#সোহাগী
#পর্ব :১০
Lutful Mehijabin
— কোন সুখের কথা কইতেছিস তুই? মাইয়াডার জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুখ কাইড়া নিয়ে কোন সুখের কথা কস! মাইয়া গো জীবনের সবচেয়ে বড়ো সুখ হইতেছে নিজের পেটের বাচ্চা। বাচ্চা ছাড়া মাইয়া গো জীবন ভরাট হয় না। সুখ তো দূরে থাক ‘মা’ ডাক না শুনলে শান্তি ও থাকে না জীবনে। মাইয়ার আরেক রুপ হইতেছে মা। আর তুই ওর কাছ থাইকা এই সুখ কাইড়া নিলি?
আমেনার কথা শুনে এবার বেশ ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন সোহানা। দ্রুত তীক্ষ্ণ দৃষ্টিপাত ফেলেন আমেনার মুখপানে। রুঢ় কন্ঠে বলে উঠেন,
— কিরা বলছে আমি ওর সুখ কাইড়া নিতেছি? বিয়াডা আগে হইতে দেও তারপর দেইখো ওর খারাপ করলাম না ভালো। খালি কয়ডা দিন যাইতে দাও সংসার কেমনে করতে হয় ওরে আমি শিখাই দিমু। তুমি হুদাই বাচ্চা বাচ্চা কইরা শুধু শুধু পাগল হইতেছো।
আমেনা ম্লান মুখে সোহানার দিকে তাকিয়ে। ইতোমধ্যে ক্রোধের বশে তার ঘাড়ে চিনচিন ব্যথা করতে শুরু করছে। অস্থির লাগছে মেয়েটার চিন্তায়! যার ফলে ঘাড়ে হাত দিচ্ছেন বারংবার। সোহানা মায়ের পরিস্থিতি বোধগম্য করতে সক্ষম হলেন। হঠাৎ শোয়া থেকে উঠে বসলেন। আমনার দিকে তাকিয়ে মুচকি হেসে বলেন,
— দেখো আম্মা, তুমি চিন্তা কইরো না। সোহাও একদিন মা হইবো। আমি কথা দিতেছি ও নিজের বাচ্চার মা ডাক শুনবো। বিয়ের পর তোমার নাতিন যখন বোঝমান হইবো তখন জামাই বাবারে বুঝাইবো। ওর শাশুড়ি শর্ত দিছে তো কী হইছে! একসময় এর কোনো দাম থাকবো না। সোহার পেটে যদি বাচ্চা আহে তাইলে ওরা নিজেগো বংশধর ফেলাইবার পারবো না। ভুঁইয়া বাড়ির মানুষ হইলো দয়ালদার। গ্রামের সবার উপকার করে। তারা কখনোই নিজের বংশের বাতি নষ্ট করবার পারবো না। বুঝতেছাও?
সোহানার কথাগুলো মনোযোগ সহকারে শুনলেন আমেনা। কথাগুলো যুক্তি আছে বলে বলতে হবে! বিয়ের পর সোহাগী যদি একবার অন্তঃসত্ত্বা হয় তাহলে নিশ্চয়ই আমিরুলের পরিবার ফেলে দিতে পারবে না। এমনকি বাচ্চার পরিচয় দিতে অস্বীকার করবে না। এতোটাও নিচু মন মানসিকতার নয় তারা! মুহূর্তেই আমেনার ঘাড়ে ব্যথা উধাও হয়ে গেলো। তার ঠোঁটের কোণে ফুটে উঠে মৃদু হাসি। সত্যিই তার নাতি রাজরানী হবে।
— আগে ভাইবা দেখি নাই রে মা। এতক্ষণ মনের মধ্যে কেমন যানি খুঁত খুঁত করতেছিলো। কিন্তু এখন মনে হইতেছে তুই যা করতেছিস ঠিক করছিস। কিন্তু সোহার বাপ জানার পর কী হইবো ভাবছিস? ও যদি খাইপে তোরে সংসার থাইকা বাইর কইরা দেই?
সোহানা আমের কথা শুনে খিলখিল করে হেসে উঠেন। হাস্যরত অবস্থায় বলেন,
— ওসব নিয়ে ভেবো না। তোমার জামায়ের কলিজায় এতো সাহস নাই। আর একবার বিয়া হয়ে গেলে মাইনা নিতে বাধ্য। আমার শুধু চিন্তা একটাই।
আমেনা খানিকটা উত্তেজিত হয়ে বলেন,
— কী চিন্তা?
