সম্পর্কের বন্ধন, পর্ব:৫+৬

0
710

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৫.
মাঝরাত, চারিপাশ ঘুটঘুটে অন্ধকার হবার কথা। অথচ বাহির এতই আলোকিত যে রাস্তার উপরের ছোট ছোট পাথরের রংও স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কারণ বাহিরে ল্যামপোস্ট জ্বলছে, পাশাপাশি বাসা-বাড়ীর বাহিরের বাতিগুলোও জ্বলছে। শহরের মানুষের এ একটা নিয়ম রয়েছে তারা কারণবিহীন রাতদিন আলো জ্বালিয়ে রাখে। শহরে থাকতে হলে বোধহয় এমন নিয়ম মানতে হবে। তাদের অতি টাকা-পয়সা আছে তা এটার মাধ্যমেই বুঝানো হয়। নাহলে খামোখা কেনো এতগুলো লাইট জ্বালিয়ে বিদ্যুৎ বিল বাড়াবে। রিপার শশুরবাড়ীর বাহিরের উঁচু ওয়ালের বাহিরে বেশ কয়েকটা লাইট লাগানো। সেসবের আবার নানা বাহার, রিপার মনে হলো এসব অযথাই অপচয়। সে হলে কখনো এতগুলো লাইট লাগাতে আর জ্বালাতে দিতো না। সে মধবিত্ত পরিবারের মেয়ে, তার বাবা খুবই হিসেবি, সে ও হয়েছে তার বাবার মতো। তার বেড রুমে দুটো লাইট প্রয়োজন তবুও সে একটি লাইট ই রেখেছে। পড়ার সময় সে বিছানার পাশে এসে লাইটের নিচে পড়ালেখা করে যায়। তবুও বাবাকে বলে দুটো লাগায় না। অথচ এখানে একটার স্থানে তিন টা। রিপা জানালার পাশে দাড়িয়ে বেশ মনোযোগ দিয়ে এসব ভাবছে। অথচ তার এখন ভাবা উচিত শ্যামলের বলা কথা নিয়ে, কিন্তু সে ভাবছে না। যে বিষয় সে জানবে সেসব নিয়ে আগে ভেবে উল্টাপাল্টা কিছু মনে নিয়ে টেনশন করতে চায় না। বলতে গেলে সে পারে না। রিপার এটা অদ্ভুদ এক অভ্যাস। এই যেমন, ফিজিক্স পরীক্ষার দিন তার ফিজিক্স পড়তে ইচ্ছা করে না, সে তখন বায়োলজি পড়ে। যেটা হবে সেটা নিয়ে এত টেনশন করার কি দরকার? হলেই তো দেখবে।

– শ্যামল সিগারেট খাচ্ছে খুব দ্রুত, অথচ এত সময়ে অর্ধেক ও শেষ করতে পারে নি। রিপার সামনে সিগারেট খাওয়া যাবে না। রিপা সিগারেটের গন্ধ নিতে পারে না। এজন্য বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট টানছে। রিপা অবশ্য এতে আপত্তি করে নি, সে আপত্তি করেছিলো যখন তাকে বলেছিলো ওখানে (রিপার সামনে) বসে সে খেতে পারবে কি না? শ্যামল আশ্চর্য ভঙ্গিমায় সিগারেটের দিকে তাকালো। সে এখনো শেষ করতে পারছে না কেনো? সচরাচর সিগারেট খায় না সে, মাঝে মাঝে খুব টেনশন হলে একটা-আধটা খায়। রুমের ভেতর থেকে চিকন কন্ঠে রিপার আওয়াজ আসলো,’ মিঃ শ্যামল, আপনার কি এখনো খাওয়া শেষ হয় নি?’ শ্যামল অর্ধ খাওয়া সিগারেট টা ছুড়ে ফেলে দিলো। ক্ষীণ স্বরে জবাব দিলো, ‘ আসছি।’ বড় বড় নিঃশ্বাস ফেলে স্থির হয়ে নিলো শ্যামল। স্বাভাবিক ভঙ্গিমায় হেটে এসে উপস্থিত হলো রিপার সামনে। রিপা বেতের সোফায় বসে আছে। তার সামনে একটা টি-টেবিল আর বাম দিকে আরো একটা তিন জনের বসার মতো সোফা। সে যেখানে বসেছে সেখানে দুজন বসতে পারবে। রিপা ইশারায় শ্যামলকে তার বাম দিকের সোফায় বসতে বললো। সাথের সোফায় বসলে কথা বলতে অসুবিধা হবে, তার চেয়ে বরং পাশের সোফায় বসলে তার তাকাতে কষ্ট হবে না। দুজন আড়াআড়িভাবে বসলো। রিপা ঘরের আশেপাশের দিকে নজর বুলিয়ে ভাবলো, এরা বেশ শৌখিন। শ্যামলের মৌনতা দেখে সে সহজ গলায় বলে,

