#সম্পর্ক
#১১
আবিরদের বাসা একই এলাকায়। হেঁটে গেলে বিশ মিনিটের মতো লাগে৷ আর রিকশায় গেলে সাত থেকে দশ মিনিট। বাসায় আসার পর থেকেই রতি চুপচাপ গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। তার মাথা কাজ করছে না এখন। কিছুক্ষণ আগেও চোখেমুখে যেই ক্ষিপ্রতা, রাগ, জিদ ছিল, তার ছিটেফোঁটাও নেই। উলটো মনে হচ্ছে, কেন চলে এলাম? আর কী কোনোদিন যেতে পারব ওই বাসায়? আবার আসার আগে বলে এসেছি, ডিভোর্স দেওয়ার কথা। আরাফ কী সত্যিই ডিভোর্স দিয়ে দিবে আমাকে? যদি দেয়, এরপর জীবন টা কী থমকে যাবে না? যেই লোকটা আমাকে ভালোবাসেনি, আগলে রাখেনি, প্রতি মুহূর্তে দিয়ে গেছে শারীরিক মানসিক অশান্তি, যেই পরিবারে আমি চাকরানির চাইতেও খারাপ অবস্থায় ছিলাম, সেখানে যাওয়ার জন্য আবার কেন উতলা হচ্ছে আমার মন-প্রাণ? তবে কী মেয়েরা এমন? সংসারের মায়া ত্যাগ করা তাদের পক্ষে খুব কষ্টের?
রতির মাথার রগ দপদপ করছে। হাজারটা প্রশ্ন মাথায়, অথচ একটি উত্তরও নেই। সে একহাতে কপাল চেপে ধরল। মনে হচ্ছে, কপাল ছিঁড়ে খুলে আসবে এক্ষুনি…
আবির ঘরে ঢুকলো সেই সময়েই। কারো উপস্থিতি টের পেয়ে রতি কপাল থেকে হাত সরিয়ে সোজা হয়ে বসল। তাকিয়ে দেখল, আবির কে। তার হাতে দুটো মগ, একটি মগ রতির দিকে বাড়িয়ে দিতে দিতে বিছানায় বসল আবির। রতি একটু হেসে মগটা নিল।
‘কেন চিন্তা করছেন ভাবি?’ কফি মগে এক চুমুক দিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়লো আবির। রতি জবাব দিল না। এই প্রশ্নের উত্তর তার নিজের কাছেই নেই!!
আবির রতির মনের অবস্থা একটু হলেও টের পেলো। দু’জনেই নিরব, রতি অন্যমনস্ক ভাবে কফি মগে চুমুক দিচ্ছে। কফির স্বাদটা ঠিক কেমন লাগছে, সেদিকে খেয়াল নেই তার। খেতে হচ্ছে বলেই খাওয়া! আবির খেয়াল করল। নিরবতা ভেঙে বলল, ‘ভালো না লাগলে খেতে হবে না ভাবি।’
রতি হকচকিয়ে উঠল একটু, সৌজন্যমূলক হাসি হেসে বলল, ‘না, না, ঠিক আছে। ভালো লাগছে খেতে।’
‘মিথ্যে কেন বলছেন? আমি দেখছি তো, আপনার মন নেই খাওয়ায়।’
রতি দীর্ঘশ্বাস ফেললো। এরপর চুপসানো গলায় বলল, ‘আসলে, যেটা হলো, আমি এখনো শক থেকে বেরোতে পারছি না। আমি কী করে পারলাম ও’কে মারতে?’ রতি মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। তার চোখের পাতা ভিজে উঠছে। সে কাঁদতে চাইছে না, ঠেলেঠুলে কান্নারা বেরিয়ে আসছে, সে শত চেষ্টা করেও আঁটকাতে পারছে না।
আবির পূর্ণ দৃষ্টি মেলে রতিকে দেখল। আফসোস হচ্ছে তার আরাফের জন্য। মানুষ ভালোবাসার কাঙাল হয়, কত মানুষ হাজার চেষ্টা করেও সত্যিকারের ভালোবাসা পায় না, আর এদিকে আরাফের কপাল আছে বলতেই হয়। না চাইতেও একটা মেয়ের পরিপূর্ণ ভালোবাসা সে পেয়েছিল,আরাফের জন্য দিনকে রাত ধরতেও রাজি ছিল রতি! অথচ আরাফ পাত্তাই দিল না!
