সুপ্ত অনুরাগে পর্ব -২৬+২৭

#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[২৬]

বেলা আটটা বাজে। গনগনে সূর্যটা ধীরে ধীরে খোলস ছাড়ছে। সোনালি কিরণ এসে হুটোপুটি করছে জানালার গায়ে। অপু জানালার পর্দা ঠেলে গ্রিলে মাথা ঠেকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এই মুহূর্তে বাড়ির অবস্থা থমথমে। তন্ময়ের বাড়ি থেকে বিয়ের প্রস্তাব সসম্মানে নাকচ করা হয়েছে। তন্ময় বিয়ে করতে অসম্মতি জানিয়েছে। বাহানা স্বরূপ জানিয়েছে তার নাকি সুদূর মার্কিনে শ্বেতী বান্ধবী আছে, তাকেই বিয়ে করবে। বিষয়টা দুই পরিবারের সম্পর্কে ভাটা ফেলেছে। এক পক্ষের লজ্জায় অপরপক্ষের অপমানে চারপাশ কেমন ভারী হয়ে আছে। সেই ভারী গুমোট আবহাওয়ার মাঝেও অপুর হৃদয়ে শান্তির সুবাতাস বিরাজমান। এদিকটা সামলানো গেছে। বাবা-মা সাময়িক দুঃখ পেলেও কাটিয়ে উঠবে। কিন্তু সমস্যা অন্য জায়গায়। সুপ্ত তন্ময়ের আত্মীয় জানলে পরিবার আবার বেঁকে বসবে নাতো? অপুর ভয়টা সেখানেই। সেই ভয় অবশ্য অমূলকই মনে হচ্ছে এখনও অবধি। সুপ্তই তো তাকে পাত্তা দিচ্ছে না। লোকটাকে সে বুঝে পায় না। এই না দেখে থাকতে পারে না অথচ এখন দিব্যি কথা না বলে, দেখা না করে আছে। না দেখলে অস্থিরতা কাজ করে এসব বলা আসলে ভাওতাবাজি। সাময়িক মোহও হতে পারে। অপু নিজের ভাবনার রাশ টানল সঙ্গে সঙ্গে। অভিমান করে লোকটার ওপর একের পর এক অভিযোগ হানছে সে। কিন্তু দোষটা যে আসলে সুপ্তের নয়। দোষটা পরিস্থিতির। অপু সুপ্তের পরিস্থিতি না জেনে কিছুতেই তাকে দোষারোপ করতে পারে না। নিজের মনই তার বিরুদ্ধে বিদ্রো’হ করে উঠল।
অপু বিছানার কাছে ফিরে ফোনটা হাতে নিল। খানিক সময় কাটল দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে। এরপর সকল সংশয় পাশ কাটিয়ে কল দিল সুপ্তের ফোনে।

সুপ্তের ইদানীং ঘুম হয় না। সারারাত জেগে ঘুমিয়েছে ভোরের দিকে। সুতরাং এখন তার ঘুম অমাবস্যার গহীন বনের ঝোপালো আঁধারের চেয়েও ঘন। নিশ্বাসের গভীরতা জানান দিচ্ছে এ ঘুম এত জলদি ভাঙবে না। বৈশাখী ছেলের পাশে এসে বসেছিলেন খানিকটা সময়। চিরুনির মতো আঙুল চালাচ্ছেন তার চুলে। উনার দৃষ্টিতে অ’প’রাধবোধ। আজকাল কিছুই হিসাব মতো চলে না। বুকের ভেতরটা খা খা করে ওঠে। পুরোনো স্মৃতিগুলো খুব বেশি জ্বা’লাতন করে। আজও স্পষ্ট মনে আছে ছেলেটাকে যেদিন হাতে পেলেন সুপ্ত তখন হামাগুড়ি দেয়। সম্মুখে মিষ্টি কটি দাঁত দৃশ্যমান। রেশমের মতো চুলের তুলতুলে বাচ্চাটিকে দেখে উনার হৃদয়ে মাতৃত্ব জাগেনি। জেগেছে ক্ষো’ভ, ঈর্ষা, ঘৃণা। তিনি মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলেন। বাড়িতে বিস্তর যু’দ্ধের দামামা বেজেছে। রফিক সাহেবের সঙ্গে কথা কাটাকাটি হয়েছে। প্রাপ্ত বয়স্ক মানুষের ঝামেলায় পড়ে ছোট্টো সুপ্ত হাত-পা নেড়ে তারস্বরে কাঁদছিল। বারবার হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিল একটু মমতা লাভের আশায়। কিন্তু বৈশাখীর মন গলেনি। বাচ্চাটি গ্রহণ করা মানে নিজের অক্ষমতা মেনে নেওয়া। পরাজয় স্বীকার করা। এই বাচ্চাকে তিনি গ্রহণ করবেন না সাফ সাফ জানিয়ে দেন। রফিক সাহেবও ছিলেন একরোখা। সুপ্তকে ছাড়লেন না। অবশেষে দুজনের জেদেরই জয় হয়। পরাজয় ঘটে ভালোবাসার। বৈশাখী পাড়ি জমান ভিনদেশে, নিজের পরিবার-পরিজনের কাছে।

