ঘৃণা ভরা চোখে তাকিয়ে আছি আমার সাবেক স্বামীর দিকে যে কিনা এই মুহুর্তে আমার বিয়ে ভাঙতে বিয়ের আসরে এসেছে। বর পক্ষের সবাই হা হয়ে তাকিয়ে আছে আমাদের দুজনের দিকে। অবশ্য অবাক হবার আরেকটি অন্যতম বিষয় হচ্ছে বর পক্ষের কেউই অবগত ছিলো না আমার আগেও একটি বিয়ে হয়েছিলো। যদিও ওদের বলার উচিত ছিলো। কিন্তু আমার পরিবার তাদের এই বিষয়ে জানাতে চাইনি। এর জন্যও আবার অন্যতম আরেকটি কারন আছে, আর সেটি হচ্ছে বর পক্ষ নাকি বিরাট বড়লোক।
যেমন তারা প্রতি ভেকেশনে ইউরোপ কান্ট্রি গুলোতে বেড়াতে যায়। এক হাজার টাকার একটা নোট মাটিতে পড়লে তা তোলার তাদের সময় নেই। এতো বড়লোক পাত্র আমার মামা, মামি, মা হাত ছাড়া করতে চাইনা। সেই জন্যই ওদের আগে কিছু জানানো হয়নি। তবে আমি চেষ্টা করেছিলাম জানানোর কিন্তু সেই চেষ্টা কোন কাজে আসেনি। বিয়েও করতে চাইনি আর কখনো কিন্তু মায়ের মুখের দিকে তাকিয়ে আবার আমার নতুন করে বিয়ের পিরিতে বসতে হয়েছে। আমি উনাকে দেখিনি এর আগে, না দেখেই বিয়েতে হ্যা বলে দিয়েছিলাম। উনিও দেখা করেনি আমার সাথে বা সবার সাথে দেখতেও আসেনি। উনিও হয়তো না দেখেই ফেমিলির পছন্দে বিয়ে করতে এসেছিলো।
আমাদের সাইডের মেহমান আর বর পক্ষের সবাই আমাদের ঘিরে রেখেছে। ফ্রিতে তামাশা দেখতে কার না ভালো লাগে। তবে আমার মায়ের লজ্জায় যায় যায় অবস্থা। মামা তো থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। আমার চোখ জোড়া সেই চির অপরিচিত লোকের দিকে তাকিয়েই আছে বেহায়ার মতো, তবে ভালোবাসা নিয়ে না, ঘৃণা, এক আকাশ সমান ঘৃণা নিয়ে তাকিয়ে আছি আমি৷ রাদিল ( সাবেক স্বামী) আমার এক হাত আচমকা টেনে ধরে
‘ বিয়ে করে ফেলবি ভেবেছিলি আমায় না জানিয়ে তাই না? আবার ওই পার্টিরও কাউকে না জানিয়ে।
আমার শরীরের সর্বস্ব শক্তি দিয়ে তার হাতটা আমার হাত থেকে সরিয়ে নিলাম। আমার হাতে ধরাতে আমার কিছু কাজিন সামনে এগিয়ে আসে ওকে ধরতে। এসব ঝামেলা দেখে আমার হবু স্বামী এগিয়ে এসেছে আরো আগেই। উনাকে আমি আগে দেখিনি কিন্তু চিনতে অসুবিধে হয়নি খুব একটা। বিয়ের শেরওয়ানি পড়ে বর ছাড়া অন্য কেউ আসবে না বিয়েতে। এই সুঠাম চেহারা তাকে সবার থেকে আলাদা করে রেখেছে।
রাদিলের চোখে খুশির ঝলক। এমন ঝামেলা বাধিয়ে খুশি হবারই কথা। আমায় অপদস্ত হেয় করার কোন পথ সে ছাড়েনা। আজকেই বা কেন ছাড়বে। অথচ কে বলবে এই লোক কে আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছিলাম। আমরণ সাথে থাকার ওয়াদা করেছিলাম। আমার ভাবনার ব্যাঘাত ঘটিয়ে রাদিল আবার বলে উঠে,
‘ না জানিয়ে বিয়ে করে নিবি? বড়লোক মাল পেয়ে আর আমার কথা মনেই নেই? আমিও দেখি তুই কি ভাবে বিয়ে করিস। কে বিয়ে করবে তোকে এমন ডিভোর্সি জেনে?
