সম্পর্ক,পর্ব-৯+১০

#সম্পর্ক
#৯

কিছুক্ষণ আগেও সূর্যের আলো ছিল প্রকৃতিতে। অথচ এখন চারিদিকে ধোঁয়াটে অন্ধকার, সন্ধ্যা তার ঝাপি থেকে আঁধার ঢেলে দিয়েছে পৃথিবীতে। অনেকক্ষণ আগে মাগরিবের আযান পড়ে গেছে। তবুও মৌনির ঘুম ভাঙার কোনো লক্ষণ নেই! মাধুরি বেশ বিরক্তের সহিত মেয়ের ঘরে এসে ঢুকলেন, ডাকলেন, ‘মৌনি, এই মৌনি, কীরে আজ পড়তে যাবি না? প্রান্ত এসে বসে আছে।’

মৌনি জবাব দিল না। কাঠকাঠ হয়ে শুয়ে রইলো। তার ঘুম ভেঙেছে মাগরিবের আগেই, তবুও সে ইচ্ছে করেই বিছানা ছাড়েনি। প্রান্তের কাছে পড়ার বিন্দুমাত্র ইচ্ছে তার নেই। সে যথাসম্ভব প্রান্তকে এড়িয়ে চলতে চাচ্ছে। নিজের ভেতরকার আগুন অনুভূতি বাদ দিতে চাইলে, তাকেই পিছিয়ে আসতে হবে।

মৌনি উঠছে না দেখে মাধুরি মেয়ের পাশে বসলেন। মৌনিটা লম্বায় হয়েছে ওর বাপের মতো। খাওয়া দাওয়া ঠিকমতো করে না দেখে শরীরে হাড্ডি বাবদ মাংস তেমন নেই, এইজন্য দেখতে আরো লম্বা লাগে। শরীরে বোধহয় রক্তও নেই, নইলে এতো ফর্সা কেন মৌনি? মাঝে মাঝে ওকে দেখতে খুব ফ্যাকাশে লাগে…
মাধুরি স্নেহ মাখা হাত মেয়ের কপালের উপর রাখলেন। আদুরে গলায় ডাকলেন, ‘কীরে মা.. উঠবি না? পড়তে যাবি না নাকি?’
এইবার মৌনি একটু নড়লো, মাধুরি মেয়ের কপালে চুমু আঁকলেন। মৌনি পিঠপিঠ করে চোখ খুললো, নিখুঁত অভিনয়!
ঘুম জড়ানো কণ্ঠে বলল, ‘সন্ধ্যা হয়ে গেছে মা?’
‘সে কী এখন হলো? আরও আধঘন্টা আগে আযান পড়েছে।’
‘ইশ! কত দেড়ি হয়ে গেছে! আসলে মা.. আমার শরীরটা একদম ভালো লাগছে না আজকে।’ বলতে বলতে মৌনি উঠে বসল।
মাধুরি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘শরীরের আবার কী হলো?’
‘জানি না। ঘুমানোর আগে প্রচুর পেটে ব্যথা ছিল আম্মু। অনেক কষ্টে ঘুমাইছি। প্রায়ই পিরিয়ড হওয়ার আগে অনেক ব্যথা উঠে আমার। আর পিরিয়ড চলাকালীন তো আরও।’
মাধুরি চিন্তিত ভঙ্গিতে জিজ্ঞেস করলেন, ‘একদম সহ্যের বাহিরে ব্যথা?’
মৌনি হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লো।
‘এই সময়ে ব্যথা হওয়াটা স্বাভাবিক, কিন্তু এতো না। তোকে একটা ভালো ডক্টর দেখানো লাগবে।’
‘পরে দেখিয়ো। আম্মু, তুমি আজ স্যারকে বলে দাও, আমি পড়ব না। সে যেন চলে যায়।’
‘আমি গরম পানি করে আনছি। পেটে স্যাঁক দিলে আরাম পাবি।’
‘না আম্মু, দরকার নেই। এখন একটু কম ব্যথা, কিন্তু একদম উঠতে ইচ্ছে করছে না। শক্তি পাচ্ছি না। আর একদিন না পড়লে খুব কী ক্ষতি হয়ে যাবে?’
‘তুই শো.. তোর আব্বু কিছু বললে আমি আছি তো। এতো পড়লেও আবার চলে না! শরীর কী ইঞ্জিন নাকি?’
‘সেই তো..’
মৌনি শুয়ে পড়ল। মাধুরি মেয়ের কপালে আবার চুমু এঁকে দিয়ে বেরিয়ে গেলেন। মৌনি স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ল। দূর আকাশে চাঁদ দেখা যাচ্ছে। মৌনি জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে গাঢ় গলায় বিড়বিড় করে, ‘চাঁদকে ধরতে চাইলেও পারব না, আপনিও আমার কাছে ঠিক তেমন প্রান্ত। চাঁদের দিকে তবু তো হাত বাড়ানো যায়, আপনার দিকে হাত বাড়াতেই ভয় লাগে আমার!’

_______
দুপুরে খেতে আসেনি দুপুর। আহ্নি বাদে সবাই গিয়ে পালাক্রমে তাকে ডাকলেও সে বের হয়নি রুম ছেড়ে। কেমন উদ্ভ্রান্তের মতো বসে আছে..
আজকে চাঁদকে টাকা দেওয়ার কথা ছিল কোচিং এ গিয়ে, দুপুর কোচিং এও গেল না। ব্যাপারটা লিলি বেগমের নজরে পড়ল। কী সমস্যা জানতে তিনি দুপুরের ঘরে এলেন।

দুপুরকে দেখে চমকে উঠলেন লিলি বেগম। দুপুরের চোখমুখ ফোলা। অনেক কেঁদেছে বোঝা যাচ্ছে! পাগলের মতো দেখাচ্ছে তাকে। শুকনো মুখ দেখে মনে হয়, না জানি কতদিন ও খেতে পায়নি! লিলি বেগম পাগল হয়ে মেয়ের ধারে বসলেন। দুপুর খেয়ালও করল না নিজের মা’কে…
লিলি বেগম ছটফটে গলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কী হইছে দুপুর… তোর এই অবস্থা কেন মা?’
দুপুর নিশ্চুপ।
‘কথা বল, জবাব দে.. কী হইছে তোর?’
‘মা, আমার কথা বলতে ভালো লাগছে না। প্লীজ, যাও।’ অত্যন্ত বিরক্তি কণ্ঠে জবাব দেয় দুপুর। তারপর লিলি বেগমের সামনে থেকে উঠে ডাইনিং রুমে চলে আসে। পানির তৃষ্ণা লেগেছে তার। এদিকে লিলি বেগম হতবাক হয়ে পড়েন দুপুরের আচরণে, এরকম বেয়াদবি আচরণ তিনি মানতে পারছেন না। লিলি বেগম ডাইনিং রুমে আসলেন, উঁচু স্বরে বললেন, ‘তুই কার সাথে তেজ দেখাচ্ছিস হ? ভুলে গেছিস, একদিন আগেও আমি তোকে উদ্ধার করলাম। নাহলে তো মুখে চুনকালি পড়তো তিনি হতচ্ছাড়ি!!’
‘বেশ করেছো আমায় উদ্ধার করে। এই জন্যে আমি আজীবন তোমার গোলাম হয়ে থাকব।’
‘থাপ্পড় দিয়ে মুখ থ্যাতা বানিয়ে দিব, জানোয়ার। আমার সাথে চ্যাটাং চ্যাটাং কথা!’
দুপুর ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল, ‘তোমার কারণে এতদিন আমি অমানুষ ছিলাম! তোমাকে মা বলতেও ঘৃণা লাগছে এখন!’
লিলি বেগম কিংকর্তব্যবিমূঢ়, চিল্লাচিল্লি শুনে রতি অনেক আগেই এসে দাঁড়িয়েছে, এবার ঝিলম আর তাশরিফও নিজেদের ঘর থেকে বের হলো। আহ্নি ভাবল, রতির সঙ্গে চিল্লাচিল্লি হচ্ছে, এই ভেবে সেও আসলো। নাছির মাহতাব কিছুক্ষণ আগেই বাহিরে বেরিয়েছেন।