অথচ এতগুলো বছর ধরে এই ছেলেটাই উনাকে মা বলে জানত। জানত পৃথিবীর পবিত্রতম সম্পর্ক হিসেবে। বৈশাখীর বড্ড অনুশোচনা জাগে আজকাল। সেই তো ছেলেটাকে আপন করল। তখন কেন করতে পারল না? তাহলে এমন ভাঙাচোরা জীবন তিনজনের কাউকেই বহন করতে হতো না। সুপ্ত কতটুকু জেনেছে তিনি জানেন না। শুধু বুঝতে পারেন নরম মনের ছেলেটা তা সহ্য করতে পারেনি। অন্তত এতদিন সে ভেবে এসেছে একসাথে না থাকলেও তার একটা মা আছে। কিন্তু এখন… সুপ্ত তাকে মা হিসেবে মানতে পারছে তো?

হুট করে ফোন বাজার শব্দে বৈশাখী হতচকিত হলেন। সুপ্তের ফোন বাজছে। তিনি ঘুম ভাঙাতে চাইলেন না। স্ক্রিনে দেখলেন ‘লাভ অর লাইফ’ দিয়ে সেইভ করা একটি নম্বর। নামটা অনেক কিছু নির্দেশ করে। বৈশাখী ধরবেন না ধরবেন না করেও ফোনটা রিসিভ করলেন। অপু প্রথমেই গমগমে সুরে বলে উঠল,
“অ্যাই! আপনি আর কত ঢং করবেন শুনি?”

বৈশাখী ফোন কানে কিছুটা বিব্রত হলেন। গলা ঝেরে বললেন,
“আমি সুপ্তের মা বলছি।”
অপু থতমত খেয়ে গেল। ভেবেছিল সুপ্তকে বকাঝকা করে নেবে এই সুযোগে। কিন্তু শুরুতেই বিভ্রাট হয়ে গেল। সে জিভ কেটে তড়িঘড়ি করে বলল,
“আসসালামু আলাইকুম আন্টি। আসলে আমি সুপ্ত ভেবেছিলাম, ক্ষমা করবেন।”
বৈশাখী ভ্রু কুঞ্চিত করে কিছু ভাবলেন। এরপর সালাম নিয়ে বললেন,
“তোমার পরিচয় মা?”
“আমি অপরাজিতা।”

এটুকু বলে অপু থেমে গেল। তার আর কী পরিচয় হতে পারে? সুপ্তের গার্লফ্রেন্ডও না, বন্ধুও না। উডবি গার্লফ্রেন্ড বলা যায়। তবে সেটা তো আর মাকে বলা যায় না। তাছাড়া তিনি অপুকে চেনেন। তন্ময়ের সুত্রে এসেছিলেন দেখতে। এখন এই সম্পর্কটা কীভাবে নেবেন সেটাও ভাবনার বিষয়। অপু কোনো লুকোচুরিতে গেল না। সরাসরি বলল,
“আন্টি আপনি আমাকে চেনেন। আমাদের বাড়িতে এসেছিলেন।”