যদি একটু বুঝতো আরাফ, তাহলে এদের মতো সুখী মানুষ খুব কমই হতো দুনিয়ায়। আবিরের বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সে খুব চেষ্টা করেছে দুপুরকে ভালোবাসতে, বেসেছেও, দুপুরের প্রতিটি ইচ্ছা, স্বপ্ন পূরণ করার জন্য পরিশ্রম দ্বিগুণ বাড়িয়ে দিয়েছিল, অথচ মানুষটি রইল না! কী নিষ্ঠুর ভালোবাসার সংজ্ঞা কারো কারো কাছে!
রতি নিজেকে সামলে নিয়েছে। কফিটুকু সব শেষ করে মগ রাখতেই আবির বলে উঠল, ‘কিছু জিনিস আছে ভাবি।’
‘কী জিনিস?’ চোখ তুলে তাকাল রতি। আবির মগ ফেলে উঠে দাঁড়াল। এই ঘরটি তারই, তবে আপাতত এটি রতির জন্য ছেড়ে দিবে সে। আবির তার বাবার রুমে শিফট হবে ভাবছে।
আলমারি থেকে একটা বড় প্যাকেট বের করে নিয়ে আসলো আবির। বিছানায় রেখে বলল, ‘দুই মাস আগে দুপুরের জন্য কিছু কসমেটিক প্রোডাক্ট কিনেছিলাম। কেউ দেশে আসলে তাকে দিয়ে পাঠাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তার আগেই তো… যাইহোক, এগুলো আপনি আর শিমি ব্যবহার করে শেষ করে ফেইলেন কেমন?’
রতি অপ্রস্তুত হয়ে উঠল, ‘না, না, আমি কীভাবে অন্যের জিনিস ব্যবহার করি? এমনিতেও আপনারা আমার জন্য অনেক করলেন!’
‘অন্যের জিনিস কীভাবে হলো ভাবি? তাকে তো দিলামই না! এগুলো এখন মালিক বিহীন, তাই আপনাকে দিয়ে দিলাম। আর এভাবে বলে ছোটো করবেন না ভাবি। একটা মানুষ কে সুন্দর জীবন দিতে পারা, কতজন মানুষ পারে বলুন তো! আল্লাহর হুকুমে আমি পেরেছি, এরচেয়ে সুখের আর কী হয়?’
রতি চুপ করে রইল। আবির মগ দুটো নিয়ে ঘর ছেড়ে বের হওয়ার জন্য উদ্যত হতেই রতি ডাকল, ‘শুনুন..’
আবির ঘুরে তাকাল, ‘জি ভাবি।’
‘ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি না থাকলে আমার জীবন টা এভাবেই শেষ হয়ে যেতো হয়তো!’
‘ধন্যবাদের কিছু নেই। আপনার সার্টিফিকেট গুলো কী সব ওই বাসায়?’
‘হুঁ।’
‘আনানোর ব্যবস্থা করতে হবে। আপনার জন্য একটা চাকরি আমি ঠিক করে দেওয়ার চেষ্টা করব। কিন্তু ওগুলো আনাবেন কী করে? ওই বাসায় আপনার ছায়া পড়লেও ওরা ক্ষেপে উঠবে।’
রতি একটু ভেবে বলল, ‘আহ্নি আছে। ও’কে বললে…’
আবির হাসল, ‘আহ্নি আর দুপুর একই মায়ের পেট থেকে জন্মেছে। অথচ দু’জন দু’মনের মানুষ!আহ্নি মেয়েটা খুব ভালো, তাই না ভাবি?’