তাশরিফ বলল, ‘কী হইছে আম্মু? চিল্লাচিল্লি করতেছো কেন ওর সাথে?’
‘সাধে সাধে চিল্লাই? এই ছেড়ির মাথার তার ছিঁড়া গেছে। কখন থেকে উল্টাপাল্টা বলতেছে।’
দুপুর নিচু স্বরে বলল, ‘মাথার তার এতদিন ছিঁড়ে ছিল৷ আজ ঠিক জায়গায় আছে।’
তাশরিফ ধমক দিল, ‘কী বিড়বিড় করিস? আম্মুর সাথে বেয়াদবি করতেছিস কেন?’
তাশরিফ এগিয়ে যেতেই ঝিলম হাত ধরে টেনে আঁটকায়। দুপুরের রাগ বেড়ে যায়। সে আকাশ কাঁপিয়ে চিল্লিয়ে উঠে, ‘তোমার আদরের আম্মার কারণে আমার সংসার আজকে শেষ!! বিয়ের পর থেকে সে খালি বুঝিয়েছে, আবির আর ওর পরিবার আমার কাছে টাকার মেশিন। আমার মাথায় সেটাই ঢুকে গেছে। আমি চাইলেও ওদেরকে আপন করতে পারিনি। একটা দূরত্ব আগেই তৈরি করে দিয়েছিল আম্মু। আর আজকে..৷ আবির আমাকে..’ দুপুর ধপ করে ফ্লোরে বসে পড়ল, রতি গিয়ে দৌড়ে দুপুরকে ধরার চেষ্টা করে। নিচু হয়ে দুপুরের এক কাঁধে হাত রাখতেই দুপুর তেতে উঠে বলল, ‘তুমিও কম যাও না৷ আবিরের কানে সবসময় বিষ ঢালছো। আর সেটার ফলাফল, আজ আবির আমাকে মুখে মুখে তালাক দিয়ে দিয়েছে।’

দুপুরের এই কথায়, ছোট খাটো একটা বজ্রপাত ঘটে গেল সবার মাথার উপর দিয়ে…
লিলি বেগম চেয়ার টেনে নির্বিকার ভাবে বসে পড়লেন। তার মাথা ঘুরাচ্ছে। এ কোন দুর্যোগ তার মেয়ের উপর নামলো! রতি – আহ্নি অবাক, দুজনেই দু’জনের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। রতি অবাক চোখে দেখল, আহ্নির ঠোঁটের কোণে একটা নাই নাই হাসি লেগে আছে৷ সে আলগোছে নিজের ঘরে চলে গেল। রতি মৃদু শ্বাস ছাড়ল। এই পরিবারে একটার পর একটা তুফান লেগেই আছে যেন! কেন এমন হচ্ছে, রতি শত ভেবেও কূল পায় না…

তাশরিফ হাতের মুঠো শক্ত করে বলল, ‘তোর মাথা ঠিক আছে? তালাক মানে?’
‘আমি সত্যি বলছি। তুমিই আবিরকে ফোন দাও। জিজ্ঞেস করো। ও আমাকে তিন তালাক বলছে।’
‘কেন? তোর দোষ কী?’
দুপুর এক সেকেন্ড থেমে মিনমিনিয়ে বলল, ‘জানি না।’
রতি মাঝ দিয়ে বলে উঠল, ‘কান্না করো না। ভাইয়া হয়তো রাগের মাথায় এরকমটা বলছেন। উনি নিজের ভুল বুঝতে পেরে সব ঠিক করে নেবেন দুপুর।’
দুপুর তেতে উঠল, ‘ঢং কম করো৷ তোমার কারণেই আমার এই দশা। খুশি তুমি? খুশি এবার? কলিজায় শান্তি পাচ্ছো?’
রতি স্তব্ধ কণ্ঠে বলল, ‘তুমি শুধু শুধু আমাকে ভুল ভাবতেছো। আমি তোমার ভাইয়ের বউ, আর সে তোমার স্বামী। তুমি কী করে আমাদের নিয়ে মিথ্যা সম্পর্ক রটাচ্ছো দুপুর!’
‘জাস্ট শাট-আপ। তোমার পকর পকর আমার ভালো লাগতেছে না। যাও এখান থেকে। আমার ব্যাপারে তোমাকে নাক গলাতে কে বলছে?’
রতির মুখটা ছোটো হয়ে গেল। সে দুপুরের পাশ থেকে কাচুমাচু ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়াল, ঝিলমের সাথে দৃষ্টি বিনিময় হলো। ঝিলমের ঠোঁটে গা জ্বালানো হাসি! সে গিয়ে রতির জায়গায় বসলো। দুপুরের মাথা টেনে নিজের বুকের ভেতর নিয়ে স্বান্তনার সুরে বলল, ‘কেঁদো না। চাইলেই এত সহজে তালাক দেওয়া যায় না। বড়রা আছে তো..’
দুপুর ঝিলমকে দু’হাতে শক্ত করে ধরে কেঁদে গেল অনবরত। রতির বুক চিঁড়ে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। সেও তো এভাবেই দুপুরকে বুকে টেনে নিতে চেয়েছে সবসময়, কই কখনো তো তার বুকে মুখ লুকোয়নি দুপুর!
রতি ধীর পায়ে আহ্নির ঘরের দিকে চলে গেল।