‘ আপনার “একটু সময়” কি এখনো শেষ হয় নি? রাত বাড়ছে, যত দ্রুত সব বলবেন ততই লাভ হবে।’

‘ বলাবলির অনেক কিছুই। বলা শুরু করলে আজ সব বলে শেষ করতে পারবো না। এর চেয়ে বরং আপনি প্রশ্ন করুন, আমি জবাব দিচ্ছি।’

রিপা ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানালো। জিহ্বা দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলে,

‘ঠিক আছে। প্রথম প্রশ্ন, আমার স্বামী কে? যদি আপনি হয়ে থাকেন তাহলে মিস নুহা আর আপনার মা কেনো বললো ওসব সাজানো এবং আমার বিয়ে আমার ভাইয়ের সাথে হয়েছে?’

‘ আপনার স্বামী ‘মোঃ নীলয় আলমগীর শ্যামল’ অর্থাৎ আমি। দ্বিতীয়ত, নুহা এবং আম্মা আপনাকে যা বলেছেন সেসব মিথ্যা। আবার সত্য।’

রিপা ভ্রুযুগল কুচকালো। শ্যামলের কথা তার বোধগম্য হচ্ছে না। কপালে তিন ভাঁজ ফেলে বলে,

‘ মিথ্যা আবার সত্য? এর অর্থ কি?কথা না পেঁচিয়ে সোজাসুজি বলেন।’

‘ কথাগুলো বাস্তবিকভাবে মিথ্যা। তবে তাদের জন্য সত্য। আপনার সাথে যে ছলনার বিয়ে হয়েছিলো সেটা তাদের জন্য ছলনা ছিলো। বাস্তবে আমি আপনাকে সত্যিকার অর্থেই বিয়ে করেছি। তাদের প্ল্যানমতো সব করেছি,শুধু মাঝেই নকল বিয়ের স্থানে আসল বিয়ে করে ফেলেছি।’

রিপার কপালে ভাঁজ সরলো না বরং আরো দৃঢ় হলো। কথাবার্তার আগামাথা না বুঝলে তার এমন প্রতিক্রিয়া হয়। মাঝেমাঝে মাথা চুলকায়। শ্যামলের কথার আগামাথা কিছুই খু্ঁজে পাচ্ছে না দেখে চোখগুলো ছোট করে তাকালো। শ্যামলের হাসি পেলো, কিন্তু সে হাসলো না। হাসি আসলে সবসময়ে হাসা যায় না, কিছু স্থানে তা সংবরণ করতে হয়। এখন হাসার অর্থ হলো সে সব মিথ্যা বলছে বা রিপাকে নিয়ে মজা করছে। তাই সে হাসলো না বরং সহজ ভাষায় বললো,