‘ওই বাসায় ও ছিল বলেই, বেঁচে থাকার জোর পেয়েছিলাম।’
‘হুম। আচ্ছা থাকেন ভাবি, আমি যাই। একটু বেরোবো।’
‘জি, আচ্ছা।’
আবির চলে যায়। রতি বোরকা খুলে বসে। ঘরের সাথেই লাগোয়া বারান্দা আছে। রতি সেখানে গিয়ে থমকে গেল। এতো এতো টবে ফুল গাছ দেখে রতির বিষন্ন মনটা হুট করেই ভালো হয়ে উঠল। ফুলের গাছ, বাগান, তার ছোটো থেকেই প্রিয়। বাবার বাড়িতে কোনোদিন বাগান করার সামর্থ্য হয়নি, টাকা কে দিবে? আর আরাফকে বহুবার বলেও রতি পাত্তা পায়নি।
এই বাসা টা আবিরের বড় আপার। তার নাম রুবি রহমান। তিনি বিদেশে থাকেন আবিরের মায়ের সঙ্গে। ওখানে কাপড়ের দোকান আছে উনাদের। আর তার হাজবেন্ড, সামিউল রহমান, এক মেয়ে শিমি, এই বাড়িতে থাকে। আবিরদের বাড়ি এখনো কমপ্লিট হয়নি দেখে আবিরের বাবাও এখানেই থাকেন, মেয়ের জামাই আর নাতনি সমেত। আবিরের বাবা আর সামিউল রহমানের একটা জায়গায় মিল, তারা দুজনেই হার্টের রোগী। শিমির বাবার তো একদম ওপেন হার্ট সার্জারী। দু’জনেই ভারী, বা পরিশ্রমের কাজ করতে পারে না বলেই স্ত্রীরা বিদেশ চলে গেছে অথচ তাদের ছেড়ে যাওয়ার কথা কখনোই ভাবেনি! এরকম স্ত্রী ও খুব কমই দেখা যায় বর্তমানে! আবিরদের পরিবারের সবাই-ই ভীষণ ভালো মনের মানুষ। আবিরের মেজো আপা তুবা চৌধুরী স্বামীর সঙ্গে গ্রামে থাকেন। বছরে একবার আসেন।
‘মামী।’ ডাক শুনে রতি পেছনে তাকাল। শিমি দাঁড়িয়ে, হাসিখুশি মুখ তার। রতি চোখ কপালে তুলে বলল, ‘এ কী শিমি! এই অবস্থা কেন শরীরের? আগে তো এত শুকনো ছিলে না!’
শিমি তার সব কয়টি দাঁত বের করে হাসল, ‘আমি খুব খাই তো, তাই এই অবস্থা।’
‘আজকালকার ছেলেমেয়ে খাওয়া দাওয়ায় এত অনীহা কেন দেখায়? বলতে পারো?’
‘জানি না মামী। আমার হাতে নিয়ে খেতে ইচ্ছে করে না। আর বাবা তো পুরো ঘরই সামলায়, তাই তাকে বেশি একটা চাপ দেইনা খাইয়ে দেওয়ার জন্য। আম্মু আসলে আমার শরীর আর এরকম থাকবে না মামী।’
রতি শিমিকে নিয়ে ঘরে ঢুকল।
‘পড়াশোনা কেমন চলছে?’
‘পড়াশোনা ওর মতোই আছে। শুধু আমি ধরতে পারছি না ও’কে।’ বলে আবার হাসল শিমি। ফকফকে দাঁত গুলো উঁকি দিলো।
রতির ভালো লাগছে। বুকের ভারটা কমছে।
‘ফাঁকিবাজি করলে একদম চলবে না। ঠিকঠাক স্কুলে যাও?’
