সবটাই_তুমিময় পর্ব ১

    -বিয়ের আগেই প্রেগনেন্ট হতে হবে আপনাকে।আমার বাচ্চার সেরোগেট মাদার হবেন আপনি।এই শর্তে রাজি হবার পরই শুধু এখান থেকে মুক্তি মিলবে আপনার।তার আগে নয়!

    কথাটা শুনে গায়ে কাটা দিলো আমার।গলার স্বরটা অচেনা নয়।ইনি অলরাউন্ডার এ এস এ! আরিয়ান সার্ফরাজ অঙ্কুর!দেশের সবচেয়ে সেরা ক্রিকেট দলের অধিনায়ক।মোস্ট এলিজেবল ব্যাচেলর হিসেবেও এর নামডাক।এই মানুষটার গলার আওয়াজে এ হেন কথা শুনে পায়ের নিচের মাটি সরে গেলো আমার।তবে এই কথা কোনোভাবে আমার জন্য হতেই পারে না।কোনোভাবেই না!হাটু আরো শক্ত করে জরিয়ে ধরে গুটিসুটি মেরে বসলাম আরো।কাপতে কাপতে চোখের চশমাটা ঠেলে কোনোমতে ঘাড় ঘুরিয়ে দরজায় তাকালাম।

    আধখোলা দরজা দিয়ে অন্ধকার ঘরে বাইরের আলো এসেছে।অনেক লম্বা করে সে মানুষটা ভেতরে ঢুকেছে।অন্ধকারে চেহারাটা অস্পষ্ট।তবে অবয়বটা সেই চিরচেনা।যার একবার তাকানোতেই হাজারো মেয়ের হার্টবিট মিস হয়ে যায়।যে মাঠে নামলেই প্রতিটা মেয়ে তাদের হৃদয় হাতে আগ্রহে বসে থাকে তার পরবর্তী রেকর্ডব্রেকের অপেক্ষায়।যার ব্যাক্তিত্ব মোহে ফেলে রেখেছে পুরো দেশকে।সেই মানুষটিই।বেশ লম্বা,নীল রঙের একটা গেন্জি পরে উনি।ট্রাউজারের পকেটে দুহাত গুজে আরামে দাড়িয়ে আছেন দরজার হেলান দিয়ে।কাপাকাপা গলায় বললাম,

    -এ্ এসব ক্ কি বলছেন আপনি?আ্ আমাকে যেতে দিন প্লিজ!

    -হ্যাঁ।যাবেন।অবশ্যই‌ যাবেন!আপনাকে আটকে রাখার কোনো ইচ্ছে নেই আমারও!

    -প্ প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে!আ্ আমি আপনার বিষয়ে অ্ অন্য কাউকে ক্ কিচ্ছু বলবো না!সত্যি বলছি!আমার কাছে তো কোনো প্রমানও নেই!আমি তো….

    -কোনো এক্সপ্লেনেশন চাইনি তো আপনার কাছ থেকে!সো রিল্যাক্স!শুধু আমার ডিলে রাজি হয়ে গেলেই আপনাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।

    -ম্ মানে?

    পুরোপুরিভাবে দরজা খুলে উনি ঘরের ভেতরে ঢুকলেন।আলোয় ভরে উঠলো পুরো ঘর।ফর্সা গরনের মানুষটা এগিয়ে এসে হাটু গেরে আমার একদম সামনে এসে বসলো।একটা শুকনো ঢোক গিলে আরো জরোসরো হয়ে বসলাম আমি।চশমাটা ঝাপসা হয়ে গেছে।কিন্তু তার চেহারা সুস্পষ্টই লাগছে।এতো কাছ থেকে এ এস এ কে দেখছি ভাবতেই বারবার বিস্মিত হচ্ছি আমি।ঘন কালো ভ্রুজোড়া,ডানপাশের ভ্রুর একটু উপরে একদম ছোট লালচে একটা তিল,গালে খোচাখোচা দাড়ি,চোখদুটো অসম্ভব গভীর,কপালে পরে থাকা চুলগুলো মাত্রাতিরিক্ত সিল্কিই মনে হচ্ছে।যেটা সচারচর মেয়েদের হওয়া উচিত।আমার মতে ছেলেদের সিল্কি চুল হতে নেই।

    -আর ইউ ওকে?

    ধ্যান ভাঙলো আমার।আবারো চশমাটা ভালোমতো চোখে এটে দিয়ে বললাম,

    -আ্ আমাকে য্….

    -এটা আমার কোশ্শেনের আন্সার ছিলো না!