‘আপনি হয়তো কিছু বুঝতে পারছেন না। বুঝার কথাও নয়, যেহেতু আপনি কিছুই জানেন না। আমি বলছি শুনুন, আপনার সামনে এতসময় যেসব উপস্থাপন করা হয়েছিলো সবকিছুই একটা চক্রান্ত ছিলো। চক্রান্ত হলো আমাকে দেখিয়ে ভাইয়ের সাথে বিয়ে দেওয়া হবে, তারপর আমার চরিত্র খারাপ প্রমাণ করে আপনাকে ভাইয়ের প্রতি দূর্বল করা হবে। ভাইয়ের প্রতি দূর্বল হলে তখন বলা হবে আপনাকে বাস্তবে ভাই ই বিয়ে করেছেন। তখন আর সমস্যা হবে না, কারণ ভাইয়ের প্রতি তো আপনার টান চলে আসবে। এসব কিছু একটা চক্রান্ত ছিলো। এ চক্রান্ত করার কারণ হলো, আপনাকে কখনো ভাইয়ের সাথে বিয়ে দিবে না আপনার পরিবার। এর শুধুমাত্র কারণ ভাই মানসিক অসুস্থ সেটা নয়, তার কারণ ভাইয়ের “প্রথম বিয়ে”,যার জন্য আমার ভাইয়ের এ অবস্থা। আপনার স্থানে অন্য কোনো মেয়ে হতে পারতো, আপনিই কেনো? এমন একটা প্রশ্ন হয়তো আপনার মাথায় এসেছে? তার উত্তর হলো, ‘ ভাইয়ের বিড়ালকে যে বাঁচিয়েছে তার সাথেই যেনো ভাইয়ের বিয়ে হয়।’ -এই উক্তিটি।’

রিপার কপালে আবার চিন্তার ভাঁজ দেখা দিলো। শ্যামলের ঠোঁট নাড়া বন্ধ দেখে সে দ্রুত বলে,

‘ সব ঠিকঠাক বলে শেষে আবার প্যাচ লাগালেন কেনো? আপনার ভাইয়ের প্রথম স্ত্রী মানে? উনি কি বিবাহিত ছিলেন? তাহলে উনার স্ত্রী কে? মিস নুহা নিশ্চই নয়। অন্য কেউ হলে সে কই? তার কি হয়েছে? আর উক্তিটি মানে? এই উক্টি কার? কে বলেছে এসব? খোলাসা করে বলেন।’

‘ জ্বি, আমার ভাই বিবাহিত। তবে বিপত্নীক। ভাবী মারা গিয়েছেন গত বছরের শেষের দিকে ভাবীর আকস্মিক মৃত্যু সহজ হলো না ভাইয়ের জন্য। মানসিক চাপ নিতে না পেরে তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছেন। বার্বিডল নামে আমার ভাবীকে ভাই ডাকতো। কারণ ভাবী দেখতে হুবহু বার্বিডলের মতো ছিলো। বিড়াল টাও ভাবীর। আর উক্তিটি হলো আমাদের পরিবারের বিখ্যাত, সরি কুখ্যাত পীর সাহেবের। যার জন্য মারা গিয়েছেন আমার পরীর মতো ভাবী। এই পীর সাহেব হলেন আমাদের পরিবার ধ্বংস করার নষ্টের মূল। যাকে সাধ্যে থাকলে গলা টিপে মেরে ফেলতে দু-দন্ড ভাবতাম না।’

কথা বলতে বলতে শ্যামলের চোখমুখ শক্ত হয়ে গেলো। কপালের রগ ফুলে ভাসমান হলো। শ্যামল যখন এই পীর সাহেবের কথা মুখে আনে, তখন তার চোখমুখ এমন হয়ে যায়। যেনো তার জীবনের সবচেয়ে বড় শত্রু হলো তিনি। রিপা এখনো হতভম্ব হয়ে আছে। সে এখনো পুরোপুরি কিছুই বুঝে উঠে নি। মাথাটা ঘোলাটে লাগছে। এ শ্যামল লোকটা এমন ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বলে কেনো? সহজ করে বললেই তো সে সব বুঝে যায়। বিরক্ত লাগছে শ্যামলের কর্মকান্ড। মানুষ অদ্ভুত, সোজা ভাত খাবে না, হাত ঘুরিয়ে উল্টিয়ে খেতে চাইবে। এমনিতেই গত কয়েকদিন যাবৎ কি হচ্ছে সে কিছুই ঠিক মতো বুঝে উঠতে পারছে না। বিরক্ত ভাব টা ঝেড়ে ফেলে কৌতুহল নিয়ে সে শ্যামলকে প্রশ্ন করলো, ‘ এই পীর সাহেব কে? আর উনি ই বা কি করেছেন? সবকিছু বিস্তারিত বলুন।’