‘যাই। প্রতিদিন যাই। না গিয়ে উপায় আছে? যে দজ্জাল বাবা!’
আবার হাসল শিমি। এই মেয়ে এতো হাসতে পারে! রতির দু’চোখে ধরা দিলো মুগ্ধতারা….
সেও তাল মিলিয়ে হাসছে শিমির সাথে। দু’জনে খোশ গল্পে মেতে উঠে। শিমিকে দেখে মনে হচ্ছে, তার ভেতর অনেক গল্পরা জমা হয়ে ছিল এতোদিন। উপযুক্ত মানুষ না পাওয়ায়, গল্পগুলো কাউকে বলা হয়নি! আজ পেয়েছে, তার মুখ খুলে গেছে।
__________
দরজায় দুমদাম শব্দ হতেই আহ্নি সাউন্ড বক্সটা বন্ধ করে দিলো। চুলগুলো ঠিক করে গায়ে ওড়না নিয়ে সে দরজা খুলতেই, লিলি বেগমের শক্ত চড়ে মাথা ঘুরে উঠল তার। তিন-চার কদম পিছিয়ে গিয়ে নিজেকে সামলালো। রাগ করার বদলে হেসে ফেললো আহ্নি। তাকিয়ে দেখল, ভয়ংকর আগুন চোখে লিলি বেগম তার দিকে তাকিয়ে আছেন। আহ্নির হাসির মাত্রা বাড়লো। রতি যেভাবে সবাইকে গাছবলদ বানিয়ে চলে গেছে, ব্যাপারটা আহ্নির মনে খুশির জোয়ার সৃষ্টি করেছে।
‘তোর দাঁত ভেঙে দিবো, মা**’ কিড়মিড় করে বললেন লিলি বেগম। আহ্নি তবুও হাসি থামালো না। উলটো ব্যঙ্গ কণ্ঠে বলল, ‘ভাবি কীভাবে তোমাকে বলল, এই যে নাটের গুরু! হা হা হা.. কথাটা মনে পড়লেই আমার পেট ফেটে যাচ্ছে হাসিতে আম্মু।’
লিলি বেগমের পায়ের তলা শিরশির করছে। হাত দুটো নিশপিশ করছে। মাথার ভেতর আগুন জ্বলছে দাউদাউ করে, তিনি এগিয়ে এসে হাত তুলে যেই না আহ্নির গালে আরেকটি চড় বসাবেন, ওমনি আহ্নি তাকে পুরোপুরি স্তব্ধ করে দিয়ে, তার হাতটা খপ করে ধরে বসল।
টেনে আসা গলার স্বরে বলল,
‘আমি ভাবি না আম্মু। আমি আহ্নি। আর আহ্নি ভীষণ বেয়াদব। বড়দের সাথে বেয়াদবি করতে আমার চেয়ে ভালো কেউ জানে না।’
‘কুত্তার বাচ্চা, তুই কোন সাহসে আমার হাত ধরছিস? এতো সাহস বাড়ছে, কলিজা বড় হয়ে গেছে? তোর একদিন কী…’ গর্জে উঠলেন লিলি বেগম।
আহ্নি শান্ত স্বরেই বলল, ‘লাভ নেই চেঁচিয়ে। আমাকে তুমি কিছুই করতে পারবে না। আমি শিশু নির্যাতন মামলা করব আম্মু। তুমি জানো, আমি সব পারি, সব…’ বলেই বা চোখ টিপলো আহ্নি। লিলি বেগমের গায়ে জ্বালা ধরে গেল।
‘বের হ তুই, ওই মা** ঝি যেমনে গেছে, তুইও ওমনে যা গা.. বাইর হ.. এখুনি বাইর হবি।’
‘আমাকে আমার অধিকার ভাগ করে দাও৷ চলে যাই।’
‘তোর অধিকার তোর পেছন দিয়ে দিমু জানোয়ারের বাচ্চা।’
‘না দিলে আমিও যাব না। আমাকে ঠেলেও সরাতে পারবা না। আর যদি আমাকে মারতে আসো তো…’
আহ্নি কথা থামিয়ে রহস্য করে হাসলো। লিলি বেগম কটমট করে বললেন, ‘কী করবি? কী করবি তুই?’
