#সে_জানে
#Part_7
#Writer_Tahsina_Islam_Orsha
নুপুর দিবসের কাধ থেকে মাথা উঠিয়ে
‘ ভাবতে হবে কারণ সেদিন ডাক্তারের রিপোর্টে আসে আমি কখনো মা হতে পারবো না। বাবা মানে আপনার আব্বুও সে কথা জানে না।
নুপুরের কথাটা শুনে দিবসের মাথায় যেন বাজ পড়েছে। বসা থেকে চমকে উঠে দাঁড়িয়ে যায়। দিবস নিজেকে যথাসম্ভব ঠিক রেখে,
‘ মানে?
নুপুর মাথা নিচু করে
‘ হুম আমি কখনো মা হতে পারবো না। এই কথা শুনে রাদিলের মাথা ঘুরে গিয়েছিলো সেদিন। রাদিল কেমন যেন হয়ে যায় মুহুর্তে। এরপর থেকে রাদিলের ফ্যামিলির সবাই আমার সাথে খারাপ আচরণ করতে শুরু করে। রাদিল মাঝে মধ্যেই আমার উপর হাত তুলতো, গালিগালাজ করতো। তারপর একদিন জানতে পারি রাদিল তার চাচাতো বোনের সাথে সম্পর্কে জড়িয়েছে। হয়তো আগে থেকেই ছিলো কিন্তু আমি জানতাম না, কিন্তু একদিন ওদের এক সাথে দেখে ফেলি। তারপর রাদিলই বলে, ও আর আমাকে রাখতে চায় না। আমার সাথে থাকতে চায়না। আমাদের বিয়েতে ওর যে চাচা এসেছিলো রাদিলেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ওই চাচার মেয়ে-ই। আমি যখন রাদিলকে বলতে শুরু করি আমি ওকে ছাড়া বাঁচবো না। ও আরেকটা বিয়ে করলেও যেন আমায় ওর কাছে রাখে, ওই দিন রাদিলের ওই চাচা এসে আমার গায়ে হাত তুলে। রাদিল সেদিন চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলো৷
নুপুর আর কিছু বলতে পারলো না তার আগেই রক্তিম চোখ নিয়ে হনহন করে বেরিয়ে যায় দিবস। পাহাড় সমান রাগ নিয়ে বেরিয়ে গেছে দিবস তা নুপুরের বুঝতে বাকি নেই। কিন্তু রাগ করার যৌক্তিকতা কতটুকু বুঝতে পারছে না। রাগ হওয়াটাও অস্বাভাবিক কিছু নয়। সে কখনো মা হতে পারবে না, আর এতো বড় সত্যটা লুকানোও অনেক বড় অপরাধ। তাই খুব বেশি দেরি হবার আগেই নুপুর সবটুকু জানিয়েছে দিবসকে।
মিথ্যে যতই শ্রুতিমধুর লাগুক না কেনো মিথ্যা মিথ্যেই হয়। তাই সত্য কষ্ট হলেও বলা আবশ্যক।
ঘড়ির কাটাতে ১টা বেজে ২৫ মিনিট। নুপুর
ঘড়ির দিকেই তাকিয়ে বসে আছে। তার চোখে ঘুম আজ বিলুপ্ত। ঘুম আসার কোন কারণও নেই। নিজের জীবনের সাথে জড়িয়ে আরেকটা জীবন সে নষ্ট করে দিয়েছে। এমন একটা মানুষকে নুপুর না চাইতেও এতো বড় আঘাত করে দিয়েছে। দিবস এখনো আসেনি। সারারাত আসবে কিনা তাও অজানা।
