#স্বপ্ন
#সাদিয়া_সৃষ্টি
পর্বঃ- ০৮
আজকাল বৃষ্টিকে বেশিরভাগ সময় অন্যমনস্ক দেখা যায়। নিজের স্বপ্নগুলো নিয়ে সে বেশ চিন্তিত। সারাদিন একই ভাবনা মাথায় ঘোরাফেরা করায় অন্য কোন কাজের মন থাকে না তার। এর মাঝেও তার স্বপ্ন দেখার বাতিক তার যায়নি। তবে কাউকে বলার প্রয়োজনীয়তা খুব করে অনুভব করছে সে। নিজের মতো এতো চিন্তার পাহাড় জমিয়েছে যে কারো সাথে সবটা ভাগ করে নেওয়ার ইচ্ছা প্রবল হচ্ছে। কিন্তু বলবে কাকে? বন্ধুদের বললে তারা মজা করেই উড়িয়ে দিবে। বাবা মাকে বললে সরাসরি মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছে নিয়ে গিয়ে ওষুধ লিখিয়ে আনবেন। কিন্তু কেউ সবটা বোঝার চেষ্টা করবে না। নিজের মন আরেকটু ঘেঁটে নিশান্তের নাম বের করল। কিন্তু তাকেও বললে যে কোন কাজ হবে তার নিশ্চয়তা নেই। সে ঠিক করল কোন মনরোগ বিশেষজ্ঞের কাছেই যাবে প্রথমে।
অফিস থেকে বের হয়েই হাঁটা ধরেছিল বৃষ্টি। তার মধ্যে এতগুলো চিন্তা করতে করতে কখন যে অনেকটা পথ পাড়ি দিয়েছে- সেদিকে খেয়াল নেই তার। নিজের ফোন বের করে চেনা পরিচিত কারো নাম্বার খোঁজার চেষ্টা করল। তার এক কলেজ ফ্রেন্ড তাকে হয়তো সাহায্য করতে পারে। তবে তার নাম্বারটা ফোনে আছে কি না সেটা মনে নেই বৃষ্টি। ফোনে আরও কিছুক্ষণ তল্লাশি চালিয়ে নাম্বারটা উদ্ধার করার পর তাতে কল দিয়ে ফোনটা কানে ধরল। আশেপাশে তাকাতেই একটা মুদি দোকানে টিভি চলতে দেখে অভ্যাসবশত সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। অভ্যাস হওয়ার কারণ ছোট থাকতেই কোন দোকানে টিভি বা রেডিও চলতে দেখলে থেমে যেত, তারপর সেটায় মন দিত। এখন সেটা তার অভ্যাসে পরিণত হয়েছে।
টিভির হেডলাইনের লেখাটা পড়ে সাথে সাথে বৃষ্টি হাত কাঁপতে শুরু করল।
“সৎ পুলিশ অফিসারের মৃত্যু; মার্ডার কেস হিসেবে সন্দেহের উপদ্রব মানব মনে।”
ছবিটা কেউ গোপন ক্যামেরায় তুলেছেন বলেই সংবাদ পাঠক দাবি করেছেন। তবে টিভি তে ছবির জায়গাটা ঘোলা করে দিয়েছে ওরা। বৃষ্টির সামনে যেন পুরো ছবি ফুটে উঠল। সে যেন ঘোলা পর্দাটা দেখতে পারছে না। পুরো ক্ষতবিক্ষত মুখটা দেখছে সে। হাত কাপার পরিমাণ বেড়ে গেল প্রচণ্ড ভাবে। ফোনের ওপাশ থেকে আওয়াজ আসছে,
‘আপনি যে নাম্বারটিতে কল করেছেন তা এই মুহূর্তে ব্যস্ত আছে। অনুগ্রহ করে কিছুক্ষণ পর পর ফোন করুন। ধন্যবাদ।’