— তোমার নাতির বুঝলেই হইলো। সোহা যদি না চিরকাল বোকা থাকে তাইলে কচু ও হইবো না। নিজের জিনিস নিজের বুইঝা নিতে হইবো। বাচ্চার জন্য ওরে চালাক হইতে হইবো।
সোহানার প্রত্যুত্তরে আমেনা মনমরা হয়ে বলেন,
— হ হাছা কইছোস। আমি এখন যাই দেহি তোর মাইয়া কী করে! মুরগির ঝোল দিয়া পোলাও খাওয়ার আশাই যে মাইয়া নামাজ কামাই দিতো না। হে আজ পোলাও সামনে পাইয়া ও খাওয়াল না। সেই সকাল থাইকা না খাওয়া।
— আরে আম্মা এতো চিন্তা কইরো না যে শরীর বানাইছে ওই শরীরে দুই বেলা খাউন না দিলে কিছুই হইবো না। এখন ওর না খাইয়া থাকা উচিত। যে মোটা হইতেছে! ত্যাড়ামি কইরা ছুইটা বাড়াই গ্রেরাম ভইরা। বিয়া দিবার পাড়লে আমি বাঁচি। বিয়া হইলে সব ভুত বাইরায়আ যাইবো।
— তাই যেন হয় রে। আমি এহন উঠি। ঘরে যাই। শরীরডা ম্যচম্যাচ করতেছে।
আমেনা আর কোন কথা বললেন না। হ্যারিকেনের ঝাপসা আলোর পথ ধরে পা চালান সোহাগীর ঘরের উদ্দেশ্যে। যাওয়ার পূর্বে সোহানার ঘরের দরজায় খিল দিয়ে বলেন,
— তোর ছাওয়াল আইজ আমাগো ঘরে থাক। সোহাগীর মুনাই ওর ঘুম পাড়াই দিছে।
— আচ্ছা রাহো। দেইখো আবার খাটে মুইতে না দেয়। ছাওয়াল টা বড়ো হইছে কিন্তু এহনো রাইতের বেলা ঘুমের মাঝে মুতে।
সোহানা বাক্য গুলো শেষ করে কাঁথা মুড়ে শুয়ে পড়লেন। আমেনা বের হতে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। রাশেদ নেই ছেলে নেই ঘর জুড়ে তার রাজত্ব! মুচকি হেসে কিছু একটা বিরবির করে চোখ বন্ধ করে ফেললেন।
____________________
জানালার গ্রিল এর সাথে মাথা ঠেকিয়ে বসে রয়েছে সোহাগী। গ্রামের প্রায় মানুষ জানার সাথে ঘেঁষে চৌকি পাতেন। সোহাগীদের বাড়িতে ও ব্যতিক্রম নয়। সেই সকল থেকে একের পর এক ঘটনা তাকে বিমূঢ় করে তুলছে। চট্পটে মেয়েটা নিরব হয়ে সেই সন্ধ্যা থেকে জানালার পানে তাকিয়ে রয়েছে। নেই কোন ক্লান্তি, নেই কোন নিদ্রা। তার শুধু একটাই চিন্তা আব্বা কোথায়? আজ বড়ো একফালা চাঁদ উঠেছে ওই আকাশে! পূর্ণিমার রাত। চারপাশের গাছপালা, ঝোর ঝাঁপ গুলো আবছা দৃশ্যমান হচ্ছে। প্রকৃতি সেঁজে উঠেছে আপন মনে! এই রুপ তিক্ত বিষাদের চিন্তা হয়ে থাকবে চিরকাল সোহাগীর হৃদয় মনে। তার জীবনের এতো বড়ো সিদ্ধান্ত অথচ বাবা পাশে নেই!