‘তেমন কিছু না। রাতে সবাই ঘুমালে বটিটা নিব, তারপর যাস্ট… কোপাবো।’ বলেই কোপানোর ভঙিমা করে দেখালো হাত দিয়ে।
লিলি বেগম পাথর চোখে তাকিয়ে আছেন। বিশ্বাস হচ্ছে না, আহ্নির সাহস এই পর্যায়ে চলে গিয়েছে!
‘বুঝলে আম্মু, যেভাবে গরু কোপায়, ওভাবে করে, একদম ক্যাঁচক্যাঁচ… তারপর জায়গায় জায়গায় টুকরো গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আমি নিরুদ্দেশ হয়ে যাব।’
হাই তুললো আহ্নি। লিলি বেগম কে চুপসে যেতে দেখে হেসে ফেললো, হো হো করে।
‘আরে চিল! আমি এতটাও পাষাণ নই যে মানুষ খুন করে ফেলবো বুঝলে? আচ্ছা এখন যাও। আমি একটু ঘুমোবো। অনেকদিন পর শান্তির ঘুম হবে আমার।’
লিলি বেগম কিছু বলতে যাচ্ছিলেন, আহ্নি তার ধরে তাকে টেনে রুমের বাইরে বের করে দরজা আঁটকে দিলো। স্তব্ধ লিলি বেগম রাগে আর বিস্ময়ে ফেটে পড়লেন। ভয়াবহ কতগুলো গালি দিয়ে দরজায় লাথি মারলেন, ককিয়ে উঠলেন নিজেই। লাথিয়া জোশের বসে জোরেই মারতে গিয়ে নিজেই ব্যথা পেয়েছেন।
ঝিলম হাত গুটিয়ে বসে আছে। তাশরিফ বার বার তাকে ঠেলছে দুপুরের রান্না বসানোর জন্য, ঝিলম যাচ্ছে না। তার এক কথা, সে এতো কাজ একসাথে করতে পারবে না। সে এই বাসায় চাকরের খাটনি খাটতে আসেনাই। সবাই শুয়ে-বসে কাটাবে আর সে কাজ করবে? দরকার পড়লে এই বাড়ি ছেড়ে চলে যাবে, তাও পারবে না। তাশরিফ ঠান্ডা মাথায় থাকার চেষ্টা করছে, পারছে না। ঝিলম কে কিছু বলা মানে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারা। দু’দিন আগে ঝিলমের বাবার সঙ্গে কথা হয়েছে তার। উনি তিন-চার দিনের ভেতরেই আসবেন। তিনি নিজ থেকে বলেছেন, যা হয়েছে হয়েছে। উনি সবকিছু দিবেন, তাশরিফ কে ব্যবসা ধরিয়ে দিবেন। এখন ঝিলমের সাথে রাগারাগি মানে সব হারানো।
তাশরিফ রাগ নিয়ে রুম ছেড়ে বেরোলো। লিলি বেগম বিরষ মুখে পান চাবাচ্ছেন, তাশরিফ এসে বলল, ‘আম্মু, আজকে দুপুরে তুমি রান্না কইরো?’
লিলি বেগম অবাক, ‘কেন? আমি কেন করব?’
‘এমনি আম্মু। তোমার হাতের রান্না কতদিন খাইনা! আজ খুব খেতে..’