নুপুরের হঠাৎ চোখ লেগে যায়। দিবস আস্তে করে দরজা খুলে রুমে প্রবেশ করে দেখে নুপুর চেয়ারে হেলান দিয়ে বসেই ঘুমিয়ে আছে। অগ্রহায়ণ মাস চলছে শীত ভালোই পড়েছে। এই শীতে নুপুর এইভাবে বসে ঘুমিয়ে গিয়েছে। দিবসের ভালো লাগলো না। দিবস আস্তে করে নুপুরের কাছে গিয়ে ফ্লোরে হাটু গেড়ে বসে। নুপুরের চুল গুলো কপাল ছুঁয়ে পড়ে আছে নিচে। শরীরের চাদরও এলোমেলো হয়ে আছে। দিবস নুপুরকে ডাকবে ভেবে হাত বাড়ায় পরক্ষণেই নুপুরের ঘুম ভাঙাতে ইচ্ছে হলো না দিবসের। নুপুরের কাছ থেকে উঠে যায় দিবস। পা টিপেটিপে টেবিলের কাছে গিয়ে হাত থেকে ঘড়ি খুলে টেবিলে রাখতেই মৃদু শব্দে ঘুম ভেঙে যায় নুপুরের। লাফ দিয়ে চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে দেখে দিবস। নুপুরের চোখে পানি জমে গিয়েছে দিবসকে দেখে। ভাবনায় কৃপণতা করে বেপরোয়া হয়ে জড়িয়ে ধরে দিবসকে। কিছু ভাবতে যেন ইচ্ছে নেই তার। দিবস নুপুরের কার্যক্রমে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে৷ হঠাৎ নুপুর ফুপিয়ে কান্না করে উঠে। নুপুরের কান্নার আওয়াজে দিবস হতবিহ্বল হয়ে,
‘ এই মেয়ে কান্না করছো কেন?
নুপুর দিবসের বুকেই মুখ গুজে
‘ আপনি তখন চলে গেলেন কেন এইভাবে?
দিবস নুপুরের মাথায় হাত রেখে
‘ রাগ সামলানোর জন্য। আমি চাইনি তোমায় এমন কিছু বলে দেই যাতে করে কষ্ট পাও। তাই বের হয়ে গিয়েছিলাম। আমার ভীষণ রাগ হলে এমনি করি। বেরিয়ে যায় বাড়ি থেকে রাস্তায় হাটাচলা করি, নয়তো কোথাও গিয়ে বসে থাকি।
নুপুরের হুশ ফিরে, হঠাৎ করে দিবসের বুক থেকে কয়েক হাত দূরে চলে যায়। দিবসও কিছু না বলে চুপ করে বসে যায় বিছানায়।
নুপুর কিছুক্ষণ নিরব থেকে
‘ রাগ হওয়াটা স্বাভাবিক। আপনাকে এতো বড় সত্য কথাটা জানানো হয়নি। সব ছেলেই বাবা হয়ে চায়।
দিবস উঠে দাঁড়িয়ে
‘ তবে কি সব মেয়ে মা হতে চায় না? সব মেয়ে মা ডাক শুনতে চায়না? প্রতিটি ছেলে মেয়েই চায় একদিন তারা বাবা মা হবে। যদি একটা মেয়ে কখনো মা হতে না পারে এতে মেয়েটার দোষটা কোথায়? এর জন্য কেনই বা ভালোবাসার মানুষটাকে ডিভোর্স দিতে হবে! ভালোবাসা কি এতটাই সস্তা নুপুর? স্বামীর থেকে তো স্ত্রীর কষ্টটা বেশি হয় যখন সে শুনে সে কখনো মা হতে পারবে না। তাহলে স্বামীর কষ্টটা কেন বড় করে দেখা হয় আমাদের সমাজে? আজীবন ভালোবেসে পাশে থাকার নামই বন্ধন। এই সামান্যতম কারণে এই পবিত্র বন্ধন নষ্ট হবার কথা নয়।
আর আধুনিক যুগ এটা। আজকাল অনেক উপায়ই আছে বাবা হবার। সে তোমাকে কখনো ভালোই বাসেনি নুপুর। মিছেমিছি তার নাম ভালোবাসা দিয়ে ভালোবাসার অপমান করো না।
নুপুর দিবসের কথা গুলো শুনে আরো বেশি কান্না করছে। তার কান্নার গতিবেগ যেন ফিজিক্সের সূত্রের সময়ের প্রতিযোগিতাকে হার মানাবে। নুপুর ভাঙা ভাঙা কন্ঠে
‘ তাহলে আপনি ওই ভাবে চলে গিয়েছিলেন কেন?
