সোহাগী পর্ব -০৪+৫

#সোহাগী
#পর্ব: ৪
Lutful Mehijabin (লেখা)

রাশেদের কথাগুলো মনোযোগ সহকারে কর্ণপাত করলো সোহাগী। রাশেদ সেই কখন থেকে তার মুখের সামনে খাবারের লোকমা ধরে রেখেছে। কিন্তু সোহাগী তার ডাগর ডাগর চোখ দিয়ে বাবার মুখে দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছে। মেয়েটা কে ভাব বিলাসী দেখে মুচকি হাসলেন রাশেদ। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে আকস্মিক রাশেদ স্বল্প উচ্চ স্বরে বলে উঠলেন,

— তা আম্মাজান হা করবেন না? আমার হাতে ব্যাথা করছে তো।

বাবার কথার প্রেক্ষিতে সোহাগী বাস্তবে ফিরে এলো।‌ তৎক্ষণাৎ হা করে ভাত আর আলু ঝোলের দলা মুখে পুড়ে নিলো। ভাত না চিবিয়ে দ্রুত গিলে ফেললো। অতঃপর ঠোঁট জোড়া সংকুচিত করে মলিন কন্ঠে বলে উঠলো,

— আব্বা তাহলে আম্মা আমাকে পড়াতে চাই না কেন? আমি তো পড়তে চাই।

রাশেদ আরেক লোকমা ভাত সোহাগীর মুখের সামনে ধরলেন। ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা স্পষ্ট রেখে বললেন,

— তোর আম্মা তো গ্রামের সহজ সরল মহিলা।‌ সে মনে করে মেয়েদের যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিয়ে মুক্তি পাওয়া যায়। সে যদি শিক্ষার মূল্য বুঝতো তাহলে কোনোদিনই তোকে বিয়ে দেওয়ার স্বপ্ন দেখতো না।‌

— আমার যে ভয় হয় আব্বা, আম্মা যদি আমাকে বিয়ে দিয়ে দেয়? কিন্তু বিশ্বাস করো আমি না পড়ালেখা ছেড়ে বেঁচে থাকতে পারবো। বইগুলোর দিকে তাকালে আমার কষ্ট দূর হয়ে যায়। কিন্তু আম্মার অভিমান যে আমার সহ্য হয়। বুক ফেটে কান্না পাই। মনে হয় আমি বিয়ে করলে যদি আম্মা খুশি হতো, আমার সঙ্গে প্রাণ খুলে কথা বলতো, রাতের আঁধারে আমাকে জড়িয়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতো, সময়ের অসময়ের আমার মুখশ্রী চুমুতে ভরিয়ে দিতো, তার মিষ্টি আদর সে যদি আমার নামে উৎসর্গ করতো বিশ্বাস করো আমি তাহলে তাই করবো। কিন্তু নানী যে বলে বিয়ে করলে মেয়েদের বাপের বাড়ি ঠাঁই নাই। আমাকে নাকি পড়ালেখা ছেড়ে দিয়ে সংসার করতে হবে! ভয় হয় আব্বা, আমাকে তুমি বিয়ে দিবে না তো?

সোহাগীর বলা প্রত্যেকটা বাক্য রাশেদের বুকে ঝড় তুলে দিলো। আচ্ছা কেন সোহানা সোহাগী কে ভালোবাসে না? কেন একটু আদর করে বুকে আগলে রাখে না? এই ছোট্ট মেয়েটার কোমল পদ্ম ফুলের মতো হৃদয় কে কেন বারংবার আঘাতে ক্ষত বিক্ষত করে? রাশেদ মনে মনে নিজেকে প্রশ্নগুলো করে উত্তর খোঁজার প্রয়াস চালালেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য! যার দরুন রাশেদের বুকে চিরে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। জিহ্বা দ্বারা ঠোঁট ভিজিয়ে সোহাগীর কথার প্রত্যুত্তরে বলে উঠলেন,