‘বাহানা করিস না। কী হইছে বল, আমি বাহানা পছন্দ করি না।’
তাশরিফ দীর্ঘশ্বাস ফেলে সবকিছু খুলে বললো।লিলি বেগম ক্রোধে কেঁপে উঠলেন, ‘সব কয়টা ধান্দাবাজি শুরু করছে আমার সাথে! ওরে এখন কিছু বলিস না। একবার ওর বাপে সবকিছু দিক, তারপর ওর তেল মজামু।’
তিনি বিরক্ত ভঙ্গিতে উঠে গেলেন, রান্নাঘরে।
________
সারাদিন রতির এর-ওর সাথে কথা বলেই কাটলো। বিদেশ থেকে বড় আপা, আবিরের আম্মাও ফোন দিয়ে রতির সাথে কথা বলেছিলেন। বড় আপা তো ইচ্ছেমতো দুপুরকে বকলেন, আবিরের আম্মা শুকরিয়া আদায় করলেন ওরকম একটা মেয়ে তার ছেলের ঘাড় থেকে নেমেছে দেখে। আর রতিকে বলেছেন, নিজের বাড়ি মনে করে থাকতে। এখানে অস্বস্তি বা লজ্জার কিছু নাই। বড় আপা খানিকটা চিন্তামুক্ত। ঘরে একজন মেয়ে তো এসেছে, এবার সংসার টা গুছিয়ে যাবে…
গ্রাম থেকে মেজো আপাও ফোন দিয়ে রতির সাথে কান্নাকাটি করেছেন। তিনি আসতে পারেন না দেখে সবসময় চিন্তায় থাকেন। এরা বুয়ার রান্না খেতে পারে না৷ নিজেরা রেঁধে খায়। কী রাঁধে, কী খায়, এই চিন্তা আপাতত মাথা থেকে নামলো বিধায় উনি রতির উপর খুব খুশি। বুক ভরে রতির জন্য দোয়া করেছেন।
মাগরিবের নামায পড়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল রতি। এত এত ভালোলাগার মাঝেও কোথাও একটা অশান্তি হচ্ছে তার। ভাবছে, আরাফ কী করছে? সে কী আসবে রতিকে ফিরিয়ে নিতে? যদি আসে, রতি কী যাবে? রতির দু’ঠোঁট কেঁপে উঠে, চোখ ভেঙে কান্নারা নামে দল বেঁধে। রতি ফিসফিসিয়ে বলে, ‘একটু ভালোবাসতে আরাফ, খুব কী ক্ষতি হতো? আমি তোমায় যথেষ্ট সুখী রাখতাম!’
ঠিক তখনি একটা কিছু এসে রতির কপালে লাগে, খুব শক্ত ভাবে। রতি পিছিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ায়। না চাইতেও মুখ থেকে বেরিয়ে আসে গোঙানি। রতি কপালে হাত দিতেই হাত ভিজে উঠে রক্তে। রতির মাথা ঘুরে যায়, কপাল ফেটে গেল?
রতি অস্থির চোখে এদিক ওদিক তাকায়। বাইরে সন্ধ্যার আঁধার, অনেক দূরে একটা রোড লাইট জ্বলছে। রাস্তাটা অন্ধকারই বটে, সেই অন্ধকারেও রতি দেখল, একটা পুরুষ অবয়ব পালাচ্ছে। রতি ভালোমতো দেখতে সামনে আগাতেই পায়ে কিছু লাগল। নিচু হয় রতি। একটা কাগজে প্যাঁচানো কিছু, রতি খুলে হতভম্ব হয়ে যায়।
ইট পেঁচিয়ে কাগজ ছুঁড়ে মেরেছে আরাফ, সেখানে গোটাগোটা অক্ষরে লেখা,
তোমার জীবন ঝাঁঝরা করে দিব রতি। তৈরি থেকো।
—তোমার চিরশত্রু আরাফ।
রতি হাত-পা ছড়িয়ে ক্লান্ত ভঙ্গিতে বসে পড়ে। বিশ্বাস হচ্ছে না এখনো, যার কথা ভেবে এক মিনিট আগেও চোখের পানি ঝরাচ্ছিল সে, সেই মানুষটা তার কপাল ফাটিয়ে দিল!
চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া_রুহি