সন্ধ্যে নামার পরে পর্ব -৩০+৩১ ও শেষ

#সন্ধ্যে_নামার_পরে
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-৩০

ফাইজা সুস্থ হলে রেশমি ফাইজাকে তার ল্যাপটপ ব্যাক করে। আর হুশিয়ার করে যায় যে, পুরোনো ঘটনা পুনরাবৃত্তি হয় এমন কাজ যেন না করে। তাহলে শাস্তি আছে। ফাইজা হাসিমুখে হুশিয়ারি গ্রহণ করে। নয়তো সে জানে, রেশমি বেগম তাকে তার ল্যাপটপ ফেরত দেবে না। সিয়ামও তার বোনের বিষয়ে এড়িয়ে যেতে বলল। কিন্তু ফাইজা চাচ্ছে সিয়ামকে দোলনের খুনিদের ধরতে সাহায্য করতে। সিয়াম চায় না ফাইজা আর কোনো বিপদে পড়ুক। ফাইজা ল্যাপটপ অন করে বাংলো থেকে পাওয়া ভিডিও ফুটেজ থেকে যথাসম্ভব ছেলেদের স্পষ্ট চেহারার ছবি সংগ্রহ করলো। তারপর সেগুলো সিয়ামের মেইল একাউন্টে সেন্ড করে দিলো। এই কাজে ফাইজা পুরোপুরি শান্তি না পেলেও কিছুটা শান্তি পেয়েছে যে অপরাধিদের শনাক্ত করতে পেরেছে। এখন প্ল্যান করে ওদের ফাঁদে ফেলতে হবে।

সিয়াম মেইল পেয়ে কিছুক্ষণের মধ্যেই ফাইজার ঘরে উপস্থিত হলো। ফাইজা তখন শুয়ে শুয়ে “শুভ্রছায়া” থ্রিলার উপন্যাসের বইটা পড়ছিল। সিয়াম আসায় বইটা রেখে উঠে বসে। সিয়াম একটা টুল নিয়ে ফাইজার বিছানার পাশে এসে বসে। কিছু সময় চুপচাপ সিয়াম তাকিয়ে থাকে ফাইজার দিকে। ফাইজা সিয়ামের দিকে তাকালেই চোখাচোখি হচ্ছে। তাই ফাইজা অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছিলো বারবার। ফাইজার অদ্ভুত অনুভূতি হচ্ছে। এটা ঠিক অস্বস্তি নাকি লজ্জাবোধ বুঝা যাচ্ছে না।

ফাইজা এবার কথা বলল, “কিছু কি বলার জন্য এসেছো ?”

সিয়াম এবার ফাইজার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে বলল, “হুম, অনেক কিছুই বলতে চাইছি। আমার অনুভূতিগুলো কারো কাছে আমানত হিসেবে রাখতে চাইছি। তবে এখন এসব নিয়ে কিছুই বলবো না। কখনো যদি উপযুক্ত সুযোগ পাই, তবেই বলবো।”

সিয়ামের কথাগুলো যেন ফাইজার মাথার উপর দিয়ে উড়ে চলে গেলো। কথাগুলো কানে প্রবেশ করলে হয়তো বুঝতে পারতো। কানে যেহেতু পৌঁছায়নি, সেহেতু কথাগুলো মাথার উপর দিয়েই গিয়েছে। ফাইজা সিয়ামের দিকে অবুঝের মতো তাকিয়ে বলল,
“সিয়াম, তুমি কি সোজাসাপটা কথা বলতে পারবে ? এরকম জিলাপির পেঁচের মতো কথা না বললেও তো পারো।”

সিয়াম ছোট একটা হাসি দিয়ে বলল, “বাদ দাও। এখন অন্য কথা বলি। দোলনের হিসেবটা আমি মিটিয়ে নেবো। এখানে তুমি একদম নাক গলাবে না, ঠিক আছে ? আর তোমার একটা প্রতিশোধ নেয়া এখনো বাকি আছে। মনে আছে তোমার ?”