    কপাল বেয়ে ঘাম গরিয়ে পরলো আমার।এ এস এ এক আঙুলে সে ঘাম মুছিয়ে দিলেন।বড়বড় চোখে তাকিয়ে রইলাম।উনি বললেন,

    -এসি করা রুম!এভাবে ঘামছেন কেনো?

    -আম্ আমি বাসায় য্….

    -বুঝেছি।এ ছাড়া অন্য কোনো কথা নেই আপনার কাছে আমার সাথে বলার জন্য।বাট এজ ফার আই নো,দেশের সব মেয়েই এ এস এ’র শুধু তাদের দিকে একবার ঘুরে তাকানোর জন্য পাগলপ্রায়।আর আপনি সামনে পেয়েও বাসায় যাবো,যেতে দিন ছাড়া কোনো কথাই বলতে পারছেন না?আপনি এক্সাক্টলি কোন মাটির তৈরী?

    শুকনো ঢোক গিললাম আবারো।বললাম,

    -প্লিজ স্যার!আমাকে যেতে দিন!আমার মনিমা বাসায়….

    -ওওও!আপনার মনিমা!ইউমিন মিসেস আফরা খানম!তাইনা মিস আহানিতা সিদরাতুল?উরফ্ মিস অদ্রি!

    জামা খামচে ধরে বিস্ময়ে তাকালাম তারদিক।উনি একপলক আমার হাতের দিকে তাকিয়ে আবারো আমার দিক তাকালেন।বাকা হেসে বললাম,

    -স্ট্রেস নিচ্ছেন কেনো?ডোন্ট প্যানিক!আপনার মতো সাহসী মেয়েকে এভাবে ঘাবড়াতে দেখে আমিই ঘাবড়ে যাচ্ছি যে!

    ….

    -আচ্ছা মিস অদ্রি?আপনার কি মনে হয়?আমার এতোবড় সিক্রেট নিজে জেনে,সমাজের বাকিসব রাঘব বোয়াল কার্লপ্রিটদের মতো আমার সিক্রেটটাও এই অদ্রি ছদ্মনামে পেপারে ব্রেকিং নিউজ হিসেবে কভার করবেন আর আমি আপনার বিষয়ে এটুকো জানবো না?তবে একটা বিষয় কি বলুনতো?আপনি মানুষটা বেশ ইন্টারেস্টিং!সবে ভার্সিটিতে পা ফেলেছেন,বয়সটা কতোই বা হবে আপনার?এই এতোটুকো বয়সে এতো সাহস?সিক্রেট রিসোর্চ হিসেবে ভোরের বাংলা নিউজপেপারে বেশ ভালোই সার্ভিস দিচ্ছেন আপনি।অনেক বড়বড় সন্ত্রাসীদের নিয়েও আর্টিকেল লিখেছেন এই অদ্রি ছদ্মনামে।দেখেছি আমি।তাই আপনাকে নিয়ে এটুক আগ্রহ তো আমার থাকবেই!খুব অস্বাভাবিক কিন্তু নয় এটা মিস অদ্রি!

    চোখ নামিয়ে নিলাম।সত্যিই সবটা জেনে গেছেন উনি।আফরা খানম আমার মনিমা।আর তার থেকেও বড় সত্য,আমিই আহানিতা,আমিই অদ্রি।যেটা আজ অবদি কেউই জানতো না।জানতে দেইনি কাউকেই।আমি তো আর পাঁচটা সাধারন মেয়ের মতোই খুব সাধারন একটা মেয়ে।শুধু সাংবাদিকতায় ঝোক একটু বেশি ছিলো ছোটবেলা থেকেই।জার্নালিজম নিয়েই পড়াশোনায় করতে চেয়েছিলাম।কিন্তু মনিমা পড়তে দেয়নি।কারনটাও বলেনি কোনোদিন।তাই ভার্সিটিতে ওঠার পরপরই লুকিয়ে একটা নিউজপেপারের সিক্রেট ইনফর্মার হিসেবে জয়েন করি।অদ্রি ছদ্মনামে।যদিও এটাও আমারই নাম।তবে পরিচিতরা আহানিতাই ডাকে।

    -মিস অদ্রি?

    বাস্তবে ফিরলাম।এএসএ বললেন,

    -আপনার আমার শর্তটা শোনার জন্য,শুধুমাত্র আপনার মানসিক প্রস্তুতির জন্য দুটোদিন ওয়েস্ট করেছি মিস!আজকে ম্যাচ আছে আমার।আর সেখানে হারতে হবে আমাকে!তাই যাওয়ার আগে ইচ্ছে করলো মনটা ভালো করেই বেরোই।আপনাকে বাসায় পৌছে দেওয়ার মতো ভালো কাজটা করেই বেরোই।আর সেটা তখনই সম্ভব যখন আপনি আমার কথায় রাজি হয়ে যাবেন।সো,আপনি রাজি?