— না রে মা তোকে আমি বিয়ে দেব না যতোদিন না তুই প্রাপ্ত বয়স্ক হবি। এখন বিয়ে দেওয়া অর্থই আমার স্বপ্ন বিসর্জন দেওয়া। তুই শুধু মনোযোগ সহকারে লেখাপড়া কর। আমার কষ্টের মূল্য দে। তোকে অনেক বড়ো হতে হবে অনেক বড়ো। তোর মায়ের তিক্ত ব্যবহার আশীর্বাদ ভেবে সবসময়ই আনন্দিত হবি। মনে রাখবি শিক্ষা অর্জন করতে হলে প্রতিটি মানুষকে নানান প্রতিকূলতার স্বীকার হতে হয়। পৃথিবীতে যতোগুলো সফল ব্যক্তিরা রয়েছে তাদের সম্বন্ধে খোঁজ খবর নিয়ে দেখ তারা ঘুটঘুটে আঁধার পাড়ি দিয়ে সফলতার শীর্ষে পৌঁছিয়েছে। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে অন্যায় অত্যাচার নিপীড়ন সহ্য করে দীর্ঘ পথ অতিক্রম করেছে। জীবনে কষ্ট ব্যতীত মানুষ উন্নতি লাভ করতে পারে না। কিন্তু সেই কষ্ট সহ্য করতে না পেরে পড়ালেখা ছেড়ে দেওয়া বোকামি বৈকি অন্য কিছু নয়। তুই ওসব বোকা মানুষের মতো কখনোই করবি না আশা করি। জীবনে হাজার বেদনার স্বীকার হস না কেন তোর এই অশিক্ষিত বাপের কথা মনে করে পড়া চালিয়ে যাবি। আমার শেষ ইচ্ছেটা পূরণ তোকে করতেই হবে মা। করতেই হবে। কথা দে।‌

রাশেদের কথাগুলো শুনে সোহাগীর চোখ জোড়া সজল হয়ে উঠলো। ভাঙা কন্ঠে বলে উঠলো,

— কথা দিলাম আব্বা হাজার বেদনার স্বীকার হলেও আমি পড়ালেখা চালিয়ে যাবো। জীবনে যতো বাঁধায় আসুক না কেন বেঁচে থাকলে অবশ্যই তোমার স্বপ্ন পূরণ করবো। শুধু একটা অনুরোধ আব্বা তুমি সবসময়ই আমার পাশে থাকবে তো?

মুহুর্তেই দু’টো দুর্বোধ্য রহস্য টপটপ করে রাশেদের গাল বেয়ে চৌকির উপর পড়লো। শুকনো ঢোক গিলেন রাশেদ। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,

— হ্যাঁ রে মা আমি সবসময়ই তোর পাশে থাকবো। কথা দিলাম। এখন যাই রে তুই পড়। বেশি রাত জাগার দরকার নেই। একবারে শেষ রাতে উঠে পড়তে বসবি।

বাক্য গুলো শেষ করে ভাতের খালি থালাটা নিয়ে উঠে দাঁড়ালেন রাশেদ। সোহাগীর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। আমেনা এখনো পানি নিয়ে আসেন নি। অতঃপর পা চালালেন বাইরে যাবার উদ্দেশ্যে।

— আব্বা তুমি খেয়েছ?

হঠাৎ মেয়ের প্রশ্ন শুনে থেমে গেলেন রাশেদ। পিছন ফিরে একপলক তাকিয়ে বললেন,

— না রে মা। এখনি খাবো।

রাশেদের উত্তর পেয়ে ক্ষুন্ন হলো সোহাগীর হৃদয়। তার বাবা সারাদিন অক্লান্ত পরিশ্রম করে নিজে না খেয়ে তাকে খাইয়ে দিলো! পৃথিবীর সকল বাবারা বোধহয় এমনই হন। সন্তানের মুখে খাবারের দানা তুলতে সাত সমুদ্র ও পাড়ি দিতে ভুলেন না। নিজে না খেয়ে সর্বদা সন্তানদের খাওয়ান। সোহাগী কিছু না বলে বইয়ের পাতায় ডুব দিলো। না তাকে যে করেই হোক বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। উচ্চতর শিক্ষা অর্জন করতে হবে। যতোদূর পড়লে তার বাবাকে কেউ ভ্যানচালক বলে অপমান করবে না ঠিক ততো দূর পর্যন্ত তাকে পড়তেই হবে।
___________________