কিন্তু সে শব্দ বৃষ্টির কানে পৌছাচ্ছে না। হঠাৎ সে পড়ে যেতে গেলে কেউ তাকে ধরে ফেলে। তার মুখে হাত দিয়ে আস্তে আস্তে বাড়ি দিতে থাকলে সে বুঝতে পারে মানুষটা নিশান্ত। সাথে সাথে সব কিছু ভুলে তাকে জাপটে ধরে ফেলে বৃষ্টি। নিশান্ত আশেপাশের মানুষের চোখের দৃষ্টি খেয়াল করে বৃষ্টিকে সেখান থেকে প্রথমে সরিয়ে নিয়ে যায়। একটা ফাঁকা জায়গায় এনে দাঁড় করায় তাকে। দুটো বিল্ডিং পাশাপাশি থাকলেও তাদের মাঝে খুব সরু অবস্থান জুড়ে ফাঁকা জায়গা। এটাকে হয়তো বর্তমানে হাঁটার রাস্তা হিসেবে ধরে নেওয়া যায়। এখানে মানুষের আনাগোনা আপাতত নেই। সেখানে বৃষ্টিকে দাঁড় করিয়ে বৃষ্টির ব্যাগ নিজের হাতে নিয়ে নেয় নিশান্ত। সেখান থেকে পানির বোতল বের করে বৃষ্টির দিকে এগিয়ে দিলে বৃষ্টি সেটা পান করে নেয়। তারপর একটু সময় পর শান্ত হলে নিশান্ত প্রশ্ন করে বসে,
— “তুমি এখন ঠিক আছো?”
— “জ্বি।”
— “কি হয়েছিল?”
— “কিছু না।”
— “আমাকে বল বৃষ্টি। কাউকেই যদি না বল তাহলে কিভাবে হবে? কাউকে তো বলতে হবে। আমি কোথা দিচ্ছি আমি সবটা ঠিক করে দেব।”
বৃষ্টি কিছুক্ষণ নিশান্তের চোখে তাকিয়ে থাকল। তার চোখে ভরসার একটা স্থান খুঁজে পেয়ে সাথে সাথে আবার নিশান্তকে জড়িয়ে ধরল। তারপর কাঁদতে কাঁদতে নিজের স্বপ্ন সম্পর্কে সবটা বলল। শেষে বলল,
— “এতদিন যেসব স্বপ্ন দেখতাম, সেসব স্বপ্ন সত্যি হয়নি। কিন্তু এই স্বপ্নটা আজ সত্যি হয়েছে। কোন একটা টিভিতে দেখুন। ওই একই লোক, সেই মারামারি একই ছাপ, এতোটা কো-ইন্সিডেন্স হওয়া সম্ভব না। আমি জানি না ঠিক কি হচ্ছে আমার সাথে। আমি কিচ্ছু জানি না। কিন্তু আমার খুব খারাপ লাগে মনে হয় খালি আমার স্বপ্ন দেখা মানেই কারো ক্ষতি হওয়া। তাছাড়া এর আগেও কয়েকবার এমন হয়েছে, স্বপ্নের ঘটনা বাস্তবতার সাথে মিলে যাচ্ছে কিন্তু মানুষটা মিলত না। আমি আর নিতে পারছি না এসব। নিজেকে অন্যের জন্য বেশ ক্ষতিকারক বলে মন হয়।”
নিশান্ত তার পুরো কথা শুনে বৃষ্টির মাথায় হাত বুলাতে থাকল। নিজের সাথে আরেকটু শক্ত করে চেপে ধরে বোঝানোর চেষ্টা করল সে আছে তার সাথে। বৃষ্টি হয়তো বুঝল। সে ধীরে ধীরে শান্ত হতে থাকল। কিন্তু নিশান্তকে ছাড়ল না। মূলত সে নিশান্তের কাছ থেকে উপহাস আশা করে যখন শেষ পর্যন্ত গুরুত্ব পেল, তখন আর সেই ভরসার স্থান ত্যাগ করতে ইচ্ছা হলো না তার। তাছাড়া ভয়টা তো আছে, যদি এই সবটা তার কল্পনা হয়, নিশান্ত যদি সত্যিই তার কোথা শুনে আসলে তাকে উপহাস করে! কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। নিশান্ত অনেকক্ষণ ধরে বৃষ্টির মাথায় হাত বুলিয়ে দিল। বৃষ্টি যখন বুঝতে পারল এটা সত্য তখন নিজে থেকেই সরে এলো। নিশান্তের হাত থেকে নিজের ব্যাগ নিয়ে সেখান থেকে চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালে নিশান্ত তার হাত চেপে ধরল।