স্বল্প ভরে দরজা ধাক্কা দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন আমেনা। সোহাগী এখনো একই ভাবে বসে রয়েছে। পরনে তার সেই শাড়ি! দরজার মৃদু আওয়াজ শুনেও সোহাগীর কোন সাড়া। সোহাগীর পায়ের নিচে এক কোণে গুটিশুটি মেরে শুয়ে রয়েছে তার ছোট ভাই। ছেলেটা গভীর ঘুমে মগ্ন। আমেনা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ধীর পদে সোহাগীর পাশে এসে দাঁড়ালেন। আস্তে করে হাত রাখলেন সোহাগীর পিঠের উপর।
— কী হইছে সোনা? মন খারাপ করিস না। সব ঠিক হইয়া যাইবো।
আমেনার কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালো সোহাগীর। তার চোখের কোণে অশ্রু চিকচিক করছে। বুকটা ভারি হয়ে আসে। নানির এই শান্তনা বানী মধুর সুর তার হৃদয় হাল্কা করলো। ভেঙে পড়লো সোহাগী। জমে থাকা বেদনা কান্না হয়ে বেরিয়ে এলো বাগযন্ত্র বেরিয়ে এলো। তৎক্ষণাৎ আমেনা কে জড়িয়ে হাউমাউ করে কেঁদে ফেললো সোহাগী। কান্নারত কন্ঠে বলে উঠলো,
— নানী গো আমার আব্বা কোথায়? আমার আব্বা কোথায়? আমি এই বিয়ে করবো না নানী। তুমি মাকে বোঝাও।
আচমকা সোহাগীর আক্রমনে আমেনা ভরকে গেলেন। কি বলবে তিনি? কী উত্তর দিয়ে মেয়েটা কে শান্তনা দিবেন তা ভেবে পেলেন না। নিশ্চুপ থেকে হাত দিয়ে আগলে ধরলেন সোহাগী কে।
__________________
রাতের আঁধার কেটে চারপাশ আলোকিত হয়ে উঠছে। সূর্যি মামা মুখ তুলে চেয়েছেন খানিকক্ষণ আগে। আজ যেন প্রকৃতি মনমরা হয়ে রয়েছে। বাতাস থমকে রয়েছে। আকাশে স্বল্প কালো মেঘ। সব মিলিয়ে মনে হচ্ছে সূযি মামার বুঝি মারাত্মক মন খারাপ!
কোমরে আঁচল গুঁজে সাত সকালে কাজে লেগে পড়েছেন সোহানা। আজ বাদে কাল মেয়েটার বিয়ে ঘরবাড়ি পরিস্কার তো করতেই হবে। দু এক জন আত্মীয় স্বজন সকাল সকল চলে আসবে। তাছাড়া গ্রামের প্রায় সবাই জেনে গিয়েছে এ সম্বন্ধে। ভুঁইয়া বাড়ির ছেলের বিয়ের বলে কথা!
আমেনা সকালে উঠে উনুন চা ধরিয়েছেন। সারা রাত সোহাগীর কান্নাকাটি তার আর ভালো লাগছে না। মাথা ব্যাথা চটে বসেছে। সোহানা রান্না ঘরের সামনে ঝুঁকে ঝাঁরু দিচ্ছেন এবং মুচকি মুচকি হেসে চলছেন। এমন সময় হঠাৎ টিনের গেইট দিয়ে কেউ প্রবেশ করলো। সোহানা মুখ তুলে তাকলো। রফিক এবং তামিম এসেছে ব্যাগ কাধে ঝুলিয়ে। মুহূর্তেই বিরক্ত ছেয়ে গেলো সোহানার মুখে।
রফিক সোহার মায়ের মুখ দেখে শুকনো ঢোক গিললো। এই সাত সকালে তার উপস্থিতি মোটেও পছন্দ করেন নি।
— কাকি মা সোহাগী কোথায়? ওরে একটু ডাইকা দিবেন।
রফিকের কথা শুনে বিরক্ত মাখা কন্ঠে সোহানা উত্তর দিলেন,
— ওরে ডাকা যাইবো না। তোরা যা এখান থাইকা। কাল ওর বিয়া। তখন আসিস কইডা খাইয়া যাইছ।
সোহাগীর বিয়ের কথা শুনে চমকে উঠলো রফিক এবং তামিম। বাকরুদ্ধ হয়ে থাকলো মিনিট কয়েক। অতঃপর তামিম বললো,
— কাকি একবার সোহারে একটু ডাইকা দাও না।
তামিমের কথা শুনে সোহানা এবার তেতে উঠেলেন। চিৎকার করে বললেন,
— তোরা যাবি নাকি মারাই দেওয়া লাগবো। বিয়াদপ পোলাপান।
আর এক মুহূর্তেও অপেক্ষা করলো না তারা। অপমানে থতমত হয়ে বেরিয়ে এলেন বাড়ি থেকে। সোহাগীর কাল ওমন আচরনের কারণ এখন পরিস্কার তাদের কাছে। বিয়েতে রাজি নয় বলেই কী কাল সোহাগী কেঁদে ছিলো! তার জন্যেই কী তাদের কাল উপেক্ষা করে চলে যেতে বলেছিলো?