ফাইজা মাথা ঝাঁকিয়ে “হ্যা” জানালো। সিয়াম হঠাৎ করেই ফাইজার এক হাত নিজের দুহাতের মুষ্টিতে নিয়ে নিলো। তারপর বলল, “কাজটা তাহলে যত তারাতাড়ি সম্ভব শেষ করতে হবে। এই হাতদুটো আর কলুষিত করতে দেবো না।”

এই কথা বলে সিয়াম উঠে চলে গেলো ফাইজার ঘর থেকে। ফাইজা মূর্তিমান হয়ে ওভাবেই বসে রইলো কিছুক্ষণ। সিয়ামের হঠাৎ করে হাত ধরে নেয়া যেন ফাইজার ভেতরটা এলোমেলো করে দেয়। ফাইজা সিয়ামের হাত থেকে নিজের হাত ছাড়িয়ে নিতে চাইলেও মন যেন তা চাইছিলো না। প্রিয় মানুষকে আমরা এভাবেই আঁকড়ে ধরে রাখতে চাই। ফাইজাও তা চায়। কিন্তু মস্তিষ্কের কোষগুলো থেকে ভিন্ন বার্তা আসে।

ফাইজাকে খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দেয়,
“আরে তুইতো ধর্ষিতা। তুই আবার একটা ছেলের ভালোবাসা চাইছিস ? তাকে আঁকড়ে ধরতে চাইছিস ? তাকে পাওয়ার যোগ্যতা কি তোর আছে ? অদ্ভুত মেয়ে মানুষ তুই। এই কলুষিত জীবনে আবার অন্য কাউকে নিয়ে স্বপ্ন দেখিস। তোর মতো কি সিয়ামও তোকে চায় নাকি ? চাইবে না চাইবে না, এটাই বাস্তবতা।”

__________

আয়মান দুজন পুলিশকে সিভিল বেশে বাড়ির গেইটের আশেপাশে পাহারা দিতে বলে গেলো। বাড়িওয়ালা মনির এই মুহুর্তে থানাতে আছে। সুজনকে ধরার জন্য দুজন পাহারায় রেখেছে। সুজন অফিস থেকে আসা মাত্রই গ্রেফতার করা হবে তাকে এই কারণে। প্রায় অনেকটা রাত হয়ে গিয়েছিল। সুজন ফিরতে আজ দেরিই করছিল। পুলিশ আশঙ্কা করছে যে, সুজন আবার কিছু খোঁজ পেয়ে গেলো কিনা। এমন হলে সুজনকে ধরা একটু মুশকিল হয়ে যাবে। ঘড়ির কাটা প্রায় রাত এগারোটা ছুঁইছুঁই। এমন সময় গেইট দিয়ে একজনকে প্রবেশ করতে দেখা গেলো। দারওয়ান পাহারারত পুলিশদের ইশারায় বুঝালেন যে, এই ব্যক্তিই হচ্ছে সুজন। পুলিশ এক মুহুর্ত দেরি না করে ছুটে গিয়ে সুজনকে আটক করে ফেলে। হঠাৎ সাধারণ পোশাক পরিহিত দুজন ব্যক্তি এসে সুজনকে চেপে ধরে হ্যান্ডকাফ পড়িয়ে দিলে সুজন চমকে উঠে। হঠাৎ করে এমন ঘটে যাওয়াতে ঠিক কি হলো তা বুঝতে সুজনের মিনিট সময়ও লাগলো না। কথায় আছে না, “চোরের মন পুলিশ পুলিশ।” সুজনের ক্ষেত্রেও একই বাক্য প্রযোজ্য। সে বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে, সে গর্তে পড়ে গিয়েছে। সুজন মনে মনে ভাবছিল, “বাড়িওয়ালা মনিরতো বলেছি যে, এই বিষয়ে কোনো ঝামেলা হবে না। ঝামেলা হলে সে বাঁচিয়ে নেবে। তাহলে কোথায় এখন সে ?”

থানায় নিয়ে যাওয়া হয় সুজনকে। মনির আর সুজনকে একই সাথে বসিয়ে জবানবন্দি নেয়া শুরু হয়। সোজাসুজি কেউই স্বীকার করছিলো না সত্যিটা। তারপর দুজনকেই মাত্রাতিরিক্ত উত্তম মাধ্যম দেয়ার পর রাজি হয় সত্যটা স্বীকার করার।

