গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ
১২. (শেষ)
রিপার কম্পনরোগ দেখে মৃদু হাসলো শ্যামল। দেওয়াল থেকে এক হাত সরিয়ে রিপার উন্মুক্ত কোমড়ে রাখলো। রিপা লজ্জা পেয়ে মাথা নুয়ালো। শ্যামল তাকে আরো চেপে ধরলো। তাকে বিছানায় বসিয়ে লাইট নিভিয়ে দিলো। শ্যামল ঘনিষ্ট হতেই রিপা বলে,
‘ বিয়ের ব্যাপারটা আপনার পরিবারকে জানিয়ে দিলে হয় না?’
শ্যামল জবাব দিলো না। গুরুত্বপূর্ণ সময়ে ডিস্টার্বনেস তার পছন্দ নয়। রিপা আবারো প্রশ্ন করলো। তার কন্ঠস্বরে ভয় আর অনিশ্চয়তা টের পাচ্ছে। শ্যামল থেমে গেলো। তৎক্ষণাৎ রিপার পাশ থেকে সরে দাড়িয়ে পড়লো। নিজে ঠিকঠাক হয়ে সাথে রিপাকেও ঠিকঠাক করে দিলো।
‘ আপনি এমন করছেন কেনো? কই নিয়ে যাচ্ছেন?’
শ্যামল জবাব দিলো না। চুপচাপ রিপাকে টেনে ড্রয়িং রুমে নিয়ে আসলো। খুবই জোরে রিপার পরিবারকে ডাকতে লাগলো। কয়েক মিনিটের মাথায় একে একে সবাই উপস্থিত হলো। চোখেমুখে অবাকের রেশ ফুটিয়ে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকালো শ্যামলের দিকে। শ্যামল বিলম্ব না করে এক নিঃশ্বাসে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব বললো। আশ্চর্যজনকভাবে কথা বলার সময় সে একটু ইতস্ত করলো না, সবকিছুই বিনা আটকে বললো।
‘ এজন্যই তো ইমন ভাই ছাদে তখন এসব বলছিলেন। আর আমি কি না উনাকে পাগল ভেবে সব উড়িয়ে দিয়েছি।’
নিপা কথাটা বলে থামলো। রুবেল সাহেব গম্ভীর হয়ে বসে রইলেন। রিপা ভয় পাচ্ছে। বাবা না জানি উত্তেজিত হয়ে পড়েন। কি দরকার ছিলো এসব বলার? মনে মনে দোয়াদুরুদ পড়ে ফু দিতে লাগলো। সবার মুখভঙ্গি দেখে বুঝা যাচ্ছে তারা কতটা আশ্চর্য হয়েছেন। রুবেল উত্তেজিত হয়ে পড়লো। ক্ষোভে চেঁচাতে লাগলেন। শ্যামল নিরব হয়ে সব শুনতে লাগলো। হোসেনআরা তাকে থামাতে লাগলো।
‘তুমি চুপ করো। কি হয়েছে বুঝতে পারছো?’
‘জ্বি,জ্বি। বুঝতে পেরেছি। আপনি শান্ত হোন নাহলে অসুস্থ হয়ে পড়বেন।’
রুবেল শান্ত হলো। চুপ করে সোফায় বসে পড়লো। কেউ কিছু বলছে না। শ্যামল মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। বেশ সময়বাদে মুখ খুললেন রুবেল সাহেব। গম্ভীর সুরে বলেন,
‘তোমার মা যখন জানবেন রিপা তোমার বউ, তাহলে কি তিনি মেনে নিবেন নাকি…’
‘অবশ্যই মেনে নিবেন। ভাইয়ার ট্রিটমেন্ট চলছে। ডাক্তার বলেছে দ্রুতই সুস্থ হয়ে উঠবেন। আর কালকেই মা কে সব জানাবো। মা যখন সব জানবেন তখন তিনি নিজেই ক্ষমা চাইবেন আপনাদের থেকে।’
‘যদি এমন না হয়…..’
‘ এমনই হবে। তার জন্য পুরো পরিকল্পনা করা হয়েছে। এমনকি আমরা প্রায় সফল। শুধুমাত্র কালকের অপেক্ষা। এর জন্য আপনাদেরও সাহায্য দরকার।’
রুপসি বানু বললেন,
‘আর ওই মেয়ে নুহা না ফুহা ওর কি হবে? ‘
শ্যামল মাথা তুলে একপলক তাকিয়ে আবারো মাথা নিচু করে বলে,
‘তাকে তার স্বামী নিয়ে যাবে। তাদের সাথে আমার কথা হয়েছে।’
হোসেনআরা বিস্মিত হয়ে বলেন,
‘তিনি বিবাহিত?’