#চলবে..
®সোনালী আহমেদ

গল্প–#সম্পর্কের_বন্ধন
লেখিকা– #সোনালী_আহমেদ

৬.
শ্যামলকে প্রশ্ন করে, ‘ এই পীর সাহেব কে? আর উনি ই বা কি করেছেন? সবকিছু বিস্তারিত বলুন।’

শ্যামল ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়লো। বুঝাই যাচ্ছে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে সে অনিচ্ছুক। কিন্তু অনিহা থাকলে কি হবে তাকে তো বলতে হবে। প্রায়ই দৈনন্দিন জীবনে অনিচ্ছুক জিনিস নিয়েও চর্চা করতে হয়। সেসব হয় বাধ্যতামূলক। শ্যামলের জন্যও বাধ্যতামূলক। কিছু সময় চুপ থাকলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,

‘ পীর সাহেব, এক কলুষিত ব্যক্তির নাম। যার দখলে আমার পরিবার। আমরা হলাম তার হাতের পুতুল, তিনি যেমন চান তেমন নাচান। আমরাও তালে তালে নাচি। কদিন পর তুমিও নাচবে।’

রিপা ভ্রু কুচকে তাকালো। সে ও নাচবে মানে? তার কি আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই অন্যের কথায় চলবে? সে রিপা, তার নিজের যথেষ্ট বুদ্ধি আছে। সে কখনো অন্যের কথা ধরে চলবে না। দরকার পড়লে দুনিয়া উল্টে ফেলবে। তাতে কার কি?

শ্যামল গলা নামালো। ধীর আওয়াজে বললো,

‘ নাচতে না চাইলেও তিনি নাচাবেন। আমার মা পীর ভক্ত। ভক্ত নয়, অন্ধভক্ত। অন্ধ ভক্ত চিনো? যারা সম্পূর্ণ স্বরবর্ণ না জেনে শুধুমাত্র অ,আ জেনে লাফায়, হুদাই চিল্লাফাল্লা করে তাদেরকেই অন্ধভক্ত বলে। উনার মতে পীর সাহেব যদি হাঁচি দেন সেটারও কারণ থাকে। তিনি যদি বলে পানিতে ডুব দিয়ে নিঃশ্বাস আটকে বসে থাকতে তাহলে মা সঙ্গে সঙ্গে তা করে ফেলবেন। জানেন, আমার মা এবং ভাবীর সমস্ত গয়নাগাটি উনার দখলে, এমনকি আমাদের বাড়ী টাও। ‘

রিপা বিস্ফোরিত চোখে তাকালো। এ যুগেও এমন মানুষ হয়? হয়, হয় নাহলে তার শাশুড়ির দেখা কি পেতো? কিন্তু মানুষ এ লেভেলেরও অন্ধ ভক্ত হয়? কৌতুহলের সুরে প্রশ্ন করে,

‘ আপনার মা কি এত অবুঝ? ঘরবাড়ী অন্যের নামে লিখে দিয়েছেন? কিন্তু কেনো? নিশ্চই কোনো কারণ আছে, তাই না?’