________
আহ্নি জানালার পাশে বসে আছে। তার ঠোঁট জুড়ে ক্রুর হাসি, রতির উপস্থিতি বুঝতে পেরে সে থতমত খেয়ে গেল৷ দ্রুত হাসি মুছে রতির দিকে তাকাল।
রতি কঠিন গলায় বলল, ‘এত আনন্দ কীসে হচ্ছে তোমার? জানতে পারি?’
আহ্নি মৃদু আওয়াজে হেসে উঠল।
‘তোমার কথা বলার ভঙ্গিটা দারুণ লাগল ভাবি।’
‘চুপ করো আহ্নি। দুপুরের এই অবস্থা দেখে তোমার হাসি পাচ্ছে? সত্যি হাসি পাচ্ছে?’
‘হ্যাঁ, পাচ্ছে। তবে সেটা আপার সাথে যা হচ্ছে সে জন্যে নয়, অন্যায়কারীরা তাদের যোগ্য শাস্তি পাচ্ছে সেটা দেখে আমার অনেক আনন্দ হচ্ছে ভাবি।’
বলেই আহ্নি হাসি ছুঁড়ে দিল, সেই হাসি দেখে শিউরে উঠল রতি। ঢোক গিলে বলল, ‘তোমাকে বড্ড অচেনা লাগছে আহ্নি।’
‘কেন ভাবি? কেন এমন মনে হচ্ছে?’ উৎসুক হয়ে জিজ্ঞেস করল আহ্নি।
‘জানি না। তবে তোমার চোখে অন্যরকম খুশি, আনন্দ। সেটা কীসের আমি সঠিক জানি না।’

আহ্নি জানালার দিকে তাকাল, জবাব দিল না। বাহিরে এক মুঠো বিকেল, রোদের আলো গাছের পাতা ছুঁয়ে ছুঁয়ে পড়ছে মাটিতে, দেখতে অসাধারণ লাগছে। রতি একদৃষ্টে চেয়ে আছে আহ্নির দিকে। আহ্নির ভেতরে চলছে টা কী?জানতেই হবে…

দুপুর এলোমেলো পায়ে ঘরে ঢুকে। রতি, আহ্নি দুপুরের দিকে তাকাল। দুপুর করুণ স্বরে আহ্নিকে বলল, ‘তোর ফোন দিয়ে আবিরকে একটু ফোন দিবি?’
আহ্নির সঙ্গে সঙ্গে তীক্ষ্ণ বাক্যবাণ, ‘কেন?’
‘আমার আগের নাম্বার, নতুন নাম্বার দুটোই ব্লক করে রেখেছে। কোনোভাবেই কন্টেক্ট করতে পারতেছি না।’
‘দরকার কী? ভাইয়া তো বলেছেই তালাক, তুমি বেহায়ার মতো এতো কেন যোগাযোগ করতে চাইছো?’ চিবিয়ে চিবিয়ে বলে আহ্নি। রতি, দুপুর দু’জনেই খুব অবাক হয়।
দুপুর রক্তচক্ষু করে এগিয়ে আসে, ‘ওর সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেলে তুই খুব খুশি না?’
‘খুশি হবো না কেন? না খুশি হওয়ার কী আছে? একটা লোক তোমার মতো মেয়ের থেকে আর এইরকম একটা পরিবারের থেকে আজীবনের মতো রক্ষা পেয়ে গেল। এতে অখুশি কেন হবো আমি?’
‘আহ্নি…’ ক্রোধে কাঁপতে কাঁপতে চেঁচিয়ে উঠল দুপুর।
আহ্নি শান্ত স্বরে উত্তর দেয়, ‘চেঁচিয়ো না আপা। বেচারা ভাইয়াকে এতদিন তো শান্তি দাওনি। এবার অন্তত শান্তি দাও। তোমাকে ছেড়ে দিয়ে ভালো থাকতে চায়, তুমিও অন্তত মুক্তি দাও। প্লীজ!’
‘তু…তুই…আ…আমার বোন না!’
‘সে তো কবে থেকেই আমরা দু’জন দু-পথের পথিক হয়ে গেছি আপা! এখন ইমোশনাল হয়ে লাভ কী? পাপ গুলো করার সময়তো পরবর্তীতে কী হতে পারে তা ভাবোনি।’
‘আমি আম্মাকে ডাকছি।’
আহ্নি হাত দিয়ে মাছি তাড়ানোর মতো করে কটাক্ষ করে বলল, ‘ডাকো গিয়ে! তোমরা তো সব এক দলের, এক রকম।আর আম্মাই তো মূল নাটের গুরু.. তোমার আজকের এই পরিণতির পেছনে কিন্তু আম্মাও অনেকাংশে দায়ী আপা..’

দুপুর আহ্নির দিকে তেড়ে আসে মারতে, আহ্নিও গরম দৃষ্টি ছুঁড়ে মেরে উঠে দাঁড়ায়৷ রতি দু’জনের মাঝখানে, ভয়ে বুক অনেক দ্রুত উঠানামা করছে তার। শেষমেশ আর মারলো না দুপুর, রুম থেকে বের হয়ে যায়। আহ্নি আবার জানালার পাশে বসে, কমলা বিকেল দেখায় মনোযোগ দিল। রতি বিস্মিয় নিয়ে আহ্নিকে দেখছে। এই মেয়েটা এত দুঃসাহসী কবে থেকে হলো!

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া_রুহি

#সম্পর্ক
#১০

গত দুইদিন ধরে মাগরিবের আযান পড়তেই প্রান্ত মৌনিদের ঘরে আসে। চুপচাপ অনেকক্ষণ বসে থাকে। তারপর মৌনির জায়গায় মাধুরি এসে বলেন, মৌনি পড়বে না। তুমি চলে যাও।
প্রান্তের খারাপ লাগে তখন।মৌনি পড়তে আসে না, এটা ভেবে নয়, মাধুরি যেভাবে চলে যেতে বলেন, সেটা দেখেই। প্রান্ত খেয়াল করে দেখেছে, মঈনুল স্যার ওকে ঠিক যতটা পছন্দ করে, মাধুরি ঠিক অতটাই অপছন্দ করেন। কিন্তু কেন করেন, প্রান্ত জানে না। হয়তো নিজের সংসারে উড়ে এসে জুড়ে বসা প্রান্ত কে উনি সহ্য করতে পারেন না।উনারই বা কী দোষ? প্রান্তের বাবা-মাই তো ওর দায়িত্ব কোনোদিন নিতে চায়নি। কেইবা ওর বাবা-মা তাইতো প্রান্ত জানে না।সেখানে উনারা প্রান্ত কে পড়ার সুযোগ করে দিয়েছেন, রাখছেন, খাওয়াচ্ছেন, এই বা কম কীসে?
তবুও মাধুরির কটা কটা কথায় প্রান্ত আহত হয় খুব, ভেতরে ভেতরে। বাহিরে প্রকাশ করে না।

প্রান্ত ‘আচ্ছা আন্টি’ বলে উপরে নিজের ঘরে চলে এলো। তারপর ভাবতে লাগল, মৌনির হয়েছে কী? পড়তে আসছে না আবার স্কুলেও আগে ভাগে চলে যায়, যেন প্রান্ত সামনে না পড়ে.. মৌনি কী তাকে এড়িয়ে চলছে? প্রান্ত ঠোঁট বাঁকিয়ে বলে, ‘চললে চলুক, আমার কী?’ তারপর নিজে পড়াশোনায় মনোযোগ দেয়।