_______________________
উদাসীন হৃদয় নিয়ে বসে রয়েছে জুবায়ের। কাল সারারাত একটি বারের জন্যও সে চোখের পাতা এক করতে পারে নি। ভুঁইয়া বাড়ি থেকে প্রস্থান করতেই মাথার ভেতত তীব্র ব্যথা শুরু হয়। রাতভর ব্যথায় ছটফট করে শরীরটা নিস্তেজ হয়ে পড়েছে। ব্যথা শুধু মাথায় সীমাবদ্ধ ছিলো না। বুকের ব্যথাও পাল্লা দিয়ে তাকে আষ্টেপিষ্টে ধরেছিলো। যন্ত্রণায় দাঁতে দাঁত চেপে চোখ বন্ধ করে শুয়ে ছিলো সে। বুকের বা পাশটাতে হাত রেখে বারংবার নিজেকে প্রশ্নে করেছে।
— আচ্ছা, বুকের বা পাশটাতে এমন অদৃশ্য অদ্ভুত ব্যথা করে কেন! আমার কী কোন কঠিন ব্যাধি হয়েছে?
প্রধান শিক্ষকের অফিস রুমে বসে কথাগুলো আপন মনে ভেবে চলছে জুবায়ের। বেশ কিছুদিন যাবৎ রোগ শয্যায় ভুগছেন এই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক। অন্য অন্য শিক্ষকের তুলনায় প্রধান শিক্ষকের অনুপস্থিতে জুবায়েরের দ্বায়িত্ব দ্বিগুণ বেড়ে গিয়েছে। সামনে মাসে মাধ্যমিক পরীক্ষা। এই অবস্থা প্রিয়ার পরিস্থিতি করুন!
বহু বড়ো ঝামেলার স্বীকার হয়েছে জুবায়ের। সে যেখানে যাক বা যাই করুক না কেন প্রিয়ার চিন্তা যেন তার মস্তিষ্ক থেকে মুছে না। এক মুহূর্তেও প্রিয়াকে ভুলে থাকতে পারে না সে। এমন পরিস্থিতি সত্যিই অভাবনীয়!
— স্যার আসবো?
হঠাৎ কারো কন্ঠস্বর পেয়ে নড়েচড়ে বসলো জুবায়ের। মুহূর্তেই তার মনে পড়লো বিদ্যালয়ের দপ্তরীর কথা। দুটো ছেলে নাকি তার সাথে সাক্ষাৎ করতে এসেছিলো। কিন্তু ক্লাসের বেল পড়াতে ছেলেগুলো চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। দপ্তরীর বলেছিলো, ছেলে দুটো নাকি মহা নাছোড়বান্দা। ঘন্টা পড়া সত্যেও যেতে চাই নি। বারবার বলেছে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজন রয়েছে জুবায়ের সাথে, মাস্টার মশাই না আসা অবধি যাবে না তারা। অবশেষে দপ্তরীর বকুনি খেয়ে শ্রেণী কক্ষে যেতে বাধ্য হয়েছে। যাওয়ার পূর্বে বলে গিয়েছে, তারা ছুটির পর আসবে। পইপই করে বলেছে মাস্টার মশাই দপ্তরী যেন তাদের আগমনের সংবাদ মাস্টার মশাই কে জানাই।
জুবায়েরের একবার হাত ঘড়ির দিকে তাকলো। বললো,
— এসো ভেতরে এসো।
তৎক্ষণাৎ ভেতরে প্রবেশ করলো রফিক এবং তামিম। বিচ্ছু দুটোকে চিনতে মোটেও অসুবিধা হলো না জুবায়ের। এ বছর ওদের কোন ক্লাস পাই নি জুবায়ের। কিন্তু টাটা দু বছর এদের গণিত ক্লাস জুবায়ের। এরা দুজন পড়াশোনা না করে দিনভর গ্রাম ঘুরে বেড়ায়। ওদের দু জনের সবসময়ই সোহাগী থাকে। কিন্তু সোহাগী গ্রাম ঘুরে বেড়ালেও পড়াশোনা বেশ এগিয়ে। যার দরুন জুবায়েরের প্রিয় শিক্ষার্থীর তালিকায় সর্বোউদ্ধে সোহাগীর অবস্থান। মাঝে মাঝে বিদ্যালয় ছুটির পর গণিত বুঝতে জুবায়েরের কাছে আসে সোহাগী। অবাক-কান্ড হচ্ছে সে যেদিন ছুটির পর তার কাছে পড়তে আসতো তখন এই বিচ্ছু দুটো চুপচাপ পাশে বসে থাকতো। কিন্তু আজ সোহাগী কে ওদের সাথে না দেখতে বেশ খটকা লাগলো জুবায়ের। সে ভ্রূ কুঁচকে রফিকের মুখপানে তাকালো। বললো,
— কীরে কি হয়েছে? তোরা তো পড়া বুঝতে আসিস নি নিশ্চয়ই! সোহাগী কোথায়?
