
আয়মান লেখা বন্ধ করে এক হাতে তোহার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলল, “এইতো একটুখানি কাজ আছে। মিনিটখানেক বাদেই ঘুমিয়ে পড়বো।”
তোহা উঠে বসে আয়মানের হাত থেকে ল্যাপটপটা কে প্রকার কেড়েই নিয়ে যায়। আয়মান বলে উঠে,
“ও বউ কি করছো এইটা ? কাজটা শেষ করতে দাও। বলেছিতো এখনই ঘুমিয়ে যাবো।”
“আমি শুয়েছি সময়ও বলেছেন মিনিটখানেক পরই ঘুমিয়ে পড়বেন। আপনার মিনিট কি এখনো শেষ হয় না ?”
“শেষ হবে তো। ল্যাপটপটা দিয়ে দাও। তারাতাড়ি দিলে আমি তারাতাড়ি শেষ করে তারাতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বো, ওকে ?”
“আমি আর আপনার কথা শুনছি না। আপনি এখনই শুয়ে পড়বেন।”
আয়মান বুঝে গিয়েছে যে, এখন আর কোনো অজুহাতই কাজে আসবে না। শুয়ে পড়া ছাড়া আর উপায় নেই। আয়মান শুয়ে পড়ে দুহাত মেলে ধরে আদুরে স্বরে তোহাকে ডাকলো। তোহাও আর দেরি না করে লুটিয়ে পড়লো আয়মানের বুকে। বৈবাহিক সম্পর্ক এক বিশাল বড় নেয়ামত। কারো যদি কোনো নারীকে একান্তে পাওয়ার ইচ্ছে থাকে তবে সে বিয়ে করুক। বিবাহ নামক এত সুন্দর একটা ব্যবস্থা থাকতে মানুষ তবুও কেন ধর্ষণ করতে যায় ? এদের মস্তিষ্ক বোধহয় পুরোটাই খালি কলসির মতো ফাঁকা। নয়তো এরা ধর্ষণের কাজে লিপ্ত হতো না। তাও একজন গর্ভবর্তী নারীর সাথে। কতটা জঘন্য হতে পারে এদের চিন্তাধারা। যার ফলে এরা এমন কাজ করে সাচ্ছন্দ্যে।
_______
মাঝরাতে সাদিয়া আর রাসেলের মাঝে তুমুল ঝগড়া। কি নিয়ে ? সবুর করুন, বলছি। রাসেল আর সাদিয়া সম্পর্কে স্বামী-স্ত্রী। এখানে সাদিয়ার আরেকটা পরিচয় হচ্ছে সে একজন স্বাধীন প্রিয় টিকটকার। যা ইচ্ছে তাই কন্টেন্ট তৈরি করে সেলিব্রেটির স্রোতে গা ভাসাচ্ছে। রাসেল এই নিয়ে তেমন কিছুই বলে না কখনও। বুঝতেই পারছেন স্বামী_স্ত্রী সম্পর্ক, রাসেল চাইছিলো বউকে আদর সোহাগ করার। সেই উদ্দেশ্যেই সাদিয়ার গায়ে হাত দিয়েছিল। কিন্তু সাদিয়া এতে ভিষণ ক্ষেপে যায়। সাদিয়া রাসেলকে যখন বলে, “তুই আমাকে মাঝরাতে ধর্ষণ করতে চাচ্ছিস ?” তখন রাসেলের ভিষণ রাগ উঠে যায়। এমনতর কথা নিজের স্ত্রীর মুখ থেকে শুনলে যে কারোই রাগ উঠে যাবে। রাগ উঠার সাথে সাথেই রাসেল সাদিয়ার গালে চর বসিয়ে দেয়। চর খেয়ে সাদিয়া এতই রেগে যায় যে রাসেলকে মা-বাবা তুলে গালমন্দ করে। সাদিয়া চেঁচিয়ে বলে,
“বেজন্মার ঘরে বেজন্মা, তুই আমার গায়ে হাত দিলি কেন ?”
“তোর উপর আমার অধিকার আছে। তুই আমারে বললি কেন যে, আমি তোরে ধর্ষণ করতে চাইতেছি ? ধর্ষণ কি বুঝোস ? আমি তোর বৈধ স্বামী। তুই এই কথা কিভাবে বললি ?”
“হাজার বার বলবো। তুই আমাকে ছুবি কিসের জন্য ? তুই কি আমার অনুমতি নিছিলি ? আমার ফিগার নষ্ট করার ধান্দা করোস ?”