‘জ্বি। আমি রিপাকে এ বিষয়ে সব জানিয়েছি। বিয়ের বছর ঘুরে আসছে। নুহা আমাদের পরিবারের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে তার অসুস্থ স্বামীকে ছেড়ে দিয়ে বাড়ীতে এসেছিলো। হাসপাতালে ভাইয়াকে অসুস্থ দেখেই সে এ ধরনের ঘৃণিত বুদ্ধি এটেছে। এবং পরবর্তীতে পীরের সাথে হাত মিলিয়েছে। গত কয়েক মাসে তার কাছাকাছি থেকে তার অতীতের সব তথ্য জানতে পেরেছি। ‘
‘এসব কবে থেকে হচ্ছে? ‘
শ্যামল মাথা নিচু করে বলে,
‘গত ছয় মাস থেকে। নুহা ছয় মাস পূর্বে আমাদের বাড়ীতে এসেছিলো। ‘
রুবেল সাহেব হেসে উঠলেন। আচমকা তার হাসি দেখে ভড়কে গেলো সবাই। রুবেল হাতে তালি দিয়ে বলে,
‘নাটক করো আমাদের সাথে?নাটক? কাল কি এমন হবে যে সব ঠিক হয়ে যাবে? বোকা পেয়েছো আমাদের, তাই না? এই রিপার মা তুমি পুলিশে খবর দাও, এক্ষুনি পুলিশ এসে প্রতারকদের নাটক ঠিক করবে।।’
অনেক্ষণ পর রিপা মুখ খুললো। এতক্ষণ সে চুপ করে ছিলো। মিনমিন গলায় বলে,
‘বাবা। পুলিশ ডাকার দরকার নেই। একবার দেখে নাও না কাল কি হয়। যদি কিছু না হয় তখন নাহলে পুলিশ ডেকো।’
রুবেল সাহেব অবিশ্বাসের সুরে বলে,
‘ রিপা,এসব তুই বলছিস?’
রিপা মাথা নিচু করে ফেললো। বাবাকে প্রচন্ড ভয় পায়। রুবেল যখন রেগে থাকে তখন কথা বলা তো দূর তাদের তিন বোন তার সামনেই আসে না। রুবেলের মনে হলো তাবিজ বলতে সত্যিই কিছু আছে নাহলে তার মেয়ে এত বদলে গেলো কীভাবে? রুবেল রাগ করে চলে গেলো। তাদের যা করবার ইচ্ছা করুক। সে এসব মুখ তুলেও দেখবে না। একে একে সবাই চলে গেলো। শুধু রুপসি বানু আর রিপা ব্যতীত। শ্যামল মনে মনে কথা গুছিয়ে নিলো। রুপসি বানু তার শেষ ভরসা। তাকে মানাতে পারলেই কাল সে আরো অনেক বিষয় খোলাসা করতে পারবে। সে লেগে পড়লো রুপসি বানুকে বুঝাতে।
–
সাহেব পীরের বাড়ীতে বড় অনুষ্ঠান চলছে। বছরে এই একদিন এমন আয়োজন হয়। লোকজন ও চলে আসে ভক্তি দেখাতে। এ দিনে সাহেব বাবার অনেক আয় হয়। বছরের পর বছর এ উৎসব উদযাপিত হয়ে আসছে।নির্মলা বেগম কখনো এই দিনের উৎসবে উপস্থিতি মিস করেন না। এবারও করেন নি। পুত্র-পুত্রবধু এবং হবুপুত্রবধু ও কন্যাসহ স্বপরিবারে উপস্থিত হয়েছেন। তাদের সাথে রুপসি বানুও উপস্থিত হয়েছেন। পীর সাহেব আজ ভক্তদের সকল অনুরোধ পালন করবেন। তাই তিনি মাঝ উঠোনে পাটি বসিয়ে বসেছেন। বহু কাহিনী করে রুপসি বানু তিন নম্বর সিরিয়াল নিয়েছেন। যা অবর্ণনীয়। পর্যায়ক্রমে তার পালা আসতেই তিনি পাটির সামনে এসে বসলেন। একদিনেই পীর সাহেবের প্রতি তার ভক্তি দেখে হতবাক শ্যামলের পরিবার। পীর সাহেবের সামনে সামান্য দূরত্ব বজায় রেখে তিনি সেজদার ভান করলেন। ছলছল চোখে বললেন,