রফিক এবং তামিম একবার নিজেদের দিকে তাকলো। অতঃপর মাথা নিচু করে ফেললো। রফিক বলে উঠলো,
— ও আর আইবো না মাস্টার মশাই। ওর বিয়া ঠিক হয়েছে। কালকে বিয়া।
সোহাগীর বিয়ে! আকস্মিক বিষ্ময়ের ছেয়ে গেলো জুবায়ের মুখশ্রী। মাথাটা যেন চট করে ব্যথা করে উঠলো। একে তো প্রিয়ার চিন্তা এখন আবার নতুন দুঃসংবাদ! স্কুলের মধ্যে মেধাবী মেয়ের এতো কম বিয়সে বিয়ে মানতে নারাজ সে। এ তো গুরুতর অপরাধ! ১৯২৯ সালে সর্ব প্রথম ‘বাল্যবিবাহ নিধোর আইন’ প্রণীত করা হয়। যেখানে মেয়েদের নূন্যতম বয়স ১৪ করা হলো পরবর্তীতে ১৯৮৪ সালে এই আইন সংশোধন করে মেয়েদের বিয়ের নূন্যতম ১৮ বছর নির্ধারন করা হয়। তখন ১৮ বছরের নিচের বয়সী মেয়েদের বিয়ে দিলে সেই বিয়ে হিসেবে গণ্য করা হয়। যার মোতাবেক সোহাগী এখনো বিয়ের জন্য অপ্রাপ্তবয়স্ক! মুহূর্তেই জুবায়ের ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। ক্রোধের বসে। চেয়ার থেকে দাঁড়ালো। উত্তেজিত কন্ঠে বলে উঠলো,
— বাল্যবিবাহ আইন সংশোধন করা হয়েছে তবুও এ যেন কমার নাম নেয় না। সোহাগী রাজি তো?
রফিক জুবায়েরের কথার প্রত্যুত্তরে কান্নারত কন্ঠে বললো,
— না মাস্টার মশাই সোহা রাজি না। আইজ সকালে ওগো বাড়িতে গেছিলাম। ওর মাই আমাগো খেদায় দিছে। ও আমাগো দেইখা কাইন্দা দিয়া ঘরে ঢুইকা গেছে।
#সোহাগী
#পর্ব :১১
Lutful Mehijabin (লেখা)
রফিক জুবায়েরের কথার প্রত্যুত্তরে কান্নারত কন্ঠে বললো,
— না মাস্টার মশাই সোহা রাজি না। আইজ সকালে ওগো বাড়িতে গেছিলাম। ওর মাই আমাগো খেদায় দিছে। ও আমাগো দেইখা কাইন্দা দিয়া ঘরে ঢুইকা গেছে।
তৎক্ষণাৎ জুবায়ের উত্তেজিত হয়ে বললো,
–কার সাথে বিয়ে? কোন বাড়িতে?