________
আহ্নিদের বাড়িতে আজ বিশাল তোড়জোড়। তবে পুরো তোড়জোড় টাই করছে আহ্নি আর রতি মিলে। আবির এসেছে, একদম সকাল সকাল। সঙ্গে এসেছে আবিরের বাবা আর বিয়ের উকিল বাবা। আবিরকে দেখেই নিজের ঘরে দমবন্ধ করে বসে আছে দুপুর। আবিরের সাথে এরপর অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারেনি সে। এমনকি আরাফের ফোন দিয়ে, আহ্নির ফোন দিয়ে, সবার ফোন থেকেও ট্রাই করেছে। পরে বুঝলো, আবির আর নেটেই ঢুকেনি। সরাসরি দু’দিন পর বাংলাদেশে ইমার্জেন্সি টিকেট কেটে চলে এসেছে। হাতে নিয়ে এসেছে একমাসের ছুটি…

মুখোমুখি সোফায় বসে আছে আবির, আবিরের বাবা, উকিল বাবা, আর অন্য সোফায়, আরাফ, তাশরিফ, নাছির মাহতাব। লিলি বেগম দাঁড়িয়ে আছেন। রতি আর আহ্নি এসে কিছু ফলমূল, চা, বিস্কিট ট্রে সমেত সেন্টার টেবিলের উপর রাখল। আবির হইহই করে উঠল, ‘এসব কেন করতে গেলেন ভাবি? এগুলোর প্রয়োজন ছিল না।’
রতি একটু হাসল। আহ্নি জবাব টা দিল, ‘আপনি আজ প্রথম আমাদের বাড়ি এলেন। খালি মুখে পাঠাবো?’
আবির কিছু বলার আগেই উকিল বাবা গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘অথচ প্রথমদিনেই আসতে হলো খারাপ সংবাদ নিয়ে। কী কপাল!’ উনার ঠোঁটে তাচ্ছিল্য। রতি আর আহ্নি চুপচাপ রুম থেকে বেরিয়ে গেল।
যাওয়ার আগে রতি তাকিয়েছিল আবিরের দিকে। তার চোখ দুটো ছলছল, রতি খুব খুশি, এরকম একটা পরিবারের থেকে আবির মুক্তি পেতে চলেছে এই দেখে। সে ভাবে, সেও কী পারে না এই পরিবার রেখে দূরে চলে যেতে? কিন্তু.. কই যাবে? কোথায় উঠবে? আছে কোনো ঠিকানা? মনের গহীন থেকে উত্তর আসে, নেই। রতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে।

আবির দেখেছে, রতির কপাল ফোলা, গাল ফোলা আর লাল। মার গুলোর দাগ দু-একদিনের মধ্যে পড়েছে। কে মেরেছে? আরাফ? কেন? আবির আরাফের দিকে তাকায়। দেখে আরাফ আবিরের দিকেই কটমট করে তাকিয়ে আছে।

আহ্নি আর রতি আহ্নির ঘরে এসে বসল। আহ্নি জানালার কাছে গিয়ে হাতের ইশারায় ডাকল, ‘ভাবি দেখে যাও। টুনটুনি পাখি, কী সুন্দর!’
রতি উৎসুক হয়ে এগিয়ে যায়। গ্রিলের একদম কাছে এগিয়ে পাখি দেখার চেষ্টা করে। তখন অসাবধানতা বশত কপালে গ্রিলে সংঘর্ষ লাগে, রতি আস্তে করে ‘আহ’ বলে ককিয়ে উঠে। আহ্নি তাকায়। রতি কে কপাল ডলতে দেখে আহ্নি মৃদু রাগ নিয়ে বলল, ‘ওর (দুপুর) সাথে এত কাহিনী হচ্ছে, তাও ওর শিক্ষা হলো না। এসবের জন্যেও তোমাকে দায়ী বানালো আর ভাইয়াও কাল রাতে তোমাকে কী মারটাই না দিলো! ইশ.. আমি ঘুমিয়ে গেছিলাম৷ দরজা আঁটকানো ছিল বলে শুনিনি। শুনলে…’
রতি অল্প একটু হাসল, ‘তুমি এত সাহস কোথাও পাও আহ্নি? আমাকেও কিছু দাও না। আমার মনের জোর খুব কম।’
‘কম বলেই ভাইয়া এত অবিচার করার সুযোগ পায়। আর জানে যে, যত যাই করুক, তুমি এখানে পড়ে থাকবা। কোথাও যাবা না। এই জন্যে আরো বেশি করে। আসলে এই বাসার সবাই বুঝে গেছে তোমার মাত্রা কতটুকু।’ আহ্নি দীর্ঘশ্বাস ফেলে। তার কষ্ট হয়। ভাবির জন্য কিছু করতে পারে না বলে নিজেকে অপদার্থ মনে হয়। রতি তার আপন বোনের চেয়ে কম নয়!

রতি ক্ষণকাল চুপ করে থেকে বলল, ‘আমার একটা যাওয়ার জায়গা থাকলে আমি সত্যি চলে যেতাম আহ্নি। আমার এখানে দমবন্ধ হয়ে আসে। জানো, মাঝে মাঝে নামাযে নিজের মৃত্যু কামনা করি। তবুও.. আচ্ছা এতো কেন আয়ু দিয়েছি আল্লাহ আমাকে? এত করে বলি, আমায় নিয়ে যেতে। কেন নেয় না?’
‘ছিঃ ভাবি। নিজের মৃত্যু এভাবে কামনা করতে নেই। তোমার হায়াত-মউত আল্লাহ দিয়েই পাঠিয়েছেন। আয়ু শেষ হলে এক সেকেন্ড ও থাকতে পারবে না। হয়তো তোমার জীবনে এখনো অনেক কিছু বাকি ভাবি, এই জন্যে এখনো তুমি বেঁচে আছো।’
রতি ক্ষীণ গলায় বলল, ‘হয়তো।’

বাহিরে ঝকমকে রোদ, আকাশ পরিষ্কার। পাখিরা মনের সুখে উড়ে বেড়াচ্ছে। সেদিকে তাকিয়ে রতির বুক ভার হয়ে আসে আপনাআপনি। ইচ্ছে হয়, ওই পাখিদের মতো নির্দ্ধিধায় আকাশে উড়ে বেড়াতে। সেটা কী কখনো সম্ভব? রতির জন্য?

________
আবির বলল, ‘দুপুর এতদিনে নিশ্চয়ই বলে দিয়েছে, আমি কেন এতো হুড়াহুড়ি করে বাংলাদেশ এসেছি।’
আরাফ শান্ত কণ্ঠে জবাব দিল, ‘হুম। বলেছে।’
তাশরিফ অশান্ত সুরে বলল, ‘কিন্তু আমরা মানবো না। বললেই তো হয় না। বিয়ে কী নাটক নাকি?’
‘আমি তো কোনো নাটক করিনি ভাইয়া। ইন ফ্যাক্ট আমার তরফ থেকে কোনো সমস্যাই ছিল না। যা করার আপনার বোন করেছে।’ দৃঢ় কণ্ঠে শান্তভাবে বলল আবির।
নাছির মাহতাব দর্শক হয়ে আছেন। ব্যবসা বানিজ্য হারানোর পর থেকে উনি হীনমন্যতায় ভোগেন। সংসারের কোনো কিছুতেই নাক গলান না। এমনকি দুপুরের বিয়ের সময়েও উনি হ্যাঁ, না বলেননি। আসলে কেউ জানতেই চায়নি…
মানুষ টা ছোট করে নিঃশ্বাস ফেলে পেছনে দাঁড়ানো লিলি বেগমের দিকে তাকালেন। এই একটা মানুষ কে ইচ্ছেমতো পিটাতে পারলে উনি শান্তি পেতেন। ওঁর জন্যেই আজ সংসারের এই দশা। একটা ছেলেমেয়েও মানুষ হয়নি। সব হয়েছে অমানুষ!!