“তুই কি জানোস তুই একটা মা*.., বাজারের ব্যা*..। তুই যে অন্য বাইরের ছেলেগুলার সাথে কাপল ভিডিও বানাস, ওরা যে তোর শরীরের এখানে ওখানে ছোঁয়, তখন কি তোর সেন্স থাকেনা ? সাইধা সাইধা অন্য ছেলেদের ছোঁয়া পাইতে বেশ মজা লাগে তাইনা। একমাত্র স্বামীর স্পর্শে তোর হয় না।”
“মুখ সামলাইয়া কথা বল। নয়তো খারাপ হইয়া যাইবো কিন্তু।”
“তোর মতো খা*কির সাথে কি ভালো ব্যবহার করতাম রে ? তোর ইজ্জত তো তুই নিজেই বিলাইয়া দেস। তুই তো ওইসব ছেলেগুলার কাছে ফ্রিতে পাওয়া জিনিস। তোরে বিয়া কইরা নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারছি।”
“কুড়াল মারা কাকে বলে এবার দেখবি।”
এই কথা বলে সাদিয়া বেড সাইড টেবিলের উপরে রাখা ফুলদানিটা দিয়ে আঘাত করে রাসের মাথায়। রাসেল বিছানা থেকে মোবাইলটা নেয়ার জন্য উবু হওয়াতে সাদিয়ার এই কর্মকাণ্ড খেয়াল করেনি। যার দরুন মাথায় আঘাত পেতে হলো। সাদিয়া এত জোরেই আঘাত করেছিল যে, ফুলদানীটা আঘাতে ভেঙে বেশ কয়েক খন্ডে বিভক্ত হয়ে গেলো। রাসেল বুঝতে পারেনি যে, এভাবে তাকে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করতে হবে। মুহুর্তের মধ্যেই দুনিয়া থেকে বিদায় জানালো রাসেল। রক্তে ভেসে গেলো তাদের বিছানা। সাদিয়া রাসেলকে আঘাত করার পরেও একটু দূরে দাঁড়িয়ে রাগে ফুঁসছিল। যখন দেখলো রাসেল আর নড়াচড়া করছে না, বন্ধ হয়ে গেছে তার চোখের পলক ফেলা তখন সাদিয়ার টনক নড়ে। মনের ভেতর ভয় জেকে বসে। রাগ এমন একটা জিনিস, যা মানুষের জীবনে ভয়াভহ পরিনতি বয়ে আনতে বেশি সময় নেয় না। এই মুহুর্তে এমন ঘটনাই ঘটেছে। রাসেল-সাদিয়া দম্পতি পরিবার থেকে আলাদা বসবাস করতো শহরে। দুই পরিবারের কেউই ওদের বিয়ের কথা জানতো না। রাসেল জবের জন্য এখানে থাকতো। পরিবারকে বলতো সে একা থাকে।
সাদিয়া তার টিকটক ক্লোস ফ্রেন্ড রিজুকে ব্যাপারটা জানালো। এই রিজু সংসারে অশান্তির মূল কারণ ছিল। রাসেল ভেবেছিল সব ঠিকঠাক হয়ে যাবে। কিন্তু ধৈর্যের ফল বিফলে গেলো। এতে রাসেলেরও ভুল ছিল। সাদিয়া রিজুকে বাড়িতে ডাকার ঘন্টা খানেকের মধ্যেই রিজু চলে আসে। রাসেলের লাশটাকে গুম করার পরিকল্পনা আটছে দুজন মিলে। রিজু বুদ্ধি দিচ্ছে রাসেলকে কে-টে টুকরো টুকরো করে বস্তায় ভরে কোনো নর্দমায় দেলে দিতে। কিন্তু সাদিয়া চাচ্ছে এসব কিছু না করে এভাবেই সব ফেলে রেখে চলে যেতে। সাদিয়ার কথাই রইলো। সাদিয়া তার যা কিছু ছিল তা সমস্ত কিছু প্যাকিং করে রিজুর সাথে গভীর রাতে বের হয়ে যায়। রাসেলের দেহ যেভাবে পড়ে গিয়েছিল ঠিক সেভাবেই পড়ে রইলো। সাদিয়া ঘরের বাইরে তালা বন্ধ করে চাবি বাহিরে এসে ড্রেনে ফেলে দেয়।
যা ঘটে গেলো, আসলে তা কি হওয়া উচিৎ হয়েছিল ? সাদিয়ার কি উচিৎ ছিল না নিজেকে ঠিক রাখা ? তার কি উচিৎ ছিল না সোশ্যাল মিডিয়ার অপব্যবহার না করার ? একটা মায়ের বুক যে সে খালি করে ফেললো তার কি ধরনের বিচার হওয়া উচিৎ ? রাসেলের উচিত ছিল জেনে শুনে সাদিয়ার মতো মেয়েকে বিয়ে না করা। সে সেটা করেছে, তার উপর ফ্যামিলির কাউকেই জানায়নি। এই পরিনতির জন্য ঠিক কাকে দায়ী করা উচিত ?
“সোশ্যাল মিডিয়া আমাদের কারো জীবনে ক্ষতির কারণ হয়ে না হোক।”
চলবে….
চলবে…
ঘটনা ক্লিয়ার করার দরকার ছিল। তাই একটা প্লট দিয়েই আজকের পর্বটা শেষ করেছি।