রিপার মতে, কারো অন্ধ বিশ্বাসের পেছনে জোরালো কারণ থাকে। এমনি এমনি কেউ কাউকে এত বিশ্বাস করে না। নিশ্চই হৃদয় নিঙড়ানো কিছু করেছে সেজন্যই হয়তো তার মায়ের এত ভরসা। তাবিজ-তুমারে তার বিলকুল বিশ্বাস নেই। তো এটা স্বাভাবিক যে কোনো তাবিজ-ফাবিজ করে বশ করে নি। বরং তার মায়ের মনে বিশাল জায়গা করে নিয়েছে যার জন্য এত বিশ্বাস।

শ্যামলের মুখে অন্ধকার নেমে এলো। নিশ্চই কোনো দূর্বিষহ স্মৃতি মনে পড়েছে। স্মৃতিগুলো হয় বজ্জাত। যখনই কারো চোখে ভাসবে তখনই তার চোখ মুখ অন্ধকার করে তুলবে। কদাচিৎ হাসালেও পরক্ষণেই তার জন্য মনকে কাঁদিয়ে তুলে। শ্যামল বিষন্ন কন্ঠে বলে,

‘ আমার জন্মের পূর্ব থেকেই মায়ের এ ভক্তি। উনার এ ভক্তি জন্ম নেওয়ার কারণ হলো আমার ভাই। একদা আমার মা বন্ধা ছিলেন, তার কোনো সন্তান হতো না। তখন শরণাপন্ন হন এই পীরবাবার। উনার বিধিনিষেধ মেনে চলার পরের বছর ই জন্ম হয় আমার ভাইয়ের। এরপর, একে একে আসি আমি আর আমার বোন। তখন থেকে যে উনার ভক্তি তা আজ পর্যন্ত বিদ্যমান।’

-‘বলেন কি? উনার এত ক্ষমতা? ‘

-‘আরে দূর! বালের ক্ষমতা। মায়ের তখন ডাক্তারি চিকিৎসা ও চলছিলো। ডাক্তারের ঔষধ ও খেতেন। কিন্তু উনি মানেন পীরের কারণে বাচ্চা হয়েছে। কারণ ঔষধ তো এর পূর্বেও খেয়েছেন তখন সারে নি কেনো? আরে ভাই, ঔষধ কি সাথে সাথে কাজ করে? এসব ঔষধের সময় লাগে। অনেক ঔষধ আছে যেসব ধীরে ধীরে কাজ করে,আবার অনেক ঔষধ দ্রুত। কিন্তু আমার মা কে তা বুঝানো কারো কি সাধ্যে পড়ে?’

শ্যামলের চোখ লাল টকটক হয়ে গিয়েছে। শ্যামল যখন রেগে যায় তখন চোখ লাল হয়ে যায়। প্রত্যেক মানুষের রাগ প্রকাশের আলাদা আলাদা ভঙ্গিমা রয়েছে। শ্যামলের রাগ প্রকাশের ভঙ্গিমা এমন। সে শান্ত থাকে, চোখমুখ লাল হয়ে যায়। কখনো ভাংচুর করে না বা অন্যের উপর রাগ দেখায় না। নিজের ভেতর চেপে রেখে খুবই সহজ ভঙ্গিমায় অন্যের সহিত কথা বলবে।
রিপা কথা ঘুরালো। এ প্রসঙ্গ থেকে তার ভেতর নুহার প্রসঙ্গের কথা বলা জরুরী মনে হচ্ছে। যদিও এ বিষয়ে তার কৌতুহল কম নয় তবুও ওই বিষয় নিয়ে কথা বলা জরুরী। তাছাড়া শ্যামলের সাথে এ বিষয় নিয়ে কথা বলতে যেয়ে যদি দেখা যায় শ্যামল উত্তেজিত হয়ে গিয়েছে। তখন না থাকবে বাঁশি আর না বাজবে বাঁশুরী। বুঝা’ ই যাচ্ছে শ্যামল রেগে আছে। থাক এ নিয়ে পরে জানবে। রিপার উড়ো স্বভাব। সে একটা বিষয় নিয়ে স্থির থাকতে পারে না। এ যেমন, ভাত খাওয়ার সময় যদি মিষ্টি আনা হয়। তখন সে ভাত রেখে মিষ্টি খেতে যাবে। এখনও সে পীরের কথা বাদ দিয়ে, নুহার কথা শুনবে। শ্যামল না বলতে চাইলেও জোর করে শুনবে। এমন বিচিত্র স্বভাব সে বাচ্চাকাল থেকেই পেয়েছে। শ্যামলের মুখোমুখি হয়ে ভ্রু নাচিয়ে বললো,