আরাফ গমগমে আওয়াজ করে বলল, ‘সব সম্পর্কেই ঝামেলা হয়। তাই বলে তালাক কোনো সমাধান না।’
‘আপনার বোন এমন কিছু করেছে, যেটা আমি কেন, কোনো পুরুষই মেনে নিতে পারবে না।’
‘কী এমন করেছে?’ বলল তাশরিফ।
‘প্রমাণ সহ দেখাবেন। আমরা শোনা কথায় বিশ্বাসী নই।’ যোগ করে আরাফ।

আবির মৃদু হাসল। এই দুই ভাইকে দেখলে ওর এখন রাগ লাগে, জাস্ট রাগ! বড়টা তো অকর্মের ঢেকি,অথচ ভাব করে এমন, যেন দুনিয়া উলটে ফেলছে উনি। আর ছোটো টা… এতো দেমাগ আর অহংকার কীসের এদের? উফ! এরকম একটা পঁচা শামুকে কী করে যে পা কেটে বসলো আবির আর ওর পরিবার, আবির কিছুতেই ভেবে পায় না। যাক বাবা, এদের থেকে বেঁচে যাচ্ছে এই অনেক…
নয়তো আজীবন টা ধুকে ধুকে মরতে হতো।

উকিল বাবা বললেন, ‘আমরা প্রমাণ সহই দেখাব আপনাদের মেয়ের কাহিনী। কত ভালো মেয়ে ভেবেছিলাম! আর বের হলো কী!’
আবিরের বাবা কষ্ট চেপে হাসলেন, বললেন, ‘আমার কপালটাই পোড়া!’
‘না, না ভাইজান। এমন বইলেন না। আমরা যে আগেভাগে জানতে পারছি এইতো অনেক। নইলে আজীবন অন্ধকারে থাকতাম। মেয়ে মানুষ এতো লোভী হয়! ছিঃ’
মুখ বিকৃত করলেন উকিল বাবা। লিলি বেগমের গা জ্বলে উঠল, ‘আপনি কথাবার্তা সাবধানে বলেন ভাই সাহেব। আমার মেয়ের চরিত্রে কলঙ্ক লাগাচ্ছেন।’
‘মিথ্যা তো আর বলছি না আপা! আপনার মেয়ে যা করেছে, তাই বলছি।’ বললেন আবিরের বাবা।
‘দুপুর একটু আধটু ঘুরে বেড়ায় বন্ধুবান্ধব নিয়ে মানলাম। এটা কী দোষের কিছু? এখনো তো শ্বশুর বাড়ি যায়নি, তাই না? আর এই যুগের ছেলে মেয়েরা কী ঘরে বসে আঙুল চুষে দিন পার করে? এই বয়সে ঘুরবে না তো কোন বয়সে ঘুরবে?’
আবির হেসে বলল, ‘আন্টি, শুধু ঘুরলেও একটা কথা ছিল। ও তো লিমিট ক্রস করে ফেলেছে নিজের।’

লিলি বেগম থমকান, চমকালেন ভেতরে ভেতরে। আবির কী কোনো কিছু টের পেয়েছে নাকি আন্দাজে ঢিল মেরে কথা আদায় করতে চায়? লিলি বেগম থমথমে গলায় বলেন, ‘কী করেছে শুনি… ওর ভাইদের কথা মতো প্রমাণসহ দেখাও পারলে।’
আবির মুচকি হেসে পকেট থেকে ফোন বের করে। এরা সব কয়টা এমন ভাব ধরে যেন ভাজা মাছটা উলটে খেতে জানে না! দুনিয়ার বাকিসব মানুষ ভোদাই, আর এরাই চালাক? আবির ঠান্ডা মাথার মানুষ দেখে ও’কে যতটা ভোদাই এরা ভাবে, ও ততটা ভোদাই নয়.. প্রমাণ সব কালেক্ট করেই এসেছে। এমনকি ডিভোর্স পেপার রেডি করিয়ে সেটাতে নিজের সাইন পর্যন্ত দিয়ে নিয়ে এসেছে। আজকে এখানেই তার সাথে দুপুরের সমস্ত সম্পর্ক আইনত ভেঙে যাবে… এরপর দুপুর দুপুরের জায়গায়, আবির আবিরের জায়গায়। একটু কষ্ট হবে, তবে সেটা আবির ঠিকই মানিয়ে নিতে পারবে। মিথ্যে মরিচীকার পেছনে দৌঁড়ে জীবন বা সময়, কোনোটাই নষ্ট করার মতো ছেলে সে নয়!

লিলি বেগম, তাশরিফ, আরাফ সবাই-ই উৎসুক চোখে তাকিয়ে আছে। আবিরের বাবা নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে বসে রয়েছেন। তার কপালের শিরা দপদপ করছে রাগে। কোন কুক্ষণে যে এরকম একটা পরিবার পেয়েছিল সম্পর্ক গড়ার জন্য, সেটাই বুঝতে পারছেন না তিনি!! আবিরের মা দেশে থাকলে বেশ হতো। মেয়েটাকে ধরে ইচ্ছেমতো কয়েক ঘা দিত, তার প্রাণ জুড়াতো…