জুবায়েরের প্রশ্নের প্রত্যুত্তরে রফিক মলিন গলায় বললো,
— ভুঁইয়া বাড়ির ওইযে কয়েক দিন আগে যে বেডার বউ মইরা গেলো ওই বেডার সাথে। আপনি বিয়েটা আটকান মাস্টারমশাই।
কথাটা শুনে মুহূর্তেই চুপসে গেলো জুবায়ের। খানিকের জন্য স্তব্ধ হয়ে পড়লো সে। বর্তমানে তার নিকট সবকিছু পরিষ্কার! তারমানে প্রিয়ার ফুপাতো ভাই আমিরুলের সাথে সোহাগীর বিয়ে হতে চলছে। যে লোকটা কীনা বিবাহিত এবং এক সন্তানের বাবা। শেষে মেয়েটা কে বয়স্ক লোকের সাথে বিয়ে দিচ্ছে ওর পরিবার! জুবায়ের নিজেকে নিয়ন্ত্রণ রাখতে চেষ্টা করলো। মানুষ কতোটা নিম্ন মন মানসিকতার হলে এতো স্বল্প বয়সী মেয়ে কে বিয়ে দেওয়ার কথা চিন্তায় আনে তাও আবার দ্বিগুণ বয়সী পুরুষের সাথে? পরপর দুটো শুকনো ঢোক চেপে জুবায়ের ম্লান হয়ে বলে উঠলো,
— এখন তোরা যা। দেখি আমি কোন ব্যবস্থা করতে পারি কিনা।
রফিক জুবায়েরের কথা শুনে মাথা নিচু করে কয়েক কদম পিছনে গেলো। যাওয়ার পূর্বে জুবায়েরের কে সালাম দিয়ে বিষন্ন হৃদয় নিয়ে বেরিয়ে পড়লো।
ছেলে দুটো চলে যেতেই জুবায়ের হাফ ছেড়ে বাঁচলো। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে চেয়ারে বসলো। চেয়ারের পিছনটাতে মাথা ঠেকিয়ে, চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেললো। দুশ্চিন্তায় তার মাথা ভারী হয়ে এসেছে। সে এখন কী করবে? সোহাগীর বিয়ে কীভাবে ভেঙে ফেলবে। তার ভীষণ অস্থির করছে। ভুঁইয়া বাড়ির লোকের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া মানে বোকামি বৈকি অন্য কিছু না!
নিজের মাথা চেপে ধরলো জুবায়ের। চোখ বন্ধ অবস্থায় বিরবির করে বলে উঠলো,
— আমাকে ক্ষমা করে দিস সোহাগী। আমি যে নিরুপায়। নিজ স্বার্থে আমি পিছপা হলাম। তোর বিয়ে ভাঙার সামর্থ্য থেকেও যে নেই রে। কিন্তু আর যাই হোক বিয়ে পর যেন তোকে পড়তে দেয় সে ব্যবস্থা করে দিবো। ক্ষমা করিস তোর মাস্টারমশাই কে।
কথাগুলো বলে বুকের বা পাশে হাত রাখলো জুবায়ের। ইদানিং প্রিয়ার সান্নিধ্যে পাবার আশায় তার বুকটা প্রতিনিয়ত ছটফট করে। শেষের পরিনতি ভেবে চিন চিন ব্যথা হয় তার বুকের মাঝে। সে কী প্রিয়াকে পবিত্র বন্ধনে আঁকড়ে নিতে পারবে না! আজিজ ভুঁইয়া রাজি হবে তো। নাকি নাকজ করে দিয়ে তাকে শুন্য হাতে ফিরিয়ে দেবেন। খুব ভয় হয় জুবায়েরের। তাই তো সে আজ প্রমাণ করে দিলো মানুষ স্বার্থপরথ। নিজ স্বার্থে নিজের বিবেক বিসর্জন দেওয়া মোটেও অসম্ভব নয় তাদের পক্ষে। পৃথিবীর বুকে এমন কোন মানুষ নেই যে কী না স্বার্থপর! একে অপরের প্রতি ভালোবাসা ততক্ষণ থাকে যতক্ষণ পর্যন্ত না মানুষের স্বার্থে আঘাত লাগে। স্বার্থের কাছে হেরে যায় দৃঢ় বন্ধুত্ব,স্নেহ, মায়া মহব্বত, আবেগ, ভালোবাসা ! এ যেন এক চিরন্তন সত্য বানী।