‘ আপনি আগে বলুন, নুহা কে? তার বিষয়ে কোনো ক্লারিফিকেশন পাই নি? ‘

শ্যামল স্বাভাবিক হলো। রাগ সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে সে। হুটহাট যেমন রেগে যায় ঠিক তেমন হুটহাট শান্ত হয়ে যায়। গণণা করলে দেখা যাবে এমন লোকের সংখ্যা বেশি। খুবই কম লোক হয়,যাদের রাগ দীর্ঘস্থায়ী হয়। শ্যামল তাদের কাতারে পড়ে না, সে অন্যদের মতো। রিপার কৌতুহল আর সন্দেহ দেখে তার চোখেমুখে পরিবর্তন এলো না। বরং না দেখলে পরিবর্তন আসতো। নারীজাত নিজের স্বামীর সাথে পর নারীর সহিত হালকা দেখা পেলেও তা নিয়ে কখনোই কথা বলতে ছাড়ে না, সেখানে তার সাথে নুহাকে আপত্তিকর অবস্থায় দেখেছে। কাজেই এ বিষয় নিয়ে প্রশ্ন না করাটা আশা করা বোকামি। শ্যামল গলা খাঁকারি দিয়ে পরিষ্কার করে নিলো। নিচু কন্ঠে বলে,

‘ নুহা সম্পর্কে আমার কাজিন। আপন নয়,দূরসম্পর্কের। পেশায় সে একজন নার্স। মূলত আমার ভাইয়ের খেয়াল রাখার জন্য তাকে বাসায় আনা হয়েছে।’

‘ আচ্ছা। তাহলে আপনার কথার অর্থ হলো, সেদিন ওসব আমাকে দেখানোর জন্য নাটক ছিলো। আপনার কি মনে হয় না সে অবস্থা খুবই বেশি হয়ে গিয়েছিলো?’

‘হু। এতটা খারাপ অবস্থা তৈরী করার কথা ছিলো না। আমি কিছু বলার পূর্বেই আপনি চলে এসেছিলেন,তাই আমি অভিনয় চালাতে বাধ্য হয়েছিলাম।’

‘ আমার মোটেও তেমন মনে হচ্ছে না। কোনো মেয়ে কখনোই কারণবিহীন নিজের ইজ্জত নিয়ে এতটা কাহিনী করে না। জোরালো কোনো কারন থাকে। তাছাড়া তার চোখে আর কন্ঠে আমি স্পষ্ট জোর দেখেছি। এত তুচ্ছ সম্পর্কে কেউ এমন করে না।’

শ্যামল কয়েক সেকেন্ড মৌনতা পালন করলো। তারপর খুবই ধীর স্বরে বলে,

‘তার আরো একটা পরিচয় আছে।’

‘সেটা কি?’

‘ সে আমার হবু বউ। আমার বিয়ে ঠিক হয়েছে তার সাথে। যেখানে আমার ইচ্ছা বিন্দু পরিমাণ নেই। মা’কে কি জাদু করেছে সে, কে জানে? তিনি মোমের মতো গলে প্রস্তাব দিয়ে বসলেন। আমি সাথে সাথে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম, কিন্তু উনারা সেটা গ্রাহ্য করেন নি। তাই আমিও উনাদের গ্রাহ্য করে নি, উনাদের চাল উনাদের উপর দিয়ে দিলাম। বিয়ে করে নিলাম আপনাকে। উনি আমাকে না জিজ্ঞেস করে যেমন বিয়ে ঠিক করেছেন, ঠিক তেমন আমিও বিয়ে করে নিয়েছি।’