আবির ফোনে ঘাটাঘাটি করে কিছু ছবি সামনে আনে। তারপর আরাফের হাতে ফোন দিতে দিতে বলে, ‘নিন, দেখুন।’
আরাফ ফোন হাতে নিয়ে হা-মুখ করে বসে রইলো। ছবিতে দেখা যাচ্ছে, একটা ছেলে, উদাম গায়ে বসে আছে। তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসে আছে দুপুর, মুখটা হাসি হাসি। দুপুরের গায়ে কোনো ওড়না নেই। ব্যাকগ্রাউন্ড দেখে মনে হয়, এটা কোনো ফ্ল্যাট বাসা! আরাফ চোখ খিঁচে ফোন দূরে সরায়। ভাই হয়ে বোনের এরকম নষ্টামির ছবি সে দেখতে পারবে না…
তাশরিফ আরাফের থেকে ফোন কেড়ে নেয়। সেও হতভম্ব, নাছির মাহতাব কৌতূহল বশত উঁকি দিয়েছিলেন, দ্রুত চোখ সরিয়ে নেন এরপর। তিনি ঘামছেন। বাবা হয়ে সন্তানের এরকম ছবি দেখা যে কতটা অসম্মানজনক, সেটা ভুক্তভোগী ছাড়া কেউই বুঝবে না। তাশরিফ প্রশ্নবিদ্ধ চোখে আবিরের দিকে তাকাতেই আবির বলল, ‘সামনে স্ক্রল করুন। আরো পিক আছে তো। এই একটা দেখেই আপনারা তব্ধা খেয়ে গেলেন?’
তাশরিফ মিনমিনিয়ে বলল, ‘এগুলো ফেক ছবি। আমার বোন এসব করতেই পারে না।’
‘তাই? ফেক ছবি? আমার এক বন্ধু আছে গ্রাফিক্স এক্সপার্ট। ওর কাছে এগুলো পাঠিয়ে দেই? ও-ই যাচাই বাছাই করে বলুক, এগুলো সত্য নাকি মিথ্যা।’
লিলি বেগম একদম ভেঙে পড়েছেন। তিনি অশান্ত পায়ে রুম ত্যাগ করেন। তাশরিফ কী বলবে ভেবে পায় না। আরাফ লজ্জায় মাথানিচু করে ফেলেছে। সে বলল, ‘কাউকে দেখাতে হবে না। এসব সত্য..’
আবির সন্তুষ্ট হয়ে বলল, ‘তাহলে আপনারাই বলুন, আমি কী কারণে দুপুরের সাথে সম্পর্ক রাখব?’
আবিরের বাবা হড়বড় করে বললেন, ‘কোনো কারণ থাকলেও তো এই মেয়েকে আমি আমার ঘরে উঠাচ্ছি না। আর আমার ছেলে যদি একে নিয়েই সংসার করতে চায়, তবে তাকে ত্যাজ্য করতে একবারও ভাববো না আমি।’
আবির বলল, ‘জানেন আরাফ ভাই, আমি একবার নয়, দুই-তিন বার আপনার বোনের এসব পিক পেয়েছি তাও বিভিন্ন ছেলেদের থেকে। আড্ডা সমাজে দুপুর একটা কমন নেম।সবাই ও’কে নিয়ে যা-তা আলোচনা করে। করবে নাইবা কেন? এসব করে বেড়ালে তাকে কে ভালো চোখে দেখবে? তারপরও দুপুর কে কিছু বলিনাই৷ উলটো অন্য ভাবে বুঝিয়েছি। কিন্তু না, আপনার বোন তো শুধরানোর নয়। তাই আমিই হাল ছেড়ে দিলাম।’ উকিল বাবার দিকে তাকিয়ে আবির বলল, ‘আংকেল, কাগজটা বের করুন।’
তিনি কাগজ বের করতেই আবির বলল, ‘এটা ডিভোর্সের কাগজ। আমার সই করা শেষ। দুপুর কে ডাকুন। ওর সই লাগবে।’

নাছির মাহতাব নিঃশব্দে উঠে চলে গেলেন। একদম বাড়ি থেকেই বেরিয়ে পড়লেন। তিনি আজ গন্তব্যহীন ভাবে হাঁটবেন। পারলে কোথাও নিরুদ্দেশ হওয়ার চেষ্টা করবেন। এই অসম্মানের জীবন তার আর ভালো লাগে না।

আরাফ বা তাশরিফ কাউকেই ডাকতে হলো না, লিলি বেগম মারতে মারতে দুপুরকে নিয়ে এলেন সোফার ঘরে। দুপুরের ঠোঁট কেঁটে গেছে এক পাশ দিয়ে। সেখান থেকে গলগল করে রক্ত ঝরছে। সে কাঁপছে, কাঁদছে। সবাই হতভম্ব হয়ে উঠে দাঁড়ালেন। রতি, আহ্নি, ঝিলম সবাই সোফা ঘরে চলে এলো। একটা হুল্লোড় পড়ে গেল রীতিমতো।

আবির এগিয়ে আসতেই চোখের পলকে তার বুকের উপর ঝাপিয়ে পড়ল দুপুর। আবির দু’হাতে ঝাপটে ধরে নিজের টাল সামলালো। একটু পেছনে সরে গেল। আবিরের বাবা, উকিল বাবা হতভম্ব। আরাফ, তাশরিফ গরম মেজাজে দাঁড়িয়ে আছে। লিলি বেগম হাঁপাতে হাঁপাতে কান্নামিশ্রিত গলায় বললেন, ‘ও আর ভুল করব না বেয়াই সাহেব। আর ভুল করব না। আমি ওরে আজীবনের মতো শিক্ষা দিয়ে দিছি। আপনারা আর রাগ রাইখেন না। মাইনা নেন… মাইনা নেন আমার মাইয়ারে। নাইলে আমি সমাজে কী মুখ দেখাবো? মাইয়া বিয়া দিছি, অথচ সংসার করার আগেই তালাক! আমার মেয়ের গায়ে আজীবনের মতো কলঙ্ক লেগে যাবে। দয়া করেন, কলঙ্ক লাগাবেন না। দরকার পড়লে আমরা আরো যৌতুক দিব। আপনারা যা চান, তাই পাবেন৷’

আবিরের বাবা গমগমে স্বরে বললেন, ‘মেয়ে কী বিয়ে দিচ্ছেন নাকি বিক্রি করছেন? আপনারা হয়তো আপনাদের বাড়ির বউদের থেকে এসব নেন, আমরা নেই না। আমরা তো আগেই বলেছি আমাদের কিছুর প্রয়োজন নেই।’

লিলি বেগম অপমানিত হলেন, কিন্তু গায়ে মাখালেন না। অনুরোধ করে বললেন, ‘তাইলে দুপুরকে আপনাদের বাড়ির বউ হিসেবে মেনে নেন ভাই। রাগ রাইখেন না আর। সব ভুলে আসেন আমরা আবার আত্মীয় হই।’
‘মাফ করবেন। আমি আমার সিদ্ধান্তে অটল। আমি কখনোই আপনার মেয়েকে আমার ঘরের বউ হিসেবে মেনে নিব না। তবে আমার ছেলে যদি এরপরও ও’কে নিয়েই সংসার করতে চায়, আমি বাঁধা দিব না।’