“মেয়েটর নাম তিথি। সুজনের সাথে মাস কয়েকের সম্পর্ক ছিল তার। সুজন তিথিকে নিজের করে পেতে চাইতো। নিজেরে করে পাওয়া মানে তিথিকে নিংড়ে নেয়া। বেশ কয়েকবার তিথি সুজনের জোড়াজুড়িতে রাজিও হয়। ওরা রাত কাটায় কোনো এক হোটেলের কক্ষে। তিথি তার বাসায় কোনো না কোনো অজুহাত দিয়ে কোনোরকমে বেঁচে যেতো। সুজনের কাছে বিয়ের কথা তুললে সে নানান বাহানা দেখাতো। আরো সময় চাইতো। এদিকে তিথিকে বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তুতি নিচ্ছিলো। কোনো এক পর্যায়ে সুজন রাজি হয় বিয়ে করতে। তিথি সুজনের সাথে বাড়ি থেকে বিয়ের দুদিন আগেই পালিয়ে আসে। সুজনের আর তিথি মিলে মনিরদের বাসায় ভাড়াটে হিসেবে উঠে। নিজেদের স্বামী-স্ত্রী পরিচয় দিয়েই উঠেছিল এখানে। বেশ কয়েকদিন কেটে গিয়েছিল। সুজন এদিককার একটা অফিসে চাকুরী জোগাড় করে নেয়। তিথি বেশ কয়েকবার বিয়ে করে ফেলার কথা বললে সুজন বারবার অজুহাত দিচ্ছিলো। এক পর্যায়ে তিথি আর সুজনের মাঝে ঝগড়া বাধে। মনির বাহির থেকে কোনো ভাবে ওদের বিয়ে না করে একসাথে থাকার ব্যাপারটা জেনে যায়। মনিরের মাথায় তখন দুষ্টু বুদ্ধি উঁকি দেয়।

একদিন সুজনকে ডেকে বিষয়টা জিজ্ঞেস করলে সুজন জানায় যে, সে তিথিকে কখনোই বিয়ে করবে না। যেই মেয়ে বিয়ের আগেই বিছানায় শুতে দ্বিধাবোধ করে না, তাকে আবার কিসের বিয়ে ? সুজন এও বলে যে, ওর লজ্জা সেদিনই ভেঙে গিয়েছে যেদিন সে আমাকে তার সম্পূর্ণটা বিলিয়ে দিয়েছে। আমার সাথে এমন রাজি হতে পারলে সে অন্য ছেলেদের সাথেও রাজি হবে। কারণ তার লজ্জাটুকু শেষ। মনির সুজনের এই কথায় যেন বুক ভরে সাহস পায়। খুনের রাতে সুজন আর মনির একসাথে তিথিকে ভক্ষণ করার প্ল্যান করে। রাতে যখন দুজন মিলে তিথির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, তিথি তখন তার সর্বোচ্চ দিয়ে নিজেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে। সুজনকে তিথি ভালোবাসে। যার জন্য পুরো পৃথিবী বির্জন দিয়ে সুজনের হাত ধরে চলে এসেছে। আজ সেই ভালোবাসার মানুষটার এই রূপ মেনে নিতে কষ্ট হচ্ছে। তিথির হাত পা ছুড়াছুড়িতে বিরক্ত হয়ে মনির তিথির ঘাড় বরাবর আঘাত করে। দশ মিনিটের মধ্যেই তিথি ছটফট করতে করতে নিঃশেষ হয়ে যায়। ওরা বুঝতেই পারেনি যে ওরা ঠিক কি করেছে। মানুষের ঘাড়ের মেরুদণ্ড এর দুপাশের ধমনিতে কোনোভাবে আঘাত পড়লে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে যায়। যার দরুন দশ মিনিটের মধ্যেই ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে মারা যায়।

মানুষ যখন বিপদে পড়ে তখন হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। সুজন আর মনিরের ক্ষেত্রেও এরূপ ঘটে। যখন তারা বুঝতে পারলো যে তিথি আর বেঁচে নেই, তখন লাশ গুম করার জন্য উঠেপড়ে লাগে। অবশেষে তিথিকে টুকরো করে পানির ট্যাংক এ লুকিয়ে ফেলে। পাপীরা কখনো শান্তিতে বাঁচতে পারে না। দুদিন আগে বা পরে তাদের শাস্তি কোনো না কোনো ভাবে পেতেই হয়। ধিক্কার সুজনের মতো এমন মানুষের। যে কখনোই ভালোবাসার যোগ্যতা রাখে না। আফসোস এমন তিথিদের জন্য। যারা এতটাই বোকা যে, ভালোবাসার মানুষটার জন্য পুরো পৃথিবীকেই হারাতে রাজি। তবে এই আত্মত্যাগ এর মূল্য নেই।”