রিপা চুপ রইলো। কি বলা উচিত বুঝতে পারছে না। শ্যামলের যুক্তি তার মোটেও পছন্দ হচ্ছে না। সম্পর্ক টা ঘুরেফিরে প্রতারণার হয়ে যাচ্ছে। এ কেমন বন্ধন? স্বাভাবিক কোনোরকম সম্পর্ক ই নেই। রিপা ঠোঁট নাড়লো,

‘ আপনি জেদের বসে আমাকে বিয়ে করেছেন? এ সম্পর্ক টা কি শুধুই একটা জেদ? আপনার পরিবার জেনে যাওয়ার পর যদি না মানে তাহলে কে ভেঙ্গে যাবে “সম্পর্কের বন্ধন”? ছেড়ে দিবেন আমাকে?’

শ্যামল চুপ থেকে এক দৃষ্টিতে রিপার দিকে তাকিয়ে রইলো। সে তো এ কথা ভাবে নি,নির্মলা বেগম যদি না মানে তখন সে কি করবে? ভাবা উচিত ছিলো। এত বড় বিষয় কীভাবে ভাবলো না। এর জন্য নিশ্চই তার বড় ধরনের শাস্তি পাওয়া উচিত। শাস্তি টা কঠিন হলে ঠিক হবে। তখন দ্বিতীয়বার কিছু করবার পূর্বে মনে পড়বে। পরক্ষণে চিন্তা করলো, মা না মানলে কী হবে? সে মানিয়ে নিবে। মানতে না চাইলে জোর করে মানাবে। দরকার পড়লে দুনিয়া উল্টিয়ে ফেলবে। হু কেয়ার’স? রিপার মতো মিষ্টি মেয়েকে মানবে না কেনো? ভাইয়ের জন্য যদি মেনে থাকে নিশ্চই তার জন্যও মানবে। সে পছন্দ করে এত সহজে হেরে যাবে না। হু হু…

রিপা ঝুঁকে তাকালো শ্যামলের দিকে। কৌতুহলী হয়ে বলে,

-‘ কি বিরবির করছেন? উত্তর দেন। আপনি কি জেদের কারণে বিয়ে করেছেন?’

শ্যামল কঠিন গলায় জবাব দিলো,

‘ না।’

রিপা চেয়ে রইলো। শ্যামল লজ্জিত মুখে বললো,

‘আপনাকে আমার ভালো লাগে। আপনি যখন হাসেন তখন আরো ভালো লাগে। ওই যে সেদিন গোলাপি রঙ এর গোল ফ্রকের সাথে সাদা ওড়না পরে হাসতে হাসতে সিড়ি লিফ্টে নামছিলেন তখন খুব মিষ্টি লাগছিলো আপনাকে।’

কথাটা বলেই জিভ কাটলো। শিট! এটা কি করলো? লজ্জা ভাব নিয়ে কথা বলেছে? সে কি মেয়ে? মেয়েরা এমন ইনিয়ে-বিনিয়ে মুখ লাল করে কথা বলে। সে তো পুরুষ, তার উচিত ছিলো গম্ভীর গলায়, মোটা মোটা স্বরে কথা বলার। এত বড় ভুল সে কীভাবে করলো? হয়েছে টা কি? আজ ভুলের উপর ভুল করেই যাচ্ছে। মুহূর্তেই মুখ ফ্যাকাশে বর্ণ ধারন করে নিলো। তার এভাবে কথা বলা একদম উচিত হয় নি। এ ঘোর অন্যায়। রিপার দিকে তাকাচ্ছে না। তাকালেই দেখবে মেয়েটা তার উপর উপহাস করছে। কি দরকার যেচে যেচে লজ্জা পাওয়ার? সে মাথা নিচু করে নিচের দিকে তাকিয়ে রইলো।

#চলবে…
®সোনালী আহমেদ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here