সম্পুর্ণ ঘর জুড়ে অন্ধকার আচ্ছন্ন। চৌকিতে কাত হয়ে শুয়ে রয়েছেন রাশেদ। ঠিক তার বিপরীত মুখী হয়ে সোহানা শুয়ে। আজ ইচ্ছে করেই সোহানা তার সাত বছরের ছেলেকে আমেনা সঙ্গে অন্য ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন।‌ উদ্দেশ্যে তার একটা আর তা হলো সোহাগীর একটা ব্যবস্থা করা। তাই সোহানা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন ভালোবাসে রাশেদ কে বোঝাবে। যে করেই হোক বুঝিয়ে ছাড়বে। ঝি ঝি পোকার কন্ঠস্বর তাদের নিরবতা ভেঙ্গে চিৎকার চেঁচামেচি লিপ্ত হয়েছে।
শুধু তাদের কারো মুখে কোন কথা নেই। দু জন একে অপরের থেকে মুখ ঘুরিয়ে রেখেছে। ইদানিং রাশেদের শরীরটা বড্ড ক্লান্ত হয়ে যায়। একটু আয়েশ করে শুলে যেন এক রাজ্য তন্দ্রা এসে তার চোখের পাতায় ভর করে। যথারীতি আজও রাশেদের চোখ জোড়া লেগে এসেছে। কিন্তু পক্ষান্তরে সোহানা আঁকুপাঁকু করছেন রাশেদের সঙ্গে কথা বলার জন্য।
হঠাৎ নিরবতা ভেঙে সোহানা ফিসফিসিয়ে বলে উঠলেন,

— এই সোহার আব্বা, খুমাইছো?

রাশেদ সোহানার কন্ঠস্বর পেয়ে চোখ জোড়া উন্মুক্ত রাখার প্রয়াস চালালেন। ঘুমঘুম কন্ঠে বলে উঠেন,

— না , ঘুমাই নি। কিছু বলবে?

রাশেদের প্রশ্ন শুনে সোহানার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।‌ তিনি বিনা দ্বিধায় বলেন,

— জানো আইজ কি হুনছি রাহা ভাবির কাছ থাইকা?

প্রতিবেশী রাহা ভাবির সম্বন্ধে কথা শুনে খানিক বিরক্ত হলেন রাশেদ। অবশ্য নিজেকে সংযত রেখে বলেন,

— কি বলেছে?

সোহানা একটা শুকনো ঢোক গিলে ভীতি কন্ঠে বলে উঠলেন,

— ভাবির চাচতো বোনের মাইয়ারে চার দিন ধইরা খুঁইজা পাওয়া যাইতেছে না। মাইয়া নাকি সপ্তাহ খানিক আগে পাশের গ্রেরামের এক পোলার লগে কেলেংকারি ঘটাইছিল। মাইয়াডার বেশি বয়স না কইলাম, আমাগো সোহানা কয়েক মাসের বড়। ওই নাকি মেলা উড়নচণ্ডী মাইয়া ছিলো। এই গ্রেরামের থাইকা ওই গ্রেরামের হগলে ওরে চিনতো!

রাশেদ সোহানার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনলেন। খানিক টা চিন্তিত হলেন মেয়েটা জন্য। সোহানা ফির বলতে লাগলেন,

— আমার না সোহাগী জন্যে অনেক চিন্তা হয়। এখন ওর বয়সটা ভালা না। ওর এখনো ভালা মন্দ বোঝার বয়স হয় নাই। তাই কোন সময় কোন অন্যায় ঘটাই ফেলায় তা বলা যায় না। তুমি একটু ভাইবা দেহো গ্রেরামের অবস্থা ভালা না। যতো তাড়াতাড়ি মাইয়াডার বিয়া দিবার না পরুম ততোদিন আমি শান্তিতে ঘুমায়তে পারুম না। তুমি আমারে বোঝার চেষ্টা করো।

রাশেদ মুচকি হেসে আকস্মিক নিম্ন কন্ঠে বলেন,

— তুমিই তো বললে আমার মেয়ে ছোট মানুষ ভালো মন্দ বোঝার বয়স হয় নি। তাহলে এই বয়সে কীভাবে মেয়েটা সংসার করবে? আর তাছাড়া কতোবার বলছি তোমাকে, আমি সোহাকে পড়ালেখা করাতে চাই।

প্রথমে খানিকটা চমকে উঠেন সোহানা। তাকে যে করেই হোক ক্রোধ নিয়ন্ত্রন রাখতে হবে! বার দুয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলে সোহানা তপ্ত কন্ঠে বলে উঠেন,