— “আর এসব নিয়ে ভাববে না। আমি যখন বলেছি সবটা ঠিক করে দেব, তখন সবটা ঠিক করে দেবোই। এখন নিজেকে স্বাভাবিক রাখো। আর এখানে দাঁড়িয়ে থাকো। আমার রিকশা মনে হয় এতক্ষণে চুরি হয়ে গিয়েছে। সেটা আনছি আমি।”
এমন গম্ভীর মুহূর্তে রিকশার কোথা মনে পড়তেই বৃষ্টি না চাইতেও হেসে ফেলল। ঠিকই তো! কার না কার রিকশা নিশান্ত একদিনের জন্য ধার নিয়ে এসেছে, চুরি হয়ে গেলে তো সমস্যা! নিশান্তকে না আবার নতুন করে রিকশা কিনে সেটার লাইসেন্স বানিয়ে দেওয়া লাগে রিকশাওয়ালাকে!
বৃষ্টির ভাবনার মাঝেই নিশান্ত রিকশা নিয়ে হাজির হলো। বৃষ্টি কোন কথা না বলে রিকশায় উঠে পড়ল। নিশান্ত এই ওই কোথা বলে বৃষ্টির মন ভালো করায় উঠে পড়ে লেগেছে। এমনকি মাঝে মাঝে লাগামহীন হয়ে বৃষ্টিকে ২-৩ বার বিয়ে করার কথাও বলে ফেলেছে। বৃষ্টি প্রতিবারের মতো কপাল চাপড়ে বসে থেকেছে। ছেলেটা ১ নম্বরের প্লে-বয়।
_____
এর মাঝে কেটে গিয়েছে আরও ২ দিন। সেদিন বৃষ্টিকে বাসায় পৌঁছে দেওয়ার পর নিশান্ত নিজের রুমে ঢুকে দরজা আটকেছিল তারপর আর সারা রাত দরজা খোলেনি। একেবারে পরের দিন সকালে ঘুমুঘুমু চোখেই বের হয়েছে। বৃষ্টির মনে হল ছেলেটা সারারাত জেগেছিল। আর সারা রাত হয়তো তার আজব স্বপ্নের কথাই ভেবেছে। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে নিজের খাওয়ায় মন দেয় বৃষ্টি। তারপর তৈরি হয়ে বের হয়ে আসে অফিসে যাওয়ার জন্য। সারাদিন কর্মব্যস্ততায় কেটে যাওয়ায় না সময় দেওয়া হয় নিজের পরিবারকে আর না দেওয়া হয় নিজের নতুন গেমস তৈরি করার ইচ্ছাকে। সবটা চাপা পড়ে যাচ্ছে। তার উপর নিশান্ত এর মানা করা সত্ত্বেও স্বপ্ন নিয়ে বেশ ভাবনা চিন্তা হয় তার। মনে মনে এই ছকও কষেছে- যদি সত্যিই কোন অশরীরীর কাজ হয়ে থাকে তাহলে ওই পীরের ঝাড়ুর বাড়ি কিভাবে হজম করবে সেই কথাও। উপায় পেয়েছে একটা- মুখে একটা বড় বাজারের ব্যাগ দিয়ে যাবে, তারপর ঝাড়ু দিয়ে মারলেও তার মুখে লাগবে না সেটা।
এসব কোথা ভাবতে গিয়ে আজকাল স্বপ্নের থেকে ঝাড়ুর চিন্তা তার বেশি হয়। হঠাৎ কানে একটা আওয়াজ ভেসে আসায় সে থেমে যায়।
— “কি ভাবছ?”