দুপুর একথা শুনে খাঁমচে ধরে আবিরের শার্ট। আবির দুপুরকে টেনে নিজের থেকে সরায়। দুপুরের ঠোঁট ফুলে গেছে। চোখের পানি, নাকের পানি একাকার, রোদন করতে করতে সে বলল, ‘আমাকে ক্ষমা করে দাও আবির। তোমার পায়ে পড়ছি, ক্ষমা করো।’ বলেই আবিরের দু’পা জড়িয়ে ধরে দুপুর। আবির চমকে উঠে। পরক্ষণেই রাগ রাগ কণ্ঠে আদেশ দেয়, ‘পা ছাড়ো, এক্ষুনি।’
দুপুর ছাড়লো না। আবিরের পায়ের সাথে নিজের মাথা ঠেকিয়ে কেঁদে যাচ্ছে। আবির টেনে দুপুরকে দাঁড়া করালো। তারপর টেবিলের উপর থেকে কাগজটা নিয়ে দুপুরের সামনে ধরে বলল, ‘সাইন করো।’
দুপুর হাউমাউ করে কেঁদে উঠল। আবির বিরক্তি কণ্ঠে বলল, ‘ঢং কম করো। তোমার এই ন্যাকা কান্না আমার সহ্য হচ্ছে না।’
‘আবির…’
‘চুপ.. তোমার মুখে নিজের নাম শুনতে চাই না। চুপচাপ সাইন করো, চলে যাই। তোমার জন্য সারাদিন নিয়ে আসিনাই।’
‘আমি মরে যাব আবির, আমি মরে যাব।’
‘গেলে যাও.. আমি কেয়ার করি না। সাইন করো, করো…’
আবির ধমকে উঠে। দুপুর ভয়ে কুঁকড়ে যায়। তবুও সাইন করে না, স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আবির আরাফকে উদ্দেশ্য করে বলল, ‘বুঝলাম না ভাই! আমি চাচ্ছি না সংসার করতে, তারপরও এসব ড্রামার মানে কী? জোর করে ঘাড়ে তুলে দিবেন? আজব!’
আরাফের মেজাজ চটে। আবিরের ত্যাড়া ত্যাড়া কথা আর সহ্য হচ্ছে না তার। দুপুর একটা ভুল করেছে, ক্ষমাও তো চাইছে। মাফ না করে উলটো বাড়াবাড়ি করছে আবির, আরাফ এগিয়ে এসে দুপুরের চুলের মুঠি খপ করে ধরে, দৃঢ় ভাবে। বলল, ‘কান্না থামা। অপাত্রে কান্না ঢালবি না। আমি এর থেকেও ভালো জায়গায় তোকে বিয়ে দিব। তুই সাইন কর। এরকম ভাব ওয়ালা লোকের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখাই ভালো।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, না রাখাই ভালো। সাইন করো,কই করো না কেন?’ হেসে হেসে বলল আবির, তবে সে জানে আর ওই উপর ওয়ালা জানে কী পরিমাণ আগুনের উত্তাপে তার মন জ্বলছে, জ্বলে ছারখার হয়ে যাচ্ছে।

দুপুর করুণ চোখে আরাফের দিকে তাকালো। আরাফ চুল ছেড়ে দিয়ে দুপুরের হাতে কলম গুঁজে দিল। লিলি বেগম হইহই করে উঠলেন, ‘এটা তুই কী করতেছিস?’
‘তুমি চুপ থাকো আম্মা। আরাফ একদম ঠিক করতেছে। আমাদের বোন এত ফেলনা নাকি? ওকে এর চেয়েও ভালো জায়গায় বিয়ে দিতে পারব।’ গজগজ করতে করতে বলল তাশরিফ। অগত্যা ধরে বেঁধে দুপুরের সাইন নেওয়া হলো। আবির হাঁপ ছেড়ে বাঁচে যেন…

দুপুর দু’হাতে মুখ ঢেকে এক কিনারায় গিয়ে কেঁদে ফেললো। তার কেমন যেন লাগছে। মনে হচ্ছে বুকটা খালি খালি হয়ে গেল। কিছু একটা চলে গেল জন্মের মতো.. কিন্তু সে তো আবিরকে ভালোবাসেনি, তাহলে এই অনুভূতির নাম কী? রতির বুক ছিঁড়ে যাচ্ছে। ব্যথায় বিষাক্ত অন্তর নিয়ে সে দুপুরের পাশে এসে দাঁড়ালো। দুপুরকে শক্ত করে ধরতেই দুপুর ছ্যাত করে উঠল, ‘দূরে যাও। আমার কাছে আসছ কেন? আলগা পিরিতি দেখাতে? এখন তো তোমার রাস্তা ক্লিয়ার। যাও যাও, দু’জনে প্রেম করে বেড়াও।’

আবির হতভম্ব হয়ে তাকায়। রতি লজ্জায় মিশে যায়। আহ্নি এসে রতির হাত ধরে টেনে নিয়ে যেতে যেতে সবাইকে শুনিয়ে বলে, ‘লজ্জাও হয় না তোমার ভাবি! যারা তোমাকে এত হেয় করে, পাত্তা দেয় না, সেই তাদের কাছে বারবার কেন যাও সেধে অপমানিত হতে?’ উত্তরে রতি মলিন ঠোঁটে হাসল।

আবির ভরাট কণ্ঠে বলল, ‘আহ্নি, দাঁড়াও।’
আহ্নি দাঁড়াতেই আবির অনেক সাহসের একটা কাজ করে ফেললো। এগিয়ে এসে রতির সামনে দাঁড়ালো। ভরসার কণ্ঠে বলল, ‘আপনি যাবেন আমার সাথে? এখানের চেয়ে অনেক অনেক ভালো থাকবেন।’

আহ্নি অবাক, অবাক ঘরে দাঁড়ানো প্রতিটি মানুষ। দুপুর কান্না থামিয়ে তাকিয়ে আছে আবির আর রতির দিকে। রতি চোখের পলকও ফেলছে না। তার ভেতরটা ভয়ে থরথর করে কাঁপছে।

আরাফ এগিয়ে আসে, কাঠকাঠ গলায় বলল, ‘এসব কী বলছো তুমি?’
আবির ঘুরে তাকায়। তার চোখে জ্বলন্ত আগুনের আঁচ, আরাফ একটু ঘাবড়ে যায়।
‘আপনি চুপ করুন। অন্যের মেয়েকে ঘরের চাকর বানিয়ে রেখেছেন, আবার সবসময় মারেন, আমি তাকে একটা ভালো জীবন দিতে চাই। রতি ভাবির বাবা-মা যদি তাকে সাপোর্ট করতো, আমি শিউর, সে অনেক আগেই এই ঘরে লাথি মেরে বেরিয়ে যেতো। মাথার উপর ছাদ নাই বলেই উনি বেরোতে পারছেন না। সেই ছাদ আমি দিবো উনাকে।’ তারপর রতির দিকে ঘুরে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘যাবেন ভাবি?’