‘বাবাগো, বাবা। আমার জামাই মরে গেছে আজ দশ বছর। তার কাছে এক বক্স মুক্তো ছিলো। একবার সফরে যাইয়া পাইছিলো। হে মরার আগে আমি বাড়ীতে ছিলাম না, এর লাইগা ওগুলা কই রাখছে আমি জানি না। আমি তার লগে কথা কইবার চাই। ওগুলা কই জানবার চাই।’
সাহেব-বাবা চোখ মেললেন। চোখদুটোতে মনিমুক্ত চিকচিক করছে। বেশ খানেক সময় কথাবর্তা চালু রেখে খবর জেনে নিলেন রমিজ মিয়া মুক্তো কই রাখতেন? কতগুলো ছিলো? কোন স্থানে থাকতেন। সব ডিটেইলস জেনে নিলেন। এরপর শরীর নাড়া দিয়ে তিনি রমিজ মিয়ার রুপ ধারন করলেন। হালকা পাতলা অভিনয় করে তিনি বলে দিলেন ওই ঘরের মাটির নিচে রাখা। পুরো ঘর ভেঙ্গে তল্লাসি করলে পাওয়া যাবে। রুপসি বানু খুবই আনন্দিত হলেন। ভক্তির শেষ পর্যায় পর্যন্ত চলে গেলেন। পীর সাহেব তখনও রমিজ মিয়ার রুপ ধারন করে আছেন। রমিজ মিয়া সেজে তিনি অনেক অভিনয় করলেন। রিপার উপর পূর্বের প্রতিশোধ স্বরুপ সকল স্বর্ণ-গয়না দাবি করলেন। রিপা চুপচাপ সব শুনে নিলো। প্রায় ঘন্টা আধেকের মতো সাহেব-বাবা অভিনয় চালালেন। রুপসি বানু হাটু গেড়ে দ ভঙ্গিতে বসেছিলেন, এবার তিনি সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়লেন। হাতের ফোন টা রিপার দিকে এগিয়ে দিতে দিতে বললো,
‘নে, তোর দাদাজানরে কল দে। দিয়া বল সে যেনো এক্ষুনি আসে। ‘
নির্মলা বেগম অবাক হয়ে বললেন,
‘মানে?’
‘মানে টানে কিছুই না। এতক্ষণ যা ছিলো সব আপনার পীর বাবার ঢং ছিলো। দাদাজান বেঁচে আছেন। তিনি ফুফির বাড়ীতে। পীর সাহেব তো মৃত মানুষের ভেতরে যেতে পারেন, জীবিতদের নয়। কিন্তু তিনি জীবিত দাদার ভেতরে যেতে পেরেছেন। এর অর্থ নিশ্চই বুঝতে পেরেছেন?’
উপস্থিত লোকজন ক্ষেপে গেলো। তাদের পীরবাবাকে কেউ প্রমাণসহ মিথ্যা বলছে এসব তাদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। স্বরগোল শুরু হওয়ার পূর্বেই পুলিশ ফোর্স বেরিয়ে আসলো। অফিসার নিঝুম কিছু প্রমাণ হাতে নিয়ে বললেন,
‘আপনারা উত্তেজিত হবেন না। উনারা যা বলছেন সব সত্যি বলছেন। পীর সাহেব এর সবকিছুই ছল। আপনাদের সম্পর্কে উনি যেসব বলেন, সেসব কিছু আগে থেকেই খোঁজ করে নিয়ে আসেন। উনার পাশে যে তিনজনকে দেখছেন তারা তিনজনই ডিটেক্টিভ। উনারাই এসব খবর যোগাড় করেন। আর এই যে উনি আপনাদের তাবিজ আর ঔষধপত্র দেন। সেসব ফেইক এবং ইল্লিগেল প্রোডাক্টস। এসবে উচ্চমানের ড্রাগস থাকে। যার পরিমাণ একটু কম বেশি হলেই তৎক্ষণাৎ মারা যাওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ। এসব ড্রাগসগুলো অবৈধভাবে সিঙ্গাপুর থেকে আনেন। এর সাথে আরো অনেকেই যুক্ত রয়েছে। আমরা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছি। আর এই যে দেখুন সিসিটিভি ফুটেজ যাতে গত কয়েকদিন এখানের সকল কর্মকান্ড রেকর্ড করা হয়েছে।’