বৈশাখী যারপরনাই চমকে গেলেন, থমকে গেলেন। অপরাজিতা তো সেই মেয়ে যার সঙ্গে তন্ময়ের বিয়ের কথা হলো, আবার ভেঙেও গেল। সে সুপ্তকে ফোন করল হঠাৎ! আবার সুপ্তের ফোনে তার নম্বর ‘লাভ অর লাইফ’ দিয়ে সেইভ করা! বৈশাখীর মাথা তালগোল পাকিয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য। ধাতস্থ হয়ে বললেন,
“আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
________________

সুপ্তের ঘুম ভাঙল বেলা এগারোটায়। বাইরে তখন রোদ ম’রা মেঘলা আকাশ। হেমন্ত বিদায়ী এই ঋতুকে ঠিক নির্দিষ্ট কোনো ঋতুর নামে অলংকৃত করা মুশকিল। এসময় আকাশ ফুঁড়ে হুটহাট বৃষ্টি ঝরে, বাদলা মেঘের নৌকা ঘোরে আকাশ সীমায়। কখনো তীক্ষ্ণ ফলার মতো রোদের হলকা গায়ে বিঁধে আবার রাতের বাতাস লোমকূপ কাঁপানো শীত বয়ে আনে। সুপ্তের পরনে একটা লাইট ব্লু টিশার্ট ও ব্ল্যাক ট্রাউজার। সে চোখ কচলাতে কচলাতে নামছিল সিড়ি বেয়ে। পুরোপুরি নামা হলো না। এক অনাকাঙ্ক্ষিত দৃশ্য তাকে সিড়িতেই ভড়কে দিলো। মুখ থেকে ছিটকে বেরিয়ে এলো আশ্চর্যান্বিত শব্দ,
“মাই গড!”

বসার ঘরে সোফায় বসে আছে অপরাজিতা। পরনে সেই শাড়িটা যা সুপ্ত তাকে উপহার দিয়েছিল। খোলা চুল, হাত ভর্তি কাচের চুড়ি টুংটাং করছে। সুপ্ত বোবা হয়ে তাকিয়ে রইল সেদিকে। কতক্ষণ তাকিয়ে ছিল সে নিজেও জানে না। ফুপির ডাকে চমক ভাঙল। ফারিহা চ্যাচিয়ে উঠল,
“এই সুপ্ত! ওখানে দাঁড়িয়ে দেখছিস কেন? নিচে আয়।”

একযোগে বসার ঘরের সকলের দৃষ্টি এলো সুপ্তের দিকে। তাকাল অপুও। দুচোখে আজ কাজল টানা। সম্ভবত এই প্রথম সুপ্ত তার কাজল চোখ দেখল। হা করে দেখতে নিয়েও নিজেকে সামলে নিল। এই মেয়ে এখানে কী করছে? তন্ময়ের সঙ্গে ঘুরতে এসেছে? ভাবনাটা মাথায় আসতে সুপ্তের মুখটা গম্ভীর হলো। সে নিচে নেমে আসল নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে। অপুর মুখটা ধীরে ধীরে লাল হচ্ছে। নার্ভাসনেসে হাত ঘামছে অনবরত। সুপ্তের মায়ের ডাকে সে চলে তো এসেছে কিন্তু কিছুতেই স্বাভাবিক হতে পারছে না। সুপ্তের আগমনে তার হৃদয়ে ডঙ্কা বাজতে শুরু করেছে। মনে মনে নিজেকে গা’লা’গাল করতেও ভুলল না, কেন সাজতে গেল এত? এদিকে তাকে দেখো, মুখটাকে রামগরুড়ের ছানা করে রেখেছে।

বৈশাখী অপুর পাশে বসে ওর হাত ধরে রেখেছেন। ভুল বোঝাবুঝি ঠিক কোথায় হয়েছে তিনি জেনেছেন খানিক আগে তন্ময়কে চেপে ধরে। সব শুনে মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার মতো অবস্থা। এই বিয়েটা হলে সুপ্ত আরেকবার ভেঙে পড়ত। এত এত দুঃখ, হতাশা নিয়ে ছেলেটা বাঁচতে পারত? তিনি সুপ্তকে নামতে দেখে ফারিহাকে নিয়ে খাবারের ব্যবস্থা করতে রান্নাঘরে চলে গেলেন। বসার ঘরে আপাতত অপরাজিতা একা রইল।