— “ঝাঁটা পেটা করার কথা।”
— “তুমি আমাকে মারার কোথা ভাবছ?”
— “না, না । আমি নিজে মার খাওয়ার কথা ভাবছি।”
— “ঠিক আছে, আমি অ্যান্টির কাছ থেকে ঝাঁটা আনতে যাচ্ছি।”
— “কেন?”
— “তোমার সকাল সকাল এতো সুন্দর শখ হয়েছে। এখন যদি আমি আমার হবু বউ এর ইচ্ছা পূরণ না করি তাহলে ব্যাপারটা ভালো দেখায়?”
— “আপনি আমাকে মারবেন?”
— “যাক! মানলে তো তুমি আমার হবু বউ।”
— “আপনার স্বপ্নে।”
কথাটা বলেই থেমে গেল বৃষ্টি। ‘স্বপ্ন’ শব্দটা তেঁতো লাগে তার কাছে। সে কথা ঘুরিয়ে বলল,
— “আপনার চোখ লাল হয়ে আছে কেন? ঘুমাননি?”
— “ঘুম তো তুমি কেঁড়ে নিয়েছ বৃষ্টি।”
— “বেচারি আপনার হবু বউ। আপনার চাপা শুনতে শুনতে চ্যাপ্টা হয়ে যাবে।”
— “তোমার অফিসে দেরি করে গেলে বস বকেন না?”
— “হ্যাঁ।”
— “তাহলে আমার সাথে ঝগড়া করছ কেন? রিকশায় ওঠো।”
নিশান্তের কথা শুনে মনে পড়ল অফিসের কথা। তারপর থেকে সব স্বাভাবিক। নিশান্তের সাথে থাকলে নিজের চিন্তাগুলো ভুলে থাকা যায়। তাই যখন মন খারাপ হয়, তখনই নিশান্তকে কল করে। দেখা যায় কাজ বাদ দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিশান্তের সাথে কথা বলছে। পরে বসের বকাও খায়। বকা খাওয়ার পর মন খারাপ করে বসের কেবিন থেকে বের হয়ে আবার নিশান্তকে কল করে।
মনে মনে সে নিজেও জানে, নিশান্তের প্রতি সে কতটা দুর্বল হয়ে পড়ছে। কিন্তু স্বীকার করে না কখনো। এই তো, রোজ নিশান্তের পাগলামো কি সুন্দর হ্যান্ডেল করে! নিশান্ত বেচারা তো বুঝতেও পারে না বৃষ্টির মনে তাকে নিয়ে কি অনুভূতি। সেই অনুভূতি যে বন্ধুত্ব ছাপিয়ে সীমানা অতিক্রম করেছে বহু আগে, সেটা সবার অজানা। যখন নিশান্ত তার সামনে লাগাম ছাড়া কথা বলে, তখনও তো নিজেকে প্রকাশ করেনি বৃষ্টি। কাউকে জানতে দেয়নি নিজের মনের কথা। মাঝে মাঝে নিশান্ত বৃষ্টির মুখ থেকে কিছু কথা বের করে নেয়, তবুও সেটা কথার জালে ফাসিয়ে। সুতরাং, সেটাও কেউ বুঝতে পারবে না। সবাই মনে করবে বৃষ্টি কথার জালে আটকে অমন কথা বলে ফেলেছে। আজকাল বৃষ্টির ছোট মাথায় অনেক প্রশ্ন ঘুরে, নিশান্তের প্রতি নিজের অনুভূতি, এতো বছর আবিরের সাথে থাকা, তাদের মধ্যে সম্পর্কটা আসলে কেমন ছিল, স্বপ্ন, গেমস, পুলিশ অফিসার ইত্যাদি। তবে এতগুলোর মধ্যে শুধু একটার উত্তর-ই সে জানে।
মন এর গহীন থেকে তখন কেউ ফিসফিস করে,
“নিশান্তকে ভালোবেসে ফেললি!”
চলবে।
2