পীর সাহেব বিস্ফোরিত চোখে তাকালেন। হুশ উবে গিয়েছে। প্রাইভেট রুমে তিনি উপস্থিত ব্যতীত কারো প্রবেশ নিষিদ্ধ, তাহলে এ রুমের ভিডিও কীভাবে ধারন করা হয়েছে? ওখানে শুধু ভক্তদের পরিবারের মৃত লোকদের ভেতরে প্রবেশ করেন। গত দিনে শুধুমাত্র রিপা এসেছিলো। এরপর তিনি আর কাউকে এলাউ করেন নি, কারণ সিঙ্গাপুর থেকে লোকজন এসেছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে রিপার দিকে তাকাতেই দেখলেন, রিপা মুচকি মুচকি হাসছে। যার অর্থ হলো রিপা ই ওই ঘরে তার নজর এড়িয়ে এটা লাগিয়েছে। কিন্তু কখন?কীভাবে? ইশশ, এত বড় ভুল করলাম কীভাবে? বলেই কপাল চাপড়ালেন তিনি। লোকজন চোখ কপালে তুলে সব দেখতে লাগলো। একে একে পীরের সকল কু-কর্ম বেরিয়ে আসলো। লোকজন থু থু ফেলে ধিক্কার জানিয়ে চলে যেতে লাগলো। তবে তার মধ্যে এখনো বেশ কয়েকজন পীরের ভক্ত রয়ে গিয়েছেন।সবকিছু দেখেও অবিশ্বাস করলো।
নির্মলা বেগম কিছু সময়ের জন্য সেন্সলেস হয়ে গেলেন। তার জন্য বড়সড় ধাক্কা ছিলো।
পীর সাহেব কে পুলিশ গ্রেফতার করেছে। চারপাশে রিপোর্টার রা ভিডিও ধারন করছে। সাথে নানারকম মশলা মাখানো কথা লাগাচ্ছেন। রুপসি বানু বেশ সময় নিয়ে পীর সাহেবের পাশের বাক্সটার দিকে তাকিয়ে আছেন। কাচের জিনিস টা দেখতে বাক্স উহু অনেকটা বাটির মতো। রুপসি বানুর বেশ মনে ধরেছে। তার মষ্তিষ্ক অনেক্ষণ যাবৎ যুদ্ধ করছে এটা নিবে কি নিবে না। রুপসি বানুর মাথার উপর থেকে সাদা রুপসি বললো, ‘না, না নিস না।’ লাল রুপসি বলে, ‘নিয়ে নে রুপসি। আমি বলছি নিয়ে নে।’ রুপসি বানু এদিক-ওদিক তাকিয়ে একটুখানি হেসে বললো, ‘থাক তুই যখন এত জোর করছিস নিয়েই নিতেছি।’ কথাটা শেষ না করেই কৌটাে টা আঁচলের নিচে লুকিয়ে ফেললেন। মনে মনে বললেন,’ শুন পীর বাবা, আমি নিতে চাই নাই, শয়তানে জোর করছে দেইখা নিছি। নাহলে এগুলা আমি তাকিয়েও দেখতাম না।হু হু…’
পরিশিষ্ট – সেদিনের পর নির্মলা বেগমের অন্ধ বিশ্বাস ভেঙ্গে যায়। তিনি তার ভুলের জন্য অনুতপ্ত এবং রিপার পরিবারের কাছে ক্ষমাও চেয়ে নেন। শ্যামল তখন তাকে সব জানিয়ে দেয়। নির্মলা বেগম প্রথমে মেনে নিতে না চাইলে পরবর্তীতে ঠিকই মেনে নেন। এভাবেই যদি তার ভুলের প্রায়শ্চিত্ত হয় তাতে ক্ষতি কি? নুহাকে বের করে দিয়েছেন তিনি নিজেই। ইমনকে সরকারী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়েছে। তার অবস্থা এখন বেশ উন্নত। ডাক্তার বলছে আর অল্প কয়েক মাসেই সে সুস্থ হয়ে উঠবে। রিপা দুই মাসের প্রেগন্যান্ট। সে বেশ এক্সাইটেড। শ্যামলকে কি করে জানাবে লজ্জায় ভাবতে পারছে না। সে ঠিক করেছে কাগজে লিখে বলবে আমাদের সম্পর্কের দ্বিতীয় সিড়িতে পা ফেলেছি। শীঘ্রই আসবে নতুন জীবন,নতুন বন্ধন। শ্যামল নিশ্চই অবাক হয়ে যাবে। খুশিতে দেখা দিবে কেঁদে দিয়েছে। রিপা কল্পনা করে হেসে ফেললো। সম্পর্কগুলো কেনো এত সুন্দর।
সমাপ্ত