সুপ্ত গম্ভীর মুখে এসে অপুর ডানপাশের সোফায় বসে পড়ল। হাত বাড়িয়ে জুসের গ্লাসটা নিয়ে তাতে চুমুক দিলো। অপু অবাক হয়ে খেয়াল করল তার ভঙ্গুর দশা। চোখের নিচে যেন ঘোর আঁধারী সন্ধ্যা নেমেছে। চোখ ডেবে গেছে অনেকটা। চেহারার সেই জৌলুশ, প্রাণবন্ততা ম্লান। অপুর বুকটা হু হু করে ওঠে। এত দুঃখ কীসের তার? সুপ্ত জুসের গ্লাসে নজর রেখে বলে উঠল,
“বাড়িতে হঠাৎ নতুন মেহমান?”
“নতুন বলেই হঠাৎ এলাম। আস্তে আস্তে পুরোনো হয়ে যাব।”
সুপ্ত চোখ তুলে চাইল। অপুর ভাষার এই টোন তার চেনা নয়। হবেই বা কী করে। তার সঙ্গে তো জীবনেও হেসে কথা বলেনি এই মেয়ে। আর আজ ঠোঁট দিয়ে মধু ঝরছে। সুপ্ত অপুর ঠোঁটের দিকে চাইল আঁড়চোখে। টকটকে লিপস্টিকও মাখা হয়েছে! বলল,
“কে নিয়ে এলো? তন্ময়?”

অপু ঠোঁট টিপে চুপ রইল। বিয়েটা যে হচ্ছে না লোকটা কী জানে না? মনে তো হচ্ছে। অপু মেকি হেসে বলল,
“হ্যাঁ।”
“ও কই?”
“চলে গেছে…দরকারি কাজে। খুবই ব্যস্ত।”

সুপ্ত খেয়াল করল তার মেজাজ খারাপ হচ্ছে। গতদিন আগেই ফোন করে তার সঙ্গে কান্নাকাটি করল। আর আজ সব ভুলে তন্ময়ের সঙ্গে সেজেগুজে বেড়াতে এলো, তাও কিনা তারই বাড়িতে? এতই সোজা অনুভূতি পালটে ফেলা! সুপ্ত তো পারেনি। এই যে দূরত্ব সে সৃষ্টি করেছে, তাতে নিজেই প্রতিনিয়ত জ্ব’লে পু’ড়ে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে। অন্তরে অতৃপ্তি খা খা করছে। ইচ্ছে করছে এই সাজ নিজের হাতে নষ্ট করে দিতে। তন্ময়কে অন্ধ করে দিতে যেন অপরাজিতার দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকাতে না পারে। সুপ্ত লম্বা শ্বাস নেয়। তাচ্ছিল্যের দৃষ্টি হানে অপরাজিতার পানে। মেয়েটাকে সে সহজ-সরল ভেবেছিল। সুপ্ত আর এক সেকেন্ডও বসল না সেখানে। হনহনিয়ে হেঁটে ওপরে উঠে গেল। সিড়ি বেয়ে উঠে করিডোরে পা রাখতেই বাবার সম্মুখীন হলো। রফিক সাহেব ছেলের পিঠ চাপড়ে ক্ষীণ স্বরে বললেন,
“ওসব রাজশাহী-টাজশাহী যাওয়ার নাম ভুলে যাও। মেয়ে আমার পছন্দ হয়েছে। এবার দেবদাসপনা ছেড়ে তাকে ঘরে তোলো।”

সুপ্ত চকিতে নিচে তাকায়৷ চোখাচোখি হতেই অপু থুতনি নামায়। মেয়েটা লজ্জা পাচ্ছে!
#সুপ্ত_অনুরাগে
#প্রভা_আফরিন
[২৭]