আয়মান যথাসাধ্য সুজন আর মনিরের বিরুদ্ধে শক্তপোক্ত চার্জশিট তৈরি করলো। যাতে বিজ্ঞ আদালত ওদের কর্মের যথাযথ শাস্তি দেন।
#সন্ধ্যে_নামার_পরে
ফাতেমা তুজ জোহরা
পর্ব-৩১ (শেষ)

টিভি অন করে বিছানায় গিয়ে বসলো মিদুল। সকাল সাতটার খবর দেখতে বসে ব্রেকিং নিউজে চোখ স্থির হয়ে যায় তার। মিদুল হঠাৎ এমন খবর দেখবে তা ভাবতে পারেনি। দ্রুত বিছানা থেকে নেমে টিভির পাশে থেকে মোবাইলটা নিয়ে ডায়াল করে ফাইজার নম্বরে। ফাইজা তখন পরিবারের সাথে বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলো। ফোন কলের আওয়াজে খাবার রেখেই ছুটে গেলো তার ঘরে। ফোন স্ক্রিনে মিদুলের নম্বর দেখে দ্রুতই কল রিসিভ করে।

ফোনের ওপাশ থেকে মিদুল উদ্বিগ্ন কণ্ঠে বলল, “তুমি আমারে না বইলা একা একা এই কাজটা কেমনে করলা আফা ?”

ফাইজা বুঝতে পারলো না মিদুল হঠাৎ কল করে এসব কি বলছে। ফাইজা মিদুলের প্রশ্নের উত্তরে বলল, “কথা ক্লিয়ার করে বল। কি করেছি আমি ?”

মিদুল পূর্বের কণ্ঠের ন্যায় বলল, “এতবড় কাজটা একা করেও এখন জিগাইতেছো যে কি করছো ? এরকম কিন্তু প্ল্যান আছিলো না।”

ফাইজা ঝাড়ি দিয়ে বলল, “আরে ধুর, কি হইছে সেইটা বল। সোজাসুজি কথা বলতে পারলে বল, নয়তো ফোন রাখলাম।”

এবার মিদুল বলল, “ঠিক আছে, আর কিছু কইতাম না। টিভি চালাইয়া খবর দেখো। তাইলেই বুঝবা আমি কি কইতেছিলাম।”

এতটুকু কথা বলে মিদুল কল কেটে দিলো। মিদুল ভাবছে মিদুলকে রেখেই ফাইজা এত বড় কাজটা করে ফেলেছে। কিন্তু ফাইজা নিজেও এখনো জানেনা এই বিষয়ে। ফাইজা ফোন রেখে বসার ঘরে গিয়ে টিভি অন করে খবরের চ্যানেল এ দিলো। সংবাদ শিরোনাম ইতোমধ্যে শেষ হয়ে গিয়েছিল। তাই ফাইজা আসল ঘটনার খবরটা মিস করেছে। এখন কি ঘটেছে জানার জন্য পুরো খবরটা শোনা লাগবে। আলাল সাহেব ফাইজার পাশে এসে বসলেন।

বসে বললেন, “কি গো মা, খাবার আধ খাওয়া রেখে টিভি খুলে বসলে কেন ?”

ফাইজা টিভির দিকে তাকিয়েই বলল, “খবর দেখবো আব্বু। মিদুল কেন জানি ফোন করে রাগ দেখালো। তাকে রেখেই নাকি কাজ সেরে ফেলেছি। কিন্তু করেছিটা কি আমি নিজেও জানিনা।”

আলাল সাহেব বললেন, “আচ্ছা খাবারটা শেষ করো। এভাবে অর্ধেক খেয়ে রাখতে নেই। হা করো আমি খাইয়ে দিই।”