— তোমাকে কে বললো যে বিয়া দিলে মাইয়ারে পড়াইবের পারবা না! সোহা তো আমার ও মাইয়া। আমিও চাই ও পড়ুক। কিন্তু তাই বলে অবিয়াত্তা অবস্থায় না। আমি এমন জামাই খুঁজুম যে ওরে বিয়ার পর পড়াবো। এখন ভাইবা দেখো, এতে মাইয়া দিয়া ভয় নাই।

কথাগুলো বলেই কিছুটা থামলেন সোহানা। অতঃপর পুনরায় বলতে আরম্ভ করেন।

— ওর লগে পড়ে একখান মাইয়া কয় দিন আগে কি অঘটন ঘটাইলো তোমার মনে নাই! অবিয়াত্ত অবস্থায় তিন মাসের পোয়াতে ছিলো। পরে তো বাচ্চার বাপ রে খুঁইজাই পাওয়া যায় নাই। আমার এসব মনে করলে আমার কলিজা কাঁইপা উঠে। তাই কইতেছি সময় থাকতে মাইয়ার বিয়া দেও। এডা তোমার শহর না। এডা গ্রেরাম। এইখানে মাইয়া ঘরেতে আটকে রাখা মুশকিল। আমাগো মতো গরিব মানুষের ঘরের কিশোরী মাইয়া ঘরে রাখা আতঙ্ক বৈকি অন্য কিছু নয়।

অবশেষে কথাগুলোর প্রেক্ষিতে সোহানার দিকে ফিরে শুলেন রাশেদ। তার বুকের ভেতর অজানা আতঙ্ক জেঁকে বসেছে। সোহানা কথাগুলো তো মিথ্যা বললে চলবে না। শহর আর গ্রাম মোটেও এক না। শহরের মানুষ গুলো হচ্ছে গোয়াল ঘরের বাঁধা গরু ন্যায় বন্দি আর গ্রামের মানুষগুলো হচ্ছে ক্ষেতে মধ্যে বাঁধন হীন গুরুর ন্যায় মুক্ত। মেয়েটার জন্য রাশেদের ভীষণ ভয় হচ্ছে। সোহানার কথার যে যুক্তি রয়েছে। সোহানার দিকে তাকিয়ে বার কয়েক দীর্ঘশ্বাস ফেলেন রাশেদ। সে তো মেয়ে কে কথা দিয়েছি ওকে পড়াবে। না এখন বিয়ে দিবে না মানে দিবেই না। অতঃপর নিজের সীদ্ধান্তে অটল থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। সোহানা কে উদ্দেশ্যে করে বলেন,

— মেয়েটা কে নিয়ে আমার ও চিন্তা হয় কিন্তু আমি ওকে এতো কম বয়সে কখনোই বিয়ে দিবো না। সবসময়ই আগলে রাখবো। তুমি চিন্তা করো না আমার মেয়ে ওইসব মেয়েদের মতো না।

চুপসে গেলেন সোহানা। দাঁতে দাঁত চেপে ফুঁসতে আরম্ভ করলেন।

________________

বারান্দায় বসে এক ধ্যানে আকাশ পানে তাকিয়ে রয়েছে জুবায়ের। রাত প্রায় গভীর হতে গভীরতর হচ্ছে ক্রমশ! এতো রাত হয়েছে তবুও তার চোখে ঘুমের ছিটে ফোঁটাও নেই। ভুঁইয়া বাড়ির থেকে প্রিয়া কে বেদনা উপহার দিয়ে, বিদায় জানিয়ে বাসায় এসেছে ঘন্টা চারেক পূর্বে। মেয়েটা তার নিদ্রা হারাম করে তুলেছে। কী বললো মেয়েটা তার বোন রিমা নাকি বেঁচে নেই! তাছাড়া প্রিয়া কেন বললো আজ ওদের শেষ দেখা? এরপর তাদের দেখা হবে কী সন্দেহ! আচ্ছা মেয়েটা হঠাৎ ওমন আচরণ করলো কেন? সবকিছু রহস্যময় ঠেকছে জুবায়ের নিকট! ভয় হচ্ছে মেয়েটাকে নিয়ে। সে প্রিয়ার আবেগ হতে পারে কিন্তু সে তো জানে প্রিয়া তার আবেগ নয়। প্রথম যেদিন সে ওই বাচ্চা মেয়েটা কে দেখেছিল সেদিন বুকের ভেতর দুমড়ে মুচড়ে উঠেছিল। একটা সময় মেয়েটার আচার ব্যবহার তাকে মুগ্ধ করে তুলেছে যার দরুন ধীরে ধীরে অনুভূতি এসে দলা পাকিয়েছে তার হৃদয় গহীনে। কিন্তু সে কখনো প্রাধান্য দেই নি। নিজেকে সর্বদা সংযত রেখেছে। কিন্তু আজ মেয়েটা এমন প্রস্তাব মোটেও প্রত্যাশা করে নি জুবায়ের। অস্থির লাগছে খুব! বাড়ি আসার পর থেকে তার মাথায় প্রচন্ড বেগে ব্যথা করছে। এসে কিছু খেতে পারি নি। তার মা সালেহা ছেলের এই পরিস্থিতি দেখে নিজেও ঘুমতে পারছে না। বারান্দায় বারবার এসে ঘুরে যাচ্ছেন।