অপু সুপ্ত পাশাপাশি ছাদে হাঁটছে। অপুর ঠোঁটে লাজুক হাসি৷ মনে জড়তা থাকলেও চেষ্টা করছে যথাসম্ভব সেটাকে আড়াল করতে৷ সুপ্ত গোমড়া মুখে, আঁড়চোখে পার্শ্ববর্তী লজ্জাবতী নারীকে পর্যবেক্ষণ করছে। তার পর্যবেক্ষণ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না সুক্ষ্ম মেকাপের আঁচড়ও। অপু সেই চোরা চাহনি দেখে থুতনি নামায়। সুপ্ত চোখ সরিয়ে মনে মনে নিজেকে শাসায়। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারালে চলবে না। ছাদের রেলিং ঘেঁষে উঠেছে বাগানবিলাস। টবে টবে ফুটে আছে রঙিন ফুল। একপাশে দুলছে একাকী দোলনা। মন জুড়ানো পরিবেশ। অপু নীরবতা ভেঙে বলল,
“আপনাদের বাড়িটা কিন্তু বেশ শৌখিন। কে সাজিয়েছে?”
“মা আর ফারিহা ফুপি।”
“বেশ রুচিশীল।”
“তুমি হঠাৎ এ বাড়িতে?”
অপু ভ্রু বাঁকায়, “কেন সহ্য হচ্ছে না আমার উপস্থিতি?”
“প্রশ্নের বিপরীতে প্রশ্ন চাইনি।”
অপু কাঁধ ঝাকিয়ে বলে,
“আপনার মা ডাকলেন। গুরুজনের ডাক অগ্রাহ্য করতে পারলাম না।”

সুপ্ত বাঁকা চোখে তাকায়। ক্ষীণ পরিহাস করে বলে,
“সে হিসেবে তো আমিও তোমার গুরুজন। আমাকে তো শত-সহস্রবার উপেক্ষা করলে।”
“বলেছেন না বেবী ফ্লাওয়ার। সেজন্য বুঝতে সময় লেগেছে। আপনি বুঝি তাই এখন শোধ নিচ্ছেন?”
সুপ্তের বুক চিড়ে একটি চাপা শ্বাস বেরিয়ে আসে। বলে,
“উহুম, পরিস্থিতি শোধ নিচ্ছে।”
“পরিস্থিতিটা আপনার সৃষ্টি নয় কী? হুট করে কেন গুটিয়ে নিচ্ছেন নিজেকে? কেন নিজেকে বঞ্চিত করছেন?”

দুজন রেলিং ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। সুপ্ত আকাশের দিকে চোখ রাখল। বেশিক্ষণ টিকতে পারল না। রোদে চোখ ঝা ঝা করে ওঠে। চোখ বুজে বলল,
“ছাড়ো সেসব কথা। তন্ময় হুট করে বিয়ে কেন ভাঙল? আমার অবজারভেশন ভুল না হলে সে তোমার প্রতি দুর্বল ছিল। আর বিদেশি বান্ধবী কথাটাও ডাহা ভুয়া।”
“অবজারভেশন পাওয়ার আপনার একা নেই। উনারও ছিল।”
অপুর কণ্ঠটা কেমন শুকনো শোনায়। সুপ্ত চমকে উঠে বলে,
“তার মানে?”
“ছাড়ুন না সেসব কথা। বিয়েতে আমার মত ছিল না। সেটাই মূল কথা। বাই দ্যা ওয়ে, আপনার মায়ের শাড়ি পরেছি কিন্তু।”

সুপ্ত সে কথার বিপরীতে কিছু বলল না। অপুর মনে অভিমান জমে। সুপ্ত নিজেই বলেছিল অপু যেদিন মন থেকে তার হয়ে যাবে সেদিনই যেন শাড়িটা পরে। পরেছে তো আজ। মন থেকেই পরেছে। লোকটা কী ভুলে গেছে সেসব কথা? ভোলার তো কথা না। তাহলে কেন এই উপেক্ষা? সে কী আদৌ এই উপেক্ষার যোগ্য? অপু গুমোট মুখে দাঁড়িয়ে রইল। সুপ্ত চোখের ওপর আঙুল বিছিয়ে বলল,
“রোদ কড়া। চলো নিচে যাই।”
সুপ্ত দুই পা বাড়াল সামনে। অপু ঠায় দাঁড়িয়ে থেকে বলল,
“আর কিছুই বলার নেই আপনার? কিছুই না?”

