সম্পর্ক
অলিন্দ্রিয়া রুহি
|পর্ব ২|
__________
আহ্নি এক হাতের উপর অন্য হাত রেখে রাগে ফেটে পড়ছে। এই মেয়েটা একদম অন্য ধাচের হয়েছে। যেখানে এই পরিবারের অন্য সবাই রতিকে কাজের মেয়ে বৈ অন্য কিছুই ভাবে না, সেখানে আহ্নি রতিকে বড় বোনের মতো সম্মান করে, ভালোবাসে। কেউ রতিকে একটা খারাপ কথা বললেও আহ্নি তার প্রতিবাদ করে। আর আহ্নির সামনে রতির গায়ে হাত তোলা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার! আহ্নির মাঝে মাঝে এতো জিদ লাগে, ঘৃণা হয় জাস্ট। এই পরিবার তার পরিবার, এটা ভাবতেও আহ্নির বিরক্ত লাগে।
রতি উঠে যাচ্ছিল, আহ্নি কপাল কুঁচকে জিজ্ঞেস করে, ‘যাচ্ছো কই?’
–‘নাশতা বানাতে হবে। অর্ধেক করে চলে এসেছি।’
–‘তুমি এদের জন্যে নাশতা বানাবে? এসব জানোয়ারদের জন্যে?’
রতি ক্ষীণ গলায় বলল, ‘আহ আহ্নি, একটু আস্তে বলো প্লীজ।’
–‘কেন আস্তে বলবো? আমি কী কাউকে ভয় পাই নাকি?’
–‘তুমি না পাও, আমি পাই আহ্নি। তোমার এসব কথাবার্তার রিয়েকশন কিন্তু আমার উপর এসেই পড়বে পরে!’
আহ্নি এবার একটু নিভলো। কথা সত্য, সবাই ভাবে আহ্নির এরকম প্রতিবাদী রূপের পেছনে রতিরই হাত রয়েছে। আহ্নি ছোটো মানুষ তাই অনেক কিছুই বোঝে না। এই সুযোগটা নিয়েই আহ্নির কানে উল্টাপাল্টা কথা ঢোকায় রতি আর আহ্নি এরকম আচরণ করে।
আহ্নি উঠে দাঁড়াল, ‘তাহলে আমিও আসি। আমি তোমাকে হেল্প করবো ভাবি।’
রতি কথা বাড়ালো না। আহ্নি যেহেতু একবার বলেছে সে হেল্প করবে, মানে করবেই;কোনো কিছুতেই আহ্নির সিদ্ধান্ত টলানো যাবে না। রতির পিছুপিছু আহ্নিও রান্নাঘরে এসে ঢুকলো। রতি দ্রুত হাতে রুটি বেলতে বসল, আহ্নি রুটি গুলো ভাজতে শুরু করল। খানিকবাদেই রতির বড় ভাসুর, তাশরিফ রান্নাঘরে উঁকি দিলেন। নাকমুখ কুঁচকে ভার গলায় রতির উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুঁড়লেন, ‘আজ এতো দেড়ি হচ্ছে কেন নাশতা দিতে?’
–‘আর পাঁচ মিনিট ভাইয়া। রুটি ভাজা প্রায় শেষ।’ উত্তর দিলো আহ্নি। তাশরিফ এবার পরিপূর্ণ ভাবে রান্নাঘরের ভেতরে তাকাল, দেখল আহ্নি চুলোর কাছে। তাশরিফ কিছু না বলে চলে গেল। একটু পরেই লিলি বেগম আর দুপুর কেমন গরম মেজাজে রান্নাঘরে পা রাখলেন।
–‘এই তোর পড়াশোনা নাই? তোর এখানে কী কাজ হ্যাঁ?’ আহ্নিকে উদ্দেশ্য করে বলল দুপুর। রতির ভয়ে বুক কাঁপছে। এখনি আবার কোন তুলকালাম শুরু হয়ে যাবে, কে জানে! লিলি বেগম এমন ভাবে রতির দিকে তাকালেন যেন পারলে এক্ষুনি গিলে খাবেন রতিকে।
আহ্নি নির্লিপ্ত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘আমার পড়াশোনার মাথা ব্যথা একান্তই আমার। তুমি কী বুঝো পড়াশোনার আপা?’
দুপুর চোখ রাঙিয়ে বলে, ‘বেয়াদব হয়ে গেছিস! আমার সাথে বেয়াদবি করিস?’