ঝি পোকার চিৎকারে ভেসে আসছে জুবায়ের কর্ণকুহরে! কিন্তু ভাব বিলাসী হয়ে চৌকির উপর নতজানু হয়ে বসে রয়েছে। তার চোখ জোড়া সজল হয়ে উঠেছে ইতিমধ্যে! হঠাৎ কাঁধের উপর কারো হাতের স্পর্শ পেয়ে শুকনো ঢোক চেপে, চোখের জল তড়িঘড়ি মুছে নিলো জুবায়ের। সে এখন ভালো করেই জানে কে এসেছে তার কাছে। নিজেকে সংযত রেখে ভাঙা কন্ঠে বললো,

— এখানে আসছো কেন আম্মা? তোমাকে না বলেছি ঘুমিয়ে পড়তে। তোমার শরীর তো এমনিতেই ভালো না। যাও গিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো।

ছেলের উত্তর পেয়ে নিরাশ হলেন সালেহা। জুবায়েরের প্রত্যুত্তরে নরম গলায় বলে উঠলেন,

— কী হয়েছে বাজান? আমারে বল। তোর কষ্ট যে আমার সহ্য হইতেছে না। বুঝিস না কেন?

— না আম্মা কিছু হয় নি। তুমি অযথাই চিন্তা করেছো।

সালেহা ছলছল নয়নে জুবায়ের দিকে দৃষ্টিপাত ফেলেন। ছেলের চোখে জল! গোয়াল ঘর থেকে লাইটের আলো এসে জুবায়ের মুখের উপর পড়ছে। যার দরুন ছেলেটার পরিস্থিতি বুঝতে বাকি রইলো না। সালেহার ভেতরটা ধ্বক করে উঠলো। আচমকা শক্ত কন্ঠে বললো,

— তুই যদি আমারে না বলিস তাইলে আমার ম’রা মুখ দেখবি। ক কি হইছে?

জুবায়ের আর এক মুহূর্তও নষ্ট করলো না। দ্রুত মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। না, সে আর পারছে না, বুকের ভেতর পাথর চেপে বেড়াতে। হৃদয় চিরে ক্রন্দন বেরিয়ে আসছে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে একদমই পারছে না জুবায়ের। তাই নিজেকে সংযত রাখতে মায়ের কাছে ক্রন্দন রত কন্ঠে বলে উঠলো,

— মা গো, আমি যে বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার চেষ্টা করছি। আমি তো জানি, আমি কখনোই চাঁদ ধরতে পারবো না তাও অযথা কেন স্বপ্ন বুনছি, বলো না মা?
#সোহাগী
#পর্ব :৫
Lutful_Mehijabin

জুবায়ের আর এক মুহূর্তও নষ্ট করলো না। দ্রুত মায়ের কোলে মুখ গুঁজে শুয়ে পড়লো। সে আর পারছে না বুকের ভেতর পাথর চেপে বেড়াতে। নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে একদমই পারছে না। তাই নিজেকে সংযত রাখতে মায়ের কাছে ক্রন্দন রত কন্ঠে বলে উঠলো,

— মা গো আমি যে বামুন হয়ে চাঁদে হাত দেয়ার চেষ্টা করছি। আমি তো জানি আমি কখনোই চাঁদ ধরতে পারবো না তাও অযথা কেন স্বপ্ন বুনছি, বলো না মা?

জুবায়েরের কথা শুনে সালেহার বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠে। শুকনো ঢোক গিলেন তিনি। আনমনে ছেলের মাথায় হাতড়িয়ে দিতে লাগলেন। কাঁপা কাঁপা গলায় বলেন,

— তুই কোন চাঁদে হাত দেবার চেষ্টা করছিস?