সুপ্ত পেছন ফিরে দাঁড়ায়। তার লম্বাটে, বলিষ্ঠ দেহ অপুর ছিপছিপে দেহটিকে রোদের আড়াল করে দেয়। সুপ্ত এই মুখটার মায়ায় পড়েছে। হৃদয় ভেঙেচুরে পড়েছে৷ অস্বীকার করার জায়গা নেই। বরং তার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সত্য সে এই সরল, নির্মল নারীর প্রেমে পড়েছে। কিন্তু নিজের ওপর বড্ড আফসোস হয়। এই মিষ্টি ফুলটাকে সে ছুঁয়ে দিতে চেয়েও ব্যর্থ। জেনে বুঝে তার শিকড়হীন জীবনের সঙ্গে অপরাজিতার গোছানো, সুন্দর জীবনটা কেন জুড়বে? তার চেয়েও বড়ো কথা তাকে দয়া করা হচ্ছে। তন্ময় ইচ্ছে করে বিয়েটা ভেঙেছে। সে সুপ্তের সত্যিটা জানে বলেই দয়া করে বিয়েটা ভেঙেছে। সহানুভূতি দেখিয়েছে। কে জানে? অপুও হয়তো সহানুভূতির কবলে পড়ে তার প্রতি দুর্বল হয়েছে। কিন্তু সুপ্ত তার জীবনে আর কোনো সহানুভূতি চায় না। মনে মনে নিজেকে শক্ত করে নেয়। কঠিন সুরে বলে,
“তুমি বাড়ি ফিরে যাও অপরাজিতা।”
“তাড়িয়ে দিচ্ছেন? নাকি পালাতে চাইছেন? নিজের অনুভূতি থেকে?”

সুপ্ত ঢোক গিলে চুপচাপ সরে গেল। নীরব প্রত্যাখানে অপু দুই চোখ টলমল করে উঠল। ঝাপসা হয়ে এলো নতুন আশা ধারণ করা নয়নদুটি। অপু আর এক মুহূর্তও দাঁড়াল না সেখানে। হুড়মুড় করে নিচে নেমে গেলে বৈশাখীর সম্মুখীন হলো সে। বৈশাখী অবাক হয়ে বললেন,
“একি! কী হয়েছে তোমার?”
অপু চোখ নামিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে কাঁপা কাঁপা কণ্ঠে বলে উঠল,
“কিছু না আন্টি। শরীর ভালো লাগছে না। আজ বরং আসি।”

আর কিছু বলতে না দিয়ে অপু ছুটে বেরিয়ে গেল। বৈশাখী হতভম্ব হয়ে সেদিকে তাকিয়ে রইলেন। বুঝলেন দুজনের মাঝে আবার কিছু ঘটেছে। সুপ্তের রুমে গিয়ে দেখলেন সে সোফায় গা এলিয়ে চোখ বুজে বসে আছে৷ বৈশাখী গমগম করে উঠলেন,
“সুপ্ত, মেয়েটা চলে গেল কেন?”

সুপ্ত চোখ মেলল। ভাবলেশহীন গলায় বলল,
“ওহহ, চলে গেছে? ভালোই হয়েছে।”
“ভালো হয়েছে মানে? একজন মানুষকে আমি ইনভাইট করলাম। সে এলো আর তুই তাকে তাড়িয়ে দিলি? দিন দিন ম্যানারলেস হয়ে যাচ্ছিস। এক্ষুনি যাবি ওর পেছনে। আমার মেহমানকে অপমানিত করে তাড়ানোর অধিকার আমি তোকে দিইনি। তোদের ঝামেলা তোরা নিজেদের মধ্যে করবি। কিন্তু অপরাজিতা এখন আমার গেস্ট। তাকে সসম্মানে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসবি তুই।”

সুপ্ত হতাশ শ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ায়। মা ভীষণ ক্ষেপেছে। এই মুহূর্তে আর চটানো যাবে না। সে বাইকের চাবিটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে।