শেষ রুটিটা ভেজে আহ্নি চুলো বন্ধ করে দুপুরের দিকে তাকাল। শক্ত কণ্ঠে বলল, ‘তুমি নিজেও তো বেয়াদব। ভাবির সাথে বেয়াদবি করেছো!’
দুপুর ঠাস করে আহ্নির গালে একটা শক্ত চড় বসিয়ে দিয়ে লিলি বেগম কে বলল, ‘দেখছো আম্মা? তোমার মেয়ের সাহস দেখছো? এই এইটুকুন মেয়ে, অথচ তেজের ঠ্যালায় বাঁচি না। গলায় পাড়া দিয়ে দমবন্ধ করে ফেলবো বেয়াদব।’
আহ্নি হাসল, রোষপূর্ণ তাচ্ছিল্যভরা হাসি, ‘আর আমি কী চেয়ে চেয়ে দেখবো? আমার কী হাত-পা নেই? আমি কী কিছুই করব না? দশটা খেলে দুইটা তো অন্তত দিতে পারব তাই না?’
দুপুর স্তব্ধ নয়নে আহ্নির তেজ দেখছিল। তখন লিলি বেগম আহ্নির মুখোমুখি হয়ে দাঁড়ালেন। বললেন, ‘তোকে এই শিক্ষা দিছি আমি? বড় বোনের সাথে এভাবে ব্যবহার করতে হয়?’
–‘আমার যথেষ্ট শিক্ষা আছে আম্মা। শিক্ষা নাই তোমার বড় মেয়ের। তাকে শিখাও আরও। কীভাবে বড় ভাইয়ের বউয়ের সাথে আচরণ করতে হয় বোঝাও। আমার তো মনে হয়, তোমার নিজেরও অনেক কিছু শেখার বাকি আম্মা।’
লিলি বেগম ক্ষুব্ধ; আহ্নির গালে ঠাস ঠাস করে চড় মারতে লাগলেন। রতি এসে ধরার চেষ্টা করল, পারল না। দুপুর রতিকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল। রতি অনুনয় করল, ‘আম্মা, আম্মা ওকে মারবেন না, আম্মা ছাড়ুন আহ্নিকে। ছেড়ে দিন। ও বাচ্চা মানুষ।’
–‘বাচ্চা মানুষের এত তেজ কই থেকে আসে, দেখব আজ।’
লিলি বেগমের প্রতি কোনো প্রতিবাদ করল না আহ্নি বরং চুপচাপ মার সহ্য করে গেল। কিন্তু যেই দুপুরও এগিয়ে গেল মারবে বলে, ওমনি আহ্নি নিচু হয়ে বটিটা হাতে তুলে নিল। আক্রোশপূর্ণ গলায় বলল, ‘খোদার কসম, তুই যদি আমার গায়ে একটা স্পর্শ ও করিস, তোর হাত আমি কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলব।’
হাত খোঁপা করা ছিল আহ্নির চুল, মারামারিতে সেগুলো খুলে আলুথালু হয়ে গেছে। লাল চোখের ফর্সা মেয়েটিকে দেখতে কোনো অশরীরীর চেয়ে কম লাগছে না। সেই সাথে আবার হাতে বটি আরো ভয়ংকর রূপ ধারণ করিয়ে দিয়েছে…
আহ্নির এমন ভয়ংকর রূপ দেখে দুপুর পিছিয়ে গেল, লিলি বেগম থেমে গেলেন। আহ্নি ছুঁড়ে ফেলল বটিটা, তারপর একটা ঘৃণা ভরা দৃষ্টি মা-বোনের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে দিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে গেল। রতি এক কোণে দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ। তার চোখ ভর্তি পানি। তার কারণে আহ্নি কতকিছু সহ্য করে, অথচ সে আহ্নিকে রক্ষা করার জন্য কিছুই করতে পারে না! এতটাই অসহায় আল্লাহ তাকে বানিয়েছে…! আল্লাহ বানিয়েছে? নাকি রতি নিজেই নিজেকে অসহায় করে তুলছে? কী হয় একটু সাহস করে সবার মুখোমুখি দাঁড়ালে? উপন্যাসের নায়িকাদের মতোন ওত শক্ত মনের জোর, রতির কেন হয় না? প্রশ্ন হাজারটা, উত্তর কোথায়?