সালেহার প্রত্যুত্তরে জুবায়ের শক্ত কন্ঠে ঝটপট বললো,

— ভুঁইয়া বাড়ির ছোট মেয়ে, ওই চাঁদ যে জোছনা রাতে আকাশের বুকে ঝুলে থাকা চাঁদের চেয়েও অধিক আকর্ষণীয়। আমি যে কঠিন ভাবে ওর প্রতি দুর্বল হয়ে পড়েছি।

ছেলের কথার প্রেক্ষিতে সালেহা কিছু বলার ভাষা খুঁজে পেলেন না। জুবায়েরের চুলের ভেতর তার হাত স্থির হয়ে এসেছে। বুকের ভেতরটা ঝড় রাত্রির উত্তাল উদ্যম সমুদ্রের ন্যায় অশান্ত হয়ে উঠেছে। সত্যিই তার ছেলে যে বামুন হয়ে চাঁদ ধরার প্রয়াস চালাচ্ছে! জুবায়ের তার চোখ জোড়া বন্ধ করে ফির বলে উঠলো,

— জানো মা চাঁদটা আজ আমার মতো ল্যাংড়া, কালো ছেলের জন্য চোখের জল বিসর্জন দিয়েছে, নিজের সৌন্দর্য কে কম বলে গন্য করেছে। আমার কে খোলসা করে বলেছে তাকে যেন আমি নিজের সঙ্গে বেঁধে রাখি। সে যে এই বামুনের সঙ্গে সারাজীবন ঘর সংসার করার স্বপ্ন বুনছে!

কথাগুলো শুনে সালেহা অবাক চরমে পৌঁছে গেলেন। কাপড়ের আঁচল দাঁত দ্বারা চেপে ধরলেন। বিষ্ময়কর চোখে ছেলের মুখে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন! অতঃপর নিম্ন স্বরে বলেন,

— কী বলিস রে বাজান! আমার বিশ্বাস হইতেছে না। ভুঁইয়া বাড়ির মাইয়া আমার ছাওয়ালের লগে সারাজীবন পার করতে চাই? আমার এই পাখির বাসায় সংসার পাততে চাই?

সালেহার কথার প্রত্যুত্তরে জুবায়ের ছোট করে উত্তর দিলো,

— হু।

সালেহা কিছুক্ষণ ছেলের মুখে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। ছেলেটার চোখের কোণে দুর্বোধ্য রহস্য এসে পাড়ি জমিয়েছে। তা মোটেও সহ্য করতে পারছেন না সালেহা। জমিদার বাড়ির মেয়ে থেকে এমন প্রস্তাব তার নিকট বিষ্ময়কর! তাদের মতো ছোট ঘরে নিশ্চয়ই জমিদার তার মেয়েকে দিবেন না! তার চেয়ে বড় কথা তাদের মতো নিচু জাতের মানুষের স্বপ্নেও জমিদার বাড়ির মেয়ের দিকে চোখ দেওয়া পাপ। বর্তমানে নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে সালেহার। তার ছেলে যে ওই চাঁদের প্রতি ভীষণ দুর্বল! এমন পরিস্থিতিতে নিজেকে অসহায় মনে করা বেশ স্বভাবিক। সালেহা নিজেকে ধাতস্থ রাখলো। শক্ত কন্ঠে বলে উঠলো,

— তুমি কি চাও জুবায়ের? চাঁদ টা নিজের করে নিতে নাকি চাঁদের জীবন থেকে চিরতরে বিচ্ছেদ নিতে?

নিমিষেই জুবায়েরের হৃদয়মনে অদ্ভুত প্রশান্তি বয়ে গেলো। সাহসের জোয়ার বইছে বুকের ভেতর। তৎক্ষণাৎ মায়ের কোল থেকে উঠে পড়লো জুবায়ের। ব্যথাতুর মুচকি হাসির সহিত বললো,