ফাইজা না করলো না। আলাল সাহেব ফাইজাকে খাইয়ে দিচ্ছে আর ফাইজা খেতে খেতে টিভি দেখছে। বিস্তারিত খবর যখন শুরু হলো তখন ফাইজা বেশ অবাক হয়। তখন বুঝতে পারে যে মিদুল কেনো রেগে আছে। পুলিশ অফিসার শাহিন আহমেদ আর নেই। কেউ তাকে নিজ বাড়িতে নৃশংস ভাবে হত্যা করেছে। ইনিই সেই পুলিশ অফিসার যে কিনা ফাইজার কেস নেন নি। রেপিষ্টদের শেষ করার পর শেষ টার্গেট ছিল এই শাহিন আহমেদ। কিন্তু এনাকে কে শিকার বানিয়ে ফেললো ? খাবার টেবিলে বসে থাকা রেশমি, রায়হান আর সিয়াম সবাই যখন উঠে এসে খবর দেখলো তখন রায়হান ব্যতীত সবাই অবাক হলো। রায়হান এই বিষয়ে তেমন কিছু জানেনা, তাই তার কম চমকানো স্বাভাবিক ব্যাপার।

ফাইজা মুখের খাবার না চিবিয়ে সব জমিয়ে ফেলেছিল। এখন মুখ ভর্তি খাবার নিয়েই অদ্ভুত শব্দে প্রশ্ন করলো, “এই পুলিশ অফিসারের এমন অবস্থা কে করলো ? আমরাতো এখনো ঠিকঠাক প্ল্যানই করিনি।”

রেসমি আলাল সাহেবের পাশে বসতে বসতে বলল, “হয়তো কোনো ভিক্টিমই এমন কাজ করেছে। বিচার না পেয়ে হয়তো এমনভাবেই গর্জে উঠেছে প্রতিশোধের নেশায়।”

মিনিট খানেকের মধ্যেই নতুন খবর এলো। সেখানে বলছে যে, পুলিশ অফিসার শাহিন আহমেদকে খুন করেছে তার নিজেরই স্ত্রী সেবা সুলতানা। খুনি নিজেই স্বীকার করেছে খুনের কথা। আরো জানা গিয়েছে যে, পুরোনো কোনো ঘটনার রেস ধরেই সেবা প্রতিশোধ নেয়ার জন্য শাহিনকে বিয়ে করেন।

সিয়াম টিভির পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল। খবরটা শোনার পর সিয়াম এক গাল হেসে বলল, “পাপ তার বাপকেও ছাড়ে না। যাইহোক আমাদের প্রতিশোধের লিস্ট পরিসমাপ্ত হয়েছে।”

ফাইজা দ্রুত মুখের খাবারটুকু শেষ করে সিয়ামকে বলল, “দোলনের খুনিদের কি হবে ?”

সিয়াম বলল, “ফাইজা, তোমাকে বেশ কয়েকবার বলেছি যে এসব নিয়ে তুমি একদম মাথা ঘামাবে না। দোলনের ব্যাপারটা আমি পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছি। বলতে ভুলে গিয়েছি, সোহেলকে থানায় দিয়ে এসেছি। তোমাকে এসব নিয়ে ভাবতে হবে না।” সিয়াম এই কথা বলার পর সেখান থেকে চলে গেলো।

কেটে গেলো বেশ অনেকদিন। ফাইজা এখন স্বাভাবিকভাবেই চলাফেরা করছে। তবে অন্যায় দেখলে রুখে দাঁড়াতে ভুলেনি। কলেজে তোহা আর সিয়াম ছাড়া অন্য কারো সাথে তেমন বন্ধুত্ব নেই। দিন চলছিল দিনের মতোই। তবে ফাইজাকে পোড়াচ্ছিল “ভালোবাসা” নামক বস্তুটি। সিয়ামের প্রতি ফাইজা দিনের পর দিন দূর্বল থেকে দূর্বলতম হয়ে যাচ্ছিলো। নিজের দূর্বলতা লুকিয়ে রাখা বেশ কষ্টকর। ফাইজা এক মনে সিয়ামকে চাইলেও আরেক মনে নিজের অতীত জীবনের জন্য পিছিয়ে আসছে। এভাবেই পার হচ্ছে ফাইজার প্রতিটা মুহুর্ত। সিয়াম এখন আলাল সাহেবের বাড়িতেই থাকে। মাঝেমধ্যে নিজের বাড়িতে গিয়ে স্মৃতি সাঁতরে আসে। ফাইজাও আলাল সাহেবের বাড়ি আর নিজের আসল বাড়িতে সমান তালে সময় দিচ্ছে। একদিন এবাড়ি থাকলে, পরদিন ওবাড়ি।