দুপুর কটমটে চোখে রতিকে দেখতে দেখতে বলল, ‘এই ডাইনির কারণে আমার বোনের আজ এই দশা আম্মু। ও আহ্নিকে নষ্ট করছে। আহ্নিকে বিগড়ে দিছে।’
রতি ‘আল্লাহ, আল্লাহ’ করছে মনে মনে। কিছুক্ষণ আগে আরাফ যেই ঝড় তুলে দিয়ে গেছে শরীরে, তার ব্যথায় নড়াচড়া করতেও কষ্ট হচ্ছে। এখন যদি আবার দুপুর আর লিলি বেগম মিলে ওর উপর চড়াও হয় তবে রতির প্রাণটাই বেরিয়ে যাবে… আল্লাহ রতির প্রার্থনা শুনলেন। দুপুরের ফোনটা বেজে উঠল। দুপুর দৌঁড়ে চলে গেল। লিলি বেগম ও চুপচাপ প্রস্থান করলেন। রতি হাঁফ ছেড়ে বাঁচল…
আবির ফোন করেছে, দুপুর দ্রুত ঘরের দরজা আঁটকে দিয়ে ফোন রিসিভ করল। বলল, ‘হ্যালো, আবির।’
ওপাশ থেকে আবিরের গলা ভেসে এলো, ‘রিসিভ করতে টাইম লাগল যে! কী করছিলে?’
–‘ঘুমোচ্ছিলাম। তোমার ফোন পেয়ে উঠলাম।’
–‘ও.. এখনো উঠোইনি বিছানা ছেড়ে?’
–‘উঁহু..’
–‘তোমাদের ওখানে তো বোধহয় সাড়ে আটটার উপরে বাজে। তাই না?’
–‘হ্যাঁ।’
–‘এত বেলা করে ঘুমালে চলে দুপুর? মেয়ে মানুষ সকাল সকাল উঠবা। তোমার ভাবিকে ঘরের কাজে সাহায্য করবা।’
দুপুরের মেজাজ যথেষ্ট চড়ে গেল, তবু সে নিজেকে ঠান্ডা রাখল। বলল, ‘আমি কেন ভাবি কে সাহায্য করতে যাব?’
–‘সে পরের ঘরের মেয়ে বলে তাকে সাহায্য করা যাবে না? এই কথা কোনো হাদিসে লেখা আছে?
–‘না নেই। কিন্তু তারপরেও আমি তাকে কোন দুঃখে সাহায্য করতে যাব? আগে তো আমি আর আম্মুই ঘরের সব কাজ করতাম তাই না? আহ্নি ছোটো ছিল বিধায় ও কিছুই করতো না। আমি অনেক করেছি, আর কত? আর ভাইয়া বউ আনছে কী ঘরে সাজিয়ে পুজো দেওয়ার জন্য বলো? বাড়ির বউ ঘরের সব কাজ করবে, এটাই তো স্বাভাবিক তাই না? যতটুকু আরাম আয়েশ করার সেটা তো বাপের বাড়ি থেকেই করে এসেছে। শ্বশুর বাড়ি নিশ্চয়ই আরাম আয়েশ করার জায়গা না!’
আবির হেসে ফেলল, ‘বাপরে… কত লম্বা রচনা! পিএইচডি করে ফেলেছ নাকি এসবের উপর?’
–‘আচ্ছা আবির, তোমাদের বাড়ি গেলে আমিও তো কাজ করেই খাব তাই না? নাকি আমাকে সাজিয়ে রাখবে সু-কেসে? কোনটা?’
আবির ঠোঁটের হাসি চওড়া করে বলল, ‘বিয়ের পর তুমি আমাদের বাসায় গেছ হাতে গোণা ১০-১৫ দিন। তাও যতবার গেছ, ঘুম থেকে উঠছ সকাল দশটায়। আমার বড় দুলাভাই নিজ হাতে তোমার জন্য সকালের নাশতা টা বানিয়ে রাখত দুপুর। সে দুপুরের রান্নার জন্য কাটাকুটিও সব করে রাখত। নর্মালি ডেইলির রান্না হলে শুধু রান্নাটা তোমাকে দিয়ে করাত। আর বুয়া এসে ঘরের বাকিসব কাজ করে দিয়ে চলে যেত। আর আবার বাসায় আমার বাবা আর বড় দুলাভাই আর বড় আপার মেয়ে তুলি বাদে আর কী কেউ আছে দুপুর? আমার পরিবারের সাথে তোমার পরিবার তুলনা দিচ্ছ?’