তপ্ত সূর্যকে মাথায় নিয়ে অপু মেইন রোডের কিনারা ঘেঁষে হাঁটছে। রাগে, দুঃখে তার দুই চোখ বারবার ঝাপসা হয়ে আসছে। কাজল ছড়ে গেছে। জীবনে প্রথম, প্রথমবার অপুর মন কারো প্রতি অনুভূতিময় হয়েছে। নিজ মনের আগল ভেঙে, সকল দ্বিধা কাটিয়ে ছুটে গিয়েছে সেই অনুভূতির ধারক মানুষটার কাছে। অথচ তাকে ফিরতে হলো অপমানিত হয়ে। তার প্রথম আবেগকে এভাবে তুচ্ছ করতে পারল সুপ্ত? সে যে শাড়িটা পরল, চোখে কাজল দিলো, ঠোঁটে লিপস্টিক দিলো। নিজেকে সাধ্যমতো সাজিয়ে হাজির হলো সুপ্তের দুটি প্রসংশাবাক্য শ্রবণ করতে। লোকটা পারল এভাবে উপেক্ষা করতে? অপুর গাল ভিজে যায় নোনা জলের স্রোতে। সে শাড়ির আঁচল দিয়ে লিপস্টিক ঘষে তুলতে চেষ্টা করে। তা ছড়ে গিয়ে লেপ্টে গেল ঠোঁটের চারপাশে। হুট করে একটি বাইক ছুটে এসে তার গতিরোধ করল। অপু মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে গেল। নড়ল না, মাথাও তুলল না।

সুপ্ত ভ্রু কুচকে তাকায়। অপুর মুখ নত। খোলা চুলে মেয়েটার মুখ ঢেকে আছে। দেহ ঈষৎ কাঁপছে। সুপ্ত বাইক থেকে নেমে আসে। অপুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার থুতনি ধরে মুখ উঁচু করে। চোখের জলে সাজের বেহাল দশা দেখে সুপ্তের বুক কেঁপে ওঠে। অপু সুপ্তের ছোঁয়া পেতেই হু হু করে কেঁদে ওঠে। দেহের সমস্ত ভার ছেড়ে দেয় সামনে। আছড়ে পড়ে সুপ্তের বুকে। সুপ্ত ধরে নেয়। সযত্নে আগলে ধরে নিজের সঙ্গে। মাথায় হাত বুলিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
“তুমি কাঁদছো অপরাজিতা? আমি সরি! খুব সরি! তোমাকে দুঃখ দিতে চাইনি আমি। সরি, সরি!”

অপু হেচকি ওঠা গলায় এলোমেলো করে বলল,
“ইচ্ছে করে কাঁদিয়েছেন আপনি আমাকে। শোধ নিচ্ছেন। এতদিন আপনাকে ঘুরিয়েছি বলে এখন শোধ নিচ্ছেন।”
“কেঁদো না প্লিজ! আমি তোমাকে শক্ত দেখে অভ্যস্ত। তোমার চোখে বিরক্তি, রাগ, জেদ দেখে অভ্যস্ত। এভাবে কান্না দেখিয়ে দুর্বল করে দিয়ো না।”
অপু দুই হাতে শক্ত করে সুপ্তের পিঠ আঁকড়ে ধরে। বুক থেকে মাথা তুলে ভেজা গলায় বলে,
“আমার রাগ, জেদ, বিরক্তি সবের একমাত্র কারণ ছিলেন আপনি। আর এখন আমার কান্নার কারণও আপনিই হলেন।”
সুপ্ত ঢোক গিলে কণ্ঠের সিক্ততা গিলে নিল। বলল,
“এ আমার দুর্ভাগ্য। আমার জীবনের সবচেয়ে বড়ো ব্যর্থতা।”
“তবুও ফিরিয়ে দেবেন আমায়?”

সুপ্ত উত্তর দিলো না। আদুরে হাতে অপুর শাড়ির আঁচল তুলে সযত্নে ওর চোখের ছড়ে যাওয়া কাজল মুছে দেয়। ঠোঁটের লেপ্টে থাকা রঙ মুছে দেয়। অপুকে নিজের কাছ থেকে ছাড়িয়ে বলল,
“তুমি খুব ভালো মেয়ে, অপরাজিতা। তোমার নিজের বাবা-মা আছে। তোমার পারিবারে তুমি খুশি হয়ে জন্মেছ। সবার মাঝে বড়ো হয়েছো। আর আমি আসল বাবা-মা কে কোনোদিন দেখিইনি। যাদের বাবা-মা জানি তাদের জীবনেও এসেছি ভাঙন হয়ে। বড়ো হয়েছি ব্রোকেন ফ্যামিলিতে। তোমার ফ্যামিলি আমার হাতে তোমাকে তুলে দেবে না।”