আহ্নি খুশিতে কাঁপছে। সে ভাবতেও পারেনি, তার বোনটা এতো দারুণ সুযোগ পেয়ে যাবে জীবন সাজানোর…
রতি ঘোরে চলে গেছে। তার মাথা কাজ করছে না। সে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চাইছে। এই বাসায় সে কী পেয়েছে? সবাইকে ভালবাসার বিনিময়ে পেয়েছে শুধু অবহেলা, উপেক্ষা, আর কষ্ট, যন্ত্রণা..
একটু কিছু হলেই সবাই এসে ঝাপিয়ে পড়েছে তার শরীরটার উপর। এমনকি নিজের স্বামীও, যার উপর ভরসা করে একদিন সব ছেড়ে চলে এসেছে সে, সেই স্বামীও তার উপর ঝাপিয়ে পড়েছে সবসময়। কখনো শারীরিক অত্যাচার, তো কখনো আদরের নামে জৈবিক অত্যাচার, আর মানসিক সুখ সে শেষ কবে পেয়েছে, মনে নেই। এখন যদি আবিররা চলেও যায়, এরপরই তার উপর শুরু হবে ভয়ংকর আজাব! সবাই ভেবে নিবে নিশ্চয়ই তার সাথে আবিরের কিছু একটা চলছে, এইজন্য আবির তাকে নিয়ে যেতে চাইছিল। আর সবচেয়ে বেশি অত্যাচার টা করবে দুপুর.. ও যে নিজের মধ্যেই নেই। এমনিতেও রতিকেই সবসময় দোষারোপ করে!.
রতি চোখ বন্ধ করে অংক মেলায়। পাশ দিয়ে ফিসফিস করে আহ্নি বলল, ‘চলে যাও ভাবি। খুব ভাল থাকবে। চাকরিও হবে। এখানে থেকে একদিন বাচ্চা হওয়াবে, আর সেই বাচ্চা তোমারই মতো মানসিক যন্ত্রণা নিয়ে বড় হবে। তুমি কী চাও, তোমার জীবন যেভাবে কেটেছে সেভাবে তোমার বাচ্চার জীবন টাও কাটুক?’

রতি চোখ খুলে। অংক মেলানো শেষ। উত্তর পেয়ে গেছে সে। আবির, আরাফ – দুজনেই তর্কে মেতেছে। রতি ডাকলো, ‘আবির ভাই..’
আবির কথা থামিয়ে তাকায়। তাকায় আরাফও। চোখের দৃষ্টি দিয়ে বোঝায়, আজ তার একদিন কী রতির একদিন! রতির নিঃশ্বাস থামিয়ে ক্ষীণ স্বরে কেঁপে কেঁপে বলল, ‘আ..আমি, আমি যাব আবির ভাই।’
আবির খুশি হয়। বাকি সবার চোখ বড় বড় হয়ে যায়। আবির ছুটে আসে নিজের বাবার কাছে। প্রশ্ন করে, ‘ভুল করলাম আব্বু?
আবিরের বাবা হাসলেন, তিনি রতিকে ভীষণ পছন্দ করেন। কী শান্তশিষ্ট একটা মেয়ে, কত সম্মান করে সবাইকে! অথচ মার খেতে খেতে কী হয়ে গেছে চেহারা!

আরাফ সবার সামনেই রতির গায়ে হাত দিতে এগোলো, সবাইকে আরো অবাক করে দিয়ে, রতি আরাফের গালে ঠাস করে চড় বসিয়ে দিল। এত শক্ত চড় আরাফ কোনোদিন খেয়েছে কীনা মনে করতে পারে না, কানের ভেতর ঝিরঝির করতে শুরু করল। মাথা গেল ঘুরে…
সে অগ্নিচোখে রতির দিকে তাকাতেই রতি বলল, ‘আমি ডিভোর্স চাই। তোমার মতো অমানুষের সাথে আর একদণ্ড নয়। ভয় নেই, এখন আমার কোনো ভয় নেই।’
‘রতি…’
‘চুপ, চিল্লাবে না। আওয়াজ কমাও।’
লিলি বেগম ছুটে আসেন, দুপুর আসার সাহস পেল না। সবার সামনে সেও থাপ্পড় খেলে সম্মান আর থাকবে না। লিলি বেগম মুখ দিয়ে গালি উচ্চারণ করতেই, রতি বলে উঠে, ‘এই যে নাটের গুরু। আমার হাত এখনো নিশপিশ করছে কিন্তু। দিতে আমার একদম গায়ে বাধবে না। অসভ্য মানুষ যত বড়ই হোক, তাকে সম্মান করতে জানি না আমি। বুঝেছেন?’
লিলি বেগম স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন৷ রতির খোপা খুলে পিঠময় ছড়িয়ে পড়েছে। ওড়না ঝুলে পড়েছে একপাশে৷ শ্বাস উঠানামা করছে জোরে জোরে। দেখে মনে হচ্ছে, এটা রতি নয়। অন্য কেউ..

আরাফ রতির গালে সর্বশক্তি দিয়ে চড় বসায়, বলল, ‘আমার মায়ের সাথে বেয়াদবি..’ কথা শেষ করার আগেই রতি ক্ষুদার্ত বাঘিনীর মতো আরাফের উপর হামলে পড়ে। চড় দেয়, একটা নয়, বারো-পনেরো টা। গলার স্বর পঞ্চমে তুলে বলে, ‘আমাকে মারিস তুই, আমাকে!’

আহ্নি, ঝিলম মিলে রতিকে সরিয়ে আনে। সে ছোটার জন্য মোচড়ামুচড়ি লাগিয়েছে। একবার ছুটতে পারলে আরাফ কে আসমানেই পাঠিয়ে দিবে৷
আরাফ বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে দেখছে। এটা যে রতি, তার বিশ্বাস হচ্ছে না৷
আবির মুখ খুলে বলল, ‘একটা শান্ত মানুষ কে কতটা আঘাত করেছেন আপনারা যে সে এই রূপে চলে এসেছে, ভাবুন একবার। অবশ্য ভেবে লাভ নেই। ভাবি আর এখানে থাকছে না। ভাবি ব্যাগ গুছিয়ে আনো।’
আহ্নি আগে আগে বলল, ‘আমি আনছি।’ তারপর দৌড়ে রতির ব্যাগ গুছাতে গেল। সে খুশিতে ফেটে পড়েছে। তার ইচ্ছে করছে, গান ছেড়ে ধুমিয়ে নাঁচতে…

কিছুক্ষণের মধ্যেই আহ্নি ব্যাগ নিয়ে আসলো। আবির, রতি, আবিরের বাবা, আর উকিল বাবা, বেরিয়ে পড়লেন ঘর থেকে। আরাফ বারবার বলছে, ‘আর কোনোদিন এই ঘরে পা রাখতে পারবি না মনে রাখিস। এই যে বের হলি, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে মরিস। এই ঘর তোর জন্য বন্ধ!’
রতি ঘুরে তাকায়। আরাফের চোখে চোখ পড়তেই তার বুক কেঁপে উঠে। এই মানুষ টাকে সে খুব ভালোবাসতো, খুউব.. এখন আর বাসে না, একটুও না। তার কষ্টের পাহাড় এতটা ভারী হয়ে গেছে যে,ভালোবাসার মতো কঠিন জিনিসকেও সে উপেক্ষা করতে পারে! রতি আরাফের উদ্দেশ্যে থুতু ছুঁড়ে দিয়ে গটগট করে এগিয়ে যায়। রেখে যায় অপমানে থমথমে হওয়া একটি মুখ!
ওদিকে আহ্নি নিজের ঘরের দরজা আঁটকে সাউন্ড বক্সে ‘আভি তো পার্টি শুরু হুয়ি হে’ গান ছেড়ে উরাধুরা নাচতে শুরু করে।

চলবে…
®অলিন্দ্রিয়া_রুহি
*সবার মন্তব্য চাই!!

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here