— যা চাই তা কী সম্ভব মা? কিন্তু আমি যে তিলে তিলে শেষ হতে চাই না।

জুবায়ের বলা বাক্যটা শুনে সালেহা ক্রন্দন রত কন্ঠে বলেন,

— তুই আমাকে ওই মেয়েটার কথা আগে কেন বললি না? তুই এমন মনমরা হয়ে থাকিস না বাজান। তুই যদি চাস তাইলে আমি যাব তোর কাকীরে নিয়া ভুঁইয়া বাড়িতে। তোর চাঁদ যেহেতু স্বয়ং রাজি তাইলে কোন চিন্তার বিষয় নাই। আমি যাব ওই বাড়ি বিয়ের প্রস্তাব নিয়া। তোর মতো শিক্ষিত ছেলে কে ভুঁইয়া ফিরাইতে পারবো না আমার মনে হয়।

মুহুর্তেই পুলকিত হৃদয় নিয়ে সালেহাকে জড়িয়ে ধরলো জুবায়ের। সালেহার কাঁধে মাথা এলিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে উঠলো,

— মা, আমার চাঁদ যে অনেক ছোট। এ বয়সে সংসার করবে কি করে!

জুবায়ের মা ছেলের কথা প্রেক্ষিতে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন। মুহূর্তেই তার চোখ বেয়ে দু ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়লো। মুচকি হেসে তিনি বলে উঠেন,

— ওই নিয়ে চিন্তা করতে হইবো না তোকে। তোরা শুধু সুখী থাক এই প্রার্থনা করি খোদার দোয়ারে। আপাতত তোদের আকাদ সাইরা রাখুম। তারপর বউ মা যখন একটু বড় হইবো তখন ওরে ঘরে তুইলা আনবো।

জুবায়ের মায়ের কাঁধে মাথা রেখে শান্ত কন্ঠে বললো,

— মা গো, আমার যে মনে হচ্ছে তারা আমাদের ফিরিয়ে দিবে।

সালেহা উত্তেজিত হয়ে বলেন,

— কেন?

— কারন তুমিই বলো মা কোন বাবা মা চাই তার সুস্থ স্বাভাবিক মেয়ে কে পা ভাঙা প্রতিবন্ধী মানুষের সঙ্গে বিয়ে দিতে? আমাদের মতো গরীব ঘরে মেয়ে কে তুলে দিতে কোন বাবা রাজি হবে! তাছাড়া চাঁদ যে আমাদের এই পরিবেশের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারবে না। খুবই কষ্ট হবে তার। মা গো আমার না ভীষণ ভয় হচ্ছে? বলো না মা, আমি পাবো তো আমার চাঁদ টা কে? কেন মা, সৃষ্টিকর্তা কেন বামুন হয়ে চাঁদ ধরার স্বপ্ন পুষে দিলো আমার বুকের ভেতর!

নিমিষেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করেন সালেহা। জুবায়েরের পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলেন। অতঃপর কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দিলেন,

— সৃষ্টিকর্তা যা করেন তা আমাদের মঙ্গলের জন্যই করেন। তুই আল্লাহ উপর ভরসা রাখ। কিছু হইবো না। ভুঁইয়া বাড়ির হগলে অনেক ভালো মনের মানুষ। তারা নিশ্চয়ই বুয়েটের পড়া একজন ছাত্রের চেহারা না দেখে যোগ্যতা আর চরিত্রে টা দেখবেন। আর আমার ছাওয়াল যে যোগ্যতা এবং স্বচ্ছ চরিত্রের অধিকারী তা আমার আর মুখ ফুইটা বলা লাগবো না!
____________________________

রাত পেরিয়ে দিনের আলোয় আলোকিত হয়ে উঠছে চারপাশ। মাথার উপর স্কুল ব্যাগ নিয়ে বাড়ির পথে পা চালিয়ে যাচ্ছে সোহাগী। স্কুল ছুটি দিয়েছে কিৎক্ষণ পূর্বে। গরমে হাঁফিয়ে উঠেছে সে। সূর্যের তীর্যক কিরণ সোহাগীর গা উত্তপ্ত করে তুলেছে। যার দরুন বড্ড দ্রুত পদে হাঁটছে সে। রাশেদ আর তামিম তার পিছু পিছু হাঁটছে। কিন্তু ইচ্ছে করেই তাদের অবহেলা করে যাচ্ছে সোহাগী। আজ স্কুলে ও কথা বলে নি তাদের সঙ্গে। সারাদিন বিষন্ন হয়ে বসে ছিলো মেয়েটা। তার চোখ মুখ যে ফুলে গিয়েছে তা তার বন্ধুদের চোখের আড়াল হয় নি। তাই সোহাগীর মন ভালো করতে কেন মেয়েটা উদাসীন হয়ে রয়েছে তা জানতে তার পিছু নিয়েছে রাশেদ এবং তামিম।

— কীরে সোহা কথা কইতেছিস না কেন? আজ তোর কি হইলো রে!