অপু নিঃশ্বাস আটকে রইল সে কথা শুনে। সুপ্ত পায়ের দিকে তাকিয়ে আছে৷ লুকোতে চাইছে ভঙ্গুর দৃষ্টিজোড়া। রাস্তায় মাঝ দুপুরে মানুষের আনাগোনা নেই। দূর থেকে হুটহাট গাড়ি ছুটে এসে বাতাসের ঝাপটা দিয়ে চলে যাচ্ছে। সেদিকে অবশ্য ওদের কারো খেয়াল নেই। অপু আবারো সুপ্তের বুকের কাছটায় সরে এলো। যেখানে সে পেয়েছে শান্তির আবাস। বলল,
“আপনার অতীত আমার কাছে কোনো বিষয় নয়। অতীত আঁকড়ে কেন বর্তমানকে অসুখী করছেন আপনি? আমরা চাইলেই সুখী হতে পারব। আপনি শুধু আগের মতো হয়ে যান, সুপ্ত।”
“তোমার পরিবার মানবে না।”
“পালিয়ে যাব।”

সুপ্ত ঠোঁট বাঁকা করে হাসল। বলল,
“এসব চিন্তা তোমার ভালো মেয়েসুলভ মস্তিষ্কে কী করে এলো?”
“সঙ্গদোষে… আপনি আমাকে এলোমেলো করে দিয়েছেন।”
“মাথাটা ঠান্ডা করো। তুমি পারবে না। বাবাকে তুমি আমার চেয়েও বেশি ভালোবাসো। উনার মতের বাইরে তুমি যেতে পারবে না।”
“চেষ্টা না করেই হার মেনে নেব বলছেন? বাবা আমাকে ভালোবাসে। দেখবেন ঠিক মেনে নেবে।”

সুপ্ত এ নিয়ে কথা বাড়াল না। তপ্ত রোদে স্নান করে দুজনেই ঘেমে উঠেছে। সে বাইকে উঠে বলল,
“এসো।”
অপু চুপচাপ উঠে বসল। সুপ্ত বাইক স্টার্ট দিলে সে আলতো করে মাথা ঠেকাল তার পিঠে। চোখের জলে ভিজে গেল টিশার্ট। ভিজল সুপ্তের চোখ, অশ্রুস্নাত হলো উভয়ের বুকের ভেতরে সংরক্ষিত এক অভিন্ন প্রেমের রাজ্য।

বাইক গিয়ে থামল ফরিদ মিয়ার টংয়ের দোকানের সামনে। অপুর মাঝে আজ ভয় নেই। সে বাইক থেকে নেমেই গেল ফরিদ মিয়ার দোকানে। দুজনকে একসঙ্গে বাইকে দেখে ফরিদ মিয়া প্রায় লাফিয়ে উঠেছে। অপু চোখ মুছে নাক টেনে পার্স থেকে দশ টাকার নোট বের করে বলল,
“সেদিন আপনাকে ভুল বলেছিলাম, ফরিদ মিয়া। আপনি আমাকে আপা নয়, ভাবী বলে ডাকবেন। এই নিন আপনার চায়ের দাম। সময় পেলেই কিন্তু আপনার দোকানে চা খেতে আসব।”

ফরিদ মিয়া বিস্ময়ে বোবা হয়ে গেছে। জিভ নড়ছে না। আলতো করে মাথা কাত করে টাকাটা নিতে গিয়ে তারও কেন জানি চোখ ভিজে গেল। অপু বেরিয়ে গেল দোকান থেকে। সুপ্ত তখনো বাইকে বসে আছে। অপু তার কাছে গিয়ে বলল,
“সেদিন বলেছিলেন আপনার জীবনটা আঁধার আর আমি ফুল। আপনার অবগতির জন্য জানাই, ফুলেরা শুধু সূর্যের আলোতেই ফোটে না। কিছু ফুল রাতের আঁধারেও ফোটে। তাদের বিচরণ অন্ধকারের মাঝেই সীমাবদ্ধ। সূর্যের আলোয় ঝরে যায়। আমিও আপনার আঁধারের যামিনীপুষ্প হতে চাই। গ্রহণ করবেন না আমায়?”

সুপ্ত কোনো কথা বলতে পারল না। আলতো করে অপুর হাত আঁকড়ে ধরল।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here