____________
ঘড়ির কাঁটায় ছুঁই ছুঁই এক। চিন্তা গ্রস্থ মুখশ্রীতে আসমা পায়চারি করছেন আজিজ ভুঁইয়ার কক্ষে। বোন এবং ভাগ্নের চিন্তায় বেশ বিরক্ত আজিম। তার যুক্তি অনুযায়ী মা ছেলে মিলে অযথাই চিন্তা করছে। আসমা বারংবার একই বানী বলে যাচ্ছেন।
— ভাইজান কী হবে এখন? আমার ভীষণ ভয় করছে।
মুহূর্তেই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন আজিজ। গম্ভীর গলায় বলে উঠেন,
— আহ্! আসমা। চিন্তা করছিস কেন? দেখ তুই যা ভাবছিস তেমন কিছুই হবে না ।
পায়চারি থামিয়ে দিলেন আসমা। তৎক্ষণাৎ আজিজের পায়ের কাছে এসে বসে পড়েন। আজিজের পায়ে স্পর্শ করে বলেন,
— ভাইজান আজ বিয়েটা হোক। আমরা গিয়ে ওই মেয়েকে উঠিয়ে নিয়ে আসি। আমিরুল গন্জে গেছে। যাওয়ার আগে বলছে কোন চিন্তার বিষয় নাই। ও একাই শহরের হিসাব-নিকাশ করে নিবো। বলছে আসার পরপরই সোহাগীদের বাড়িতে যাইবো। তার আগে যেন আমরা রাশেদ মিয়ার বাড়ি উপস্থিত থাকি। ওই মেয়ে রে ওর মনে ধরছে। ছেলেরে কথা দিছি। আপনে সাফিদে আর ছোট ভাই কে বুঝিয়ে বলেন।
আসমার কথাগুলো শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলেন আজিজ। হঠাৎ বিরক্ত কন্ঠে বলেন,
— এমন কাজ করার আগে তোর ছেলের সাবধান হওয়া উচিত ছিলো। সবসময়ই টাকা বা ক্ষমতা আশ্রয়ে বাঁচা যায় না। তোর ছেলে আর তুই দুইজনই গাধা। দুর্ঘটনা ঘটানোর আগে আমিরুলের ভাবা উচিত ছিলো। যে কাজের জন্য বারবার টাকা খসে মান সম্মান হারানোর ভয় হয় সে কাজ ঘটানোর একদমই অনুচিত। নাতির কথা ভেবে হলেও এ পথ অবলম্বন করতে নাও পারতি তোরা!
আজিজের কথার প্রেক্ষিতে মাথা নিচু করে ফেললেন আসমা। মলিন কন্ঠে বলেন,
— আমি বুঝতে পারি নি ভাইজান। আমিরুল যে এমন ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে তা কখনোই ধারণা করতে পারি নি। ক্রোধের বশে উন্মাদ হয়ে গেছিলাম আমি। এই সামান্য কারনে আজ আমার উপর থেকে তোমার ছায়া সরিয়ে নিও না ভাইজান। সাফিদ কে রাজি করাও।
আসমার উপেক্ষা করে উঠে দাঁড়ালেন আজিজ। সরু দৃষ্টিতে তাকিয়ে ক্ষিপ্ত গলায় বললেন,
— সামান্য ঘটনা বলছিস তুই? পাগল নাকি! তোদের জন্য আমাকে কতো শত ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছে জানিস? আর পয়সার কথা বাদই দিলাম। তোর ছেলের যে ভবিষ্যতে ও এমন ভয়ানক ঘটনা দ্বিতীয়বার ঘটাবে না এর কোন সন্দেহ নেই! এখনি কেন বিয়ে করতে হবে ওকে?
— ভাইজান আমি কথা দিতেছি ও আর এমন কোন কাজ করবে না যাতে তোমার অসুবিধা হয়। কথা দিলাম। এখন তৈরি হও রাশেদ ফকিরের বাড়ি যাবো। ওই মেয়ে কে আনলে আমাদের যা লাভ হবে না ভাইজান!