এখন বিদ্যুৎবিহীন মাঝরাত। রুটিন মাফিক ফাইজা আজ আলাল সাহেবের বাড়িতে আছে। মনটা ভিষণ উদাসীন। বরাবরের মতো জানালা খুলে দাঁড়িয়ে রইলো এই মাঝরাত অব্দি। নাহ, দাঁড়িয়ে লাভ হলো না। অশান্ত মনটাকে শান্ত করার জন্য বাগানে চলে গেলো। রাতে ফোটা ফুলের সুভাসে অনেকটাই সতেজতা বিরাজ করে। বাগানের বেঞ্চিতে গিয়ে বসলো ফাইজা। আকাশের আধখানা চাঁদের আলো ফাইজার শরীর বেঁয়ে পড়ছে। কি অপরূপ এক সৌন্দর্য এই মুহুর্তে ফাইজাকে আঁকড়ে নিয়েছে। রোজ ছাই হওয়া হৃদয়টাকে চাঁদের আলোয় চোখ বন্ধ করে পুনর্ঘটন করছিলো। এমন সময় চমকে উঠে ফাইজা।

কপালে উষ্ণ চুমুতে চোখ মেলে তাকায় ফাইজা। নিজের মুখমন্ডলের উপর মৃদু হাসিমাখা আরেকটা মুখমণ্ডল দেখে ফাইজা অপলক তাকিয়ে রইলো। এই ছেলেটার দিকে ফাইজা আজীবনই এভাবে তাকিয়ে থাকতে রাজি।

সিয়াম ফাইজার পাশে বসতে বসতে বলল, “এভাবে একা মাঝরাতে জ্যোৎস্না বিলাস করা মোটেও ভালো নয়। আমাকে ডাকলেও তো পারতে।”

ফাইজা বলল, “সবসময় কাউকে ডাকা যায় না। কিছু ডাকের জন্য অধিকার লাগে।”

সিয়াম ফাইজার দিকে তাকিয়ে বলল, “নিয়ে নাও না অধিকার। কেউ কি নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে ?”

ফাইজা তাকালো সিয়ামের দিকে। তারপর বলল, “এই অধিকার পাওয়ার যোগ্য নই আমি।”

সিয়াম ফাইজার দিকে ফিরে আলতো করে ফাইজার এক হাত নিজের হাতে জড়িয়ে নিলো। তারপর বলল, “ফাইজা, আমি তোমার অধিকার সীমায় বসবাস করি। আমার জীবনের একমাত্র সত্তা তুমি। আর কোনো বহুমাত্রিক মাত্রা আমার জীবনে নেই। সেইটা তুমি জানো ফাইজা।”

ফাইজা কাঁদো কাঁদো চোখে সিয়ামের দিকে তাকিয়ে বলল, “আমার অতীতকে কি মুছে ফেলা সম্ভব ? আমি কিভাবে কারো যোগ্য হতে পারি ?”

সিয়াম বলল, “হুস… এসব আর বলবে না। তুমি নিজেই একটা যোগ্যতার বক্স। একটা ভালোবাসার বক্স। আমি কি এই আদুরে বক্সটা পেতে পারি আমার পুরো জীবনের জন্য ? আমার শুধু একটাবার অনুমতি চাই।”

ফাইজা হেসে দিয়ে বলল, “এভাবে কেউ বক্স বলে প্রপোজ করে ? অদ্ভুত প্রস্তাবানা! ঠিক আছে, অনুমতি দেয়া হলো।”
সিয়াম আর ফাইজা অদ্ভুত ভাবে দু’জনই কেঁদে ফেললো। আমরা শুধু দুঃখ কষ্টেই কাঁদি না। আমাদের যখন অতি কাঙ্ক্ষিত বস্তুটির প্রাপ্তি ঘটে, তখন আমরা এভাবেই কেঁদে আনন্দ প্রকাশ করি।

অদূরে দাঁড়িয়ে রায়হান ওদের আনন্দ স্পষ্টই দেখতে পেলো। এই মুহুর্তে পঞ্চম নম্বর সিগারেটটা মুখে নিয়ে জ্বালিয়ে ধোঁয়া উড়িয়ে নিজের ঘরে চলে গেলো। কেউ ভালবাসা পেলে কেউ হারাবে, এটাই নিয়ম। রায়হান কোনো ভাবে এই নিয়মের আওতায় চলে এসেছিল। সিগারেট একা পুড়ছে না, সাথে রায়হানের হৃদয়ও পুড়ছে।

সমাপ্ত

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here