    -ক্ কি‌ চান আপনি?

    -শুনুন মিস অদ্….

    -আমি কোনো অদ্রি নই!আমি আহানিতা!আহানিতা সিদরাতুল!

    উনি মুচকি হাসলেন।বললেন,

    –ফাইন!আপনি অদ্রি নন!আমার কাছে আপনার এই পরিচয়টাই যথেষ্ট যে,আপনি আমার বাচ্চার সেরোগেট মাদার!

    আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পরলো।আবারো একইকথা বললেন উনি।এবার তো আমাকেই বলেছেন!কিন্তু এসব কেনো বলছেন উনি?ওনার বাচ্চার সেরোগেট মাদার?আমি?

    -কি যা তা বলছেন আপনি!

    -এএসএ যা তা বলে না মিস অদ্রি!

    -মানেহ্?

    -আপনার আর কোনো প্রশ্নের উত্তর পাবেন না আপনি।তবে আমার শর্তে রাজি না হলে আপনি জানেন না আমি কি কি করতে পারি!আজ হোক,বা কাল!আপনাকে আমার শর্তে রাজি হতেই হবে।ইটস্ ফাইনাল!

    -কি চাইছেন কি আপনি?আম্…

    -আপনার লাইফের দশমাস সময় আমাকে দিতে হবে আপনাকে।এটুকোই!আমার সন্তানকে‌ শুধু দশমাস নিজের গর্ভে ধারন করতে হবে আপনাকে,যাকে বলে সেরোগেট মাদার!তারপরই আপনার মুক্তি।ডোন্ট ওয়ারি,এএসএ স্পর্শও করবে না আপনাকে।জাস্ট টিনি একটা অপারেশন হবে,তারপরই আপনি প্রেগনেন্ট!দশমাস পর বেবি হয়ে গেলেও আপনি পুরোই ভার্জিন থাকবেন।এজ সিম্পল এজ দ্যাট!

    সেরোগেশন!এতোবড় কথাটা উচ্চারন করতে এতোটুকো বাঝে নি তার।এই লোকটা এতো নিচ মানসিকতার লোক কেউ কোনোদিন হয়তো কল্পনাও করতে পারবে না।সবাই তো কতো ভালো ভালো বলে তাকে‌ নিয়ে।আমিও তো তাই জানতাম,মানতাম।আর উনি?ওনার আসল রুপটা জেনে গেছি এই কারনে আমাকে এতো বাজে ভাবে অপমান করতে চাইছেন উনি!না!তা কোনোভাবেই হতে দেবো না আমি।নিজেকে সামলে শক্ত গলায় চেচিয়ে বললাম,

    -স্টপ অল দিজ ননসেন্স!আপনি ভাবলেন কি করে আপনার কথায় আমি সেরোগেশনের জন্য রাজি হয়ে যাবো?এতোটা খারাপ মনের মানুষ আপনি?আপনাকে তো….

    উনি কানটা চুলকে বললেন,

    -ওরে বাবা!সত্যিই আপনার ঝাঝ আছে বলতে হবে!যাইহোক,এসব বলে কোনো লাভ নেই।আমি জানি,আমি কি!শুধু বলুন আপনি রাজি কি না!

    -আমাকে মেরে ফেললেও আপনার এই প্রস্তাবে আমি রাজি হবো না মিস্টার অঙ্কুর!

    -বেশ জোর গলায় বললেন কথাটা?উম্!কারনটা কি এটাই যে এ দুদিনে কোনো ক্ষতি করি নি আপনার?একারনেই ভেবে নিয়েছেন,আপনাকে মেরে ফেলবো না আমি?

    ….

    -শুনুন মিস অদ্রি!আমি সত্যিই মারবো না আপনাকে।জাস্ট আপনার এই সাংবাদিক পরিচয়টা…

    -সবাইকে জানিয়ে দেবেন তাইতো?জানিয়ে দিন!সবাই জেনে গেলে কি?দু চারজন খারাপ লোক,যাদের এগেনিস্টে আমি আর্টিকেল লিখেছি তারা এসে মেরে ফেলবে আমাকে এইতো?কিচ্ছু যায় আসে না আমার তাতে।মৃত্যুকে কোনোদিনও ভয় পাইনি আমি মিস্টার অঙ্কুর!তাই….

    -আরে আরে,শেষ করতে দিন আমাকে!উফ্!অনেক কথা বলতে পারেন আপনি দেখছি!শুনুন,সবাইকে নয়,আপনার মনিমাকে জানাবো শুধু!তার আহানিতা,তাকে লুকিয়ে জার্নালিজমে জড়িয়েছে।তারপর যা হবার….