বেশ আকুতির সাথে কথাগুলো বললেন আসমা। আজিজ খানিকটা সময় চুপ থাকলেন। একমাত্র ছোট বোন কে ভীষণ ভালোবাসেন তিনি। আসমার কথার অমান্য করার মতো সাহস এ পর্যন্ত তার হয়ে তার। স্বল্প বিরক্ত নিয়ে আসমার কথায় সম্মতি জানালেন আজিজ।
— ঠিক আছে যাহ। তবে আমি যাব না। সাফিদ কে বলছি ও যাবে আমি যেতে পারছি না। তোর ভাবি আর কয়েক জন কে নিয়ে যা। তবে প্রিয়াকে নিবি না কিন্তু। যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে টা সেরে ফেলবি। আমি লোক পাঠাচ্ছি ওদের বাড়িতে যেন বিয়ের আয়োজন শুরু করে আধ ঘণ্টার মধ্যে।
আজিজের কথা শুনে আসমার ঠোঁটের কোণে চমৎকার হাসির রেখা ফুটে উঠলো। মুহূর্তেই সে বিয়ের আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন।
____________
রাশেদের বাড়ির আনাচে কানাচে জুড়ে লোকজন গমগম করছে। স্বল্প কিছু মানুষ কে নিমন্ত্রণ করেছেন সোহানা। হঠাৎ ভুঁইয়া বাড়িতে থেকে বিয়ের সংবাদ পেয়ে চমকে উঠেছিলেন। প্রথমে দুশ্চিন্তা গ্রস্থ হলেও পরক্ষণেই আনন্দিত হয়েছেন তিনি। যাক বাবা বাঁচা গেলো! যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব সোহাগী কে বিদায় করতে পারলেই বাঁচেন। বলা তো যাই না কখন কি ঘটে যায়। রাশেদ যদি সপ্তাহ খানিক না থেকে কাল বা আজ বিয়ের পূর্বে চলে আসে, তাহলে কী হবে! নিশ্চয়ই বিয়েটা ভেঙে যাবে।
ইতোমধ্যে সোহাগীর প্রতিবেশী কয়েক জন মহিলা বিয়ের খরব পেয়ে ছুটে চলে এসেছে! তবে সোহাগী মাচার ঘরে রয়েছে বিধায় কারো সাথে তার সাক্ষাৎ হয়নি। সোহাগী ভুঁইয়া বাড়ির বউ হবে ভেবে কেউ ইর্ষায় জ্বলে পুড়ে যাচ্ছে। আবার কেউ গর্বিত হচ্ছে।
______
হঠাৎ বাড়িতে ভেতর মানুষের কোলাহল শুনে সোহাগীর বিষাদগ্রস্ত হৃদয় কুঁ ডাকতে আরম্ভ করেছে! আমের কিংবা সোহানা তার খোঁজ নেয় নি। রাতারাতি অনুভূতিহীন কঠিন পাথরে পরিণত হয়েছে মেয়েটা। কাল রাতে ভীষণ কেঁদে ছিলো সে। মায়ের পা জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে কেঁদেছিলো। কিন্তু কেউ তার যন্ত্রণা বুঝেনি। শক্ত, শীতল মাটির উপর সারারাত গড়াগড়ি খেয়েছে কিন্তু তাকে কেউ শান্তনা পর্যন্ত দিতে আসেনি। রাতারাতি হঠাৎ আমেনা চুপসে গিয়েছেন। সোহানার কথা মতো কাজ করছেন। সোহাগীর নানীর পরিবর্তনে ভীষণ খুন্ন! যার দরুন তার বেদনা হাজার গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সকালে আলো ফুটতেই সোহাগীর কান্না শুকিয়ে এসেছিলো। রাতভর জেগে সারা রাত্রি নির্ঘুম পাড় করে দিয়েছে মেয়েটা। সে যেন চোখের পলকে এক প্রাপ্তবয়স্ক নারীতে রুপান্তরিত হয়ে উঠছে! সবকিছু ঠিকঠাক ছিলো। রাশেদের অপেক্ষা তার প্রতীক্ষার প্রহর যেন এক যুগে পরিণত হয়েছে। আব্বা আসছে না কেন? সকাল বেলা উঠেই মাচার ঘরে চলে এসেছিলো সোহাগী। বাবার অভাব পূরণ করার উদ্দেশ্যে রাশেদের রিকশার উপর গুটিয়ে শুয়ে ছিলো। ঠিকই তখনই সোহানার চিৎকার চ্যাচামেচির শব্দ! রফিক এবং তামিমের কন্ঠস্বর পেয়ে ঘরের দরজায় ছুটে এসেছিলো সোহাগী। তাদের দেখে আনন্দিত হৃদয়ে ছুটে যেতে চেয়েছিলো। কিন্তু কোন এক আজনা কারণে যেতে পারে নি! লুকিয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে ছিলো খানিকক্ষণ। ইশ, তারা কি আর এক সাথে ঘুরতে পারবে না! বিয়ের পর এক পুরু দেয়াল তৈরি হবে তাদের ভেতর। চাইলেও কথা বলতে পারবে না। হঠাৎ রফিক দৃষ্টি গোচড় হয় মাচার ঘরে দরজায়। রফিকের দৃশ্যমান হয়, সোহাগী শাড়ির আঁচল মুখ চেপে অঝরে কেঁদে চলছে। প্রাণ প্রিয় বন্ধুর চোখের জল দেখে রফিকের বুক কেঁপে ওঠে! দুজনের দৃষ্টি মিলিত হতেই কান্নারত অবস্থায় ঘরের ভেতর ঢুকে পড়ে সোহাগী।
(চলবে)
[