দুপুর চুপ করে রইল। আবিরের বাবার ওপেন হার্ট সার্জারী বিধায় উনি তেমন একটা কাজ আগে থেকেই করতে পারতেন না। তাই সংসার চালাতে আবিরের মা অনেক আগেই বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন। এখনো বিদেশেই কাজ করে যাচ্ছেন। আবিরের বড় আপা রুবার হাজবেন্ড জলিল রহমানও হার্টের রোগী, তাই রুবা আপাও মায়ের কাছে বিদেশে থাকে, কাজ করে। তাই বাসায় থাকে মূলত আবিরের বাবা, বড় দুলাভাই আর দুলাভাইয়ের একমাত্র মেয়ে তুলি। আবিরের ছোট আপা তুবা চৌধুরীর বিয়ে হয়ে গেছে, সে তার শ্বশুর বাড়িতেই থাকে। মাঝে মাঝে এসে বাবা, দুলাভাইকে দেখে যায়।
যেখানে দুপুরের শ্বশুর বাড়িতে গোটা তিনেক মানুষ, তাও কাজের বুয়া আছে আবার দুলাভাই নিজেও ঘরের সব কাজে দুপুরকে সাহায্য করে, সেখানে রতির বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা। এই ঘরে এক গ্লাস পানিও কেউ ঢেলে খায় না। রতি চাকরানি আছে তো… অযথা পানি ঢেলে হাতের এনার্জি নষ্ট করে কী লাভ?
দুপুরকে চুপ করে থাকতে দেখে আবির হো হো করে হেসে উঠল। দুপুর রাগী গলায় বলল, ‘হাসছ কেন?’
–‘দুপুরের ঝুড়িতে ভাষা নেই, ব্যাপারটা হাস্যকর বটে…’
–‘আমি এমনিই চুপ ছিলাম।’
–‘কিছু বলার থাকলে তো বলবে তাই না? যাইহোক, তোমাকে কিছু বলার প্রয়োজন।’
–‘কী?’
–‘এখন না। প্রয়োজনীয় সব প্রমাণ পাই, তারপর বলব।’
দুপুরের বুকটা ছ্যাৎ করে উঠলো। কোন প্রমাণের কথা বলছে আবির? গতকাল যে কোচিং না গিয়ে চাঁদের সঙ্গে ঘুরতে গিয়েছিল, সেটা কী জেনে গেল তবে? না, না, জানার প্রশ্নই আসে না। এই বিষয়টা চাঁদ আর দুপুর ছাড়া কেউ জানে না। এমনকি দুপুরের বেস্টফ্রেন্ড ও না। দুপুরের ভয় হতে লাগল তবুও। গতকাল সে আবিরকে বলেছে, ‘আমি ঘুমাবো। কোচিং যাব না।’ আর বাসায় বলেছে, ‘আমি কোচিং যাচ্ছি।’ দুইদিক দিয়ে ম্যানেজ করে চাঁদ কে নিয়ে ঘুরতে গিয়েছিল গোলাপ গ্রামে। ইশ, যাওয়া টা উচিত হয়নি। এবার যদি কিছু হয়, আবির তাহলে তালাকই দিয়ে দিবে দুপুরকে! উফ! এত্তোবড় ভুল দুপুর কীভাবে করলো। তালাকের চেয়েও বড় বিষয়, মাত্রই আবিরদের বাড়ির কাজ ধরেছে ওরা। আর কয়েকটা দিনের অপেক্ষা, বাড়িটা হয়ে গেলে আবির নিজেই বলেছিল, দুপুরের নামে লিখে দিবে। আবিরের যা, দুপুরের জন্যেই সব… সেই সাথে তালাক হলে পেতো কাবিনের পুরো দশ লাখ টাকা! উফ, পুরোই মালামাল হয়ে যেতো দুপুর। কিন্তু এখন যদি কিছু হয়, বাড়ি তো দূর, টাকাও পাবে না দুপুর। ইশশিরে….!
দুপুর উশখুশ করতে লাগলো। আবির ওদিকে ক্রমাগত ‘হ্যালো হ্যালো’ করে যাচ্ছে।
–‘এই দুপুর, কথা বলছ না কেন?’
–‘হুঁ… মা ডাকছে। আমি এখন যাই? ফ্রেশ হয়ে ফোন দেই?’
–‘আচ্ছা।’
দুপুর ফোন রেখে দ্রুত চাঁদের নাম্বারে ডায়েল করতে লাগল। চাঁদকে আবারও সাবধান করে দিতে হবে যেন আবির তার বিষয়ে কোনোকিছুই না জানতে পারে।
(চলবে)