রাশেদ কথা শুনে একবার আড় চোখে পিছু তাকালো সোহাগী। তামিম আর রাশেদ তার পিছু নিয়েছে! সোহাগী জবাব দেওয়ার পূর্বে তামিম বললো,

— ওই ছেমড়ি ঢং করতেছিস কেন? আমারা কী করছি? কাল কে তোরে নিয়া নদীর পাড়ে যাই নি দেইখা কি রাগছাস? রাগিস না সোহা। চল আজকে যাই।

তামিমের কথাগুলো সোহাগীর কর্ণকুহরে পৌঁছানো মাত্রই ছুটে দৌড় দিলো সোহাগী। দু হাত দিয়ে চোখের জল মুছতে লাগলো। দৌড়ে বাড়িতে যাওয়ার পথে বললো,

— তোরা আমার পিছে আসবি না বললাম। আমি তোদের উপর রাগ করি নি। তোরা আমাকে বিরক্ত করবি না প্লিজ।

সোহাগীর কথার প্রেক্ষিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে পড়লো রাশেদ এবং তামিম। তারা দুজনে বাকরুদ্ধ! সোহাগীর এমন আচরণ মোটেও প্রত্যাশা করে নি ।

—

বাড়ির কাছে পৌঁছাতেই সোহাগীর বুকের ভেতর ধ্বক করে উঠলো। তার বিন্দু পরিমান ইচ্ছে নেই বাড়িতে প্রবেশ করার। কিন্তু তাও বাধ্য হয়ে পা বাড়ালো। ভেতর প্রবেশ করতেই চমকে উঠে সোহাগী। তাদের পুরো বাড়ি জুড়ে পোলাও এবং মুরগির মাংস কোষানোর সু ঘ্রাণে মম করছে! আজ কতোদিন পর এই সুমিষ্টি ঘ্রাণের সাথে পরিচিত হলো সে। বিষয়টা মোটেও সুবিধা জনক লাগলো না তার! শুকনো ঢোক গিললো। অতঃপর ব্যাগ কাধে নিয়ে কলপাড়ারের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো। মুহূর্তেই হুট করে কোথা থেকে যেন আমিনা এসে উপস্থিত হলেন। সোহাগীর কাধে থেকে ব্যাগ কেড়ে নিয়ে বললেন,

— যা তো সোনা, একবারে গোসল সাইরা আই। সাবান মাইখা গোসল করবি কইলাম। শরীরের কী অবস্থা করছিস দেখছাস একবার! বেশি করে মুখ ডলবি কিন্তু।

আমেনার কথা ভাব ভঙ্গি অপরিচিত লাগে সোহাগীর নিকট। কিছুই বুঝতে পারছে না সে। নিজেকে স্বাভাবিক রেখে স্বল্প আওয়াজে সোহাগী বললো,

— কেনো নানী?

আমেনা খুশী মনে প্রত্যুত্তর দিলেন,

— তোরে আজ নতুন শাড়ি দিয়া সাজামু তাই। এহন যা তো গোসলে যা।

অজানা শঙ্কায় কেঁপে উঠলো সোহাগী কাঁপা গলায় বললো,

— শাড়ি পড়াবো কেনো নানী?

— তোরে ভুঁইয়া বাড়ি থাইকা দেখবার আইবো আজ।

আমেনার কথা শেষ হতেই দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলো সোহাগী। আজ তার সঙ্গে কি হতে চলছে বিষয়টা ভালো করে অবগত আছে। ভীষণ অস্থির লাগছে সোহাগীর। না, কখনোই তার বাবা তাকে বিয়ে দিবে না। বাবাতো কাল রাতেই বলেছে তার মা হাজার চাপ প্রয়োগ করুক তবুও তাকে বিয়ে দিবে না। দেখতে আসছে তো কী হয়েছে! তার তো অনেক দূর পড়তে হবে। বাবার স্বপ্ন পূরণ করতে হবে। বাবার কথাগুলো তার কানে প্রতিধ্বনি তুলতে লাগলো। সোহাগী কাঁপা কন্ঠে আমেনাকে জিজ্ঞাসা করলো,

— আব্বা কোথায় নানী?

(চলবে)
(চলবে)

[