দিবস নুপুরের হাত ধরে বিছানায় বসিয়ে নিজেও বসে
‘ কারণ আমার রাগ উঠেছিলো তোমার উপর। এই জন্য না যে তুমি মা হতে পারবে না কখনো। বরং এই জন্য এতো কিছুর পরও তুমি ওই বাস্টার্ডটার সাথে থাকতে চেয়েছিলে, আর ওর চাচা তোমার গায়ে হাত তুলেছিল। ভাবতেই আমার মস্তিষ্কে আগুন লেগে যাচ্ছে। আত্নসম্মানের থেকে ভালোবাসা সব সময় বড় করে দেখা উচিত নয় নুপুর। সবাই ভালোবাসার জন্য বাঁচেনা। অনেক মানুষ আছে যারা ভালোবাসা বাদ দিয়ে আত্নসম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। আত্নসম্মানের জন্য বাঁচে।
আমি যেই মেয়েটাকে ভালোবাসতাম। সে যখন অন্য কাউকে বিয়ে করতে চায় আমি নিজের আত্নসম্মান বিসর্জন দিয়ে তাকে আমার হতে বলেছিলাম। কিন্তু ভুলে গিয়েছিলাম ভালোবাসা সবার জন্য না। সবাই ভালোবাসার মানে বুঝতে পারেনা। তাই তাদের সামনে আত্নসমান বিসর্জন দিয়ে কোন লাভ নেই। সরে যায় তার থেকে। আর তখনি ভালোবাসা শব্দ থেকেই আস্থা উঠে যায় আমার।
নুপুর চুপ করে শুনছে দিবসের কথা। কি মুগ্ধতা সেই ঠোঁঠে। যা বলছে তার সবই যেন সত্যি। দু’জন মানুষই বিপরিতধর্মী। নুপুর যে জিনিসটা জটিল করে দেখছে, ঠিক সেই জিনিসটা তিনি সহজ করে করে তোলছে। এতো ভালো কেন দিবস! এতো ভালো মানুষের কাছে থেকে কি তাকে ভালো না বেসে থাকা যাবে!
নুপুরের চাহনি দেখে দিবস হো হো করে হেসে উঠে। দিবসের হাসিতে নুপুর ভাবান্তর ঘটে। লজ্জা পেয়ে যায় মুহুর্তে। দিবস উঠে দাঁড়িয়ে
‘ ৩টা বেজে গিয়েছে। শুয়ে পড়, আমি ফ্রেশ হয়ে আসছি।
দিবস ফ্রেশ হতে চলে যায়। নুপুর উঠে জানালার পাশে যায় একটু খোলা বাতাসের জন্য। আজকে কেন যেন ভালো লাগছে ভীষণ। নিজেকে সামান্য লাগছে না আজ। কোন চাপা কষ্ট কাজ করছে না ভিতরে। আজ যেন সে মুক্ত। পাখির মতোই মুক্ত।
দিবস ফ্রেশ হয়ে এসে দেখে নুপুর বিছানার মাঝে বালিশ রাখছে। বালিশ গুলোকে আচ্ছামত ধোলাই করছে মনে হচ্ছে। দিবস মুখ মুছতে মুছতে
‘ কি ব্যপার মাঝখানে কি ইন্ডিয়া পাকিস্তানের বর্ডার তুলছো নাকি?
নুপুর চোখ বুঝে মুখ টিপে
‘ আসলে রাতে আমি অনেক নড়াচড়া করি তো কোথায় থেকে কোথায় চলে যায় তার ঠিক নেই। তাই আপনার সেফটির জন্য এটা বানালাম।
দিবস ভ্রু কুঁচকে
‘ বাহ আমার সেফটি!!
নুপুরের কথা শোনে দিবসের হাসি যেন থামছেই না। আজকে হেসে হেসে সে শহীদ হয়ে যাবে তবু হাসি থামাবে না এমনটাই ভাবছে নুপুর। নুপুর কথা না বাড়িয়ে কম্বল দিয়ে পা থেকে মাথা অব্দি ঢেকে শুয়ে পড়ে। দিবস কিছুক্ষণ একা একা হেসে সে………
চলবে……..
ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।