আমার কান্নার বেগ বাড়ছে তার কথার সাথে। বমি পাচ্ছে কেন জানি। তীব্র রাগে মাথা ব্যথা উঠে গিয়েছে। আমি কিছু বলতে যাবো ঠিক তখনি আমার হবু স্বামী এগিয়ে যায় রাদিলের কাছে।
‘ কি সমস্যা আপনি কে?
রাদিল বিরক্ত ভংগী নিয়ে তাকিয়ে উনার দিকে
‘ ওহ এই তাহলে বর। তাহলে উনার মতো ছেলে ডিভোর্সি মেয়েকে বিয়ে করতে আসছে। এই ছেলের বাপ …..
আর কিছু বলতে পারলো না রাদিল তার আগেই কষিয়ে একটা থাপ্পড় মারে উনি৷ রাদিল থাপ্পড় খেয়ে পড়ে যায়। উঠে উনার শরীরে হাত দিতে যাবে তখনি আরেকটা ঘুসি মারে রাদিলকে। আমার হবু শশুর এতক্ষণ চুপ ছিলো। কিন্তু এমন অবস্থা দেখে আমার হবু শশুর সামনে এগিয়ে যায়৷ এই বিয়ে আদৌ হবে কিনা জানি না, আর আমি কিনা উনাকে হবু শশুর বলে সম্মোধন করে নিজেকে নিজে হাসির পাত্র বানাচ্ছি।
যাই হোক উনি সামনে এগিয়ে গিয়ে,
‘ দিবস কি করছিস ছেড়ে দে ওকে। আমি দেখছি তুই ছাড় ওকে।
উনি রাগে মাথা থেকে টুপি ফেলে দিয়ে
‘ না বাবা আজকে আমি ওকে মেরেই ফেলবো ও তোমাকে অপমান করতে চেয়েছিলো। জাস্ট ওয়েট দেখো আমি ওকে কি করি।
দিবস আরো মারার জন্য সামনে যেতে নিলেই ওর কিছু বন্ধু এসে ওকে ধরে ফেলে। একজন বলে
‘ দিবস কি করছিস! আজকে তোর বিয়ে এমন করিস না৷ শান্ত হয়ে বস। আমরা ওকে পুলিশেও দিতে পারবো তোর হাত নষ্ট করার কি দরকার।
হঠাৎ কয়েকজন লোক ভিতরে আসে। সবাই নুপুরের খুব পরিচিত। নুপুর ওদের দিকে ফিরে তাকালো না একবারের জন্যও। রাদিলের চাচা আর রাদিলের ছোট ভাই। ওরা এসে নুপুরের মামার কাছে ক্ষমা চেয়ে রাদিলকে নিয়ে যায়। নুপুর কান্নার জন্য কিছু বলতে পারছে না। নুপুরের মামা শাহিন সাহেব দিবসের বাবার কাছে গিয়ে
‘ বেয়াই সাহেব আম…
শাহিন সাহেব কিছু বলার আগেই দিবসের মা খালেদা আক্তার সামনে এগিয়ে এসে
‘ এই বিয়ে হবে না। আপনাদের স্পর্ধা দেখে আমি অবাক হচ্ছি আপনাদের সাহস কি ভাবে হলো এতো বড় কথা আমাদের থেকে লুকিয়ে আপনাদের বিয়ে দিতে। এমন মেয়েকে আমি ঘরের বউ করে ঘরে তুলবো আপনি ভাবলেন কি ভাবে?