    থেমে গেলাম আমি।এতোক্ষনে চেচিয়ে প্রতিটা শব্দ উচ্চারন করতে থাকা গলাটার জোর ফুরিয়ে আসতে লাগলো।আমার সাংবাদিকতায় সম্পৃক্ততা মনিমা মানতে পারবে না কোনোদিনও।ও চলে যাবে আমাকে ছেড়ে।একা হয়ে যাবো আমি!কি করে থাকবো মনিমাকে ছাড়া?শেষ হয়ে‌ যাবো!এএসএ উঠে দাড়ালেন এবার।বললেন,

    -এতোটাও বোকা নই আমি মিস অদ্রি যে,আপনাকে মৃত্যুর ভয় দেখাবো।ওটাতো একটা বাচ্চাও জানে,অদ্রি নামটা জীবন বাজি রেখেই ছ মাসে এতোসব নিউজ কভার করে এসেছে।আর আমি তো চাক্ষুস দেখেছি,আপনি আমার বিষয়েও অনেককিছু প্রমানসমেত জোগার করেছেন।মৃত্যুভয় থাকলে প্রদীপ সরকারের ওখানে যেতেন না আপনি!তাই ভয়টা সে বিষয়েই দেখালাম,যা দেখে সত্যিই ভয় পান আপনি।আপনার মনিমার সঙ্গ!এবার বাকিটা আপনি ঠিক করুন!

    শব্দ করে কেদে দিলাম আমি।বললাম,

    -কেনো এমন করছেন আপনি?আপনার কি ক্ষতি কর্…

    -কোনো ক্ষতি করেননি আপনি আমার।কিন্তু হ্যাঁ,আমার কথা না মানলে আপনার ক্ষতি হয়ে‌ যাবে।আপনার পরিচয়,আপনার সম্মান কিছুই অবশিষ্ট রাখবো না আমি।যতোটা ভালো বলে সবাই আমাকে চেনথ,ততোটা ভালো কিন্তু আমি নই!আমার চাওয়া পুরন করতে,সব সীমা পার করতে পারি আমি।তাই ভেবেচিন্তে সিদ্ধান্ত,সরি সিদ্ধান্ত কেনো বলছি?ভেবেচিন্তে বেশি সময় না নিয়ে তাড়াতাড়িই হ্যাঁ বলুন!আপনি অবশ্যই শুধুমাত্র দশমাস আমাকে না দিয়ে,আজীবনের তরে নিজের সম্মান আর মনিমাকে হারাতে চাইবেন না রাইট?ডিসিশন ইজ ইউরস্!যতো তাড়াতাড়ি হ্যাঁ বলবেন,ততো তাড়াতাড়িই স্বস্তি,মুক্তি দুটোই পাবেন!মেক এভরি সেকেন্ডস্ কাউন্ট মিস অদ্রি!

    চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পরতে লাগলো আমার।প্রদীপ সরকারের ওখানে তাদের হাতেই মরতে পারলে হয়তো তা ভালো হতো।যখনতখন ধরা পরলে মৃত্যু,এমনটা জেনেই এই কাজে নিজেকে জরিয়েছিলাম আমি।কিন্তু উনি যা বলছেন তা তো মৃত্যুর চেয়েও বড় শাস্তি হবে আমার কাছে।ওখান থেকে বাচিয়ে এনে আরো বড়,ভয়ানক শাস্তি দিতে চাইছেন উনি আমাকে।দরজা খুলে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন এ এস এ।কি মনে করে আবারো পিছন ফিরলেন।বললেন,

    -আমি চাইলেই আপনার প্রেগনেন্সির দুদিন হয়ে যেতো আজ!কিন্তু আমি আপনাকে জোর করতে চাইনা।তাই আমার ভদ্র ব্যবহার চলাকালীনই রাজি হয়ে‌ যান।আমার বেবি চাই,আর সে আপনার গর্ভেই বেড়ে উঠবে মিস অদ্রি!এট এনি কস্ট!

    দম মেরে বসে রইলাম মেঝেতেই।মাথা কাজ করছে না আমার।ওনার বাচ্চা চাই,তবে বিয়ে করছেন না কেনো?সেরোগেশন করিয়ে বাচ্চার কি দরকার?যদি তাও হয়,তবে এর জন্য আমিই কেনো?এতোবড় শাস্তি কেনো দিতে চাইছেন উনি আমাকে?শুধুমাত্র ওনার জীবনের একটা চরম সত্যি জেনে গেছি বলে?নাকি আরো বড় কোনো কারন?

    #সবটাই_তুমিময়
    #লেখনিতে-মিথিলা মাশরেকা
    সূচনা পর্ব

    [

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here