শাহিন সাহেব নতজানু হয়ে
‘ বেয়াইন সাহেবা আমি বুঝিনি এই বেয়াদবটা এসে এমন করবে। ওর সঙ্গে আমাদের মেয়ের আর কোন সম্পর্ক নেই। ওদের অনেক আগেই বিচ্ছেদ হয়ে গেছে। আপনি প্লিজ দয়া করে এই বিয়েটা ভাঙবেন না।
দিবস রাগ নিয়ে
‘ কিন্তু আপনারা এতো বড় একটা বিষয় এভাবে লুকিয়ে রাখতে পারেন না। এই বিয়ে আর সম্ভব নয়।
দিবসের বাবা জীবন চৌধুরি আর চুপ থাকতে পারলো না। দিবসের কাছে গিয়ে তার কাধে হাত রেখে
‘ আমি জানতাম দিবস। আমি সবই জানতাম নুপুরের ব্যপারে, আর সব জেনেই আমি এই বিয়েতে মতামত দিয়েছি।
উপস্থিত সবাই এক কথায় চমকে উঠলো। তাদের কানাঘুষা নিমিষেই শেষ হয়ে গেলো। উনি জেনে শুনে এতো সুন্দর একটা ছেলের জন্য এমন ডিভোর্সি মেয়ে ঠিক করেছে ভেবে অবাক হচ্ছে। নুপুরও অনেক বড় একটা ধাক্কা খেল উনি সব জানে শুনে। কিন্তু উনি কি ভাবে সব জানে?
দিবস কিছুক্ষণ চুপ থেকে
‘ বাবা তুমি সব জেনেও?
দিবসের বাবা চোয়াল শক্ত করে
‘ হ্যা সব জেনেও। আর আমি জানি তুই আমার কথা ফেলবি না। আমার কথার অসম্মান হোক চাইবি না। আমার নুপুর মাকে পছন্দ হয়েছে।
খালেদা আক্তার স্বামীর কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে
‘ ছেলে তোমার কথা শুনে বলে তোমার বাধ্য বলে যা ইচ্ছে করবে নাকি। এই বিয়ে হবে না মানে হবে না। আমি আর কিচ্ছু শুনতে চাই না।
এই দিকে দিবসের বাবা জীবন চৌধুরি দিবসকে ওদের থেকে একটু দূরে নিয়ে কি যেন বুঝাচ্ছে। আর দিবস মাথা নিচু করে শুনে যাচ্ছে।
খালেদা আক্তার রাগে চিল্লাপাল্লা করছে ভীষণ।অবশ্য উনার রাগের জন্য যথেষ্ট কারণ আছে।
বর যাত্রী প্রায় রেডি হয়ে গিয়েছে চলে যাবার জন্য তখনি দিবস তার বাবার কাছ থেকে ফিরে আসতেই খালেদা আক্তার তাকে ধরে
‘ দিবস চল অনেক হয়েছে। এই বিয়ে হবে না আর এখানে এক মুহুর্তও অপেক্ষা করার দরকার নেই।
দিবস মায়ের দিকে একবার তাকিয়ে নুপুরের দিকে তাকায় তারপর আবার সবার দিকে তাকিয়ে
‘ এই বিয়েটা হবে মা। আমি এই বিয়েতে রাজি।
বাবার কথার অসম্মান আমি জীবন থাকতে হতে দিতে পারিনা।
খালেদা আক্তার মুখ ভার করে
‘ কি বলছিস তুই দিবস?
নুপুরের মা সামনে দিবসের কাছে এগিয়ে এসে
‘ বাবা আমি তোমার বাবার কাছে আগেই সব বলে দিয়েছিলাম। আমি ভাবিনি তোমার বাবা রাজি হবে এই কথা শুনে কিন্তু উনি উনার মত একটুও বদলায়নি এই কথা শুনে। আমার ভাই ভাবিও জানে না এই কথা আমি তোমার বাবাকে যে বলেছি। আর তোমার বাবা ই সবাইকে বলতে বারণ করেছে। আমার মেয়েটা ভীষণ ভালো বাবা। এই সব কিছুর পিছনে ওর কোন দোষ নেই।
নুপুর কান্না করছে। মায়ের কথায় তার অসহায়ত্ব ফুটে উঠছে স্পষ্ট। তার যুদ্ধের শুরু আবার হতে যাচ্ছে যার থেকে নুপুর পালিয়ে বেরিয়েছিলো এতদিন৷ এতো বড় মিথ্যা দিয়ে যে সম্পর্ক শুরু হতে যাচ্ছে সেই সম্পর্ক কি আজীবন টিকবে?
চলবে……..
#সে_জানে
#Part_1
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন। কেমন হয়েছে গল্প অবশ্যই জানাবেন৷